জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো !! এ জীবনে এও দেখে যেতে পারলাম, আমাদের টগবগে তুরুন টাইগারের দল ছিনিয়ে নিয়ে এলো অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ান ট্রফি । জয় বাংলাদেশ, জয় ক্রিকেট, জয় তরুণ টাইগার্সের দল । তোমাদের বুক ভোরে আশীর্বাদ করছি, তোমাদের দেখিয়ে দেওয়া পথে তোমাদের বড় ভাইয়েরাও ইনশা আল্লাহ এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের ক্রিকেটকে । আজ ক্রিকেটের তথাকথিত মোড়ল ভারত কে ৩ উইকেট হারিয়ে জয়োৎসবে মেতে উঠলো বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ।

গতকাল রাতে বন্ধুর বাসায় দাওয়াতের পার্টিতে আলাপে আলাপে একসময় কথা উঠলো ভোর তিনটায় (স্থানীয় সময় ) অনুষ্ঠিত আগামী কালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ এর ফাইনাল খেলার কথা । অনেকে অনেক নেগেটিভ মন্তব্য করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে । আমি ঠান্ডা মাথায় শুনছিলাম উনাদের আমাদের ক্রিকেট নিয়ে তাচ্ছিল্ল মন্তব্য। তখন কে জানতো সৃষ্টিকর্তা লিখে রেখেছেন ম্যাচের ভাগ্য বাংলাদেশের দিকে । সারা রাত অপেক্ষায় থাকলাম আকাশ কুসুম স্বপ্ন নিয়ে ।

সকাল সাত টা থেকে কাজ । ভোর ছয়টায় সেল ফোন অ্যালার্ম দেওয়া ছিল । কিন্তু, কিসের এলার্ম, কিসের কি, ছেলের হাত তালি আর চিৎকারে আরো আগে ঘুম ভেঙ্গে গেলো । নিচে এসে দেখি, পাগল ছেলে আমার সারা রাত জেগে থেকে ফ্যামিলি রুমের দেয়ালে রাখা বড় টিভি স্ক্রিনের সাথে ল্যাপটপের কানেকশন দিয়ে খেলা দেখছে । ভারতের একটি করে উইকেট পড়ছে আর ছেলে আমার কাক ভোরের  নীরবতা ছিন্ন করে গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পরে উল্লাস করছে । আহা!! এই প্রবাস জীবনে দেশের প্রবল টানে আচ্ছন্ন পাগল ছেলে আমার!!

যাক, কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি স্বরূপ কাপড় পড়তে পড়তে ভারতের শেষ উইকেটের পতন দেখার সৌভাগ্য হলো । সব কয়টি উইকেট হারিয়ে ভারতের অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট দল এর রানের চাকা থমকে গেলো মাত্র ১৭৭ রানে । দারুন বল করেছে আমাদের তরুণ বলারেরা । তরুণ অভিষেক দাস ৯ ওভার বল করে ৪০ রানে নিয়েছে ওদের মূল্যবান তিনটি উইকেট । এছাড়া, শরিফুল ইসলাম ও জুনিয়র সাকিব নিয়েছে প্রত্যেকে দুইটি করে উইকেট । ভারতের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কেবল যাইসোয়াল। তিনি করেছেন ১২১ বলে ৮৮ , যথাক্রমে ৩৮ ও ২২ রান করে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন তিলক ভার্মা ও জুৱেল ।

কাজের জায়গায় আজ কেন জানি প্রচুর ব্যাস্ততা ছিল । কম্পিউটারে লাইভ খেলা দেখারমতো সময় ছিল না । কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে স্কোরবোর্ড দেখছি । বাংলাদেশের ওপেনারদের ৫০ রানের জুটি, আহা !! কি যে আনন্দ !! কিন্তু ঘটনা ঘটলো তারপরেই । ৫০ থেকে ৬২ রানের মধ্যে দুই উইকেটের পতন ও একজন আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্যাভিলিয়নে । দুরু দুরু মন নিয়ে ফেসবুকে নিউজের পেজে পোস্ট দিলাম “আবারও বড়দের মতো মহামারী!! জিততে পারবেতো বাংলাদেশ????” দেখি দুই একজন হতাশাগ্রস্থ কমেন্ট লিখেছেন । মহা চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে যে দুইজন আউট হলেন তাদের মধ্যে একজন আবার সেই বিখ্যাত মাহমুদুল হাসান জয় যিনি সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করেছিলেন । ভালো খেলতে থাকা পারভেজ হোসেন ইমন প্যাভিলনে  যাওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়লো ।

এবার মঞ্চে এলেন বঙ্গ সেনা[পতি আকবর আলী । কমেন্টসে কেউ কেউ লিখছেন এইমুহূর্তে বাংলাদেশের দরকার একজন এম এস ধোনি-র মতো ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড় । সেনাপতি আকবর নিজেরমতো খেলতে থাকলেন কান্ডারি হয়ে ধীর স্থিরভাবে । আহত ইমন আবার উইকেটে এলেন । ইমন, আকবর মিলে জয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ইমন আউট হওয়ায় আবার শঙ্কা বাঁধ সাধলো প্রকৃতি । বাংলাদেশের ইনিংসের বয়স তখন ৪০, খেলা আরো ১০ ওভার বাকি, বাংলাদেশের রান সাত উইকেটে ১৬২, জয় থেকে মাত্র ১৬ রান দূরে । বৃষ্টি ধেয়ে এলো বাংলাদেশের জয়ের রথ টেনে ধরতে। খেলা সাময়িক বন্ধ । শুরু হলো পাটিগণিতের হিসাব নিকাশ । এই মুহূর্তে আর যদি বল মাঠে না গোড়ায় তবে ডার্ক / লুইস মেথড অনুযায়ী জয় বাংলাদেশের । কিন্তু, বৃষ্টি-র কৃপায় জয়ে যে দেশবাসী সন্তুষ্ট না সেটা বুঝে থেমে গেলো বৃষ্টি । সাময়িক বন্ধ থাকা খেলা শুরু হলো নতুন করে । ডার্ক / লুইস মেথড অনুযায়ী নতুন লক্ষমাত্রা ধার্য হলো ১৭০ অর্থ্যাৎ বাংলাদেশকে জিততে হলে করতে হবে ৩০ বলে মাত্র ৭ রান । টান টান উত্তেজনা। প্যাভিলিয়নে যে দুইজন ব্যাডসম্যান বসে আছে তানজিম হাসান ওরফে জুনিয়র সাকিব আর শরিফুল ইসলাম যাঁদের ব্যাড করার অতীত পারফরম্যান্স তথবৈচ । আসার কথা হচ্ছে  উইকেটে আছে সেনাপতি আকবর ।

বলার রকিবুল ধীর লয়ে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে আকবর আলীকে । বৃষ্টির পরে শুরু হওয়া ৪১ তম ওভারের চথুর্ত বলে বলার রকিবুল যেন পাকাদস্তুর ব্যাডসম্যান এর মতো একটি ৪ হাঁকিয়ে জেতার সমীকরণকে একেবারে মাটিতে নিয়ে এলেন , জিততে হলে করতে হবে দুই রান, হাত প্রচুর বল বাকি। ওভারের শেষ বলে সিঙ্গল নিয়ে রকিবুল আবারো ব্যাটিং এ । এই মুহূর্তে খেলা টাই । দক্ষিণ আফ্রিকার পঁচেফস্ট্রুমে খেলা দেখতে আশা গুটিকয়েক বাংলাদেশী সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে । চিৎকার করে গলা ইতিমধ্যে ভেঙ্গে ফেলেছে বাংলাদেশকে সাপোর্টকরা দর্শকেরা । দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র বাংলাদেশির অনেকের চোখে তখন আনন্দশ্রু । কাজের জায়গায় কাজ ফেলে দিয়ে কম্পিউটারের সামনে ইতিহাসের সাক্ষ হতে দাঁড়িয়ে পড়েছি । । ৪২ ওভারের প্রথম বলেই রকিবুলের সিঙ্গেলের মাধ্যমে এলো মহেন্দ্রক্ষণ । ধরা দিলো দেশে/বিদেশে প্রথম বারের মতো কোনো আন্তর্জার্তিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল কাপ । তাও আবার বিশ্ব কাপ।

প্রবাসে বসে বাপ, ব্যাটা গলা মিলিয়ে গাইতে থাকলাম :

“জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো
এমন করে আকুল হয়ে
আমায় তুমি ডাকো।।

তোমার কথায় হাসতে পারি
তোমার কথায় কাঁদতে পারি
মরতে পারি তোমার বুকে
বুকে যদি রাখো মাগো।।

তোমার কথায় কথা বলি
পাখির গানের মতো
তোমার দেখায় বিশ্ব দেখি
বর্ণ কত শত।
তুমি আমার—খেলার পুতুল
আমার পাশে থাক মাগো।।

তোমার প্রেমে তোমার গন্ধে
পরান ভরে রাখি
এইতো আমার জীবন-মরণ
এমনি যেন থাকি।
বুকে তোমার—ঘুমিয়ে গেলে
জাগিয়ে দিও নাকো মাগো।।”

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“কৃতজ্ঞতা বোধ”
পরবর্তী নিবন্ধপৃষ্ঠা ছেঁড়া থেকে **
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন