আগের লেখায় আমি চেষ্টা করেছি সম্পর্ক তৈরী এবং তা ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা৷ আজ আমি লেখার চেষ্টা করবো একেবারে শুরুথেকে অর্থাৎ নিজ থেকে৷ আমরা অনেকেই সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পিছনে অতি দ্রুত অন্যকে দোষারোপ করার চেষ্টা করি৷ হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা সঠিক৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজের দোষ সম্পর্কে উদাস থাকি৷ আর তাই, আমি মনেকরি, কান হারিয়েছে বলে কাকের পিছনে না ঘুড়ে চলুন, নিজের দিকে তাকাই, অনেক সময় নিজের সামান্য কিছু ভুল থেকে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে৷ অথবা আমার বিবেচনায় যাকে সঠিক ভাবছি অন্যের বিবেচনায় তা সঠিক নাও হতে পারে৷ আর তাই একারনেই, আত্মবিশ্লেষণ সম্পর্ক উন্নয়নে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে আমি মনে করি৷
আত্মবিশ্লেষণ-এর শুরুতে আমাদের মনোজগৎ নিয়ে জানতেহবে৷ সম্পূর্ণ মনোজগৎ-কে তিন স্তরে ভাগ করা যেতে পারে: সচেতন, অর্ধসচেতন,ও অচেতন৷ এই মনোজগৎ-কে হিমশৈল বা Iceberg -এর সাথে তুলনা করলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে৷ হিমশৈল-এর অধিকাংশই থাকে পানির নীচে৷ প্রায় একতৃতীয় অংশ পানির উপর ভাসতে থাকে৷ ঠিক তেমনি, আমাদের মনোজগৎ-এর সামান্য অংশ থাকে সচেতন স্তরে৷ আর তাই, অর্ধসচেতন, ও অচেতন অবস্থায় আমরা যা করে থাকি তা স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা তা মনে করতে পারিনা. বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড মনোজগৎ-এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন যেগুলিকে তিনি আইডি, ইগো এবং সুপার ইগো নাম চিন্নিহিত করেছেন৷
ফ্রয়েড মনেকরেন আইডি শুরু হয় শিশুর জন্মের সময়থেকেই৷ তাঁর ভাষায় আইডি চলে Pleasure Principle এর উপর যা গঠিত হয় ভালোবাসা, সুপ্রবৃত্তি, কুপ্রবৃত্তি ইত্যাদি নিয়ে৷ আইডি চায়, দ্রুত প্রাপ্তি (Immediate gratification)৷ জন্মের পর, শিশু কেঁদে উঠে যা থামে মা শিশুকে কোলে নেওয়া এবং দুধ খাওয়ানো মধ্য দিয়ে৷ একইভাবে, আমাদের যখন কোন ভালো বা খারাপ আকাঙ্ক্ষা জাগে তা তাড়িত হয় আইডি-র মাধ্যমে৷ আরো অন্যভাবে যদি বলা যায়, একটি ছেলে বা একটি মেয়ে যখন ওপর একটি ছেলে/মেয়ে-কে পাওয়ার আকাঙ্খা জাগে, এই আকাঙ্খা তাড়িত হয় তাঁর আইডি-র দ্বারা৷ আইডি যখন কাউকে তাড়না করে তখন তা কোনো বিচার বুদ্ধি মেনে চলেনা৷ কিন্তু, সুপার ইগো, আইডি-কে নিয়ন্ত্রণ করে বিচার-বুদ্ধি দিয়ে. মানুষের সুপার ইগো তৈরী হয় তাঁর শিক্ষা/দীক্ষা, বাবা/মা ও পরিবার থেকে গড়ে উঠা বাল্যশিক্ষা, তাঁর পরিবেশ, তাঁর মতাদর্শ ইত্যাদি অনেককিছুর উপর৷ সুপার ইগো এবং ইগো-র ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় একজন মানুষ ইগো দ্বারা তাড়িত হয়ে কোনোকিছু করার আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে৷ একটি ছেলে/মেয়ে যখন আরেকটি ছেলে/মেয়ে-কে পছন্দ করে, তখন তাদের নিজ নিজ সুপার ইগো তাদের মনোজগৎ-এর ভিতর অনেক তোলপাড় শুরুহয় এবং পরবর্তীতে ইগোর মাধ্যমে তারা সিদ্ধান্তে আসে৷
এতক্ষন, ইনিয়ে বিনিয়ে এই মনোজগৎ নিয়ে এত কথা বলার চেষ্টা করছি এজন্য যে এই যে আইডি, সুপার ইগো, ইগো নিয়ে খেলা, ক্রিয়া-বিক্রিয়া অহরহ ঘটে থাকে আমাদের মনোজগতে৷আমি মনে করি, আমরা আমাদের আইডিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা৷ কিন্তু, সুপার ইগোকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ইগোকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারি৷ আমাদের কিন্তু মূল আলোচনা ছিল সম্পর্ক এবং আজকের আলোচনা ছিল আত্মবিশ্লেষণ৷ যেহেতু, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক মূলত মানুষের কাজের উপর নিভর করে চলে, আর মানুষের কাজ চলে অবচেতনভাবে তাঁর আইডি, সুপার ইগো, ইগো- সমন্বিত ক্রিয়া-বিক্রিয়া দ্বারা৷ সুতরাং, আমরা যখন আত্মবিশ্লেষণ করবো তখন এগুলি অবশ্যই মাথায় রাখবো৷ আমাদের মধ্যে একটি ব্যাপার আমি প্রায়ই লক্ষ্য করি, অমুক বলেছে আমি অমুক-কে অমুক কথা বলেছি ৷অথচ আমি জানি, আমি এটা বলিনি৷ এটা নিয়ে কথা কাটাকাটি/ এমনকি হাত হাতি পর্যায়ে৷ এমনতো হতে পারে আমি যখন কথাটি বলেছি, আমি অন্যমনস্ক ছিলাম বা অন্য কোনোকাজে এতবেশি মগ্ন ছিলাম কি বলেছি তা খেয়ালিই করিনি৷ আর তা নিয়ে ফাটাফাটি৷ আমি যদি বুদ্ধিমান হয়েথাকি, তবে আমাদের বলা উচিত, ভাই আমি কি বলেছি কি বলিনি তাতো খেয়াল নাই, যদি সত্যি বলে থাকি তাঁর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি৷ ছোট্ট একটি কথা৷ এর মাধ্যমে আপনি আপনাদের মধ্যে সুসম্পর্ক আগেরমতোই অটুট রাখতে পারবেন৷
আমাদের চারিপার্ছে এইযে সম্পর্কের এত অবনতি, মারামারি, খুনাখুনি এগুলি অনেকাংশে আমরা কমাতে পারি আমাদের শিক্ষা, নীতি, মতাদর্শ দ্বারা আমাদের সুপার ইগো-কে পরিচালিত করার মধ্যদিয়ে৷তাই, আমি মনেকরি, সম্পর্ক উন্নয়নে একেবারে প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে আত্মবিশ্লেষণ ৷ মানুষকে দোষ দেয়ার আগে আত্মসমালোচনা করুন ৷ আজকাল অনেকেই, ইয়োগা, মেডিটেশন ইত্যাদি করে থাকে ৷ এছাড়াও, প্রত্যেক ধর্মেও বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যক্রম আছে যা পালনের মাধ্যমে নিজের সুন্দর গোছানো মনোজগৎ তৈরী করা সম্ভব ৷ আসুন, আমরা সবাই আত্মবিশ্লেষণ করি৷ আমরা প্রতিনিয়ত বলে বেড়াচ্ছি অমুক কারাপ, তমুক খারাপ. কিন্তু আমি কেমন? কতটুকু সময় আমি দিয়েছি পরিবারের প্রতি, ছেলে/মেয়েদের প্রতি, বাবা/মায়ের প্রতি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু/বান্ধবের প্রতি ৷ আসুন, আমাদের মনোজগতের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশাল অচেতন স্তর থেকে মনেপ্রাণে ঝেড়ে ফেলি সকল কুপ্রবৃত্তিকে৷ সব সময় নিজিকে মানব কল্যানকর কাজে নিয়োজিত করি৷Practice makes a man perfect. প্রতিনিয়ত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সর্বক্ষণ নিয়োজিত থাকবো ভালো চিন্তায়, ভালোকাজে৷ আত্নবিশেষণ আমাদের উপহার দিক সঠিক উপলদ্ধির, যা থেকে দূরে থাকবো সকল পাপ কাজ থেকে, অন্যায় কাজ থেকে. ভাতৃত্বের বন্ধনে জাগিয়ে তুলবো একটি সুসম্পর্কময় মানবসমাজ৷