একটি বছর যোগ হলো না বিয়োগ হলো এবং কি হলো বা কি হলো না !
অনেকেই যখন আমার এই লেখা পড়বেন তখন অলরেডি নূতন বছর শুরু হয়ে গেছে। যাইহোক, নতুন বছরের সুভেসছা সবাইকে। এখন একটি বছর যোগ হলো না বিয়োগ হলো; এই প্রশ্নের উত্তর গ্লাস হাফ ফুল অথবা হাফ এম্পটির মতো। ক্রোনোলজিক্যাললি ভাবলে দেখা যাবে জীবনে আরও একটি বছর যুক্ত হলো, কিন্তু যদি আমরা ভেবে দেখি আমাদের সবাইকে মরতে হবে এবং আমাদের প্রত্যেকের সময় এই জগতে সীমিত তাহলে কিন্তু একটি বছর বিয়োগ হলো। এবং এটি বয়োসের ক্ষেত্রে হলে বয়স আপনার কমে গেলো বৈকি, যদিও আপনি শিশু হয়ে জাস্ছেন না।
আর কি হলো বা কি হলো না এক ধরণের জীবনের হালখাতার মতো। আসুন আমরা দেখি সে হালখাতার হিসাব।
আপনার আসে পাশে, পৃথিবীর এখানে সেখানে কি হলো কি বা হলো না সে খবর আপনারা অলরেডি পেয়ে গেছেন এবং পেয়ে যাবেন। আমি কিছু কথা শেয়ার করবো আমার বেক্তিগত হিসাব নিয়ে। বিগত বছরটি ভালো খারাপ সব মিলিয়েই পার হয়েছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় বিগত বছরটি আমার এবং আমাদের পরিবারের জন্য ছিল অত্তান্ত ট্রাজিক। বছরের শুরুর দিকে আমার ছোট বোনের হাসব্যান্ড গাড়ি একসিডেন্টে প্রথমে আহত হয় তারপর সেরে ওঠার পরে প্রায় ২/৩ সপ্তাহ বাদে হার্ট ফেইল করে মৃত্যুবরণ করে। তার বয়স ছিল ৪০ বছরের মতো। বয়স যেমন তার খুব বেশি ছিল না, তেমনি খুব কমও ছিল না, কিন্তু অত্তান্ত অসহনীয় বা অকল্পনীয় বিষয় যেটা ছিল সেটা হলো তার ছেলেটির খুবই কম বয়সে অর্থ্যাৎ মাত্র ৯ বছর বয়সে তার প্রানপ্রিয় বাবাকে হারানো। আপনি যদি তার বাবার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সময় এবং তার থেকে এই ছোট ছেলের সাথে তার কাটানো সময় বিচার করেন তাহলে খুব বেশি না। সপ্তাহে একদিন এবং অন্যদিন বিকালে হয়তো ২/৩ ঘন্টা। আমাদের যাদের এই অবস্থা হয়নি তারা হয়তো এই অভাব ১০০% কখনো বুজতে পারবোনা। এই সময়টি যখন আর থাকে না তখন বোঝা যায় কত ছোট ছোট ঘটনা বা স্মৃতি; যেগুলিকে এখন অনেক তুসচ্ছ মনে হস্ছে সেগুলি কত মূল্যবান।
আজেকের আমার ছোট লেখাটি সেই ছোট বাচ্চাদেরকে উৎসর্গ করে যারা আমার ভাগ্নে সাম্যর মতো ছোটকালে বাবা/মাকে হারিয়েছেন এবং যাদের বাবা মা এখনো বেঁচে আছে তাদের জন্য। যুগের এবং সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে পারিবারিক অবস্থার যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি আধুনিক ম্যাটেরিয়ালিস্টিক এবং যান্ত্রিক জীবনের কারণে আমাদের সাথে আমাদের ছেলেমেয়েদের আত্মার বা আন্তরিক যোগাযোগের দূরত্ব বেড়ে চলেছে। আমাদের মাথায় দুঃখজনকভাবে এই চিন্তা আসে না যে আমাদের নিজেদের জীবন যেমন অস্থায়ী তেমনি আমাদের সাথে আমাদের বাচ্চাদের ধার্য করা সময় অতি অল্প। এই একই দেশে থাকি, তারপরেও কিছুদিন যোগাযোগ না হলে কোনো বন্ধু বান্ধবকে তাদের বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন সেতো বাসায় থাকে না ভাই, গত বছর ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে, এবং এর পর আফছোছ করতে থাকে তাদের বাচ্চাদের সাথে কাটানো সময়ের স্বল্পতার কথা বলে। এই আক্ষেপ কমবেশি সবারই থাকে তবে অনেকেরই ক্ষেত্রে এই আক্ষেপ খুব বেশি এবং দুঃখজনক। এই সময়টাকে বাড়ানোর কোনো পদ্ধতি নেই যদিও আমরা বলি কেন আমার বাচ্চা দ্রুত বড়ো হয়ে গেলো। একথা বললেও আসলে কি আমরা চাই আমাদের বাচ্চা তাদের জীবনের বিভিন্ন স্টেজ গুলি পার না করে শুধু ছোট হয়ে থাকুক, আমি নিশ্চিত এরকম হলে জীবন হয়ে যাবে মানডেন অথবা মনোটোনাস। তবে এই আক্ষেপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কি করতে পারি ! সে বেবস্থা অনেকেই জানেন, তবে আমি আমার কিছু মতামত এখানে বেক্ত করছি।
সময় যত অল্পই হোক সেটাকে স্মৃতিময় এবং মধুর করে তোলা যায় যদি কি না বাচ্চাদের সাথে যতটুকু সময় কাটানো যায় সেটা ডিসেন্ট ভাবে কাটাতে পারি। আপনার বাচ্চার সাথে আপনার কাটানো মাত্র ২০ মিনিটের ডিসেন্ট সময় ২০ ঘন্টা জাস্ট সময় কাটানোর থেকে খুবই মূল্যবান এবং তাপপর্যপূর্ণ। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান যুগের গ্যাজেট, যেমন রেডিও, টেলিভিশন, ফোন ট্যাবলেট ইত্যাদির কাছে আমাদের ডিসেন্ট সময়ের দায়িত্ব দিয়ে দেই। আবার যত টকু সময় দেই সেটা শুধু মাত্র সময় দেওয়াই, ডিসেন্ট সময় নয়। আমি শুধু নিশ্চিত নয়, বেপারটি পরীক্ষিতও যে ডিসেন্ট সময়ের কথা অনেকে ভাবেন না কারণ তারা ভাবেন সময় তো দিচছি অথবা ডিসেন্ট সময় কাকে বলে সেটা জানেন না। আমি ডিসেন্ট সময় বলতে সেই সময়কে বোঝাসচি, যখন আপনি আপনার বাচ্চার সাথে খেলা করছেন বা সময় কাটাচ্ছেন তখন আপনি তার সাথে এতটাই সম্পৃক্ত যে সে মনে করছে তার বাবা/মা হয়তো কোথায় গেছে, এবং সে তার খুব প্রিয় কোনো একজনের সাথে সময় কাটাচ্ছে। আমি একটি ছোট এবং গল্প বলে শেষ করছি।
প্রায় ৭/৮ বছর আগে আমরা কয়েকটা পরিবার মিলে সামারে কোনো এক পার্কে বেড়াতে গেছি। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বিকালের দিকে সবাই ছোলা-মুড়ি খাচ্ছি, আড্ডা মারছি আর ছোটরা খেলাধুলা করছে। ওদের মধ্যে এক বন্ধুর বাচ্চা অন্যদের তুলনায় বয়োসে একটু ছোট ছিল। এক পর্যায়ে আমি একটু ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে কালিদাসের মেঘদূতের একটি অংশ পড়ছিলাম। অন্যরা তখন পাশেই গল্প করছিলো। হটাৎ ওই বাচ্চাটি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো তুমি কি করছো, আমি বললাম বই পড়ছি, সে বললো কি বই। তাকে তো তখন আর আমি কালিদাস আর শকুন্তলা বেক্ষা করতে পারি না তাই, বলতে গেলে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাকে মেগদুত মানে কি সেটা বললাম। সে তখন আমাকে বললো মেঘদূত কি তাহলে বাবাকে ডেকে দিবে। আমি বললাম বাবাতো এখানে, গল্প করছে তাকে তো তুমি এমনিতেই ডাকতে পারো। সে বললো ডেকেছি কিন্তু সে আমাকে ওই বাচ্চাদের সাথে খেলতে বলেছে।
আমি ওর বাবাকে ডাকলাম এবং ওদের ২ জনসহ আমরা কিছুক্ষন সম্ভবত একটি পাজেল নিয়ে খেললাম। এর পর সে চলে গেলো পাশের ওয়াটার স্প্লাসে খেলতে। ওখানেও আমরা কিছুক্ষন ওর সাথে ভিজলাম। তারপর সে চেঞ্জ করে নিজে নিজেই আবার খেলতে শুরু করলো। এর পর আমরা ফিরে আসার সময় কিছুটা পথ সে আমাদের গাড়িতে আসলো। ওই দিনের পর থেকে সেই বাচ্চাটি কেন যেন আমার ভক্ত হয়ে গেলো। অথচ আমি জাস্ট তার কিছু কথা শুনেছিলাম এবং আমিও কিছু বলেছিলাম যাতে করে ও চলে যায় এঁবং আমি পড়াতে ফিরে যেতে পারি কিন্তু এটা যে এতো থেরাপিউটিক কাজ করবে তা বুঝতে পারিনি। আমি যদিও তাকে শান্ত করার জন্য তার কথা শুনেছিলাম, শুধুমাত্র পার্থক্য এই যে তার কথাগুলি যত হাবিজাবি বা সাধারণ হোক না কেন আমি একটু carefully শুনেছিলাম এবং যে অল্পটুকটু সময় তার সাথে কাটিয়েছিলাম সেটি ঠিক তার মতো করেই কাটিয়েছিলাম। আমার প্রফেশনাল কাজে active listening এর গুরুত্বপূর্ণ আছে এবং সেটা আমরা প্রাক্টিসও করি কিন্তু সেই দিন থেকে শিখলাম বাচ্চাদের সাথে ডিসেন্ট সময় দেওয়া কাকে বলে।
সেই বাচ্চাটি এখন বেশ বড়ো। তার বাবা তাকে সম্প্রতি জিজ্ঞেস করেছিল এই ছুটিতে তারা যদি একটি দিন অন্য কারো বাসায় কাটায় সেটা কেমন হয় এবং কোন বাসা তাদের প্রথম পছন্দ, সে বলেছিলো আমাদের বাসা। গল্পটি শুনে মনে হতে পারে এ আবার তেমন কি, কিন্তু এইটুকুই অনেক অনেক পরিবার এখানে করতে পারছেন না। কাজ, বেস্ততা, বাস্তবতা অনেক কিছুরিই ওজর আছে কিন্তু যত ওজোর থাকুক না কেন আমি বলতে পারি ওই ডিসেন্ট সময় টুকু আপনি অবশ্যই বের করতে পারেন। আমার যদি সময় থাকতো তাহলে আমি যারা এই ডিসেন্ট সময়টুকু বিভিন্ন ওজরে বের করতে পারেন না এবং নির্ভর করেন আধুনিক গেজেটের উপর তাদেরকে হাতে ধরে দেখিয়ে দিতাম জীবন যত ব্যস্তই হোক না কেন বাচ্চাদের জন্য কিছুটা ডিসেন্ট সময় অবশ্যই বের করা যায়।
একটি দিন যেভাবে যায় ১০ বছরও সেভাবে যায়। অর্থাৎ একদিনে ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা যেভাবে ঘোরে দশ বছরেও ঠিক সেভাবেই ঘোরে, তবে আপনার বাচ্চার একদিনের বয়সের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো নয়। যদি আপনি আপনার বাচ্চাকে একদিন পরে দেখেন তাহলে মনে হবে কোনো সময়ই কাটেনি কারণ কোনো সিগনিফিকেন্ট পরিবর্তন হয়নি কিন্তু তার সাথে ডিসেন্ট সময় কাটানোর ধার্য করার সময়ের একদিন কিন্তু ঠিকিই চলে গেলে। আসুন তাহলে নতুন বছরে আমরা যারা বাবা-মা তারা শুরু করি আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে সেই সুন্দর মুহূর্তটুকু কাটানোর। আর এটিই যেন হয় আমাদের নতুন বছরের রেসুলেশন। আমার লেখাটি পড়ে আপনার এটকুটকুও যদি ভালো লেগে থেকে তাহলে কাছে ডাকুন আপনার বাচ্চাকে, তাকে জড়িয়ে ধরুন এবং তাকে জানান সে আপনার জীবনের জন্য কতখানি মূল্যবান। আমার এই লেখায় লাইক দেওয়া বা কমেন্ট করার থেকে সেই সময়টুকু আপনার বাচ্চাকে দিন এবং হা, কমেন্ট তখনি করুন যদি সেই ডিসেন্ট সময়টুকু দেওয়ার জন্য আপনার বাচ্চার চোখে মুখে যদি কোনো অভিব্যক্তি দেখেন।
অবশেষে আপনাদের কাছে দোআ চাসছি যে আল্লাহতালা যেন অন্তত আমাকে ততদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখেন যতদিন পর্যন্ত আমার ভাগ্নেটি অ্যাডাল্ট না হয় অর্থাৎ নিজের টা নিজে বোঝা শিখে। আর আমিও আপনাদের জন্য দোআ করি যাতে আল্লাহতালা যেন আপনাদেরকেও ততদিন বাঁচিয়ে রাখেন যতদিন তারা স্বাবলম্বী না হয়। আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে আগামী ২০১৮ এর শেষেরদিনে আবারো হাজির হবো আপনাদের সামনে আপনাদের বাচ্চাদের সাথে কাটানোর কিছু ডিসেন্ট এবং মধুর মুহূর্তের বর্ণনা নিয়ে। আপাতত এটাই আমার নতুন বছরের রেসুলেশন।
ধৈর্য ধরে বিষয়টি পড়ার জন্য আপনাদেরকে ধণ্যবাদ।
বি. মুকুল
টরন্টো
৩১ সে ডিসেম্বর ২০১৭