পর্ব – ২
ডঃ হোসেনের সাথে দু ঘন্টা কিভাবে কেটেছিল।
প্রায় ২১ বছর আগের কথা। ফিনল্যান্ডের তাম্পেরে বিশবিদ্যালয় থেকে স্নাতোক্তর সেরে হেলসিংকি বিশ্বিবিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে একটি গবেষণা করছি। সাথে আমার ঘনিষ্ঠ বনধু ডঃ মুজিবও তখন তার পিএইচডি শুরু করেছে। আমরা তখন একিই ছাত্রাবাসে থাকি। মুজিব তার পার্ট টাইম কাজ সেরে বিশ্বিবিদ্যালয় হয়ে বাসায় ফিরেছে। আমার রুমে এসে বললো চলেন ভাই আজ বিকালে একজনের এর সাথে দেখা করে আসি। আমি বললাম কে। সে বললো ডঃ কামাল হোসেন। আমি আর কিছু না শুনেই বললাম নারে ভাই ঐসব রাজনিতিবিদদের ধারে কাছে আমি নাই। ও বললো, অসুবিধা নেই ভাই উনি ওই ধরণের লোক না কারণ আমি দেশের রাজনীতি সমন্ধে কিছুটা জানি এবং আপনাকে নিশ্চয়তা দিস্ছি যে আপনি হতাশ হবেন না। দেশে থাকা কালীন সময়ে দেশের রাজনীতিবিদ সমন্ধে আমার এই জাতীয় কমন ধারণা ছিল, যদিও সবাই এক না তাই আমার ধারণা হয়তো ঠিক ছিল না। উল্লেখ্য বনধু ডঃ মুজিব ছাত্রদল ডোমিনেটেড একটি আবাসিক হলে থাকতো এবং তৎকালীন বিশ্বিবিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার একজন রিপোর্টার ছিল। যাহোক তার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম এবং রাজি হয়ে ভালো কাজটি করেছিলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ বনধু মুজিবকে এই সুযোগটি করে দেওয়ার জন্য।
এবার মুজিবকে প্রশ্ন করলাম কিভাবে তার সাথে ভদ্রলোকের দেখা হলো। সে বললো সে যখন তার কাজ শেষে হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে হেটে আসছে তখন তার পাস্ দিয়ে এক দল লোক হেটে যেতে দেখলো। হটাৎ তার দৃষ্টি পড়লো হেটে যাওয়া দলের দল নেতার প্রতি এবং তাকে দেশি দেশি মনে হওয়ায় এবং ডঃ কামাল হোসেন এর সাথে মিল থাকায় সে দ্রুত হেটে তাকে প্রশ্ন করলো, “আপনি কি বাংলাদেশী, এবং আপনার নাম কি ডঃ কামাল হোসেন”. উনি তার দলের লোকদের একটু থামিয়ে মুজিবকে বললেন জি হাঁ আমিই ডঃ কামাল হোসেন এবং বাংলাদেশী।” স্বাভাবিকভাবে উনি পাল্টা প্রশ্ন করে মুজিবকে বললো সে কি করে। মুজিব বললো সে পিএইচডি করছে। উনি শুনে খুব খুশি হয়ে তার সঙ্গীদের একে একে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন ইনি আমাদের দেশের একজন যুবক গবেষক, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। উনি মুজিবকে বললেন আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো, দুই দিন আগে দেখা হলে আপনাকে নিয়ে একটু ঘোরা ফেরা বা কথা বলতে পারতাম কারণ এখানে কোনো বাঙালির কথা জানিনা। উনি তখন মুজিবকে বললেন উনি বিকালে দিকে একটু ফ্রী থাকবেন তাই মুজিব তার হোটেলে গেলে তার ভালো লাগবে। উনি বললেন পরেরদিন উনি নেদারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক আদালতে একটি সেমিনারে যোগ দিতে যাবে তাই আজ বিকালেই সুযোগ আছে কিছু সময় কাটানোর। উনি মুজিবকে ইন্টার্নকন্টিনেন্টাল হোটেলের তার রুম নম্বর বলে সঙ্গীদের নিয়ে আবার হাটা শুরু করলেন।
মুজিব বললো উনি মুজিবকে তার সমস্ত সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, তারা কেউ বা কোনো দেশের আইন মন্ত্রী, পররষ্ট্র মন্ত্রী, পরিবেশ মন্ত্রী, জাতিসংগের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা ইত্যাদি। যাহোক সেই দিন বিকালে আমরা যথারিতি চলে গেলাম হেলসিংকি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। রিসিপশনিস্ট বললো উনি আমাদের কথা বলে গেছেন তবে ১৫ মিনিট দেরি হবে কারণ উনি তখন ফিনিশ পরিবেশে মন্ত্রালয়ের একটি নৈশ ভোজে আছেন। উনি হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংগের একটি আইন ও পরিবেশ বিষয় সম্মেলনে গিয়েছিলেন।
আমরা যখন লবিতে অপেক্ষা করছি তখন হেলসিংকিতে অবস্থানরত আর একজন পিজা দোকানের মালিক আসলেন তাকে সাহায্যকারী একজন আইন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে। ওই ফিনিশ ভদ্রলোক শুধু তার আইনজীবী ছিলেন না, বরং উনি হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং গবেষক ছিলেন। ভদ্রলোক একটি বই লিখেছিলেন তাই উনি সেই বইটি সমন্ধে ডঃ কামাল হোসেনের মন্তব্য নিতে এসেছিলেন। উনি আমাদেকে ডঃ কামাল হোসেন সমন্ধে কিছু তথ্য দিলেন যেটা আমাদের জানা ছিল না। এসময়ে আমার নিজেকে লজ্জিত মনে হলো কারণ আমি প্রথমে মুজিবের আমন্ত্রণে সাড়া দিতে চায়নি এবং আমাদের দেশেরই একজন বিশিষ্ট্য লোকের কথা একজন ফিনিশের কাছ থেকে শুনতে হলো। যাহোক কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে ডঃ কামাল হোসেন এলেন।
হোটেলের কাউন্টার থেকে আস্তে আস্তে হেটে এসে আমাদের সাথে করমর্দন করলেন। আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম। উনি আমাদেরকে দেখে খুব খুশি হলেন। শুরু হলো আলাপচারিতা। যতদূর মনে পড়ে আমি আমার গবেষণা সম্বন্ধের কিছু প্রশ্ন, তৎকালীন আমাদের সরকারের শ্রম রফতানিনীতি এবং জাতীয় সংসদের ইনডেমিনিটি বিল নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু মুজিব যেহেতু একসময় পত্রিকার রিপোর্টার ছিল তাই সে বেশি বেশি প্রশ্ন করলো। আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর উনি ঠান্ডা মাথায় এবং অনেক গুরুত্ব সহকারে দিলেন। আমার একটু লজ্জাই লাগছিলো কারণ উনার তুলনায় আমরা তখন জ্ঞান গরিমা এবং বয়সে ছোট একটি চুনো পুঠি কিন্তু মনে হসছিলো উনি যেন উনার মতোই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারো সাথে আলাপ করছেন। তার এই নমনীয়তা আমাদের জন্য একটি বড়ো শিক্ষা ছিল। তার কথা শুনছিলাম আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম মানুষ কি করে এতো সাধারণ হতে পারে।
আলোচনার এক পর্যায়ে আমাদের গবেষণা নিয়ে কথা হলো। উনি বললেন বাংলাদেশে গিয়ে যদি আমাদের গবেষণার বিষয় জাতীয় কোনো তথ্যের দরকার হয় বা আইন মন্ত্রালয়ের কোনো সাহায্য দরকার হয় তাহলে যেন আমরা উনার সাথে দেখা করি, উনি উনার কলিগ বা পরিচিত জনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। এ কথা যে উনি mean করছিলেন সেটা প্রমানের জন্য উনি পকেট থেকে উনার বিজনেস কার্ড বের করে আমাদেরকে দিলেন এবং বলেন আমরা যেন দেশে গেলে উনার সাথে দেখা করি। এবার বিজনেস কার্ডটি দেখে আরো চমক খেলাম। উনার মতো একজন বিখ্যাত লোকের কার্ডটি এতো সাধারণ হয় কি করে। মনে পড়লো দেশে আমার এক আত্মীয়ের কার্ডের কথা, করতেন ছোট একটি ব্যবসা কিন্তু তার কার্ডটি দেখলে মনে হয় যেন কোনো এক বিশিষ্ট্য শিল্পপতি, ঠিক যেন কাঁচা ধানের মতো। আমি সঙ্গে করে আমার এক ফিনিশ বনধুর দেওয়া একটি ৩৫ মিঃ পুরোনো ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যামেরাটি নিয়ে আমার আর মুজিবের মোড়ামুড়ি দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন ছবি তুলবো কি না। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম এবং উনার সাথে একটি কবি তুললাম। আমরা উনাকে তার পরের দিন আমাদের আমন্ত্রণে হেলসিংকিতে থেকে যেতে বললাম কিন্তু উনার পরবর্তী ৩ দিন ইউরোপ আমেরিকা সহ আরো কিছু ট্যুরের বেস্ততায় আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করতে পেরে ক্ষমা চাইলেন এবং পরবর্তীতে আসলে, আমরা থাকলে উনি আমাদের সাথে আরো একটু বেশি সময় কাটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদেরকে বিদায় জানালেন। সেই দিন সন্ধ্যার দুটি ঘন্টা কিভাবে কেটে গেলো বুজতে পারলাম না।
একটু বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা আমাদের রেগুলার কমিউটিং ট্রেন মিস করলাম তাই একটু বেশি সময় নিয়ে বাসে যেতে হলো তবে সম্ভবত জীবনের এই ট্রেন মিস হওয়াটা এবং আমার বড়ো বোনের বিয়ের পরে তার প্রথম শশুর বাড়ি যাওয়ার লঞ্চ মিস হওয়াটা খুবই সুখের ছিল।
জানিনা পাঠকদের কেমন লাগবে তবে ডঃ কামাল হোসেনের নাম মনে আসলেই ২১ বছর পার হয়ে গেলেও স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে ওই দুটি ঘন্টার কথা এবং চেষ্টা করি জীবনে ছোট হোক বড়ো হোক সবাইকে একই চোখে দেখার। আল্লাহতালা উনাকে দীর্ঘজীবী করুন, সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং আইনের প্রতি সম্মান দিতে নিজের বিবেককে জাগ্রত করুন।
মুকুল
টরন্টো