টরন্টো থেকে:-
কানাডায় দশটি প্রভিন্স ও তিনটি টেরিটেরি আছে। সব মিলিয়ে কানাডার জনসংখা সাড়ে পয়ত্রিশ মিলিয়নের কিছু বেশি। তার মধ্যে অন্টারিও তেই কানাডার একতৃতিয়াংশ জনবসতি। আবার অন্টারিও প্রভিন্সের জনসংখার মধ্যে টরন্টোর জনসংখা সবচাইতে বেশি। বিশের যে কোনো দেশ থেকে যে কেউ কানাডায় ইমিগ্রান্ট হয়ে আসতে গেলে সর্বপ্রথমেই চিন্তা করে অন্টারিও এবং টরন্টোর কথা। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বিশ্বে বসবাসের একটি অন্যতম সেরা দেশ হিসেবে কানাডা ও সেরা শহর হিসেবে টরন্টোর কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। জীবন যাত্রার মান, আইন শৃঙ্খলা ,সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিব্র্শের দিক থেকে টরন্টো সব সময়ই উপরের দিকে থাকে। তাই বিশ্বের এ দেশের সেরা দেশের সেরা শহরে বসবাস করতে পেরে নিজেকে অনেক সময় অত্যান্ত ভাগ্যবান মনে হয়।তাই অনেক সময় হোম সিকনেসে আক্রান্ত হলেও নিজেকে শান্তনা দেই যে বিশ্বের একটি উন্নত দেশে বসবাস করার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আরো ভালো লাগে যখন মনে হয় আমার একমাত্র সন্তান ভবিষতে এ দেশেরই নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারবে।
কি কারণে কানাডা বিশ্বের সেরা দেশের মধ্যে অন্যতম বা টরন্টো শহর বসবাসের জন্য সবদিক থেকে উন্নত ও নিরাপদ বলা হয় তা আমরা প্রায় সকলেই জানি। মানুষের সকল মৌলিক চাহিদা পূরণে এ দেশে যে সব ব্যবস্থাবলী রয়েছে তা আমাদের দেশের সাথে বা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনা করা যায় না।এখানকার নাগরিক অধিকার বা সরকারের দেয়া অনেক সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নাই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহকালে কেউ যখন কোনো বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হন তখন সে ঐসব বিষয়ে কি কি সুবিধা অসুবিধা এ দেশে আছে তা জানতে পারেন। তবে আমার বাক্তিগত উপলদ্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে কি কারণে এ দেশকে বসবাসের জন্য আমার কাছে সেরা মনে হয় তার কিছু কিছু দৃশ্যমান বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। আমরা সকলেই জানি যে অন্ন ,বস্ত্র ,শিক্ষা,বাসস্থান একজন মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের মানুষের মৌলিক চাহিদা। শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য এসব জিনিসের যদি অভাব না হয় এবং এগুলি যদি সকলের আয়ত্তের মধ্যে থাকে তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে সে দেশ বা জায়গা বসবাসের জন্য সর্বোত্তম।
কানাডায় মানুষের জীবন যাপনের জন্য এসব বিষয় সহজলভ্য ও নিশ্চিত করা হয়েছে। কিভাবে মানুষের এসব মৌলিক চাহিদা এ দেশে নিশ্চিত করা হয়েছে এখন দেখা যাক। প্রথমে যদি অন্ন বা খাদ্যের নিশ্চয়তার কথা চিন্তা করি তবে দেখা যায় সেটা কানাডায় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা হয়েছে। কারো কাজ থাকুক বা না থাকুক সে কখনো না খেয়ে কষ্ট পাবে না। কাজ না থাকলে সরকার বেকার ভাতা ও এমপ্লয়মেন্ট ইন্সুরেন্স প্রদান করে থাকে ।এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও কাজ থেকে কোনো লোক ছাটাই করলে তাকে নিদ্রিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। কাজেই মানুষের বেকার থাকাকালীন কেউ এ দেশে না খেয়ে মরবে না। সরকারী বা বেসরকারী যে কোনো চাকুরিজীবী অর্থাৎ দেশের সব নাগরিকের জন্য আছে পেনশনের ব্যবস্থা। সুতরাং বলা যায় যে এ দেশে একজন মানুষের জীবনের পুরোটা সময়ের জন্যই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা যদি ধরি তবে দেখা যায় শিক্ষা এখানে সার্বজনীন ও সবার জন্য উম্মুক্ত। হাই স্কুল পর্যন্ত শিক্ষা সম্পূর্ণ ফ্রি বা অবৈতনিক। শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে বহুমুখী সুযোগ সুবিধা । যে কোনো বয়সে যে কোনো বিষয়ে এখানে স্কুল কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে লেখা পড়া করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার বায় নির্বাহের জন্য আছে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধা, স্কলারশিপ ও ঋণ গ্রহনের সুযোগ। গত ফেব্রুয়ারী মাসে অন্টারিও সরকরের প্রাদেশিক বাজেট পেশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য টীউশন ফি ফ্রি করে দেয়া হবে। এ দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশও সময়োপযোগী শিক্ষা গ্রহনের জন্য সম্পূর্ণরূপে উপযুক্ত। লেখা পড়ার পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত হয় সে বিষয়ে সবাই সচেতন।
বাসস্থান বা থাকার জায়গার ব্যবস্থাও সবার জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। সাধারণত ইমিগ্রান্ট হয়ে প্রথমে কেহ এ দেশে আসলে তার আর্থিক সামর্থ অনুযায়ী নিজ উদ্যোগে বাসা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারেন। তবে কেহ চাকুরী বা কাজ পেতে দেরী হলে বা বেকার থাকলে সে সরকারী বাসা বাড়ির জন্য আবেদন করতে পারেন। এদেশে ছেলেমেয়েরা একপর্যায়ে মা বাবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরিনত বয়সে এসে সবাই নিজ নিজ চাহিদা মত জীবন যাপন করে থাকে। বৃদ্ধ মা বাবা নিজ বাড়িতে থাকতে না চাইলে সরকারের তত্ত্বাবধানে তাদের থাকার ব্যবস্থা আছে। এসব বাড়িকে ‘ওল্ড হোম’ বা ‘রিটায়ারমেন্ট হোম’ বলে।একজন লোকের বৃদ্ধ বয়সে যাতে তার প্রয়োজনমত হাতখরচ, চিকিত্সা বা থাকা খাওয়ার কষ্ট না থাকে সে বিষয়ে সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
মানুষের জীবনের এসব মৌলিক চাহিদার সাথে আরো সংশ্লিষ্ট রয়েছে চিকিত্সা ,যাতয়াতের সুবাবস্থা ,আইন শৃঙ্খলা ,শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান ইত্যাদি। আমার জানামতে এসব বিষয়েও কানাডা বিশ্বের অনেক দেশের থেকে এগিয়ে রয়েছে। যেমন বেশির ভাগ অসুখের চিকিত্সা এখানে সবার জন্য ফ্রি। ডাক্তার ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা এবং সেবার মানও কোনো অংশে খারাপ নয়। মানুষ যাতে প্রয়োজনে সকল চিকিত্সা পেতে পারে সেটা এখানে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে নিশ্চিত করা হয়েছে।
কানাডার যাতয়াত ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। টরন্টো শহরের কথাই যদি ধরি তবে দেখা যায়,শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খুব সহজেই যাওয়া আশা করা যায়। গ্রেটার টরন্টোর যে কোনো প্রান্ত থেকে ডাউন টাউন যেতে একঘন্টার বেশি লাগে না। কানাডার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভালো। আমার প্রায় এক যুগ বসবাসের অভিজ্ঞতায় আমি এমন কোনো বড় অনিয়ম বা বড় ক্রাইম এদেশে দেখিনি। পত্রপত্রিকা বা রেডিও টেলিভিশনে এমন কোনো বড় খারাপ খবর আমি অন্তত দেখি নাই যাতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এ দেশে প্রকৃতই মনুষের বন্ধু বা সাহায্যকারী। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো বলেই মানুষ দিনে বা রাতে যখনই খুশি কাজ করে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে।
এভাবে যদি আরো বিষয় পর্যালোচনা করা যায় তাহলেও দেখা যাবে কানাডার জীবনযাত্রার মান বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অনেক ভালো।গত বছরে ইউ এন ডি পি’র Standard of Living by Country: Human Development Index এর রিপোর্টে বলা হয়েছে “ There are many jobs in Canada that attract people to the country. The jobs in Canada provide a high quality of living and the country too is a peaceful place to stay in. (Source:http://hdr.undp.org/en/composite/HDI).” এ ছাড়া “2015 Toronto World Rankings: Toronto was named the best place to live in the world by The Economist based on 6 of its indexes.” একই ভাবে আরো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ বা পর্যালোচনাতেও কানাডার জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দেয়া হয়েছে।গত ফেব্রয়ারী মাসে অন্টারিও প্রভিন্সের বাজেটে ‘বেসিক ইনকাম গারান্টি’ প্রকল্প চালু করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্প চালু হলে দরিদ্র বা স্বল্প আয়ের লোকেদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে বর্তমানে চালু ওয়েল ফেয়ার সিস্টেম সহ দরিদ্র মানুষের জন্য অন্যান্য প্রকল্পের চাইতে বেশি কার্যকর হবে বলে নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। কাজেই কানাডা এবং বিশেষ করে টরন্টো শহর যে বসবাসের জন্য বিশ্বের সেরা তাতে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নাই।
লেখাটি বেশ গোছালো এবং চমৎকার. আমরা টরন্টো-তে থাকতে পেয়ে অবশ্যই গর্বিত!!