কানাডায়  সারা বিশ্বের সব জাতির মানুষের  বাস ; এ দেশে বহির্জগৎ থেকে  অভিবাসী, ছাত্রছাত্রী  বা  শরণার্থী হিসাবে এসে প্রয়োজনীয়  ক্ষেত্র বিশেষ পড়াশুনা করে নিজের যোগ্যতা প্রমান করে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সব সময় ছিল এবং আজ ও আছে ।

কানাডার  আবহাওয়া  বৈচিত্রময়; বিচ্ছিন্ন তুষার, বরফ,  অতিরিক্ত ঠান্ডা  এবং গ্রীষ্মের আরামদায়ক আবহাওয়া, ফুল ও সবুজের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো- মনে হবে প্রকৃতি যেন ফুল ও সবুজে  সাজিয়ে রেখেছে।   

শীতে কখনও সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না । এই প্রচন্ড  ঠাণ্ডার দেশে  এসে সবাইকে-ই প্রথম দিকে অনেক কষ্ট করতে হয় ; তার কারণ এখানকার আবহাওয়া,কাজের ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এখানকার অতিরিক্ত ঠান্ডা হাওয়ায় পোকামাকড়, রোগজীবাণু  তেমন একটা থাকে না; অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়া নতুনদের   জন্য চ্যালেঞ্জ  হিসাবে নিতে হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম থেকেই শুরু হয়ে  এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঠান্ডা থাকে।  তবে মজার ব্যাপার হলো যে এখানে বাড়ি,শপিং, গাড়ি,অফিস, কারখানা -সর্বত্রই তাপ (heat) দেয়া থাকে।    

নতুন অভিবাসী,ছাত্রছাত্রী   বা  শরণার্থীদের  সবাইকেই  একটা বা দুইটা কাজ করে বাড়িভাড়া দিয়ে  ভরণপোষণ কষ্ট সাধ্য। আজকাল একজনের মেস করে থাকতে গেলেও ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার  মাসে ভাড়া দিতে হয়।  ফ্যামিলি হলে এক রুমের  ভাড়া ও ১,৫০০ থেকে ২,০০০ ডলার । তাছাড়া জিনিসপত্রের দাম আকাশ চুম্বি,ধরাছোয়ার বাইরে।  ।  নতুনদের জন্য এ দেশের চরম আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে  কাজ করা ও একই সাথে খণ্ডকালীন অধ্যয়ন করে দক্ষতা অর্জন করা অত্যধিক  কঠিন।  অতি  সাধারণ  নিত্য নৈমিত্তিক যেখানে যা পাওয়া যায়,এ ধরণের কাজ  কতখানি কষ্টকর তা বুঝানো যাবে না। ডিসেম্বর থেকে এখানে সাদা তুলার মতো তুষার পাত শুরু হয়,এই তুষার বাড়ির আঙিনায় বা রাস্তায়  লবন দিয়ে পরিষ্কার না করলে কিছু সময়ের মধ্যে (পিচ্ছিল ) পাথরের আকার ধারণ করে; এতে বিশেষ ধরণের জুতা ও গরম কাপড় ব্যতীত  সাধারণ কাপড় বা জুতা পড়ে বাহিরে যাওয়া যায় না ।    

তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে  হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা  দেশে জমিজমা বিক্রি, ব্যাঙ্ক লোন  করে  ইউরোপ আমেরিকার রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে একটু কাজের জন্য। এই  যুবক ছেলেরা বিদেশে যে ধরনের কাজ করে,দেশে এ ধরণের কাজের চিন্তা ও করে না। ঠেলার নাম বাবাজি,ঠেকায় পড়লে সবই সম্ভব, যেভাবে পরিশ্রম করে, এতে অতি অল্প সময়ে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে  কাজ শিখে নেয়।  কানাডায়  অনেকেই খালি হাতে  এসে প্রানপনে কাজ শিখে কয়েক বৎসরের মধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে বাড়ী গাড়ি খরিদ করে ভালো অবস্থায় থাকে-কানাডা  নতুনদের জন্য স্বপ্নের দেশ।  

আমি টরোন্টোর উপ-শহর নর্থ ইয়র্ক থাকি;আমার চারিদিকে যত লোক রয়েছে -এদের অধিকাংশই ইতালি,মেক্সিকো,জ্যামাইকা, পাকিস্তান এবং  অন্যান্য দেশ থেকে  এসে কষ্ট করে আজ এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আমার প্রতিবেশী এঞ্জেলো দ্বিতীত বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯৪৬ সনে )শিপে হ্যালিফ্যাক্স এসেছে ; ঘন্টায় ০.৭৫ সেন্ট হিসাবে যেখানে যা পেয়েছে তাই দিয়ে শুরু করেছে। আজ সে ৯০ বৎসরের বেশি বয়স, মাঝে মধ্যে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কাহিনী আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে, তার ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। এ দেশে  প্রতিটি লোক সৎ ভাবে কাজ করে দাঁড়িয়েছে।   আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই,তাছাড়া  ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে white  color  job বা অফিসে আরামের কাজ খুঁজে খুঁজে হয়রান হয় । আজকাল আমাদের বাংলাদেশে ও ছেলেরা  নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতি বা ধারণা ব্যবহার করে  ব্যবসা  করছে।  আমি গতবার ঢাকা শহরে  কিছু কিছু ছেলেদের পোষা- পাখির ব্যবসা করতে  দেখেছি।  আমি জিজ্ঞেস করতে, একটা বিশেষ ধরণের কবুতর তিন হাজার টাকা চেয়েছিলো , কেউ একজন বললো একটা পাখি দশ হাজার টাকা ও বিক্রি হয়।  

  ২

পৃথিবীর যে কোনো দেশে যুদ্ধ  ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে  কানাডা সরকার সর্বাগ্রে মানবতার খাতিরে  সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যায়।  দুঃস্থ,অসহায় মানুষের সাহায্য করার সাথে শরণার্থীদের কানাডায় এনে হোটেলে বা সরকারি  অথবা ভর্তুকিযুক্ত বাড়িতে থাকা খাওয়ার  ব্যবস্থা করে  প্রশিক্ষণ দিয়ে  কাজে লাগায়  এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াশুনা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। স্কুল থেকে মেধাবী ছেলেমেয়েদের বাছাই করে বিশেষ প্রোগ্রামে পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত  করে দেশের কাজে লাগে  ; কানাডা একটা মানবতার দেশ ;  কানাডা সরকার শরণার্থীদের এবং দেশের সবাইকে সমান চোখে দেখে – একটা সময়সীমা পার হলে নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে। 

এ সব লোকদের অনেকেই নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশের পৌরসভা, প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় (ফেডারেল)  নির্বাচনে অংশ  নিয়ে   নিজেদের দক্ষতা ব্যবহার করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে থাকে।  উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে  বর্তমান টরন্টো মেগাসিটির মেয়র অলিভিয়া চাও (Olivia Chow    )  একজন  চীনা বংশোদ্ভূত উচ্চ শিক্ষিত   ও দক্ষ মহিলা , সে বহুদিন থেকে কানাডার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।  মাননীয়  মিস্টার আহমেদ হোসেন, একজন সোমালিয়ান-কানাডিয়ান, ফেডারেল সরকারের  মন্ত্রী,যিনি ১৬ বৎসর বয়বসে এ দেশে এসে পড়াশুনা করে নিজেকে তৈরী করে রাজনীতিতে ঢুকেছেন।  গর্বের সঙ্গে বলতে পারি -অন্টারিও প্রাদেশিক সদস্য মিস ডলি বেগম,বাংলাদেশে (সিলেট )জন্ম এবং এ দেশে মাবাবার সঙ্গে এসে পড়াশুনা করে নিজেকে তৈরী করে ( প্রাদেশিক সংসদে সবচেয়ে কম বয়সী) রাজনীতিতে ঢুকেছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।  ৩০ উর্ধ বয়েসের  এই ডলি বেগম গত দুই মেয়াদ অধিক সংখ্যক ভোট নিয়ে পাশ করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।    এ দেশে বয়স দেখে না , যোগ্যতা দেখে বিচার  করে নির্বাচিত করে।  

মিস মরিয়ম মনসেফ, আর একজন কানাডিয়ান  রাজনীতিবিদ, যিনি শরণার্থী থেকে ফেডারেল ক্যাবিনেট মন্ত্রী  হয়েছিলেন । ১৯৮২ রাশিয়া আফগানিস্তান দখলের পর তাঁর মাবাবা ইরানে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই তাঁর জন্ম।  বাবা ইরান -আফগানিস্তান বর্ডারে মারা যায় ;মা কানাডা আশ্রয় চেয়ে দরখাস্ত করলে তা মানবতার দিকে বিবেচনা  করা হয় এবং মরিয়ম কানাডায় পড়াশুনা করে।    তিনি  ২০১৫ সাল থেকে কানাডার হাউস অফ কমন্সে লিবারেল সদস্য হিসাবে  প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং  ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রলায়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও কানাডার সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।

মারিয়াম মুনসেফ  এমন-ই একটি দেশ  থেকে কানাডায় এসেছেন, যার ভূখণ্ডে বিদেশী বিজয়ীদের আধিপত্য এবং অভ্যন্তরীণভাবে যুদ্ধরত দলগুলির মধ্যে দ্বন্দ্বের দীর্ঘ দিনের ইতিহাস রয়েছে । এশিয়া ও ইউরোপের প্রবেশদ্বারে, এই ভূমিটি প্রায়  খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ সালে ম্যাসেডোনিয়ার মহান আলেকজান্ডার(Alexander the great ) কর্তৃক জয় করা হয়েছিল।এগারো শতকের বিজয়ী গজনির মাহমুদ, যিনি ইরান থেকে ভারত পর্যন্ত একটি সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন, তাকে আফগানিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চেঙ্গিস খান ১৩ শত  শতাব্দীতে অঞ্চলটি দখল করেছিলেন।  ১৯  শতকের সময়, ব্রিটেন, রাশিয়ার হাত থেকে তার ভারতীয় সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য, আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, যার ফলে ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধ বহুদিন চলার পর ব্রিটিশ দখলে আসে।

১৯৭৩ সনে  এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের সর্বশেষ রাজা মোহাম্মদ জহির শাহকে উৎখাত করা হয় ।  এই দেশটি ১৯৭৯-১৯৮৯ সময় সোভিয়েট দখলে চলে যায়। এর মধ্যে আফগান সৈন্য, মুজাহিদ ও রাশিয়ান সংঘর্ষের ফলে  ১৯৮২ র দিকে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন আফগান পাকিস্তানে  এবং আরও ১.৫ মিলিয়ন ইরানে পালিয়ে যায় । এই আফগানিস্তানের মাটিতেই  মুজাহিদ ও তালেবানের জন্ম হয়।  আফগানিস্তানে গণতন্ত্র আজ ও ফিরে আসে নি। আফগানিস্তানে মহিলাদের শিক্ষা তথা স্কুল,কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি পড়াশুনা, চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে- এক কোথায় বলতে গেলে মহিলারা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।     

১৯৮৪ সনে  ইরানে (শরণার্থী) জন্মগ্রহণকারী  মিস মারিয়াম মনসেফ কানাডার মন্ত্রিসভায় নিযুক্ত সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রীদের একজন হিসেবে নিজের নাম তৈরি  করেছেন।  তিনি বলেন আমি যে সময়  এ দেশে এসেছি   ” এই নতুন দেশের সংস্কৃতি,ভাষা,খাবার, আবহাওয়া,স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা,পোশাক,সমস্ত কিছুই আমাকে  বিস্মিত করেছিল। ”  মারিয়াম মুনসেফ ৩১ বৎসর বয়সে কানাডার ফেডারেল সরকারের একজন মন্ত্রী হয়েছেন  ; হয়তো তাঁর আফগানিস্তানের বন্ধুরা এই বয়সে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে রান্নাবান্না, বাচ্চা ও  হান্ডিপাতিল  নিয়ে ব্যস্ত।এখানকার  মুক্ত জীবন ব্যবস্থা  মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে দিতে সাহায্য ক

বাংলাদেশী অনেক যোগ্য ব্যক্তি বা ছেলেমেয়ে এ দেশে এসেছেন , অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অনেকেই এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে – সে দিনটি  বেশি দূরে নয়।        

সমাপ্ত

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন