ইতি পূর্বে আমি উত্তম কুমার /সুচিত্রা সেন এবং দিলীপ কুমার/সায়েরা বানুকে নিয়ে কিছু লিখেছি। এবারের পর্বে ভারতীয় সিনেমা জগতের কৌতুক অভিনেতা জনি ওয়াকার ( নভেম্বর ১৯২৬-জুলাই ২০০৩) কে নিয়ে  শুরু করলে কেমন হয় ? জনি ওয়াকার এর ভালো নাম বদরুদ্দীন জামালুদ্দিন কাজী। অনেকের  ধারণা জনি ওয়াকার নূর মহম্মদ চার্লি,ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানী কমেডিয়ানকে খুব পছন্দ করতো, তাই সে সব সময় ও ভাবে কমেডি করে কথা ও গান গাইতো। তার বাবা একজন কারখানা শ্রমিক এবং পরিবারে ১০ ভাই বোনের মধ্যে তার স্থান ছিল দ্বিতীয়। বাবার চাকুরী চলে যাওয়ার পর, সংসারের রুটি রোজগারের দিয়িত্ব তার উপর পড়ে। সে বাস কন্ডাকটর হিসাবে প্রথম কাজ শুরু করে এবং তার ফাঁকে ফাঁকে আইসক্রিম,ক্যান্ডি,সবজি,ফল মহল্লায় মহল্লায় বিক্রি করতো । জনি ওয়াকার  সব সময় বাসে প্যাসেঞ্জেরদের আনন্দ দেয়ার জন্য এবং  মহল্লায় মহল্লায় আইসক্রিম ,ক্যান্ডি এবং সবজি,ফল বিক্রির সময় লোকদের আকর্ষণ করার জন্য গান ও অভিনয় করে লোক  সমাগম করতো । তবে তার স্বপ্ন ছিল মুভিতে অভিনয়  করা । তার কথা বার্তার মধ্যে কমেডি ও অন্য  রকম প্রতিভা দেখে,  সিনেমা অভিনেতা বলরাজ সানি ,ইন্ডিয়ান তৎকালীন বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক গুরু দত্তের নিকট নিয়ে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয় । গুরু দত্ত ওর নাম পাল্টিয়ে জনি ওয়াকার নামে   সিনেমায় লাগিয়ে দেয় এবং   জনি ওয়াকারকে আর পিছু ফিরতে হয় নি । সে সর্বমোট ৩০০ বা  তার ও বেশি মুভিতে অভিনয় করেছে । বড়ো বড়ো অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সবাই তার মতো একজন কৌতুক অভিনেতাকে নিয়ে কাজ করতে আনন্দ বোধ করতো। সে মুভিতে মদের অভিনয় করতো, তবে জীবনে কোনো দিন মদ স্পর্শ করে নি । সে হিন্দি সিনেমা জগতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সাকিলার ছোট বোন নুরজাহানকে বিয়ে করে । সংসারে তার   তিন ছেলে ও তিন মেয়ে, অনেক পরিশ্রম করে সে নিজের সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিল  এবং জীবনে তাঁকে আর অভাবে পড়তে হয় নি। সারাজীবন জনগণের নিকট একজন কৌতুক অভিনেতা হিসাবে বেঁচে ছিলেন ।

এবারে অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক । আমার এক প্রতিবেশি কার্লো যাকে আমি গত ১৫ বৎসর থেকে একজন কঠোর পরিশ্রমী লোক হিসাবে চিনি। তার স্ত্রী ফিলোমিনা এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে,   আমাদের পারিবারিক প্রতিবেশি ও বন্ধু । প্রতিবেশী হিসাবে  ওর সঙ্গে মাঝে মধ্যে আমার অবসর সময়ে আলাপ করি । কার্লো ৭৯ বৎসর বয়স্ক একজন (ওয়ার্ক ও হলিক ) কাজের মানুষ । সে অবসরপ্রাপ্ত ,কিন্তু কাজ ছাড়া থাকেনা । আমি যখনই দেখি, কিছু না কিছু নিয়ে ব্যাস্ত । ওর অতীত ইতিহাস জানার আগ্রহ অনেক দিনের।

কার্লোর জন্ম ইতালির কোনো এক ছোট্ট শহরে ( ১৯৩১) । তার বাবার সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না। ছোট বয়সে সে কাঠ কেটে বিক্রি করে বাবার সংসারে আর্থিক সহযোগিতা করতো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর  সে জার্মানিতে ৮ বৎসর কন্সট্রাকশনে  কাজ করে । যুদ্ধের সময় সে ইতালিতে ছিল,তবে কাজ করতে গিয়ে জার্মানির ধ্বংসাবশেষ  তার  নজরে পড়েছে । তার কাছ থেকে আমি জার্মানির ধ্বংস সম্পর্কে বাস্তব অনেক কিছু জানতে পারি ।সে বলে শুধু জার্মানি  নয়, ইউরোপের সব কটা দেশ ধ্বংস হয়েছিল,তবে জার্মানি সব চেয়ে বেশি। বহুদেশের লোক  জার্মানির পুনর্ঘটনে কাজ করেছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়  জার্মানির বাড়ি ,ঘর,কল কারখানা,রাস্তা ঘাট সব কিছুই ধ্বংস প্রাপ্ত ছিল । যুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশ এগিয়ে এসে জার্মানির পুনর্ঘটনে সাহায্য করে। বিভিন্ন দেশের আর্থিক সাহায্যে এবং লোকজন দিয়ে অনেক বৎসর কাজ করে দেশকে দাঁড় করিয়ে দেয় । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্বে ৪০ হাজারের ও অধিক কানাডিয়ান সৈন্য প্রাণ হারায় ।   লক্ষ লক্ষ লোক  সর্বস্য হারিয়ে আমেরিকা/ কানাডায় রিফুজী হিসাবে চলে আসে । এ সব লোক  যারা বেঁচে আছে এবং তাদের ছেলে মেয়েরা অনেকেই প্রিয় জন হারানো স্মৃতি স্বরণ করতে গিয়ে আজ ও  চোখের জল ফেলে ।

কার্লো ষাটের দশকে  ইমিগ্রেশন নিয়ে এ দেশে আসে ও কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার হিসাবে কাজ শুরু করে । সে সময় এ দেশে কাজ  পাওয়া অনেক কঠিন ছিল । অনেক সময় সে বরফের রাস্তায় হাটতে গিয়ে চিৎ পটাং হয়ে পড়ে আঘাত পেতো । একবার শক্ত (আইস)বরফের ওপর হাটতে গিয়ে সে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায় এবং হাসপাতালে যেতে হয়।  প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে বাহিরে রাস্তায় দৈনিক ৮ ঘন্টা কত যে কষ্টের কাজ, যারা না দেখে বিশ্বাস করতে পারবে না । মেশিন দিয়ে মাটি কেটে রাস্তা তৈরী করা আবার কখন ও  বাড়ি ঘরের নির্মাণ, সব ধরনের কাজই সে করেছে ।  কয়েক বৎসর কাজ করে কিছু ডলার জমিয়ে দেশে গিয়ে বিয়ে করে, স্পনসর করে স্ত্রীকে  নিয়ে এসে দুইজনে কাজ শুরু করে । আস্তে আস্তে অনেক বৎসর কাজ করে  ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বাড়ি খরিদ করে।  এ ভাবেই কাজ করতে করতে একদিন অবসর নেয় ।  এ কাহিনী বলতে গিয়ে তার  দু’চোঁখ জলচিয়ে উঠে। সে যুগে একজন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কারের মজুরি ছিল সপ্তাহে  ৩৫ ডলার । আমি প্রশ্ন করলাম,তুমি তো জার্মানিতে ও থাকতে পারতে । সে বলে যে,” আমি জার্মানির বাসিন্ধা বটে । তবে আমার বোন কানাডায় থাকতো,সে আমাকে স্পনসর করেছে এবং আমার বোনের মতে কানাডা  শান্তিপ্রিয় দেশ, তাই এ দেশে এসে সেটল হয়েছি ।“  আমি বহু বৎসর থেকে ওকে দেখি,ওকে অলস ভাবে বসে থাকতে কখন ও দেখি না । আমার মতে, সে একজন পারফেক্ট কাজের লোক । বাড়ি  ঘর রেনোভেশন সংক্রান্ত সব ধরণের কাজ সে জানে । আমি তাকে কোনো কাজ নিয়ে বিরক্ত হতে দেখি নি ।  তাকে কোনো কাজ দিলে সে বসবে না যে পয্যন্ত কাজ শেষ না করবে। তার স্ত্রী ফিলোমিনা  এক রেস্টুরেন্ট শেফ এবং বহু বৎসর কাজ করে এখন অবসর নিয়েছে । তার ছেলে মেয়েরা তার সঙ্গে থাকে না । ওদের নিজস্য কাজ ও আলাদা পারিবারিক জীবন, প্রায় উইক এন্ডে  মা বাবাকে দেখতে আসে । অত্যন্ত হাসি খুশি জীবন, দুইজনের  ইটালিটিতে বাড়ি আছে এবং যখন যায়,ঘরের দরজা খুলে দুই এক মাস থেকে আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে আসে । কারো কোনো লোভ লালসা নাই,জোর দখল করার।

আমার পিছনে (ব্যাকডোরে )এক প্রতিবেশী,নাম তার স্যাম । বয়সে কার্লোর  চেয়ে ২/৩ বৎসরের বড়ো,   সে ও ইতালির সিসিলির অরিজিনাল বাসিন্দা । ১৯৫৬,  কয়েক শত লোক একত্রে ইতালি থেকে রেফিউজি হিসাবে  জাহাজে করে এসে  হ্যালিফ্যাক্স, কানাডায় ঢুকেছে ।  যখন যা পায় সে ভাবেই কাজ শুরু করেছিল।  হ্যালিফ্যাক্স, আলবার্টা সুবিধা করতে না পেরে টরন্টো  এসে (সেটলড) স্থায়ী ভাবে বাস করতে শুরু করে। পরে  সিসিলি গিয়ে বিয়ে করে । মাঝে মধ্যে গল্প করি । সে বলে সে সময় এক ঘন্টা কাজ করলে ৭৫ পয়সা মজুরি পাওয়া যেত। কার্লো আর স্যাম আমার খুবই প্রয়োজনীয় বন্ধু মানুষ । অনেক সময় এরা আমার বাড়ির কাজে অনেক উপকার ও করে। স্যাম বাসায় একা থাকে । তার দুই ছেলে দূরে আলাদা ভাবে বৌ, নাতি, নাতনি নিয়ে থাকে। তার স্ত্রী অসুস্থ এবং সিনিয়র হোম নার্সিং  কেয়ার এ থাকে। সে মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখে আসে।

আমাদের আর এক প্রতিবেশি ফ্লোরা ৮৫ বৎসর বয়ষ্কা মহিলা একাকী থাকে। আজ থেকে ১৫ বৎসর পূর্বে তার স্বামী এবং দুই বৎসর হলো সে তার জ্যৈষ্ঠ ছেলেকে হারিয়েছে ক্যান্সারে । তার দুই ছেলে  খানিকটা দূরে  থাকে বৌ আর নাতি নাতনি নিয়ে ।  হাসব্যান্ড ইতালি থেকে  দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পর  এখানে এসে সেটলড হয়েছে। সে বলে,” এ বাড়ি তৈরী হওয়ার সাথে সাথে আমরা কিনেছি । এখানে আমার ছেলেরা হয়েছে, এ বাড়ির সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক । আমি একা হলে ও একা মনে করি না। আমরা প্রতিবেশি সবাই তার খেয়াল রাখি। ফ্লোরার সব চেয়ে অসুবিধা  উইন্টারে যখন হেভি স্নো শুরু হয়। আমার ঘরের দরজা আর তার ঘরের দরজা সামনে সামনি । অনেক সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে যদি তার ঘরের দরজা একটু পরিষ্কার করে লবন দিয়ে দেই। প্রচন্ড শীতে সে বড় একটা ঘর থেকে বের হয় না। সামারে আস্তে আস্তে বাহিরে তার বাড়ির সামনে বেঞ্চে বসে থাকে। লোকজন আসা যাওয়ার পথে তার খবর নেয় । তবে হাসপাতালে বা ডাক্তারের নিকট যেতে হলে মাঝে মধ্যে আমি গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাই যদি কোনো কাজে কর্মে ব্যাস্ত না থাকি, নতুবা সে ট্যাক্সি করে চলে যায় ।

আমাদের আর এক প্রতিবেশি মারিয়া  ৮৫/৮৬ বয়ষ্কা মহিলা। সে ও গত ৬০ বৎসরের ও বেশি সময় আমার পেছনের বাড়িতে থাকে।  অনেকদিন হয় তার স্বামী মারা গিয়েছে। তার দুই মেয়ে একটু দূরে নাতি /নাতনি নিয়ে থাকে এবং  তার একমাত্র ছেলে তার সঙ্গে থাকে।সে প্রচন্ড ঠান্ডা আর গরমে প্রতিদিন বাহিরে হাটে । গরমে  প্রায়ই সকাল থেকে বিকাল পয্যন্ত নিজের বাগানে কাজ করে, দুই বা তিন বার ও একটা ব্যাগ ও লাঠি নিয়ে বাজারে যায়, উদ্দেশ্য বাজার করা নয়, উদ্দেশ্য হাঁটা হাঁটি  করা সুস্থ ও নিজেকে ব্যাস্ত রাখা। সে খুব সামাজিক, এই এলাকার লোকজনের খোঁজ খবর রাখে।

মারিয়ার স্বামী মারা গাছে ১৯৯৪,  আজ থেকে ২৫/২৬ বৎসর হবে। এখনও সে তার স্বামীর সেমেটারিতে (সমাধি) মাসে অন্তত একবার ফুল নিয়ে কিছক্ষন গিয়ে স্বরণ করে। সে ফুল নিয়ে ভালো করে সেজে গুঁজে বাসা থেকে বের হয়ে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক সময় এত ঠান্ডা ও বরফ থাকে যে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর। দুই একবার আমি ও আমার স্ত্রী বের হয়েছি শপিং বা আত্মীয় স্বজনকে দেখতে, ও দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য।  ওকে দেখে আমার ওয়াইফ জিজ্ঞেস করে, “হ্যালো মারিয়া কোথায় যাবে? ” সে জবাব দেয়, ” আমি আমার স্বামীর সেমেটারিতে যাবো।“আমার স্ত্রী  ও ছেলে মেয়েরা ওকে খুব ভালো বাসে ।” আমার স্ত্রী  আমার দিকে তাকায়, আমি সায় দিলে ও ডাকে,” মারিয়া আমরা ওই দিকে যাবো। সে খুশি হইয়া গাড়িতে আসে আমরা ওকে সেমেটারিতে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি কিছু সময় অপেক্ষা করবো? ” সে বলে না, আমার যাইতে দেরি হবে। তোমরা চলে যাও।  নিজে ভাবি, ” কতখানি ভালোবাসা থাকলে একজন  বৃদ্ধা   মহিলা কানাডার প্রচন্ড বরফ আর ঠান্ডার মধ্যে তার স্বামীর সমাধির পার্শে ফুল নিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারে। “একেই বলে প্রেম, একেই বলে ভালোবাসা ।” সব মানুষের মারিয়ার মতো প্রেম,ভালোবাসা  থাকুক বা থাকা উচিৎ ।   এক গুচ্ছ ফুলের  মূল্য তার নিকট কয়েক ডলারের  চেয়ে ও  অনেক বেশি। যখনই তার স্বামীর সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করি, তার চেহারার দিকে তাকালে বুঝতে পারি তাঁর স্বামীর প্রতি গভীর অগাধ ভালোবাসা ছিল।

আমাদের ঘরে কোনো কিছু স্পেশাল হলে, আমার স্ত্রী বা মেয়ে   তাকে ডেকে আনে । বিশেষ করে আমার মেয়ে ওকে দেখলে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে,” Maria I love you!” সে ও বলে ” I love you too!”   তার সবজির বাগান, ফুলের বাগান  আমাদের পাশা পাশি। সে বাগানে আসবে আর আমাদের বাগানে লনে ও একটু কাজ করবে। তার বাগানের সবজি ,আঙ্গুর অবশ্যই  আমার ছেলে মেয়েদের জন্য শেয়ার করবে। শুধু সে একা নয় !কার্লো এবং ফ্লোরা তাদের ও একই অবস্থা।  ইতালিয়ান অত্যন্ত আতিথিয়েতা পরায়ণ লোক। তাদের সমাজ ব্যবস্থা আমাদের সঙ্গে অনেক খানি মিল রয়েছে।

এখানে অনেকেই ক্যারাবিয়ান, সোমালিয়ান,পাকিস্তানী আরও অনেক দেশের লোক রয়েছে। বেশির ভাগ লোক এখানে খালি হাত পা নিয়ে অনেক কষ্ট করে আস্তে   আস্তে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে বাড়ি করেছে। সবার অবস্থাই,” হ্যান্ড তো মাউথ। “ কাজ করে আর কোনো রকমে সংসার চালায়। দুই এক বার দেশে পরিবার নিয়ে গেলে, অনেকেরই  ব্যাঙ্ক থেকে লোন করতে হয়। তা পরিশোধ করতে কয়েক বৎসর লেগে যায় ।

এই যে লোকগুলি নিয়ে আলোচনা করলাম তাদের কারও একটার বেশি থাকার বাড়ি নাই বা দুইটা বাড়ি করার চিন্তা ভাবনা নাই। ছেলে মেয়েরা স্টুডেন্ট লাইফ থেকে কাজ করে পড়া শুনা করে নিজেরা যার যেই কাজে  ব্যাস্ত। সময় পাইলে (ছুটিতে ) এখানে সেখানে বা কটেজে নিজের পরিবার নিয়ে সময় কাটায় বা একটা কিছু কোর্স করে, নিজেকে   ব্যাস্ত রাখে। সবাই যখন একত্রে ছিল এই বাড়িটা সবার জন্য দরকার ছিল। মনে হত বাড়িটা অনেক ছোট ।এখন কেউ থাকেনা, একজন বা দুইজন থাকে, কাজেই অনেকে বাড়ি বিক্রি করে এপার্টমেন্টে চলে যায়। এতে শীতে বরফ পরিষ্কার করা আর গ্রীষ্মে লন পরিষ্কার করা (মেইনটেনেন্স) ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায় । ফ্লোরা তার বাড়িতে একা থাকে এবং মাঝে মধ্যে জিজ্ঞাসা করি। তুমি কি একা ক্লান্ত (বোরে) হও ? সে বলে, নাহঃ  আমার কোনো অসুবিধা হয় না। কাল বিকেলে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে ছিল কফি শপ কি খোলা আছে? আমি বললাম।করোনার কারণে সব বন্ধ। তবে ড্রাইভ  উইন্ডো দিয়ে কফি নেয়া যায় । সে বললো শপে গিয়ে বসে বসে একটু কফি খাইতে পারলে ভালো হত । আমি বললাম সে অবস্থা কবে হবে বলা মুশকিল।

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গিয়েছে যারা  হিজরত বা ইমিগ্রেশন/রেফিউজি হিসাবে   অন্য দেশে যায় তারা ভালো থাকে। এর মূল কারণ হলো ,এ সব লোক পেছনে সর্বস্য হারানো , অনেক পরিশ্রম করে নিজেদের প্রতিষ্টিত করে। এ ছাড়া এদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার পিছনে  অনেক সময় ব্যায় করে। কানাডাতে যে সব লোক দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এসেছে এরা ছিল সর্বস্য হারা এবং শিক্ষিত জ্ঞানী লোক। এরা নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে ছেলে মেয়েদেরকে শিক্ষা দিয়েছে (এডুকেশন ) , লোভ, লালোসা শিখায় নি, এরা কৃতকার্য (সাকসেসফুল) লোক।
এখানকার বড়ো বড়ো ব্যবসা প্রতিষ্টান, বড়ো বড়ো শিক্ষিত ,ব্যারিস্টার, পার্লামেন্ট সদস্য, মন্ত্রী, এ সব লোক যারা এ দেশের পলিসি মেকার,  তাদের অধিকাংশ পূর্ব পুরুষ ইউরোপিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ড। মূলতঃ এ সব লোক এ দেশের কর্ণধার। ইউরোপের বাড়ি/ঘর, রাস্তা ঘাট আর এখনকার দেখলে মনে হবে অনেকটাই কার্বন কপি। এরা সর্বস্য হারিয়ে আসলে ও তাদের ধ্যান ধারণা ছিল একই।

কানাডাকে রেফিউজি কান্ট্রি বলা হয়। সারা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের লোক এ দেশে পাওয়া যাবে। এ দেশের সরকার প্রতিটি কমুনিটির  নিজস্য ভাষাকে ধরে রাখার জন্য সচেষ্ট। এখানে কমিউনিটি স্কুল গুলিতে ছেলে মেয়েদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষা দান পদ্দ্বতি রয়েছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা প্রতি উইকেন্ডে স্কুল গুলিতে নিজস্য ভাষা শিখে।এ  ছাড়া এখানে প্রতিটি কমিউনিটিতে  নিজস্য ভাষায় নিউসপেপার , রেস্টুরেন্ট ও নিজস্য দেশীয় দোকানে  খাওয়া দাওয়া পাওয়া যায়, শুকনা মাছ, মিষ্টি, দেশীয় তাজা মাছ, তরকারি, সবই পাওয়া যায়, বাজার থেকে কিনে আনো, রান্না করো, আর খাও।এ দেশের সরকার সংখ্যা লঘু ( ভিসিবল মাইনোরিটি) লোকদের দাবিকে মর্যাদার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে থাকে ।প্রতিটি কমিউনিটি তাদের নিজস্য দেশীয়  অনুষ্ঠানে নিজেদের দেশ থেকে শিল্পী ও নামি ধামি লোকদের দাওয়াত  করে তাদের গান ও মূল্যবান বক্তব্য  উপভোগ করে। প্রতি সামারে কমিউনিটি বনভোজন(পিকনিক) হয়ে থাকে, তার সঙ্গে সব ধরণের গান বাজনা ও মূল্যবান বক্তব্য উপভোগ করা হয় ।

আমাদের দেশ থেকে যদি কেউ এ দেশে আসতে চায়, অবশ্যই   সৎ উপদেশ দেয়া উচিৎ, এখানকার ভাষা,কাজের দক্ষতা,তদুপরি হার্ড ওয়ার্কিং প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হতে  হবে । তাছাড়া দেশিও  মিথ্যা,বানোয়াট আর ধোকাবাজ লোকদের হাত থেকে দূরে থাকতে হবে । নিজের যোগ্যতা প্রমান করে কানাডিয়ান  হাই কমিশনে সরাসরি কাগজ প্রসেস, সব চেয়ে সহজ ও ঝামেলা মুক্ত । এতে টাকা পয়সা অপচয় হওয়ার ভয় থাকে না ।   মনে রাখবেন, এ দেশে সব সময় দক্ষ কাজের লোক  দরকার আছে । অযথা হয়রান হয়ে মা বাবার টাকা পয়সা দালাল কে দিয়ে সর্বস্য হারাবেন না ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিনটি কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধহ্যাপি বার্থডে কানাডা
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন