বেশ আগে উপরোক্ত উক্তিটি কোথাও দেখেছিলাম, তবে মনে নেই কোথায়। ছোট একটি বাক্য কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্যই কিছু মানুষের জীবন যেভাবে প্ল্যান করেছিলেন সেভাবে চলেছে, কিন্তু অনেক অনেক মানুষ আছেন যাদের জীবন যেভাবে ভাবা হয়েছিলো বা যে ভাবে প্ল্যান করা হয়েছিল সেভাবে হয়নি বা চলেনি। আর স্বাভাবিক ভাবেই কোনো কারণে প্ল্যান মাফিক না হলে শুরু হয় আমাদের অনন্ত জ্বালা।
যেমন ধরুন যাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন তাকে পাননি, আবার যার ভালোবাসা পেলেন তাকে বিয়ে করা হলো না। আবার তাকে বিয়ে করা হলো ঠিকই কিন্তু সংসার বেশি দিন করা হলো না। চেয়েছিলেন ঘরভর্তি পোলাপান, হলো মাত্র একটি অথবা হলোই না। জীবনে যে পেশাটি/চাকরিটি নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন সেটি হলো না। যেখানে যেই জায়গায় বাস করতে চেয়েছিলেন সেখানে থাকা হলো না। নিজেকে যেমন দেখতে চেয়েছিলেন তেমনটি হলো না, হয় মোটা নয় চিকন, হয় অকালে টাক নয় গা ভর্তি অনাকাঙ্খিত লোম। চেয়েছিলেন মার্সিডিস হয়ে গেলো বাই সাইকেল, ইত্যাদি অনেক অনেক উদাহরণ আছে আমাদের মধ্যে। তো, এই রকম যখন আমাদের ক্ষেত্রে ঘটে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরাটা কপালের উপর দোষ দিয়ে কেউ কেউ কপাল চাপড়াতে থাকি, আবার কেউ frsutrated বা depressed হই অথবা কেউ unplanned জীবনটাকে কোনো রকমে টেনে নিয়ে যাই শেষ পর্যন্ত।
তবে কেউকেউ জীবন প্ল্যানমাফিক না হলেও, যেভাবে হয়েছে সেটিকে মেনে নিয়ে তার থেকেই নির্যাস নিয়ে শুরু করেন নতুন পথ চলা। তেমনই হয়তো কোনো এক জনের উপরের ওই উক্তিটি ছিল। যাহোক আমার জীবনের ২৪/২৫টি দেশের বিভিন্ন মানুষেকে জেনে, কিছু পড়াশুনা এবং বিশেষ করে আমার দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সমাজের দুস্থ ও সহায় সম্বলহীন মানুষদের সাথে কাজ করতে গিয়ে ওই জাতীয় অনেক অনেক মানুষের সন্ধান পেয়েছি যারা জীবনের স্বপ্ন, চাওয়া পাওয়া বা পরিকল্পনা সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও অবশিষ্ট ক্ষুদ্র অংশের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন নতুন জীবন এবং আমাদের অনেকের থেকে তারা বেশ সুখী। এদের ভিতরে খুব একটি গুরুত্বপূর্ণ মনোভাব লক্ষ করেছি, যেটা হলো এরা প্রথমে নিজেকেই সন্তুষ্ট করতে চান, আসে পাসের কাউকে নয়। থাকেন সোশ্যাল এসিস্টেন্সে অথবা কোনো ফ্যাক্টরিতে বা রিটেল স্টোরে নূন্যতম বেতনে চাকরি করেন, আছে শারীরিক বা মানসিক চ্যালেঞ্জ তারপরেও তাদের ঘরে ঢুকলে কেমন যেন একটি সুন্দরের আভাস মিলে। অনেকে আবার তাদের ছেলেমেয়েকেও মানুষ করছেন সুন্দরভাবে।
যাহোক, It’s ok it did not go as I planned! কথাটি হতে পারে এই সকল কিছুর মূলমন্ত্র। Success বা সাফল্য অন্যকে তুলনা করে দেখলে হবে না। এর জন্য পারলে নিজের সাথে নিজেকেই তুলনা করুন, চেষ্টা করুন আপনার আজকের দিনটা থেকে কালকের দিনটা কিভাবে একটু ভালো করতে পারেন। আর successful হতে হলে সব সময় বড়ো কিছু হতে হবে অথবা অমুক বা তমুকের মতো হতে হবে এমন চিন্তা বাদ দিন। যেমন ধরুন আমি এখানে পড়াশুনা করার সময় একটি বড়ো স্টেক হাউজে (খাবার হোটেল) চাকরি করতাম। ওখানে শ্রীলংকান এক ভদ্রলোক ডিশ-ওয়াসার হিসাবে কাজ করতেন। এখানে এসেছিলেন অন্য কোনো আশা, স্বপ্ন বা প্ল্যান নিয়ে কিন্তু সেগুলি হয়নি। তবে তিনি ওই রেস্টুরেন্টের মধ্যে আমার দেখা ২/১টি অতীব সুখী মানুষের মধ্যে একটি। উনার বয়োস অনেক ছিল। বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে থাকেন ছেলেমেয়েগুলোর কেউ উকিল, কেউ ব্যাংকার। এমন অনেকেই আছেন যারা নিভৃতে একাকী টুকটুক করে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জীবন, আমার কাছে এরা কম successfull নয়।
আবার আমার এক কলিগ আছেন যে কি না আলবেনিয়ার এক এতিম, কোথা থেকে গড়াতে গড়াতে এসে পড়েছিলেন কানাডায়, একটি শিশুর স্বাভাবিক জীবন যেভাবে হওয়ার কথা ছিলো সেভাবে হয়নি, কিন্তু এখন তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে মোটামুটি একটি চাকরি নিয়ে ভালোই আছেন, উনি কি একজন successfull মানুষ না। ঠিক তেমনি আমাদের বর্তমান CEO আফ্রিকার একজন মুসলমান এদেশে এসে আমাদের মতো বিভিন্ন কাজ করেছেন, শুরু করেছিলেন একবারে ফ্রন্টলাইন-ওয়ার্কার হিসাবে, উনিও একজন successfull লোক। এমনি অনেক উদাহরণ আছে এবং নিজের successকে নিজের মতো করে দেখতে হবে, সব সময় অন্যের সাথে তুলনা করলে চলবে না।
আর আমাদেরকেও মনে রাখতে হবে আমাদের চোখে একটি লোক খুব ভালো চাকরি করছে না, খুব ভালো নেই বা খুব successfull মনে হলেও সে যে আসলে successfull না কি সেটি সে নিজেই জানবেন ভালো করে।
একবার এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। আফ্রিকান কোনো এক দেশের একজন বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন কিন্তু এখানে পেশা দাঁড়িয়েছিল ট্যাক্স চালক, তার সাথে কথা বলে এতো ভালো লাগলো যে আমরা এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর পরেও রাস্তার পাশে ১৫ মিনিট অতিরিক্ত বসে বসে কথা বলেছিলাম। বেশ সুখী বেক্তি, স্বল্প সময়ে উনি জীবন কত সুন্দর হতে পারে সেই জিনিষগুলি খুব সুন্দর করে উনার নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ১০/১২ বছর আগে কোনো এক ভাবির বাসায় এক দেশি ভদ্রমহিলার কথা শুনেছিলাম, উনি তার পতিদ্বারা অনেক abuse হয়েছিলেন। উনারা পরে আলাদা হয়ে যান। ১০ বছর উনার আর কোনো খবর জানিনা, কিন্তু হটাৎ একদিন দেখলাম এখানে কোনো এক সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। এর পর খোঁজ নিয়ে জানলাম, উনি আলাদা হওয়ার পরে শেল্টারে যান, তারপর ইংরেজি শিখেন, ইস্কুলে যান এবং চাকরি পান। তারপর আবার বিয়ে; স্বামী ছেলেমেয়ে এবং মাকে নিয়ে খুব ভালো আছেন অথচ উনার ১০/১২ বছর আগের ওই সময়ের কথা ভাবলে ডিপ্রেশন আর আশাহত ছাড়া কিছুই মনে হবে না। এই বেক্তিগুলি হয়তোবা নিজের অজান্তেই It’s ok it did not go as I planned! উক্তিটি মনে ধারণ করে এগিয়েছিলেন।
যাহোক চেষ্টা করুন It’s ok it did not go as I planned! কে মনে ধারণ করতে এবং জীবন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে শুরু করেন সেখান থেকেই। শীতকালে এখানে বরফের মধ্যে গাড়ি চালানোর সময় দেখেন যে আমরা গাড়ি স্টাক হয়ে গেলে ঠিক যেভাবে চালাচ্ছিলাম সেভাবে না গিয়ে একটু ডাইনে বাঁয়ে অথবা কিছুটা পিছিয়ে এসে আবার সামনে জোয়ার চেষ্টা করি, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা একেবারে detour করে ফেলি। ঠিক তেমনি জীবনের ক্ষেত্রেও আপনি প্ল্যান মাফিক না হলে সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে বা সেই একই প্লানকে বার বার প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সময় নষ্ট করবেন না। নায়াগ্রা ফলস শুধু মাত্র QEW দিয়ে যাওয়া দিয়ে যেতে হবে এমন কথা নেই, ওই পথে গেলে হয়তোবা কনভেনিয়েন্ট হবে, কিন্তু সেই পথ যদি নষ্ট থাকে বা পথে সমস্যা থাকে তাহলে কি সেই পথে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করবো নাকি যাওয়া বন্ধ করে দিবো, নাকি detour করে আমার গন্তব্যে পৌছাবো। প্ল্যানমাফিক না যেতে পারলে পথচলাটা হয়তো বেশ কঠিন হতে পারে কিন্তু যখন আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছাবেন তখন আপনার ভালোলাগা সময়গুলি আপনার ওই কঠিন সময়ের থেকে অনেক বেশি ভালো লাগবে।
সবাই ভালো থাকেন।
ধন্যবাদ।
মুকুল