আমাদের বাড়ি থেকে রাইফের স্কুল পায়ে হেটে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। ২০১৮ তে স্কুলের নুতন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলে এই দূরত্ব আরো কমে আসবে। সচরাচর আমিই রাইফকে স্কুলে দিয়ে যাই। কানাডার স্বল্পস্থায়ী গ্রীষ্মের একদিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলের দিকে হেটে যাচ্ছি। রাইফ আমার গা ঘেঁষে হাঁটার চেষ্টা করছে । তাকে ক্ষেপানোর চেষ্টায় জানতে চাইলাম এতো লজ্জা পাওয়ার কারণ কি। উত্তরে বললো, “No, I am not shy. It is the scorching heat. Trying to save myself from the sun.” রাইফ আমার বামে থাকার কারণে ডানদিক থেকে আসা সূর্যের প্রখর তাপ আমিই অনুভব করছি। রাইফের গায়ে সেই তাপ লাগছে না। আর দশজন বাবার মতো সূর্যকে আড়াল করে আমিও হাটছি ছেলেকে নিয়ে। খুব সহজ, সাধারণ, স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু কেন জানি না ঠিক ওই মুহূর্তে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অপরাধবোধ নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে পড়লো নিজের মা বাবার কথা। শুধু সূর্যের তাপ থেকেই নয়, সব দুঃখ কষ্ট আড়াল করে যারা পরম মমতায় আগলে রাখেন আমাদের, প্রশান্তির ছায়া দিয়ে যান জীবনভর। অথচ জীবন সায়াহ্নে এসে তারা নিজেরা যখন একটু ছায়ার সন্ধান করেন, আমরা তখন আরো দূরে সরে যাই, তাদের মাথার উপর ছায়া দেয়ার জন্য বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারিনা। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়. কে জানে, মানুষ হয়তো আসলেই বড় অকৃতজ্ঞ। বৃদ্ধনিবাসে বসবাসরত আমার এক ক্লায়েন্টকে দেখি সারাক্ষন তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে, বসে থাকে ছেলে মেয়ের সাথে সাক্ষাতের আশায়। অথচ সে নিজেও জানে যে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ আর খ্রীষ্টমাস ছাড়া এদের দেখা মিলবে না। অবাক হবার বিষয় হচ্ছে যে এজন্য কোনো আক্ষেপও নেই তার । তার ভাষায়, “Each and every ounce of my energy was drained for them. Now they are happy, so am I. Who cares if they choose to come to see me or not”. ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করি, “ তাহলে রাস্তার দিকে চেয়ে বসে থাকো কোন আশায় ?”। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়না। জানি দীর্ঘশ্বাস ছাড়া তার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
আমাদের জীবনের একটি বড় অংশ কাটে অর্থ, বিত্ত আর সমৃদ্ধি অর্জনের দৌড়ে। এই অর্জনের দৌড়ে প্রাপ্তিযোগ হয় অনেক, আবার হারিয়েও ফেলি অনেককিছুই। অনেক সময় বিবেকবোধও। ভুলে যাই মাথার উপর বিরাজমান অদৃশ্য ছায়ার অস্তিত্ব। ভুলে যাই সেই বটবৃক্ষকে যার সুশীতল ছায়াতলে আমাদের বেড়ে উঠা।
“Daddy, can we walk a little faster ? The second bell is ringing.” রাইফের ডাকে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসি বাস্তবে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাই স্কুলের দিকে। যদিও জানি আমার এসব ভাবনার কিছুই সে বুঝবে না, তবুও ছেলের কাছে বটবৃক্ষ হয়ে থাকার সাধ আমি দমিয়ে রাখতে পারিনা।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে