কল্পনাতে আমার ছোট্ট গ্রাম:  চোখ বন্ধ করলেই দেখি আমার এই গ্রামের মেঠো পথ,পথের দুই দিকে গাছগাছালি,  পাখির কাকুলি, কৃষকের আনাগোনা, পল্লীবালাদের  ঘোমটা টেনে একটু হাঁসি, গাছের আড়ালে বা ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে বাহিরে উঁকিমেরে পর্দার আড়ালে  চলে যাওয়া। এই মেঠোপথ ধরেই দাদা,চাচা, ভাইবোনদের নিত্য  আসাযাওয়া; ভোর হলেই কাকের  কলরব,গরুর হাম্বা হাম্বা এবং মসজিদ থেকে ভেসে আসা  “আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্নাউম ” ঘুম থেকে নামাজ ভালো ধ্বনি । কাকের চিৎকার শুনে দাদি করিমুনের বুলি,  ” এইরে দেখ কাকটা এই ভোরে গাছের ডালে বসে কেমন কাতর সূরে ডাকতেছে, কার যেন কি দুঃসংবাদ নিয়ে  আসছে ? ” একটু চুপ থেকে বলে,  ওই দেখ সঙ্গে সঙ্গে টিক্-টিকি ও ডাকছে।  কি জানি কি খারাপ খবর? শুনলিতো কাক, টিকটিকি, কি জানি কি খারাপ খবর? দাদি সঙ্গে সঙ্গে জোরে জোরে আঙ্গুল কাঠে  তিনবার ঠকঠক করে  এবং আমরা জিজ্ঞেস করলে বলে  “এতে খারাপ কিছু থাকলে কেটে যায়। ”  আমরা ছোট ছেলেমেয়েরা  হেঁসে হেঁসে বলি ” দাদি, জোরে জোরে কাঠে আওয়াজ করলেই বালা মুছিবত দূর হয়ে যাবে ? ” কিছু বললেই দাদি রাগ করে ঘরের ভিতর চলে যায়। শুনো  দাদি, ভোরে আমাদের যেমন মুড়ি, পান্তা ভাত  খেতে হয়, ওরা ও সারা রাত না খেয়ে থাকে, ওদের ও খিদা লাগে এবং  কিছু খেতে হয়। সে জন্য ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে  কাকা করে চিৎকার করে। আরে তোরা কেবল না বুঝে  তর্ক করিস। এগুলি শনির দশা তোরা বুঝবি  না। 

ওই দিনই  দুপুরে ঘাগরা গ্রামের আমাদের ফুফাতো ভাই  আনিস খবর নিয়ে এসেছে, ফুফু কাল রাতে পুকুরের  ঘাটলায় পড়ে  পা ভেঙেছে ।  দাদি ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে বের  হয়ে বলে ,” এই যে দেখ আমি সকালে কাকের ও টিকটিকির ডাক শুনেই বলছি কি জানি কি খারাপ খবর? তোরা  কেবল আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করিস। শুনলি তো, কি সর্বনাশ!  

হ্যা ! দাদি তুমি তো গণক, সব বলতে পারো।  দাদি আবার রাগে বিড়বিড় করতে করতে ঘরে গিয়ে আনিসকে বলে, তোমার মায়ের এখন কি অবস্থা ?  

 পায়ে ব্যাথা, নড়াচড়া করতে পারে না, কান্নাকাটি করে ।  বাবা দক্ষিন বাড়ির জসিম কবিরাজকে ডেকেছে ,ও লতা ঔষুধ, কলাপাতা দিয়ে  পা শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। মা এখন পা নড়াচড়া করতে পারে না।শুনে দাদি চোখের পানি ফেলে,বলে  আমাকে কেউ পছন্দ করে না।  সকলে আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে।  আমরা সবাই উঠে গিয়ে বলি , ” দাদি এই কানে ধরলাম, আর তোমাকে বিরক্ত করবো না। ” দাদি একটু হেঁসে বলে , থাক এইবারের মতো মাফ কইরা দিলাম। এইবার সবাই দাদিকে জড়িয়ে ধরে আদর, দাদির  তো খুশিতে দুই চোখ দিয়ে পানি আইসা গেছে।  

দাদি বলে আমি কুলসুমকে দেখতে যাবো। আমরা বলি  ঠিক আছে  দাদি তুমি আনিস  ভাইয়ার সঙ্গে গিয়ে কয়েক দিন থেকে আসো। দাদি সাদা ধুতি ও  এক জোড়া চপ্পল পইড়া কয়, তোরা আমার পানের ডিব্বা ঠিক কইরা দে।  মা বলে এক খিলি পান হাদা দিয়া খাইয়া  যান , এখান থেকে ঘাগরা যাইতে লাগবে আধ ঘন্টা, কুলসুমকে দেখতে গেলে আপনাকে পান দিবে।  ঠিক আছে। দাদির পিছু পিছু আমরা হগ্গলে ছুটলাম, বাড়ির পুব দিকে কিছুদূর গিয়ে দাদিকে বিদায় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।   আমাদের জন্য দাদির এত আদর, এত মায়া মমতা,  কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে তাকায়, আবার হাঁটে,আবার ফিরে তাকায় । 

দাদির সঙ্গে ঝগড়া করি , তবে রাতে দাদি আমাদের ঘুমের সাথী ।  দাদি হেই ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়েছে ; দাদা ছিল দাদির জীবনের জীবন।  দাদা মাঠে লাঙ্গল নিয়ে কাজ করতো, বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে  ঘরে ফিরে আসতো, দাদিকে কাছে টেনে নিয়ে আদর না করে কি পারা যায় ?  এইখানে মসজিদের পাশে দাদার কবর।  দাদি রোজ রোজ মসজিদের কাছে গিয়ে দাদার কবরের দিকে তাকিয়ে কি যেন মুখ নেড়ে নেড়ে বলে ? জিজ্ঞেস করলে বলে তোমার দাদার জন্য দোআ করলাম।              

সে যুগে বর্ষার মৌসুমে সকাল বিকাল অবিশ্রাম ঝিঝি পোকার ডাক শুনে গ্রামের  ঝোপ জঙ্গল পার হতাম।  বিশেষ করে দিনে বা রাত্রে ব্যাঙের  ডাক শুনলে দাদি করিমন  বলতো বৃষ্টি হবে ।দাদির মতো অনেকে  বিশ্বাস করতো ব্যাঙের “গান গাওয়া” অৰ্থাৎ বৃষ্টি নিয়ে আসা। বর্ষার মৌসুমে খেত খামারে বিভিন্নজাতের ব্যাঙ গান গায়।  খেতে খামারে, জঙ্গলে,পুকুর পাড়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।  সাপ গর্ত থেকে বের হয়ে ব্যাঙ ধরে  মুখে নিয়ে না পারে গিলতে,না পারে মুখ থেকে ফেলে দিতে;  এ অবস্থায় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সাপ মারা কতই সহজ ।  

আমাদের বড় পুকুরের আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি এবং আমার সমবয়েসী আরো কয়েকজন পুকুরে ঢিল ছুড়ছি, কে কতদূর নিতে পারে এই প্রতিযোগিতা খেলায় । হঠাৎ এক সাপ পুকুরে এ দিক থেকে অপর পারে জঙ্গলের দিকে সাঁতার কেটে যেতে নজরে পড়লে আমরা চিৎকার শুরু করি।  আমাদের চিৎকার শুনে হাকিম ভাই  লাঠি  নিয়ে দৌড়ে এসে  বলে কোথায় সাপ ? ততক্ষনে সাপ জঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। অনেক খোঁজ করে ও আর সাপ পাওয়া যায় নি।      

মা-দাদি  বলতো “ভোর হয়েছে, ঘুম থেকে উঠ। ” কিন্তু সব মা-দাদি  জানে , ছোটছোট শিশুরা  রাতে প্রস্রাব করে বিছানা ভিজিয়ে রাখে । আমরা দুই জন দাদির দুই দিকে ঘুমাতাম, দাদি  মাঝ রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমাদের বাহিরে নিয়ে প্রস্রাব করাতো। এত ঘুম, চোখ খুলতে পারতাম না । দাদি চিৎকার দিয়ে বলতো ” পেশাব কর “।  ঘুমে ঢুলু ঢুলু করে পড়ে যাই। কিন্তু তাতে ও কোনো লাভ হতো না, রাতে বিছানা নষ্ট করবোই।দাদি সকালে চিৎকার করে বলতো , এই দেখ তোরা রাত প্রস্রাব করে আমার কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিস।  আমি এখন ফজরের নামাজ পড়তে পারবো না।  মা রাগ করে বেত নিয়ে এসে বলতো প্রতিদিন কেন বিছানায় প্রস্রাব করা? দাদি আমাদের জড়িয়ে ধরে বলতো, থাক ওরা ছোট, মারতে হবে না। দাদির আদর আজ ও পেতে ইচ্ছে করে। শুধু কি তাই ?  মা রাগ করতো, কাঁথা ধোয়ে  রোদে শুকাতে দিতো। দাদি অতি চমৎকার কাঁথা সেলাই করতে জানতো; চোখে পুরু চশমা দিয়ে কাঁথা সেলাই,নামাজের বিছনা, বালিশের কভারে  ও  পাখায় ফুল  তৈরী করতে জানতো।  তার কাজের জন্য সবাই প্রশংসা করতো।  

আমরা তখন ও স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি ;  প্রতিদিন বাড়ির পূর্ব দিকের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হলে বাড়িতে এসে যা কিছু পাইতাম খেয়ে আবার দৌড় দিতাম, কে কার আগে দৌড়াতে পারে এ ছিল আমাদের প্রতিযোগিতা।  

আমাদের গ্রামের হতো দরিদ্র মানুষগুলি  খড়ের চালার কুঁড়েঘরে  বা অবস্থা সম্পন্ন লোক  দুচালা/ চারচালা টিনের ঘরে,যাদের চারপাশে  গরু, ছাগল কুকুর, বেড়াল এবং গাছে কাক, পেঁচা ও নানাপ্রকার পাখি বাস করতো । প্রতি ঘরের পাশে হাঁসমুরগী  পোষা হতো, রাত হলে শিয়াল এসে মুরগির লোভে ঘোরাঘোরি  করতো এবং কুকুর ওদের দেখলে তাড়া করতো। শিয়াল এতই ধূর্ত যে একত্রে কয়েকটা এসে আক্রমণ করতো। কুকুর আওয়াজ করলেই দাদি ঘুম থেকে উঠে শিয়াল তাড়াতে যেত। 

আমরা দুই ভাই দুই দিক থেকে দাদিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকি ; দাদি বলে আরে তোরা ছাড় আমারে, আমি শিয়াল তাড়া করে আসি।  ততক্ষনে আমাদের ও ঘুম ভাঙছে, আমরা দুই ভাই উঠে দাদির পিছন পিছন  গিয়ে দেখি  শিয়াল ততক্ষনে মুরগি নিয়ে দৌড়। দাদি বলে তোদের জন্য পারলাম না । বাহিরে অন্ধকার তেমন কিছুই দেখতে পাইতাম  না। কুকুর ৫-৬টা  করে  বাচ্চা দিতো এবং রাতে  শিয়াল এসে আক্রমণ করে বাচ্চা নিয়ে যেত। সকালে দাদি বলে শিয়াল কুকুরের বাচ্চা নিয়ে যায়।  রাতে পলো দিয়ে কুকুরের বাচ্চা ঢেকে রাখ।  মা বলে রাতে কুকুরের বাচ্চা ঢেকে রাখলে কুকুর মুখ দিয়ে পলো সরিয়ে বাচ্চা বুকে নিয়ে ঘুমায়।    

রাতের অন্ধকারে আমরা সে যুগে যখন বাজার বা দূরে কোথাও থেকে আসতাম, হাতে হয়তো কোনো আলো নেই।  এ অবস্থায় জোনাকী পোকার আলো পথ দেখার কাজে সাহায্য করতো।  এই জোনাকি পোকার আলো এই নিভে, এই জ্বলে এবং এর মধ্যে আমরা পথ দেখে বাড়ি আসতাম। কিন্তু এই নিভে এই জ্বলে মিটিমিটি আলো পথ ভালো দেখা যেত না।  ফলে আমাদের অন্ধকারে হাটতে হতো।  হাতে একটা লাঠি থাকতো এই জন্য যে পথে সাপ শুয়ে থাকলে লাঠির আওয়াজে পথ থেকে সরে পড়তো। সাপ রাতে ইঁদুর ধরার জন্য গর্ত থেকে বের হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে, লাঠির আওয়াজে এরা মাঠের দিকে সরে যায়।  বর্ষা হয় হয়, আমি একবার আমাদের পাট খেত দেখতে গিয়েছি , এক সাপ পাট খেতে দেখে ভয়ে চিৎকার শুরু করি।  বাংলাদেশ গরম আবহাওয়া এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়, গরমে সাপ গর্ত থেকে বাহিরে খাবারের জন্য বাহির হয়। তাছাড়া বন্যা হলে, সাপ থাকার জায়গা নেই , হয়তো গাছের ডালে বা মানুষের ঘরে চলে আসে।  বাংলাদেশে বন্যা হলে, সাপ ঘরে উঠে, সাপের ধ্বংসনে  লোক মারা যায়।

আমাদের সে যুগে গ্রামে সিঁদেল চোর সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে চুরি করতো।  কাঁচা মাটি ও খড়ের বেড়া, চোর বেড়া কেটে বা বেড়ার নিচে সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে চুরি করে সোনা গহনা ,মালামাল নিয়ে পালিয়ে যেত। সে যুগে প্রতিটি গ্রামেই চোরের উপদ্রব হতো। ১৯৫৮, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান গ্রামে গ্রামে(অবৈতনিক)  রক্ষিবাহিনী নিয়োগ  করেছিলেন।  গ্রামের মানুষ পর্যায়ক্রমে রাতে গ্রাম পাহারা দিতো আর স্লোগান  দিতো ” বস্তি জাগোরে “।  আমাদের মজিদ কাকা এক রাতে টের পেয়ে চোরের পিছু পিছু গিয়ে এক চোর ধরে পিটিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেয় ।  সে যুগে রাতে চোর ধরা পড়লে গ্রামের লোক পিটিয়ে মেরে পেলতো।       

আমাদের ছোট সময়ে, গ্রামে মানুষ জুতা-স্যান্ডেল পড়তো  না, কাঠের খড়ম ব্যবহার করতো, কুমিল্লার কাঁঠাল কাঠের খড়ম সবাই পছন্দ  করতো, আর বলতো এই দেখ কাঁঠাল কাঠ, টেক সই, অনেকদিন পড়া যাবে। সে যুগে গ্রামে লোকজন  জুতো পড়তো না  বা কদাচিৎ পড়তো । 

বিয়ের অনুষ্ঠানে মেহমান বাড়িতে আসলে পানি খড়ম বাহিরে রাখা হতো পা ধোয়ার জন্য।  বাড়িতে বৈঠকখানা বা কাচারী ঘর যেখানে  মেহমানদের মাটিতে বিছানার, চাদর, ফুলতোলা বালিশ, ফুলতোলা হাতের পাখা দেয়া হতো এবং ঘন ঘন মেহমানদের খোঁজ খবর নেয়া হতো।   বর-দুলা  রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতো এবং ওটাই প্রচলন ছিল।    

সে যুগে মেয়েরা পর্দা করে থাকতো এবং বাহিরে পর-পুরুষকে দেখলে গুনাহ হবে ভেবে বড়ো বেশি ঘরের বাহির হতো না। মুসলমান মহিলারা বেশি রক্ষণশীল,  অনেক পরিবার মহিলাদের  ঘরের চার দেয়ালের বাহিরে যেতে দিতো না।

 কুয়াশা ভরা ভোরে গ্রামের লোক ধান কাটতে মাঠে যেত ; গ্রামের ছেরু  ধানকাটার সর্দার।  সকাল হলেই ছেরু চেঁচামেচি,”কইরে তোরা সবাই চল “।  কে কার খেতে ধানকাটতে যাবে এ দায়িত্ব ছেরুর।  উনি বলাবলি শুরু করতেন কে কার খেতে যাবে।  বিকেল  হলে ধানের আঁটি  মাথায় নিয়ে বাড়িবাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওদের দায়িত্ব শেষ ।  ভোর ৭টায় কাজ শুরু, একটা দেড়টা বাজে কাজে বিরতি নিয়ে নামাজ ও খাওয়া শেষে ২ ঘন্টা কাজ করার পর কাজ শেষ হয়ে যেত।  

ছেরু  ভূমিহীন একজন মজুর ছিলেন।  শেষ জীবনে বিনা চিকিৎসা ও  দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতেন কিনা সন্দহ।  তার দুই ছেলে ঢাকা শহরে ঠেলাগাড়ি ও বালু,সিমেন্ট দোকান থেকে  ঠেলা করে নিয়ে মালিকের বাড়ি নির্মাণ  বা কোম্পানি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন এ  দিয়ে  আসতো ।  ছোট ছেলে ঠেলা গাড়ির কাজ করতে গিয়ে রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়।  বড়ো ছেলে অকালে স্ট্রোক করে মারা যায়।  তাদের ছেলেমেয়েরা করুন অবস্থার মধ্যে কোনো রকমে বেঁচে আছে।

এই গ্রামেই আর এক ভূমিহীন অসহায় মোস্তফা  (৬ জনের ) সংসার, মাছ ধরে সংসার চালায়।  সে গ্রামে খালে, ডোবা নালাতে মাছ ধরে গ্রামের বাজারে বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালায়।  যেদিন মাছ ধরতে পারে, বিক্রি করে চাল, ডাল কিনে ছেলেমেয়েদের খাওয়া  দেয়, ছেলেমেয়েরা কোনোদিন খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে  বেঁচে থাকে।

ধান কাটা মৌসুমে  চলে  ধান মাড়ানো আর ভোরে ধান  সেদ্ধর কাজ। গরু দিয়ে ধান মাড়ানো, সেদ্ধ করা, ধান শুকানোর দিনগুলো উৎসব মনে হতো । মহিলাদের দায়িত্ব ধান সেদ্ধ এবং ঢেকিতে চাল ও বড়ো মটকাতে চাল রাখা। ধান কাটা শেষ হলে সবাই একটু আনন্দ করে শেষ করতো। ধান কাটা শেষ হলে ঘরে ঘরে হরেক রকমের পিঠা, মুড়ি, চিড়া বানানোর ধুম লেগে থাকতো ; এই সঙ্গে জামাই/নাইয়ুরী বেড়ানোর সময় । নুতন জামাই হলে তো কথাই নেই, ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরে মেয়ে/ জামাই, দরজা বন্ধ  ,  শরম,  ওই ঘরে যাওয়া যাবে না।  মাসের পর মাস জামাই আতিথিয়েতা  চলছে।     

সে যুগে মা-চাচীরা   ধান সিদ্ধ, উঠানে শুকানো,ঢেকিতে চাল করা, গোলাভর্তি,রান্না ও ঘর সংসারের এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে ব্যাস্ত, এই ছিল কর্মমুখুর জীবন। মহিলারা উঠানে কাজ করলেও চারিদিকে পাটখড়ি বেড়া দিয়ে পর্দা করা হতো যেন অপর বেগানা পুরুষ না দেখে। কোনো পুরুষ বাড়িতে ঢুকলে আগে থেকেই গলা খাকরা দিয়ে আওয়াজ করা হতো যেন সময়মতো মহিলারা উঠান থেকে ঘরে পর্দার আড়ালে যেতে পারে।  এটাই ছিল সে যুগের ইসলামী প্রথা। ঘরের প্রতিটি রুম কাপড়ের পর্দা দিয়ে আলাদা করা হতো।  

মেয়েমানুষের অসুখ, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতাল নিয়ে যাবে ? মেয়েরা বেপর্দা হয়ে বাহিরে যাবে ?  সে তো পাপের কাজ। আমাদের সে যুগে হিন্দু কবিরাজরাই গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতো-  যেমন আমাদের এলাকাতে -ললিত,শচীন্দ্র,পূর্ণ,গোবিন্দ আরো ও অনেকেই কবিরাজি চিকিৎসা করতো। মুসলমান কবিরাজ বলতে সে যুগে খুব কম ছিল। কবিরাজদের বাড়িতে সব ধরণের ঔষুধি গাছগাছরা পাওয়া যেত এবং ওরা মূলতঃ সবই বাড়িতে তৈরী করে রোগীদের দিতো।  কবিরাজ হাতে ঔষুধের টোল নিয়ে বাড়িবাড়ি যেত এবং রোগীদের রোগের অবস্থা বুঝে বড়ি দিতো।     কবিরাজি বড়ি খেতে হলে, লতাপাতা -তুলসী পাতা, কচি আম পাতা,জায়ফল,দারচিনি আরো কত কিছু সংগ্রহ করে পাটায় পিষে   বড়ির সঙ্গে যোগ করে খেতে হতো।  আবার এদের অনেকেই কবিরাজির সঙ্গে এলোপ্যাথি চিকিৎসাও করতো।  এ সব হিন্দু কবিরাজগন মুসলমান বাড়ি গেলে দুই হাত তুলে আদাব  নমস্কার বলে প্রণাম করতো।  আমাদের মুসলমান গণ ও ওদের আদাব নমস্কার বলে সাদরে ঘরে নিয়ে রোগী দেখাতো।  বাড়িতে হিন্দু কবিরাজ আসলে পর্দার আড়াল থেকে  মুসলমান মহিলারা    অসুখের বিবরণ দিতো এবং সে মতে কবিরাজি   ঔষুধ দেয়া হতো।    অনেক সময় পর্দার আড়াল থেকে রোগী একটা হাত বের করে দিলে কবিরাজ শিরা দেখে রোগ নির্ণয় করতো। এটাই ছিল সে যুগের প্রথা।  

পরপুরুষের চোখে চোখে চাহনি, মহিলাদের মুখ ও  মাথার চুল দেখা , নব্য বিবাহিত মহিলাদের পায়ে ব্যাবরিত গোলখারু বা হাতে  রেশমি চুড়ির আওয়াজ পরপুরুষ শুনবে ” হায় আল্লাহ ” এতো পাপের কাজ। আমাদের হুজুররা বলেন, না জানি কত কাল দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে যদি আল্লাহ মাফ না করেন।  হুজুরেরা বলেন মেয়ে-মানুষের সৌন্দর্য্য দেখা একমাত্র তার স্বামীর জন্য জায়েজ। অপর পুরুষ মাবাবা,শ্বশুর শাশুড়ি ব্যাতিত কারো জন্য জায়েজ নাই ।  গলার স্বর নামিয়ে কথা বলতে হবে, যেন বাহিরের লোক শুনতে না পান। যত দূর গলার আওয়াজ যাইবে ,ততোদূর দোজগের গভীরতা বাড়বে।  সে যুগে আমাদের মেয়েদের বাহিরে যাওয়া দূরের কথা, ঘরের চারিদিকে উঁচু বেড়া দিয়ে রাখতো যাতে বাহির থেকে কেউ দেখতে না পারে। অনেক মহিলারা সে যুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যেত।  আমাদের  বাড়ির এক মহিলার সন্তান হবে, এক সপ্তাহ  প্রসব ব্যাথা , বাচ্চা প্রসব হচ্ছে না।  বাড়ি থেকে দেড় থেকে দুই মাইল দূরত্বে থানা হাসপাতাল। মহিলা এক সপ্তাহ পর্যন্ত প্রসব ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে।   ওকে হুজুরী চিকিৎসা, পানিপড়া , মাটিপাড়া,আরোও  কতরকম তুকতাক গ্রামের চিকিৎসা করানো হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে নেয়া হয় নি, অবশেষে সে বাচ্চা প্রসবের ব্যাথায়  মারা গেছে। মৃত্যুর পূর্বে ওর স্বামী হুজুরের কাছে গিয়ে এর তদবিরের কথা বললে, হুজুর ওকে বলেছে একটা সাদা মোরগ নিয়ে যেতে। হুজুর নিজের পরিবার নিয়ে আয়েশ করে মোরগের মাংস ভক্ষণ করেছে –  মোরগের মাথা দিয়ে তাবিজ বানিয়ে রোগীর গলায় দিয়েছে, একবার ও বলেনি -রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।  

সে যুগে ১০-১২ বৎসরের মেয়েদের বিয়ে হতো । ছেলে পক্ষের লোকজন যথা ছেলে স্বয়ং, বাবা,ভাই,চাচা সহ কনে বাড়ি গিয়ে এই  মেয়েদের হাতপা, দাঁত, চুল , মুখের  রং দেখে বিভিন্ন প্রশ্ন করতো যেমন সূরা কেরাত, নামাজ, হাতের কাজ-  ফুল তোলা ফাখা তৈরী জানে কিনা বা রান্নাবান্না শিখেছে কিনা জিজ্ঞেস করতো।  এই ছোট্ট মেয়ে কিছু বলার পূর্বেই তার মুরুব্বি যথা দাদি, নানী সব ফরফর করে বলে দিতো, ” আমার নাতিন সব রান্না করতে পারে। ”     অনেক সময় প্রতারণা হতো -যেমন এক মেয়ে দেখিয়ে অন্য মেয়েও বিয়ে দিতো। 

আমাদের সে যুগে গ্রামে অনেকেই লেখাপড়া জানতো না।  লোকজন  তাদের স্ত্রীদের বাড়িতে রেখে চিটাগাং, ঢাকা,ময়মনসিং বা অন্যান্য শহরে কাজ করতো।  ওরা চিঠি লিখতো, কিন্তু প্রাপক লেখাপড়া জানে না,  এই চিঠি পড়তে জানতো না।  আমি প্রাথমিক বা হাই স্কুলে পড়ি , ওদের চিঠি পড়ে দিয়ে উত্তর ও দিতে হতো।  মেয়ে লোকের প্রেমের চিঠি ও আমাকে লিখতে হতো। মহিলা  তার মনের দুঃখ স্বামীকে ইনিয়ে/ বিনিয়ে চিঠির ভাষায়  বলতো, আমি শুধু লিখে দিতাম। আমি ভাবতাম, এই মহিলা তো লেখাপড়া করে নি।   কিন্তু তার ভাষাগত জ্ঞান এত প্রখর ।  চিঠি লেখার পর আমাকে পড়ে শুনাতে হতো এবং সে থেকে আমার লেখার অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। আজ আমি যা  কিছু লিখি; এই লেখা স্কুল জীবন থেকেই হাতেখড়ি ।  

১০-১২ বৎসরের মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে আসার অর্থ পুরুষ, (স্বামী) দ্বারা ভয়ভীতি ও শারীরিক অত্যাচারিত  হওয়া ব্যাতিত আর কিছুই  আনন্দের থাকতো না। যে জন্য ওরা স্বামী বাড়ি আসার কথা শুনলেই কান্নাকাটি করতো। কেন কান্নাকাটি করতো ওটা তাকে কেউ জিজ্ঞেস করতো না বা করলেও গুরুত্ব দিতো না; বরং জোর করে পাঠানো হতো, যেতে না চাইলে  হুজুরের তাবিজ ও জিনের আছর থেকে রক্ষার জন্য তদবির করাতেন। মেয়েদের বর দেখে পছন্দ হয়েছে কি ? এই প্রশ্ন অভিবাবক মহলের কেউ জিজ্ঞেস করতো না বা ওর মতামতের উপর কেউ নির্ভর করতো না।   

ক্রমশ : 

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবৃত্তিকার বেলায়েত হোসেন-পরিচিতি
পরবর্তী নিবন্ধ“Pursuit of Happiness”
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন