আজ পহেলা জুলাই, আজকের দিনে কানাডা পূর্ণ করলো তার এক শত তিপ্পান্ন বছর জীবনকাল। না, আজ আমি কানাডার জন্ম ইতিহাস শোনাবোনা। আমি এই কানাডার কাছ থেকে আমার প্রায় সতেরো বছর জীবন-যাপনের উপলদ্ধি থেকে যা পেয়েছি, শিখেছি, আজ শেয়ার করার চেষ্টা করবো।
দয়া করে আমাকে আবার ভুল বুঝবেন না। আমি মনে প্রাণে বাংলাদেশী। কাউকে খাটো করে অন্যকে বড় করার অভ্যাস আমার নেই। আমি আমার জন্মভুমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমি সেকেন্ড হোম হিসাবে কানাডাকে বেছে নিয়েছি। এই কানাডা থেকে অনেক অনেক পেয়েছি যা আমাকে কানাডার হয়ে কিছু ভালো কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি আজ প্রানখুলে কানাডার এই এক শত তিপ্পান্ন তম জন্মদিনে কানাডার বন্দনার গীত গাইবো। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাসঃ করি, এই বন্দনার গীত গাওয়ার মাধ্যমে আমার প্রিয় জন্মভূমির প্রতি আমার ভালোবাসার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ফাটল ধরাতে পারবে না।
আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে, কানাডার সিটিজেনশিপ পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হয়ে কানাডিয়ান নাগরিকত্ব পেয়ে স্বপরিবারে যখন বাসায় ফিরছি, নিজের কাছে কেন যেন রাজাকার রাজাকার অনুভূতি লাগছিলো। ধীরে ধীরে এখানকার আলো বাতাসে আমার ছেলে মেয়েরা বড় হতে লাগলো, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। আমি নতুন করে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্ৰী কমপ্লেট করে, আল্লাহর অসীম রহমতে অদ্যাবধি আমার প্রফেশনাল লাইনে চাকুরী করে যাচ্ছি। এখনকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, চাকুরী ও প্যারেন্টিং এর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে গুটিকয়েক কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
শ্রমের মর্যদা বিষয়ে দেশে হাইস্কুলে রচনা মুখস্থ করে সুন্দর সুন্দর কিছু কথা শিখেছিলাম। দেশে সেই শেখানো কথাগুলোর বাস্তবতা না দেখলেও, এখানে এসে নতুন করে শিখলাম, দেখলাম শ্রমের মর্যদা কাকে বলে। এখানে এসে আমি শিখলাম, কাজের কোনো ছোট/বড় নেই, জাত/পাত নেই। কাজ কাজই। এঁরা শ্রমিকের প্রকৃত মর্যদা দেয়। এখানে একজন শ্রমিকের কাজের জায়গা থেকে ইন্সুরেন্স সহ অনেক বেনিফিটের ব্যবস্থা থাকে। এখানে, একজন শ্রমিকের গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি থাকাকে বেমানান মনে হয় না। আর, কৃষকের কথা তো বলাই যাবে না ! এখানকার একেকটি কৃষক নিজেরাই প্রোডাকশন থেকে শুরু করে, প্রসেসিং ও মার্কেটিং করে থাকে যা তাদেরকে আর্থিকভাবে এতই লাভবান করেছে যা প্রত্যন্ত গ্রামে একেক জন কৃষকের খামার বাড়ি ও বিলাসবহুল ঘরবাড়ি দেখে সহজেই অনুমান করা যায়।
কিন্তু, আমার অবুঝ মন বাংলাদেশের প্রিয় শ্রমিক/কৃষক ভাইদের জন্য ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেঁদে উঠে। আমি যখন এখানে ওয়ালমার্ট থেকে মেড ইন বাংলাদেশ লেখা জিন্স এর প্যাণ্ট কিনি, আমার চোখের সামনে কচুরিপানায় ভরা নোংরা নর্দমার উপরে মাচা করে গড়ে উঠা বস্তির খুপরি থেকে বের হওয়া কর্ম চঞ্চল গার্মেন্টস কর্মী তরুণীর কথা মনে হয়। আগুনে পোড়া শুখনা মরিচের সাথে লবন ডোলে রাতের বাসি সাদা ভাত কোনোরকমে নাকে মুখে খেয়ে টেম্পোতে করে মহাখালী এসে পায়ে হেটে গার্মেন্টস ফ্যাক্টারীর দিকে ছুটছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টারীর দিকে। সেখানেও আরেক অত্যাচার। সুপারভাইজারের কুদৃষ্টি অথবা হটাৎ করে আগুন লাগলে একসাথে ছুঁটে পালানোর অব্যবস্থা।
আমি যেখানে কাজ করি , আমার বস একজন সাদা ককেশিয়ান ভদ্র মহিলা একদিন কথায় কথায় তার স্বামীর খুব প্রশংসা করছে। আমি সহজাত বাঙ্গালিসুলভ বাৎসল্যতা দেখিয়ে তাঁকে বললাম, ‘তোমার স্বামী কোথায় কাজ করে?’ উনি অনেকটা গর্বভরে বলছেন, আমার হাজবেন্ড একটি এলিমেন্টারি স্কুলের কেয়ার টেকার। কি সাবলীল ভাবে উনি উনার কেয়ার টেকার স্বামীর গুণগান গাচ্ছেন শুনে মন ভোরে গেলো। এখানে একজন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার অথবা প্লাম্বিং এর কাজ করে এমন শ্রমিকের বিলাসবহুল বাড়ি দেখে প্রথম প্রথম হা করে টাশকি খেয়ে তাকিয়ে ছিলাম। শুধু তাই না, প্রথম যখন কানাডাতে আসি খাঁটি বাংলা ভাষায় যাঁকে বলে ‘মুচি’, এমন একজন সাদা মুচি সাহেবকে দামি গাড়িতে করে এসে শপিংমলে নিজ দোকান ঘর খুলে জুতা পালিশ করতে দেখে আমার বেশ কিছুক্ষন সময় লেগেছিলো স্বাভাবিক হতে ।
এখানে যদিও আমরা আদর করে কিছু কাজকে ওড জব বা সারভাইভাল জব বলে প্রফেশনাল কাজের সাথে একটি সীমা রেখা টানি। কিন্তু কাজ কাজই । নিজের প্রফেশনাল জবের পিছনে ছুটতে যেয়ে আমরা যেন কোনো কারণেই ওই ধরণের কাজকে ছোট ভাবে না দেখি, কারো মনে আঘাত না দেই।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যেটা আমি শেয়ার করতে চাই, সেটা হচ্ছে, প্যারেন্টিং। অনেক অনেক বছর আগে, আমার মেয়ের তখন সম্ভবত ৪/৫ বছর বয়স হবে, ওকে নিয়ে ডাউন টাউনের বাচ্চাদের এক ডাক্তারখানায় গিয়েছি। আমার মতো আরো কিছু অভিবাবক তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন। আমরা সবাই ডাক্তারের চেম্বারের বাহিরে ওয়েটিং রুমে বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছি। বাচ্চাদের জন্যে হরেক রকমের খেলনা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যাতে বাচ্চারা বোরিং না হয়। আমার মেয়েও এ খেলনা /ওখেলনা ধরে ছুটাছুটি করছে আর আমি ওর পিছে পিছে বাসায় থেকে রান্না করে নিয়ে আসা নুডুলসের বাটী নিয়ে ওর পিছে পিছে ছুটছি। খাবার জন্য জোরাজুরি করছি। আমার দিকে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে একজন এদেশীয় সাদা ভদ্র মহিলা তাকিয়ে আছেন। উনি উনার দেড় দুই বছরের ছেলে কে বাসায় থেকে নিয়ে আসা একটি বিশেষ চেয়ারে বেল্ট দিয়ে বেঁধে বসে রেখে চেয়ারের পাশে রাখা ছোট্ট বাটিতে সুপের মতো কি একটি দিয়েছে , ছেলেটি চামুচ দিয়ে চুক চুক করে একা একা খাচ্ছে। আমি অভিভূত হয়ে আমার মেয়ের নুডুলস এর বাটী হাতে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম আমাদের প্যারেন্টিং নিয়ে অনেক শেখার আছে।
তৃতীয়তঃ, কানাডার যে জিনিসটি আমাকে অনেক আকর্ষণ করেছে তা হচ্ছে এখানকার এডুকেশন সিস্টেম। প্রথমেই বলে নেই, এখানকার কোনো স্কুল /কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দেশীয় কায়দায় এখানকার ছাত্র/ছাত্রীদেরকে কখনো রাজনীতি করতে দেখি নি। এখনকার এডুকেশন সিস্টেমের মধ্যে থেকে ছাত্র.ছাত্রীদের সেসব করার সময়ই বা কোথায়! এখানে, গ্রেড নাইন শুরু করার আগে প্রতি অভিবাবক কে স্কুল থেকে চিঠি দিয়ে কোর্স সিলেকশনের জন্য তাগিদ দেয়া হয়। প্রতিটি কোর্স দুই ধরণের থাকে: একাডেমিক ও নন একাডেমিক। একাডেমিক কোর্সগুলি হচ্ছে সেসব বাচ্চাদের জন্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্যে মন স্থির করেছে। আর নন একাডেমিক কোর্স নেয়া বাচ্চারা টুয়েলভ গ্রেড শেষ করে কলেজ লেভেল থেকে নিজ নিজ পছন্দের বিষয় নিয়ে শর্ট কোর্স করে লাইসেন্স নিয়ে কাজে ঝেপে পরে। এতে গার্জেনদেরও তেমন আপত্তি থাকে না। এখানকার ছেলে মেয়েরা নিজ নিজ পছন্দমতো তাদের ক্যারিয়ারের পথ বেছে নেয়। হাই স্কুলের বাচ্চাদের বাধ্যতামূলক কমিউনিটি ভলান্টিয়ার ওয়ার্ক, স্কুলে বিভিন্ন গঠনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাচ্চাদেরকে লিডারশিপ স্কিল্ড হিসাবে গড়ে তোলে।
এখানে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছেলে/মেয়েরা বেছে বেছে সেসব সাবজেক্ট বেছে নেয় যেগুলিতে কোঅপারেটিভ এডুকেশন (Cooperative Education Program) বা সংক্ষেপে ‘কো আপ’ ((Co–op) এর ব্যবস্থা রয়েছে। এতে করে এক দিকে যেমন বাচ্চারা পড়া অবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে, আবার বেতনও পাচ্ছে , এমন কি পড়া শেষে সেখানে কাজ করার অনেকটাই নিশ্চয়তা থাকে যায়। আবার, নন কো আপ প্রোগ্রাম ছাড়াও অনেক সাবজেক্ট আছে যেখানে ফিল্ড প্লেসমেন্ট এর ব্যাবস্থা থাকে। এসব ফিল্ড প্লেসমেন্টের এক্সপেরিয়েন্স দেখিয়েও চাকুরীতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
সর্বোপরি, একানকার স্টুডেন্ট লোন যা অন্টারিও স্টুডেন্ট এসিস্টেন্স প্রোগ্রাম (Ontario Student Assistance Program )বা অ সাপ (OSAP) নিয়ে পড়ার বিষয়টি আমাকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করেছে ও উপকৃত করেছে । এমনকি রেজিস্টার্ড এডুকেশন সেভিংস প্ল্যান (Registered Education Savings Plan )যা সংক্ষেপে আর ই এস পি (RESP) বলা হয় এটার সুবিধা নিয়েও আমার ছেলে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। একজন ছাত্র/ছাত্রী একবারে বাবা/মার ঘাড়ে না চেপে সরকার থেকে যদি লোন নিয়ে পড়ে, তবে সেসব ছাত্র/ছাত্রীদের লোন পরিশোধের একটি তাড়া থাকে যা তাদেরকে কাজে ঢোকার প্রেরণা যোগায়।
এখানকার অনেক ছেলেমেয়েদের দেখেছি, কাজের ফাঁকে অথবা সামারে, স্কুল বন্ধের সময় কাজ করে নিজের টিউশন ফি শেয়ার করছে যার কারনে OSAP- এর উপর কম চাপ পড়ছে। কি চমৎকার মানসিকতা। এতে করে, এক দিকে যেমন নিজের সরকারের কাছে টাকা ঋণ এর বোঝা কমছে আরেক দিক থেকে নিজিকে ভবিষ্যতের প্রফেশনাল কাজের জন্যে প্রস্তুত করছে। সেদিন এখানে বেড়ে উঠা এক ইন্ডিয়ান অল্প বয়সী মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে সরাসরি কেস ম্যানেজার হয়ে আমাদের প্রোগ্রামে জয়েন করলো। মেয়েটির চলন/ বলন ও কাজ কর্মে আমি অভিভূত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা তো তোমার প্রথম চাকরি তুমি এত কিছু শিখলে কিভাবে ! মেয়েটি হেসে বললো, আমি গ্রেড নাইন থেকে কাজ করি এবং তখন থেকেই অনেক কিছু শিখেছি। আমি মনে মনে বললাম আহা!! আমার মেয়েটি যদি এমন চটপটে হতো !!!
সর্বোপরি, এদেশে এসে যা আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা হলো, এখনকার স্থায়ী বাসিন্দা এমনকি আমাদের বাংলাদেশী ভাই/বোনদের মাঝেও দেখেছি সবাই জীবন কে উপভোগ করতে জানে। এখানকার মানুষেরা যেমন কাজ পাগল তেমনি এঁরা প্রচুর আমুদে। উইকেন্ডে অথবা ছুটির দিনে এঁরা স্বপরিবারে, স্ববান্ধবে বিভিন্ন বীচে, পার্কে ঘুরে বেড়ায়, বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে বারবিকিউ পার্টি করে। এখানকার বাংলাদেশী ভাইয়েরা অনেকেই যার যার মতো করে সামারে সবজি চাষ করে ও প্রতিবেশী, বন্ধু/বান্ধবীর মাঝে সেসব শাক/সবজি বিলিয়েই আনন্দ পেয়ে থাকেন। আহা!! কি স্বর্গ সুখ!! হে আল্লাহ এমন স্বর্গ সুখ তুমি আমার প্রিয় জন্ম ভূমিতেও ছড়িয়ে দাও !!
শুভ জন্মদিন কানাডা, শুভ হোক, শুচি হোক এই ধরিত্রী, কোরোনার এই ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাক এই পৃথিবীর তাবৎ মানুষ।