গত রোববার টরোন্টোর বাংলা পাড়া ডানফোর্থের গোল্ডেন এইজ সেন্টারে সন্ধ্যায় একটি একক কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করেছিল স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন বাচনিক। সেখানে কবিতা আবৃত্তি করেন আবৃত্তির শুদ্ধজন বেলায়েত হোসেন। প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যাপি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আর পশ্চিম বঙ্গের কবিদের কবিতা আবৃত্তি করেন তিনি। জনাব হোসেন বর্তমানে কানাডা ও ইউ এস এ সফর করছেন। তার সফরের উল্লেখযোগ্য বিষয় মন্ট্রিয়ালে ফোবানা (৩-৪ সেপ্টেম্বর) আর নিউ ইয়র্কে একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান (২৮ অগাস্ট)।
এখানে আবৃত্তিকার বেলায়েত হোসেনর পরিচিতি পর্বটি তুলে ধরা হলোঃ-
বেলায়েত হোসেন-এর জন্ম ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের পুরোনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। মায়ের নাম আনোয়ারা খাতুন, বাবা- মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ্। স্ত্রী-সেলিনা মমতাজ।ছেলেবেলা থেকেই শিল্প সাহিত্যের পরিমন্ডলে তার বেড়ে ওঠা। একাডেমিক পাঠাদির পাশাপাশি ছিলো পরিবারে নানারকম শিল্প সাহিত্য বিষয়ক পত্রপত্রিকার পঠন পাঠন।
গেণ্ডারিয়ায় তখন নানা সব অনুষ্ঠান হতো । বিশেষ করে বিচিত্রা অনুষ্ঠান,তাতে নানা সব ছড়া পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, পাশাপাশি স্কুলের অনুষ্ঠানাদিতো আছেই। পাড়ার নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ে, কৈশোরে বিদ্যালয়ের নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় সুধীজনের দৃষ্টি কাড়ে।দশম শ্রেণীতে থাকতেই সুযোগ হয় বাংলা সাহিত্যের অকাল প্রয়াত শক্তিমান কথাশিল্পী কায়েস আহামেদ-এর সান্নিধ্যে আসার। তার নির্দেশনা, সাহচর্য বেলায়েত এর সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিচরনের পথকে আরো তরান্বিত করে এগিয়ে নিয়ে যায় আদর্শীক রেখায়। নিয়মিত পঠন-পাঠন, অনুষ্ঠানাদি দেখা-শোনা, তার বিশ্লেষণ, আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোচনা-এমনি ভাবে গড়ে উঠতে থাকে বেলায়েত ঐ কৈশোর আর তারুণ্যে কায়েস আহামেদ এর অপার স্নেহে। তখন একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, নাটক, চিত্রকলা, রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং লেখালেখি নিয়ে সদা ব্যাস্ত এ তরুণ। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র হলেও ঝোঁক ছিলো সেই ছেলেবেলা থেকেই বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষনা করবেন।কাছে দূরে মিলিয়ে পরিবারে তখন তিন তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁদের জীবেনযাত্রা তাকে আকর্ষণ করতো। তাই স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক। সত্তরের দশকের ঠিক মাঝামাঝি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণদ হয়েও বাড়ির সবার অমতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং উত্তীর্ণ তালিকায় চার নম্বরে স্হান পায় বেলায়েত হোসেনের নাম। প্রচন্ড বিরোধিতা করেও পরিবারের মতকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি বেলায়েত। মুক্তিযুদ্ধকালে একমাত্র বড়ভাইকে হারানোয় (যাঁর লাশও পাওয়া যায়নি) বৃদ্ধ পিতার ওপর বিশাল পরিবারের দায়ভার তখনো, এমতাবস্হায় পরিবারের সকলেই বিজ্ঞানের মেধাবী এক ছাত্রের বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে অনিশ্চিত জীবনের রেখায় এগিয়ে যেতে ঘোর বিরোধী। এই স্পর্শকাতর দুর্বলতা স্বাধীনচেতা যুবককে পরিবারের ইচ্ছার কাছেই নতি শিকার করায়। পদার্থ বিজ্ঞানে লেটারমার্ক পাওয়া ছাত্রকে অবশেষে ভর্তি হতে হয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানে। ক্লাসে নতুন জানার আগ্রহে বন্ধু ও শিক্ষকদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও বেরিয়েই সেই কলাভবন আর টিএসসির আড্ডা, আবৃত্তি, নাটক, লেখালেখি। এক ধরনের অন্তর্দন্দ্ব তাকে পরের বছর পুনরায় বাংলা বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় আসীন করায় এবং তালিকায় ষোলতম স্হানে তার নাম লিপিবদ্ধ হয়। যথারীতি ভর্তি হন, কিন্তু বাধ সাধে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং-এ উদ্ভিদ বিজ্ঞানের NOC আনতে হবে। ও আর হয়ে ওঠেনি। উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনার সমাপ্তি টানেন। পরবর্তীকালে এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করেন।
দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং টান টান ব্যাস্ততা নিয়ে আবৃত্তি, গণসঙ্গীত, নতুন নতুন গ্রন্হনা নিয়ে কাজ করে গেছেন। বহু ছাত্র ছাত্রী গড়ে তোলেন বেলায়েত সেই থেকে যারা আজ শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন স্হানে প্রতিষ্ঠিত। ‘৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-এ বেলায়েত হোসেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন । বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্নয় পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই যুক্ত আছেন তিনি। বর্তমানে পরিষদ এর সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য । ছেলেবেলা থেকেই যুক্ত আছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে। বর্তমানে উদীচী’র কেন্দ্রীয় সংসদ-এর সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য। সুদীর্ঘকাল থেকে উদীচীর আবৃত্তি বিভাগ-এর প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলছেন অগনিত তরুণ উদীয়মান আবৃত্তিশিল্পী। বেলায়েত হোসেন বহু আবৃত্তি বিষয়ক পাণ্ডুলিপি রচনা, গ্রন্থনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রেস রিপোর্ট, প্রথম দিনের সূর্য, নগর তিলোত্তমার কথকথা, সাম্প্রদায়িক সমাচার, রক্তাক্ত যশোর, জোট বাঁধো তৈরী হও, বজ্রে তোমার বাজে বাঁশী, ‘এই মৃত্যু’, ‘জীবন ও সংকল্প”, ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’, ‘সূর্যদেব, ঘুমকি ভালো’ ইত্যাদি ।
আবৃত্তির পাশাপাশি ছেলেবেলা থেকে নাটকেও অভিনয় করতেন বেলায়েত হোসেন।উদীচী মঞ্চায়িত রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে প্রধান চরিত্র ‘অক্ষয়’–এর ভূমিকা রুপায়নে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন । তাঁর প্রথম একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান ‘জীবনে প্রদীপ জ্বালো’ ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হয় এবং দ্বিতীয় একক অনুষ্ঠান হয় সুনামগঞ্জে, তৃতীয় একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকায় অবস্হিত আমেরিকার EMK Centre. দেশের বাইরে ভারত, ফ্রান্স, কানাডায় তাঁর একক ও যৌথ অনুষ্ঠানে তাঁর আবৃত্তি সুধীজনে দারুণভাব সমাদৃত হয়। তাঁর প্রকাশিত একক আবৃত্তি এ্যালবাম-‘আগুনের কাছে ফুলের অঙ্গীকার’, ‘ঠিকানা’ , ‘এক আকাশের তারা’, ‘আমারই চেতনার রঙে’, দ্বৈত-এ্যালবামঃ ‘দ্বৈত রথ’, ‘বৈশাখের চিঠি’, দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গে যৌথ এ্যালবাম-পূর্বাপর,মেঘ রৌদ্রের খেলা, তোমার পতাকা যারে দাও সুধীজনে বহুল প্রশংসিত।
বেলায়েত হোসেন উদীচী ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের আমন্ত্রণে ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় আবৃত্তি কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন নিয়মিতভাবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের তিনি একজন নিয়মিত ‘এ’ গ্রেডের শিল্পী। করে থাকেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা এবং বিভিন্ন প্রামাণ্য চিত্রের ধারা বর্ণনা ।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বিপ্লোবী রবি নিয়োগী, উদীচীর ইতিহাস, এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন-এর জন্ম শতবর্ষে নির্মিত প্রামাণ্য চিএ “ম্যাডনা ইত্যাদি। কলকাতার জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ‘ তারা বাংলার’ সরাসরি অনুষ্ঠান ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’-তে নন্দিত আবৃত্তিশিল্পী বেলায়েত হোসেন পাঁচ বছরে পাঁচটি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন বিশ্বময় ভূয়সী প্রশংসিত হন। করোনাকালে তাঁর পরিকল্পনা, পরিচালনা ও সঞ্চালনায় নিয়মিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান “বন্দী দুঃসময়” অত্যন্ত জনপ্রিয়তায় তার ষাটপর্ব পর্যন্ত সম্পন্ন করেন।
পেশায় তিনি একটি স্বনামধন্য ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান। এহেনো পেশাগত গুরুত্বপূর্ণ দায়ীত্ব পালনের পাশাপাশি বেলায়েত হোসেন বলিষ্ঠতার সঙ্গে আবৃত্তি শিল্পের বিকাশে দেশ ও দেশের বাইরে স্বীয় অবদান রেখে চলেছেন। (সংগৃহীত)