ফ্লোরিডা থেকে:-
সমাজতন্ত্রের একটি শ্লোগান ছিল : সবাই ব্রেড না পাওয়া পর্যন্ত কেউ বাটার পাবেনা।
বাস্তবে দেখা গেল সত্তুরোর্দ্ধ বছর পার হয়ে গেলেও সমস্ত জাতিকে ব্রেডে বসিয়ে মানব-ফেরেশতা গন বাটারের সমুদ্রে সাতরাচ্ছেন । ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য চাই, খাদ্যের সমস্যা সমাধান হলে মানুষের আরো কিছু চাই। সুতরাং মানব- ফেরেশতাগন যদি সত্যিকারের ফেরেশতাও হতেন এবং সবার সাথে শুকনো রুটিই ভাগ করে খেতেন তাহলেও সেই সমাজ রক্ষা হতো কিনা আমার সন্দেহ।
তুরস্কে বায়েজিদ যখন একের পর এক ইয়োরোপের রাষ্ট্র গুলো দখল করে করে ভ্যাটিকান এবং খৃষ্টান দুনিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন মধ্য এশিয়া থেকে টর্নেডোর মত এসে পথরোধ করে দাঁড়ালো খোঁড়া তৈমুর। বায়েজিদকে পরাজিত করার পর রক্তখেকো এই মানুষটির দুর্বল স্থানের কোন একটি তারে টান পড়ল , গরুকে যেমন খুঁটি টানে, মহাকাশযানকে মাধ্যাকর্ষন ,তেমনি সমরখন্দ ডেকে বসলো তাকে। তাই যার বিরুদ্ধে এত বড় যুদ্ধ তাকেই আবার ক্ষমতায় বসিয়ে ফিরে গেল সে তার মাতৃভূমিতে।
আজকের এই রৌদ্রময় দিনে যখন নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ থম্ করে থেমে আছে , তাদের ছোট ছোট দ্বীপ গুলিতে বাসা বেঁধে আছে পৃথিবীর কত ঘটনাবলী, কত ইতিহাস। যখন আমার মাতৃভূমিতে বুদ্ধি বৃত্তির মানুষ গুলোর পিছু পিছু ছুটছে মৃত্যুর পেট মোটা হা করা পাইথন, তখন আমি অনেক দূরে ব্রেডের সমস্যামুক্ত হয়ে বাটারের সন্ধানে বেড়িয়েছি ।
ব্লুবেরী ফার্মে ব্লুবেরী তুলছি আর আকাশের ওই মেঘ গুলো আমার সাথে বলছে কথা , কত কথা। সারি সারি গাছগুলো দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে , তাদের ডালপালা গুলো ভেঙে পড়ছে বেরিতে, কিছু কাঁচা , কিছু আধপাকা, কিছু পাকা ও ঘন নীল, হাত বাড়ালেই ঝরে পরে । ভালোবাসার মদির স্পর্শে যেমন এলিয়ে পরে নারী প্রেমিক পুরুষের হাতে।
পাশেই আদিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ ১০০ কোটি উজ্জ্বল গোলাপী ঘাস ফুলে হেসে উঠেছে । স্বর্গবিদ যারা, তারা স্বর্গ সম্পর্কে অনেক জানেন , তাদের এডেন গার্ডেনের বর্ননা অতি নিখুঁত । আমি মর্ত্যের বিষয়ে আগ্রহী মানুষ , নরকের আগুনের আঁচ পৃথিবীতে পাই। ভোরের আজানের যে স্বর্গীয় তন্ময়তা তা খেলো করে দিয়ে ধর্মীয় উন্মত্ততার পৈচাশিক অট্টহাসি কানে এসে লাগে । অথচ স্বর্গের রূপ রস পৃথিবীতে দেখেও বর্ননা করতে পারিনে । এমন একটি মাঠ স্বর্গে থাকবে কি ? অবশ্য না যদি থাকে তাতেই কি ? আমি কি ও মুখী হবো ? কেন হবো? মানব ধর্মে বিশ্বাসীরা কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থ কোনদিন ফলো করেনি , সব গ্রন্থই তাদের কাছে পবিত্র , জীবন গ্রন্থ পবিত্রতম। কার স্বর্গে হবে তাদের স্থান?
আমি ব্লুবেরী তুলছি আর আমার মনের কারখানায় তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন আপাত খাপছাডা চিন্তার মন্ড। ৭১ সালে আমাদের দেশের মানুষ অপরিমেয় দু:খ কষ্ট ও ত্যাগের মাধ্যমে যে ধর্মনিরপক্ষ সহনশীল সোনার বাংলা গঠন করতে চাইল সেই স্বপ্ন মরে গেল মাত্র তিনবছরের মাথায়, অথচ মানুষ কোন প্রতিবাদ করলনা, হয়ে রইল বৃক্ষমানব; দেশ প্রেমিক বুদ্ধীজীবিরা যাতে দেশকে স্বপ্নের পথে গাইড করতে না পারে তার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা থেকে হত্যা করা হল তাদের । আমরা ১৪ ই ডিসেম্বর পালন করি অথচ দৃশ্যত সেই একই পরিকল্পনার মাধ্যমে বেছে বেছে নির্মূল করা হচ্ছে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিভিন্নভাবে চরিত্র হরন করে এবং আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। জয়বাংলা ও স্বাধীনতার যারা সোল্ ইজারাদার তারা ক্ষমতায় আছেন শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে । অথচ কে বা কারা সুচারুভাবে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ।
প্রিয় একজন বলে : জনগনের স্মৃতি অতি প্রখর , জনগন কিচ্ছু ভোলে না । অথচ আমার রোমের সিসেরনের কথা মনে পরে বার বার, যে ডিকটেটর সুলা, জুলিয়াস সীজারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করে করে শেষ পর্যন্ত অগাস্টাসের গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিল । সিসেরন জনগনের মেমরি সম্পর্কে চমৎকার একটি মন্তব্য করেছিল। সে যখন সিসিলির শাসনকর্তা ছিল, সে সময় রোমে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ শুরু হয় । সে সিসিলিতে বিশাল পরিমানে খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে রোমে পাঠায়। যখন রোমে ফিরে এসে সে সিদ্ধান্ত নেয় কনস্যুলেট নির্বাচনে দাঁড়াবে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায় তারা তাকে ভোট দেবে কিনা ( যে দুর্ভিক্ষের সময় তাদের খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়েছে) । জানা গেল, তারা বহু আগেই তার নাম ভুলে গেছে। তখন সিসেরন বলে “জনগনের মেমরি খুব খারাপ , কিন্তু দৃষ্টি এবং শ্রবন শক্তি খুব প্রখর : ভালো কাজ মনে রাখেনা , মনে রাখে তাদের যারা চোখের সামনে ঘুর ঘুর করে অষ্টপ্রহর আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়ায় ।”
আজকের দিনে বাস করে আমার কেনই জানি মনে হয় সিসেরন ছিল ঠিক , ভীষন রকমের ঠিক । “ব্রেড ও বাটার” হচ্ছে মানব জীবনের সবচাইতে বড় এলেগরী , একের বাটার অন্যের ব্রেড। তৈমুর সে যত বড় রক্তখেকোই হোকনা কেন তার মনেও কোমল অনুভূতির স্থান হতে পারে । পন্টেলিয়াস পাইলেটাস যীশুর মৃত্যুদন্ড দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেও আমৃত্যু বিবেকের দংশনে তিলে তিলে ভোগে ।মানুষের মন হচ্ছে এক অন্ধকার অরন্য , বিশাল অরন্য যার কাছে আফ্রিকা বা আমাজন অরন্য কিছুই নয়। আর যারা মননে নিয়োজিত তারা কেউ আস্তিকতা নাস্তিকতার বিভাজনে বিভাজিত হতে পারেনা , তারা সন্ধানী নিষাদ , তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সমগ্র মানব জাতির।
শাহাব/ মে ১,২০১৬
অনেক ধন্যবাদ দারুন লেখার জন্য