টুটুল ট্যাক্সিতে উঠেই ত্রপাকে টেক্সট করলো, ‘ত্রপা, সরি, তোমাকে বলে আসতে পারিনি, আমি টুসি আর তৃনাকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। টুসির ডায়াপার চেঞ্জ করা দরকার ছিল, মেয়েটা বিরক্ত করছিল। তৃনাও দেখলাম চুপচাপ বসে আছে, ওদের নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি। ঘন্টাখানিকের মধ্যেই ডিনারের আগেই ওদের নিয়ে ফিরে আসবো।’
টুটুলের টেক্সট পাওয়া মাত্র বিবাহবার্ষিকী উৎসবের আনন্দঘন আসর থেকে ত্রপা ফোন করলো, ‘এই, ঠিকঠাক বলতো, আসল ঘটনা কী? তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। মেয়ের ডায়াপার চেঞ্জ করার জন্যে বাচ্চাদের নিয়ে দাওয়াতের অনুষ্ঠান থেকে বাসায় যাবে তুমি তো সেই বান্দা না। বলতো, আসল কাহিনী কী?’
টুটুল কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। সে ত্রপাকে মিথ্যা কথা সরাসরি বলতে পারে না। কয়েক বছর আগে ত্রপার নিষেধ সত্ত্বেও টুটুল সেদিন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট খেয়েছিল। টুটুল কিছুতেই খাবে না। রঞ্জু বললো, ‘এই শালা আমরা তো আর গাঁজা খাচ্ছি না, খাচ্ছি সামান্য সিগারেট। আজকাল ছেলেপেলে তো কত কিছুই খাচ্ছে। শালা বিয়ে করেছিস বলে বউ যা বলে তাই শুনতে হবে, শালা মুরগী, বউয়ের আচলের তলে বসে ডিম পাড়।’
পুরষত্তে ও স্বামীত্বে আঘাত লাগায় টুটুল পর পর দুইটি বাংলা ফাইভ সিগারেট খেলো এবং বাড়ি ফেরার আগে ত্রপার ভয়ে সিগারেটের গন্ধ কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে ভয়ানক চিন্তায় পড়লো। মুখ থেকে ও হাত থেকে সিগারেটের গন্ধ দূর করার জন্য একটা আস্ত কমলালেবু খেয়ে কমলালেবুর খোসা দিয়ে দুই হাতের তালু, আংগুলসমুহ ভালোভাবে ঘসাঘসি করে টুটুল বাসায় ঢুকলো। তাতেও কাজ হলো না। বাসায় পা দিতেই ত্রপা বললো, ‘তুমি আবার সিগারেট খেয়েছো? মুখ থেকে ভক ভক করে গন্ধ বের হচ্ছে, তোমাকে এত মানা করার পরেও সিগারেট খেলে? বউয়ের টাকায় সিগারেট খাও লজ্জা লাগে না? টুটুল একেবারে ভেংগে না পরে ক্ষীণ আশা নিয়ে শেষ চেষ্টা করলো। ‘বিশ্বাসঃ কর, আমি সিগারেট খায়নি, তপু, মানিক পাশে বসে খাচ্ছিলো বলে হয়তো আমার গা থেকে গন্ধ পাচ্ছ, আমাকে এত করে ওরা বললো, আমি তাও সিগারেট খাইনি।’ বুদ্ধিমতী ত্রপা সাপের মতো চাহুনি দিয়ে শান্ত গলায় বললো, ‘আমার মানা না শুনে সিগারেট খেয়ে তুমি একটি অন্যায় করেছো, এখন আবার গড়গড় করে মিথ্যা কথা বলে আরেক অন্যায় করছো। তোমাকে আমি বইয়ের পাতার মতো পড়তে পারি।’
টুটুলের মনে হলো সেদিনের মতো আজকেও ধরা পরে যাবে না তো ! আজ ত্রপার প্রশ্ন করার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সে রেগে আছে। এই অবস্থায় যদি সে সত্যবাদীর মতো বলে দেয় ডালের চুলা অফ করেছে কি না সে নিশ্চিত হতে পাচ্ছে না তাই চেক করার জন্য বাসায় যাচ্ছে সেটা বললে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা। আসলে সরাসরি ফোনের চেয়ে টেক্সট করার প্রচুর পজিটিভ দিক আছে। কথার পিঠে ভেবে চিন্তে টেক্সট লেখা যায়। তাই সে টেক্সট -এর আশ্রয় নিয়েছিল। টুটুলের ধারণা ছিল উৎসব মুখর বাড়িতে ত্রপা অনেক আনন্দের সাথে সময় কাটাচ্ছে। টেক্সট পাওয়া মাত্র রিপ্লাই দিয়ে লিখবে, ‘বাসায় যাচ্ছো যাও আসার সময় দরজা ভাল করে চেক করবে ঠিকভাবে বন্ধ করেছো কি না।’
ত্রপা যে তার হঠাৎ করে বাসায় যাওয়ার বিষয়টি অবিশ্বাসের চোখে দেখতে পারে, টুটুল এটিও চিন্তা করেছিল। তাই সে, ব্যাকাপ প্লান অনুযায়ী বললো, ‘আরে না, কি যে তুমি বল, তোমাকে মিথ্যা কথা বলার আমার সাহস আছে? আসলে, বাচ্চাদের সয়েল্ড ডায়াপার বেশিক্ষণ রাখলে রাস হয়। আর তাছাড়া, কাল ভোরে উঠে তুমি কাজে যাবে, তোমার লাঞ্চ রেডি করা নাই, সকালে উঠে তাড়াহুড়ো লেগে যায়, তাই ভাবলাম, রাইস কুকারে পোলায়ের চালের সাথে কিছু মটরশুঁটি তুলে দিয়ে আসি, পরে রাতে বাসায় এসে কয়েকটি ক্যাপসিকাম আর ব্রকোলির ফালির সাথে ডিম্ ফেটে নিয়ে ফ্রয়েড রাইস করা যাবে। ওখানে এখন তো ম্যাজিক সো হচ্ছে, ওসব ফালতু ম্যাজিক-ফ্যাজিক আমার ঠিক ভালো লাগে না।’
স্বামীর জবাব পেয়ে ত্রপা আশ্বস্ত হলো। মানুষটা মন্দ না, চারিদিকে ঘরে ঘরে বেপরোয়া স্বামীদের নিয়ে সারা দেশের রমণীরা কত বিপদে দিন কাটাচ্ছে, বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের সংসার ভেঙে যাচ্ছে, সে তুলনায় সে কত সুখে আছে। আলহামদুলিল্লাহ । এখন, মানুষের চোখ না লাগলেই বাকি জীবনটা পার করলেই হলো। ত্রপা চট করে বললো, ‘বাড়ি যাচ্ছো যাও, টুসি যদি ঘুমিয়ে যায়, আর এখানে আসার দরকার নেই, শুধু খাবারের জন্য আবার পয়সা খরচ করে ট্যক্সি নিয়ে আসবে কোনো মানে হয় না’ – বলেই ত্রপা দুম করে ফোন রেখে দিল। টুটুল হাফ ছেড়ে যেন বাচঁলো। এ যাত্রার প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেয়া গেল । এখন বাসায় যেয়ে যদি দেখে চুলা অফ, তাহলেই রক্ষা।
বৈশাখ মাস চলছে । হঠাৎ করে আকাশে কালো মেঘ করে ঝড়বৃষ্টি নেমে এসেছে । তীব্র গরমের পরে ঢাকা শহরে জীবনযাত্রায় খানিকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে । টুটুল ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বড়ো বড়ো ফোটায় বৃষ্টি হচ্ছে, সেই সাথে বাতাস। টুটুল বিচলিত হয়ে ভাবছে আর যদি সত্যিই চুলা না অফ করে তাহলে কেলেঙ্কারি কান্ড বেঁধে যাবে। চুলার আগুন বাতাসের দমকে হয়তো এতক্ষনে আরও ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ে টুটুলের গা বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
কাছে পিঠে হয়তো কোথাও বাঁজ পড়লো । তীব্র আলোর ঝলকানির পরে মেঘের তীব্র গর্জনের শব্দ হলো। টুসি ট্যাক্সির দুলুনিতে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, বাঁজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে কান্না শুরু করলো। তৃনা ভয় পেয়ে বাবার গায়ের সাথে সেঁটে আছে। তৃনা বললো, ‘বাবা, ভয় লাগছে।’ টুটুল বললো , ‘ ভয়ের কি আছে , এই তো মা আমরা বাসায় এসেই গেছি।’ টুটুল মেয়েকে ইলেক্ট্রিসিটিবিহীন ঝড়বৃষ্টির এই রাতে বজ্রপাতের চমকানি থেকে অভয় দিলেও নিজে মনে মনে চুলার কথা ভেবে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। এই পৃথিবী দিন দিন ভয় ও আতঙ্কে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা ভয় করে বাবা -মা কে, বাবা-মা রা ভয় করে বাচ্চাদেরকে, স্বামী ভয় করে স্ত্রীকে, স্ত্রী ভয় করে স্বামীকে, ছোট ছোট দেশগুলি আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি শক্তিশালী বড়ো দেশ আক্রমণ করে, বোমা মারে। ভয় থেকে কখনো সৃষ্টিশীল কিছু হতে পারে না। ভয়-কে প্রতিস্থাপন করতে হবে ভালোবাসা ও ভক্তি দিয়ে। টুটুল যখন এসব ভাবছে ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলো তাদের গলির দিকে সাইরেন দিয়ে একটি দমকলবাহিনীর গাড়ি ছুঁটে যাচ্ছে। টুটুলের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
টুটুল ফ্ল্যাটের সামনে চলে এসেছে। বাসার সামনে কোনো দমকলের গাড়ি বা জটলা দেখা যাচ্ছে না। এটি শুভ লক্ষণ। টুটুল ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ফ্ল্যাটের দিকে এগুচ্ছে। ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় লিফ্ট বন্ধ। কোনো রকমে দরজা খুলে ভেতরে রান্না ঘরে যেয়ে টুটুল দেখলো, ডালের চুলা সে বন্ধ করেছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো টুটুল। ঠিক তখনই দরজায় নক করার শব্দ হলো। কারেন্ট না থাকায় ইন্টারকমও কাজ করছে না। এসময় আবার কে এলো ভাবতে ভাবতে টুটুল দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখলো বন্ধু রঞ্জু মিটিমিটি হাসছে। রঞ্জুর হাতে একটি ব্রিফকেস, আরেক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। রঞ্জু বললো, ‘দোস্ত ভিজে একেবারে ত্যানা ত্যানা হয়ে গেছি , ভিতরে ঢুকতে দিবি না? ভয় পাস না দোস্ত , জাস্ট দুই রাত থাকবো, কোম্পানির ওয়ার্কশপ, তিনদিনের দিন মাইরি বলছি চলে যাবো ?’
বাল্যবন্ধুকে দেখে টুটুল আনন্দিত না হয়ে শুখনা মুখে বললো, ‘ভিতরে আয়।’
টুটুলের এই শুখনা মুখের রহস্য হচ্ছে তাকে এমনিতেই হাউজ হ্যাব্যান্ড হয়ে ত্রপার সংসারে তোয়াজ করে থাকতে হয়। এর মধ্যে মাস ছয়েক আগে বগুড়া থেকে রঞ্জুর অফিসের মিটিং উপলক্ষে ঢাকায় এসেছে, এক রাত থাকবে বলে এক সপ্তাহ থেকে তারপরে গেল। ত্রপা রেগেমেগে যা তা অবস্থা। শেষের দিকে বাধ্য হয়ে টুটুল বললো, ‘ঢাকা শহরে বুঝিস তো , নিজের কাজ সব নিজেই করতে হয়, কাজের মেয়েটা ছিল সেও ভেগেছে, তুই বরং হোটেলে থাক দোস্ত। ‘
রঞ্জু বললো, ‘ ভাবীকে দেখছি না, তোরা সব আছিস কেমন ? টুটুল বন্ধুর কথার উত্তর সরাসরি না দিয়ে বললো, ‘ ভিজে চুপসে গেছিস, বাথরুমে যেয়ে গোসল করে না আমি রাতের খাবার দিচ্ছি।’ অনেক রাতে ত্রপা বাসায় ফিরে স্বামীর বন্ধুকে দেখে টুটুলকে হতবাক করে আনন্দিত গলায় বললো,’ এই তোমার বন্ধু এতদিন পর এসেছে শুধু ভর্তা ছানা ভাত দিয়েছো, একটি ডিম,টিম তো ভেজে দিতে পারতে, তোমার জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে কেন ?
প্রচণ্ড কিছুর আগে অনেক সময় মানুষকে ওলোটপালোট ব্যাবহার করতে দেখা যায়। মৃতপথ যাত্রী ঠিক মৃত্যুর আগে মুহূর্তে একেবারে স্বাভাবিক ব্যাবহার করে যেন কিছুই হয়নি। ফাঁসির আসামিকে মাঝ রাতে ডেকে গোসল করে তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার খেতে দেয়া হয়। ত্রপার এই হঠাৎ টুটুলের বন্ধুকে দেখে চেচামেচি না করে এই ভালো ব্যাবহার করাকে টুটুল বেশ অবিশ্বাসের চোখে দেখলো। পরের দিন টুটুলের সেই অবিশ্বাসের মাত্রা আরও অনেক অনেক চওড়া হলো ।
ত্রপাদের অফিসের গাড়ি ভোর সাড়ে সাত টায় ত্রপাকে বাসার সামনে থেকে উঠে নেয়। প্রায় একই সময়ে টুটুল টুসিকে কোলে নিয়ে গ্রেড সিক্সের ছাত্রী তৃনাকে রিকশায় করে মোহাম্মদপুরে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিয়ে আসে। ভোর ছয়টা থেকে সাত-টা পর্যন্ত এবাড়িতে যে প্রলয়ংকর ঝড় ওঠে তা টুটুল দক্ষতার সাথে সামাল দিয়ে থাকে। বিদেশী অফিসে ত্রপাকে বেশ পরিপাটি হয়ে যেতে হয় বিধায় ত্রপাকে সকালের রান্নার কর্মকান্ডে অনুপস্থিত থেকে রূপচর্চায় ব্যাস্ত থাকতে হয়। ত্রপার অফিস আর তৃনার স্কুলের পরে প্রায় দুপুর পর্যন্ত লম্বা সময় টুটুল যেন স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজ-উদ দৌলা। দেড় বছরের টুসিকে নিয়ে খেলা করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। এসময়ে প্রায়ই দেখা যায় টুটুল ইন্টারনেটে চাকুরী বিষয়ক ওয়েবসাইটে গভীর মনোযোগে হন্যে হয়ে চাকুরী খুঁজছে।
পরের দিন সন্ধ্যায় মাগরেব নামাজের পরে টুটুল সবেমাত্র তৃনাকে অংক করাতে বসেছে। টুসি ফিডার মুখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ত্রপা এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। দরজায় কলিংবেলের শব্দ হলো। টুটুল দরজা খুলে হতভম্ব। রঞ্জু তার মিটিং থেকে ফিরেছে, তবে একা না। একটি অল্পবয়সী শাড়ি পরা মহিলা মাথায় কাপড় দিয়ে সলজ্জ ভঙ্গিতে রুঞ্জুর পেছনে দাঁড়িয়ে, হাতে সুটক্যাস। রঞ্জু খুশিতে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়ে বললো,’ দোস্ত আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য হুট্ করে তোর ভাবি চোলে এসেছে, দেখ দিখি কি অবস্থা !’
টুটুলের মুখে কোনো কথা নেই। বিস্ফারিত চোখে সে বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এমনিতেই টুটুলকে চাকুরীজীবি স্ত্রীর রোজগারের ওপর নির্ভরকরা সংসারের হাল ধরে চলতে যেয়ে অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনতে হয় । এর মধ্যে উটকো ঝামেলা হিসাবে গতকাল রঞ্জু হাজির । গতকাল ত্রপা রঞ্জুর সাথে অস্বাভাবিক ভালো আচরণ করেছে যা টুটলকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। এখন আবার বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর আগমনে ত্রপার অভিব্যাক্তির কথা ভেবে ভয়ে ও আতংকে পলকহীনভাবে শুন্য দৃষ্টিতে মুখ হা করে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে থাকে হাউজ হাজব্যান্ড টুটুল ।
_(চলবে)
আগের পর্বের লিংক:হাউজ হাজব্যান্ড-(পর্ব এক )