আমরা যারা সোশ্যাল ওয়ার্ক, স্বাস্থ্য সেবা বা অন্নান্য কেয়ারিং পেশায় চাকরি করি এবং এই পেশা ছাড়া অনেকেই বিষয়টি সমন্ধে জানি বা শুনেছি। তবে সম্প্রতি এই বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। আপনারা অনেকেই জানেন Bell প্রায় মিলিয়ন ডলারের উপরে ফান্ডিং করেছে এ বিষয়টি কানাডিয়ানদের সামনে তুলে ধরার জন্য। এ ব্যাপারে কানাডিয়ান এক মাত্র এথলেট যে গ্রীষ্ম এবং শীতকালীন অলিম্পিক দুটোতেই সোনা জিতেছিলেন তিনি একটি ক্যাম্পেইন করেছেন, বেলের পৃষ্টপোষকতায়। যদিও আমরা সবাই কম বেশি শব্দটির অর্থ জানি কিন্তু আমি বিগত ১০ বছরের প্রাকটিসে দেখেছি অনেকেই জানেন না।
একটা জিনিসের মূল অর্থ বা পুরা রহস্য যত জানা যায় সেই বেপারে কাজ করা ততো সহজ হয়। আর বিশেষভাবে যারা সোশ্যাল ওয়ার্ক, স্বাস্থ্য সেবা বা অন্নান্য কেয়ারিং পেশায় চাকরি করবেন তাদের অবশ্যই শব্দটি এবং বিষয়টি সম্মন্ধে ভালো করে জানা উচিত।
স্টিগমা শব্দটির আভিধানিক বাংলা অর্থ পাংশু কিন্তু আমার মনে হয় স্টিগমা ব্যাবহার করলেই বেশি লোকে বুঝবে তাই আমি স্টিগমাটাই ব্যবহার করবো। সাধারণ অর্থে স্টিগমা বলতে আমরা যা বুঝি, তা হলো কাউকে একটি লেভেল এ ফেলে দেওয়া এবং সমাজে তাকে সিঙ্গেল আউট করা। শব্দটির উৎপত্তি গ্রিসে, তারপর ১৬ শত খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে গ্রিস থেকে ল্যাটিনে এবং পরে ইংরেজিতে আসে। গ্রীকে স্টিগমার অর্থ ছিল কোনো একটি পয়েন্টেড জিনিস দিয়ে একটি চিহ্ন তৈরী করা অর্থাৎ ব্র্যান্ডিং করা। যেমন ধরুন আপনি বাজারে বা দোকানে বিভিন্ন পণ্যের মার্ক/চিহ্ন দেখে জানবেন সেটা কি। ঠিক তেমনি ওই সময়ের গ্রিসে বাজারে অনেক সময়ে ক্রীতদাস বিক্রি হতো এবং তারা যে ক্রীতদাস সেটা বোঝার জন্য তাদের গায়েও এরকম একটি চিহ্ন দিয়ে রাখা হতো। অতএব স্টিগমা একটি মানুষকে নিকৃষ্ট/inferior হিসাবে চিহ্নিত করতো। Stigmaর বহুবচন Stigmata যখন ব্যবহার হয় তখন আবার এটা যীশু খ্রিস্টের হাত ও পায়ের আঙ্গুলের আহত নখকে বোঝায়, এবং পরবর্তীতে অনেক সময় এটা প্রার্থনাকারীদের হাত ও পায়ের আঙুলে দেখা যেত, যেমনটি ছিল St. Francis এর। তবে যখন ইংরেজিতে এটার ব্যবহার শুরু হলো তখন স্টিগমা দ্বারা এমন একটি মার্ক বা চিহ্নকে বোঝাত যেটি ঠিক চোখে দেখতে পাবেন না। তাই আজকে যেমন আমরা শুনি “stigma of homelessness, the stigma of overweight, and the stigma of mental illness” ইত্যাদি। তাই মানুষ যাতে stigmatized না হতে হয় সে জন্য অনেক সময় তাদের পরিচয়, অসুখের কথা, এথনিসিটি’র কথা, ডিসেবিলিটির কথা ইত্যাদি লুকিয়ে রাখে।
আমি ছোট বেলায় দেখেছি কোনো পরিবারে কারো মানসিক সমস্যা থাকলে, কারো মৃগী রোগ থাকলে বা কারো কোনো দৈহিক সমস্যা থাকলে সেটা মানুষকে প্রকাশ করতে চাইতো না এবং তাকে যথাযত চিকিসার বেবস্থা করতো না, এক্ষেত্রে অনেক সময় ধরে নিতো আল্লায় দিছে বা দৃষ্টের ইচ্ছা। এতে করে ওই ধরণের সমস্যায় আক্রান্ত লোকগুলি যেমন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতো তেমনি তারা সমাজের কোনো খাতে অবদান রাখতে পারতো না। যদিও মানসিক সমস্যার কোনো cure এখনো পর্যন্ত মেডিকেল সায়েন্সে উদ্ভাবন হয়নি তথাপি এই সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদেরকে Functional বা কার্যক্ষম করে সমাজে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে আমাদের আট দশ জনের মতো সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসাবে গণ্য করে তাদেরকে তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার অনেক সুযোগ সুবিধা এবং যথাযত চিকিৎসা আছে।
আমার আপনার যেমন ক্যান্সার, ডায়েবেটিস, ক্রনিক পেইন, মাথা ব্যথা, টিউমার ইত্যাদি হতে পারে, এবং সেটা হলে আমরা কিন্তু মার্ক মারা হয়ে যাই না, অথবা চাকরি বাকরি বা বিয়ে সাধির কথা আসলে বলি না যে অমুকের ভাই বা বোনের টিউমার হয়েছে অতএব তার বা তার ভাই বোনের সাথে আমার আত্মীয়র বিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু যদি শুনি কারো ভাই বোনের বা বাবা মার মানসিক সমস্যা আছে তাহলে একটি বিশেষ শব্দ ব্যবহার করে বলবো যে ওই (….) বাড়িতে সম্বন্ধ করা যাবে না। অথচ অন্যান্য রোগের মতো এটাও একটি অসুখ। আমি অনেক সময় আমার শিক্ষানবিশ ছাত্রদেরকে বলি, জীবনটাকে যদি একটি বৃত্ত ধরা হয় তাহলে কারো অন্য কোনো অসুখ হলে আমরা মনে করি সেই বৃত্তের কোনো একটি কোনার কোনো একটি জায়গায় অসুবিধা হয়েছে তবে পুরা মানুষটা শেষ হয়ে যায়নি বা সে আমাদের মতো অনেক কিছু করতে পারবে। কিন্তু যদি কারো কোনো মানসিক সমস্যা হয় তাহলে আমরা মনে করি যে বৃত্তটার পুরাটাই বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে এবং সেই মানুষটি দ্বারা কোনো কিছুই হবে না অথচ এরা যে আপনার আমার থেকে অনেক বেশি কিছু করতে পারে তার প্রমান পৃথিবীতে অনেক আছে। অন্যের কাছে যাওয়া লাগবে না আমি আমার বিগত বছরের কাজের সময় দেখেছি অনেক মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যথাযত চিকিৎসা/থেরাপি নিয়ে আপনার আমার থেকে অনেক ভালো কাজ করছে।
যেমন অনেকের মধ্যে আমার দুটি খুবই সাকসেসফুল কেশের কথা বলি, একজনের এতই ডিপ্রেশন ছিল যে সে ৮ বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে কিন্তু আল্লার রহমতে ৩/৪ বছর চিকিৎসা এবং থেরাপির পরে সে কাজ শুরু করেছে এবং তার বৌকে নিয়ে বাড়ি কিনে ভালোভাবে সংসার করছে, হা তাকে তার symptom কন্ট্রোলের জন্য আজীবন ওষুধ খেতে হবে কিন্তু সে এখন সমাজের একজন কর প্রদানকারী সক্রিয় বেক্তি। আর একজন ছিল খুবই মারাত্মক স্কিজোফেরনিয়ার রোগী, মাদক আসক্ত এবং তার নাম মারাত্মক কেস ছিল কিন্তু প্রায় ৪/৫ বছর চিকিৎসা এবং থেরাপির পরে সে এখন Bombardier এর কন্ট্রাক্ট এ গো ট্রেনে মেকানিকাল ডিপার্টমেন্টে কাজ করছে এবং ৮০/৯০ হাজার ডলারের মতো আয় করছে অথচ সে ছিল ODSP তে এবং ফুড ব্যাঙ্ক থেকে খাবার এনে খেত। আসলে খোদা তালা প্রতিটি মানুষকে কিছু না কিছু পোটেনশিয়াল দিয়ে পাঠিয়েছেন কিন্তু সেটি বিকাশের জন্য সবার উপযুক্ত পরিবেশ বা সুযোগ থাকে না তাই আমাদের উচিত এই ধরণের লোকদের সেই পরিবেশ বা সুযোগটা দেওয়া, তাতে করে তার নিজের যেমন উপকার হয় তেমনি আমাদের তথা সমাজের কাজে আসে।
অনেক ক্ষেত্রে আমরা ইম্মিগ্রান্টরাও আমাদের ধর্ম/বর্ণ/প্রথা/সংস্কৃতি ইত্যাদির কারণেও stigmatized হয়ে থাকি তাই আমাদের নিজেদেরকেও যেমন সচেতন থাকতে হবে আমাদের দ্বারা কেউ যেন stigmatized না হয়, তেমনি আমরা নিজেরাও যাতে অন্যের দ্বারা স্টিগমাটাইজেড না হই সে ব্যাপারে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোচ্চারও হতে হবে। এবং এটি আমার আপনার ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। মনে আছে নিশ্চয় আপনাদের, যখন ঈশ্চরচন্দ্র বিধবা বিবাহের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছিলেন তখন প্রথমে তিনি তার ভাইকে একজন বিধবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। তেমনি আমাদের নবী হজরত মোঃ (সঃ) যখন তার কাছে এক ব্যক্তি তার ছেলেকে নিয়ে বলেছিলেন হুজুর ও শুধু বেশি মিষ্টি খায় তখন নবীজি তাকে কয়দিন পরে আসতে বলেছিলেন, তার কারণ হসছে নবীজির নাকি নিজেরই মিষ্টি খাওর অভ্যাস ছিল তাই তিনি প্রথমে নিজে মিষ্টি খাওয়া কমিয়ে ওই লোককে তার ছেলেকে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। মোরাল হসছে কাউকে কিছু করতে বলতে নিষেধ করলে আগে নিজে সেটা করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তার পর শুরু করতে হবে আসে পাশের থেকে। তাহলে আসুন আজ থেকে আমি আপনি আমাকে বা আপনাকে যেই সমান দেই বা দিয়ে কথা বলি সেই সম্মানটা যেন একটি হোমলেসকে দেই বা একজন গে-লেসবিয়ান, aborginal বা মাদকাসক্তকে দেই। মনে রাখতে হবে কোনো মানসিক সমস্যা বা এই ধরণের কোনো অবস্থা খুব কম লোকেরই ইচ্ছার অধীন, তাহলে যে মানুষটি তার অবস্থার জন্য নিজে দায়ী নয় তাকে শুধু শুধু কেন stigmatazied করবো, তাহলে Trump ভাইজানকে আর বকাবকি করে কি হবে। আর সামান্য কিছু লোকের কোনো কর্মকান্ডের জন্যও শুধু মাত্র annecdotal evidence এর উপর ভিত্তি করে পুরা একটি গ্রূপ বা গোষ্ঠীকে দোষী করাও ঠিক না।
কিছু কিছু বেতিক্রমের উপর ভিত্তি করে একটি গ্রূপকে বা গোষ্ঠীকে ধিক্কার দিয়ে বসে বসে বড়ো বড়ো বুলি আওড়ালে চলবে না, বরং এগিয়ে আসতে হবে আস্তে আস্তে কিভাবে ওই বেতিক্রমগুলিকে ভালোর দিকে আনা যায়। এক কথায়,
We must align actions with words.
ধন্যবাদ
মুকুল, টরোন্টো
৬ মার্চ, ২০১৭