গভীর রাতে মেসেঞ্জারে ফোন পেয়ে তমালের ঘুম ভেঙে গেল। তমাল ফোন ধরবে না চিন্তা করেও অবশেষে ফোন ধরলো। মাঝ রাতে দরকার ছাড়া কেউ সাধারণতঃ ফোন করার কথা না। অবশ্য, দেশের কল হলে ভিন্ন কথা। অন্তত ফোনের ব্যাপারে দেশের মানুষের কান্ডজ্ঞান সম্পর্কে তমালের ধারণা তেমন সুবিধার না। একবার রাত আড়াইটার দিকে তমাল মেসেঞ্জারে দেশের একটি কল রিসিভ করে বেকুব হয়ে গেল। স্যান্ডো গেঞ্জি, লুঙ্গি পরা অবস্থায় চোখ রগড়াতে রগড়াতে কল রিসিভ করতেই স্ক্রিনে দেশের ভার্সিটি লাইফের বন্ধুদের দেখতে পেয়ে তাজ্জব হয়ে গেল। আসলে কলটি ছিল ভিডিও কল, ঘুমের ঘোরে তমাল বুঝতেই পারেনি। এক বন্ধু দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বললো, ‘কিরে দোস্ত, বৌকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলি নাকি?’

আজ অবশ্য সেরকম ফোন না। আজ ফোন করেছে শ্যালক মন্টু। মন্টু ফ্যাসফেসে গলায় বললো, ‘দুলাভাই, আব্বার আবার স্ট্রোক করেছে, আমি মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। বগুড়ায় আপনার কোনো ডাক্তার বন্ধু থাকলে জানাবেন, বিদেশ থেকে কল পেলে হয়তো পাত্তা তাত্তা দিবে। এমনিতেই আপনারা বিদেশ যাওয়ার আগে একবার স্ট্রোক করলো, ২/৩ মাসের মধ্যে আরেকবার। আপাকে বলেন অন্তত কিছু টাকা যেন ইমিডিয়েটলি পাঠায়। প্রাইভেট ক্লিনিকে ট্রান্সফার করলে তো শুধু টাকার খেলা। দুলাভাই জানি না সেবার না হয় আপনারা ছিলেন, এবার আমি একা একা হিমশিম খাচ্ছি দুলাভাই। আপাকে বলেন, যদি একবার এসে চোখের দেখা দেখে যায়, আমার কাছে অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছে না’, এই বলে মন্টু কান্নাকাটি শুরু করে দিল।

তিথি তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিথির ফর্সা পা দুটি ব্ল্যাঙ্কেটের কিছুটা বাহিরে বের হয়ে আছে, রুমের ভিতর কিছুটা শীত করায় তিথির পুরো শরীর কিছুটা কুঁকড়ে আছে। তমাল সাবধানে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে তিথির পা দুটি ঢেকে দিলো। কিছু কিছু বাড়িওয়ালারা ইলেকট্রিক বিল বাঁচানের জন্য শীতের সময় হিটিং কমিয়ে রাখে আবার গরমের সময় সহজে এসি অন করতে চায় না। বেজমেন্টের এই এক জ্বালা, বেজমেন্টে থাকা টেনেন্টদের শীত, গরমের সাথে সমঝোতা করে চলতে হয়।

তমালের খুব সিগারেটের নেশা পেয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটে একটিমাত্র শলা আছে । রাত প্রায় দুটার মতো বাজে, তিথির বাবার চিকিৎসার ব্যাপারে এই অভাবের মধ্যে দেশে মন্টুকে কিভাবে টাকা পাঠানো যায় এটার উপায় বের করার জন্য তমালকে আরো খানিকটা রাত জেগে থাকতে হবে। তমাল সিদ্বান্ত নিলো, এখন সিগারেট খাবে না, নেশা চেপে রাখার প্রাকটিস করা দরকার, এক ধরণের হার্ম রিডাকশন প্ল্যান। এভাবে কমাতে কমাতে একদিন একেবারেই ছেড়ে দিলে মাসে অনেকগুলি ডলার বেঁচে যাবে। এসব দেশে সিগারেটের প্রচুর খরচ।

তমাল হঠাৎ খেয়াল করলো, পাশের তিতাসের রুম থেকে বন্ধ দরজার নিচ থেকে চিকন আলো বের হচ্ছে। তার মানে, হয় তিতাস জেগে আছে অথবা ভুলে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তমাল আলতো করে দরজা খুলতেই তিতাস সপাট করে চেয়ার থেকে উঠে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। তমাল তিতাসের পশে বসে গলার স্বর নিচে নামিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে বললো, ‘তিতাস বাপ আমার, আমি জানি তুই ঘুমাসনি, তোর সাথে জরুরি পরামর্শ করার জন্য এলাম’। তিতাস নিরুত্তর। এমনিতেই অটিস্টিক বাচ্চারা কথা বার্তা নিতান্তই কম বলে। তাই, তিতাসের কাছ থেকে রেস্পন্সের আশা না করে তমাল বলা শুরু করলো, ‘বাবা, তোর নানা ভাইয়ের খুব অসুখ, তোমার আম্মু এখনো জানেন না, তোর কি মনে হয় তোর আম্মুকে ঘুম থেকে ডেকে এখনই বলা উচিত নাকি সকালে বলবো বুঝতে পাচ্ছি না। তোর নানা ভাইকে দেখতে যাওয়াটাও জরুরি আবার উনার চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠানোও উচিত, কোনটি করবো বুঝতে পাচ্ছি না বাবা। অবুঝ তিতাসের কাছে নানা ভাইয়ের অসুখের ব্যাপারটি গুরুত্ব না পেলেও দেশের কথা উঠতেই খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,’ বাবা তাহলে আমরা সবাই দেশে যাচ্ছি!!!’

তিথি ও তমাল সুটকেসের ভিতর থেকে দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকা পয়সার গোপন থলি বের করে হিসাব করতে বসলো, প্রায় এগারোশো ডলারের মতো আছে। তিথিকে যদি একা দেশে পাঠানো হয় তবুও কমপক্ষে হাজার দুয়েক ডলারের ব্যাপার। সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের চেক থেকে বাড়ি ভাড়া, টেলিফোন বিল ইত্যাদি দিয়ে মাত্র সামান্য কিছু টাকা থাকবে পুরা মাসের জন্য। তাই, তিথি ও তমাল সিদ্ধান্ত নিলো, দেশে না যেয়ে টাকা পাঠানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

তমাল এখনোও দেশে টাকা পাঠায়নি, টাকা পাঠানোর সিস্টেম তেমন জানে না, তাই সঙ্গত কারণেই বাল্য বন্ধু পরাগকে ফোন করলো,’দোস্ত আমার শশুর বাড়িতে ইমিডিয়েটলি হাজার খানিক টাকা পাঠানো দরকার, আমাদের বাসার কাছেই একটি সাইনবোর্ড দেখেছিলাম, ভাবছি ওদের ওখানে যেয়ে টাকা পাঠাবো, তুই কি বলিস?
– ‘দোস্ত, খবরদার এ কাজ করিস না, হাজার ডলার পাঠালে ওরা তোর আইডি দেখতে চাইবে, এসব ফাঁস হলে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে আবার সমস্যায় পরে যাবি, তারচেয়ে বরং আমি এক্ষুনি আসছি, আমার আইডি ইউজ করে একসাথে যেয়ে টাকা পাঠাবো, তোর শশুরের অবস্থা এখন কেমন?

প্রবাসে টিকে থাকতে হলে অনেক হিসাব নিকাশ করে পা ফেলতে হয়। সঠিক তথ্যের অভাবে নিউ ইমিগ্রান্টদের অনেক সময় এই জটিল হিসাব নিকাশ গুলিয়ে ফেলে সমস্যায় পরে যেতে হয় যায়। শিশুরা যেমন ভুল করে করে শেখে, প্রবাসী নিউ ইমিগ্রান্টদের সেভাবে ভুল করে শেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না, একেকটি ভুলের জন্য অনেক অনেক বড় খেসারত দিতে হয়, অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। SIN কার্ড পাওয়ার অল্প কয়েকদিন পরে তিথির ফোনে একটি কল এলো সার্ভিস কানাডা থেকে, কি যেন একটা ঘাপলা হয়েছে, SIN কার্ড বাতিল হয়ে যাবে তাই ওদের কিছু তথ্য দিতে হবে। ভাগ্য ভালো সেদিনও পরাগ সাথে ছিল, না হয় আরেকটু হলে তমাল SIN নাম্বার সব বলে দিতো। প্রবাসে নিউ ইমিগ্রান্টদের পরাগের মতো ভালো বন্ধু থাকা অনেক অনেক বেশি জরুরি।

তমাল পরাগের সাথে যেয়ে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্যালক মন্টুর নামে শশুরের চিকিৎসা বাবদ ওদের সার্ভিস চার্জ সহ মোট এক হাজার চারশো ছিয়াশি ডলার পাঠালো যা বাংলাদেশী টাকায় হবে এক লাখ টাকা। মন্টু কিভাবে টাকাটি রিসিভ করবে সেটা বুঝিয়ে বলার জন্য তমাল বাসায় এসেই  মন্টুকে মেসেঞ্জারে ফোন দিলো। কিন্তু মন্টুকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। আধা ঘন্টা খানিক পরে মন্টু ফোন দিয়ে হাউমাউ করে কান্না, ‘দুলাভাই আব্বা আর নেই…..। আপাকে বোলো আব্বাকে যদি একবার শেষ দেখা দেখে যায়।’ মন্টু আর কথা বলতে পারলো না, শুধু কেঁদেই চললো।

তিথি তমালের পাশেই ছিল, তিথির বুঝতে মোটেই অসুবিধা হলো না, তার বাবা আর বেঁচে নাই। তিথি বাচ্চাদের মতো করে চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তিথিকে জড়িয়ে তমালও নিঃশব্দে কাঁদছে। টরন্টোর স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে তিনটা বাজে। তিতাস এই মাত্র স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মাবাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে কিছুটা চমকে গেল। অটিস্টিক বাচ্চাদের ইমোশন কিছুটা যেমন বিলম্বিত ভাবে কাজ করে ওদের প্রকাশভঙ্গিও কিছুটা আলাদা হয়। তিতাস ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ক্রন্দনরত বাবা মায়ের দিকে।

প্রবাসে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বেশ কিছু ভালো কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে এখানে কোনো বাংলাদেশী পরিবারের কেউ মারা গেলে বা এমনকি দেশে নিকট আত্মীয় কেউ মারা গেলে এখানকার দেশি প্রতিবেশী, বন্ধু বধূ বান্ধব সমবেদনা জানাবে জন্য দল বেঁধে ছুঁটে আসে। এদের অনেকেই আবার রান্না করা রকমারি খাবারদাবার নিয়ে আসে, কেউবা দেশী রেস্টুরেন্ট থেকে কিনি নিয়ে আসে বিরানি, পিজ্জা প্রভৃতি যাতে মৃত্যু বাড়িতে রান্না /বান্না না করতে হয়। LINC এর ক্লাসে তিথির সাথে পরিচিত হওয়া বেশ কিছু মহিলা, তমালের বন্ধু পরাগ, পরাগের স্ত্রী, দেশী বড়ভাই বাদশা ভাই, উনার স্ত্রীসহ অনেকেই তিথিদের সমবেদনা জানাতে এসেছে। দুই কামড়ার বেজমেন্টে জায়গা না হওয়ায় উপরতলায় মালিক সোবহান সাহেবের ড্রয়িং রুমে গেস্টদের আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করা হয়েছে।

সোবহান সাহেবের স্ত্রী ফ্লোরিডায় মেয়ের বাসায় থাকায় সোবহান সাহেবকেই গেস্টদের আপ্পায়নের মূল দায়িত্ব নিতে হয়েছে। সোবহান সাহেব বড় সসপ্যানে গেস্টদের জন্য খিচুড়ি বসিয়েছেন। আরেক চুলায় রান্না হচ্ছে ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করে ডিফ্রস্ট করা কোরবানির গরুর গোস্ত। সারা বাড়িতে সেই রান্না করা গোস্তের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। তিথি মাথায় কাপড় দিয়ে সোবহান সাহেবের ড্রাইং রুমের এক কোনায় সোফায় বসে বাবাকে নিয়ে কথা বলতে যেয়ে মুহুর্মুহু কান্নায় ভেঙে পড়ছে। গেস্টদের মধ্যে দুই একজন যারা ইতিপূর্বে এভাবে দেশে বসে বাবা মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনতে হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে একজন মহিলা এগিয়ে এসে তিথিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘আপা, আমি আমার আব্বাকে এখানে আসার পরে শেষ দেখা দেখতে পারিনি। আমি যেদিন দেশ থেকে প্রথম এদেশে আসবো সেদিন সকাল থেকে আব্বা বাসায় নাই, সারাদিন মানুষটা বন্ধুদের বাসায় যেয়ে আমার জন্য টাকা ধার করতে গিয়েছিলেন। আমাদের সাথে ছিল কাটায় কাটায় দশ হাজার ডলার, আরো কিছু ডলার সঙ্গে থাকলে ভালো হতো  আমাদের ফ্লাইট রাট সাড়ে এগারোটার সময়। অন্তত তিন ঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। তার মধ্যে ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম। আব্বার জন্য ওয়েট করে করে শেষ পর্যন্ত আব্বাকে ছাড়াই মাগরিব নামাজ নামাজ পড়ে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। মাইক্রো বাস ঠিক ছাড়বে সেই মুহূর্তে আব্বা বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে হাপাতে হাপাতে মাইক্রোবাসে উঠে আমার হাত একটি খাম ধরে বললেন, ‘মা রে এখানে তিন হাজার মার্কিন ডলার আছে, সুটকেসের এক কোনায় কাপড়ের মধ্যে রেখে দে, বিদেশে যাচ্ছিস, টাকা পয়সা হচ্ছে শক্তি। আমার পায়ে ব্যাথা, তোদের সাথে আর এয়ারপোর্টে যেতে পারবো না,ভালো ভাবে থাকিস, মা সব সময় তোদের জন্য দোয়া থাকবে’। সেটিই আমার বাবার সাথে শেষ দেখা। বিনা চিকিৎসায়, অনেকটা টাকার অভাবে আমার বাবা মারা গেলেন, আমি বিদেশে থেকেও কিছুই করতে পারলাম না।’

 মহিলাটির সাথে আরো অনেক মহিলায় নাকে মুখে কাপড় গুজিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মহিলাটির কান্নায় ঘরের মধ্যে সোবাহান হাসিবের ড্রইং রুমে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরী হয়েছে। প্রবাসে বাংলাদেশিরা যারা অনেক দিন থেকে এখানে থাকেন কেউ কেউ স্বজন হারা বেদনা নিয়ে এখানে বসবাস করেন। অনেকেরই বিশেষ করে নতুন ইমিগ্রান্টদের দেশে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না, যাদের সামর্থ থাকে তাদের কেউ কেউ  খুব কাছের মানুষের মারাত্মক অসুখ বা মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শেষ দেখার জন্য দেশে ছুঁটে চলে যান, অনেকেই আবার নিজের সংসার, কাজ ফেলে দেশে যাতে পারেন না, আবার যেহেতু দেশে যেতে প্রায় দেড়দিন লেগে যায় দেশে আত্মীয় স্বজন অনেকেই আবার অপেক্ষা না করে লাস দাফন করে ফেলে। তাই এখানে প্রবাসীরা এদেশে অনেক সুখ সাচ্ছন্দের মাঝেও তাদের মৃত আত্ময়ও স্বজনদের শেষ না দেখার পর্বতসম কষ্ট বুকে নিয়ে বসবাস করেন।

দেখতে দেখতে কয়েদিন চলে গেল, জগৎ সংসারে কোনো কিছুই থেমে থাকে না। তিতাস এক দিন বিরতি দিয়ে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। LINC এর ক্লাসে আবারো বাংলাদেশী মহিলারা জোট বেঁধে ক্লাস করছে, ক্লাসের ফাঁকে এটা ওটা নিয়ে কথা বলে হেসে গড়া গড়ি খাচ্ছে। শুধু তিথি ক্লাসে অনুপস্থিত। তমাল গোল্ডেনমাইল এমপ্লয়মেন্ট এন্ড সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টারের রিজুমির উপর ওয়ার্কসপে এটেন্ড করে কিভাবে ভালো রিজুমি লিখতে হয় সে ব্যাপারে জ্ঞান নেয়ার চেষ্টা করছে। শুধু তিথির ক্ষত্রে কিছুটা ব্যাতিক্রম, বাবার কথা মনে করে করে রাত জেগে জেগে তিথির চোখের নীচে খানিকটা কালচে হয়ে গিয়েছে। এ জগতের এই এক অদ্ভুত নিয়ম, যার যায় সেই শুধু বোঝে কষ্ট !!

বাহিরে মৃদু তুষারপাত হচ্ছে। এই সিজনের প্রথম তুষারপাত। তিথি তমালদের জন্য জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখা। তিথি এদেশে এসে অনেকদিন ধরে এদেশে এই বরফ পড়ার দৃশ্য দেখার জন্য এতদিন মুখিয়ে ছিল। অথচ, তিথির সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তিথি তার সদ্য মৃত বাবার কথা মনে করে ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। অবশ্য বেজমেন্টে থেকে সেভাবে বাহিরের বরফ পড়া দেখার সেরকম সুযোগ হয়ে ওঠে না। সন্ধ্যার পরে তিথির মন কিছুটা হালকা করার জন্য তমাল অনেকটা জোর করে তিথিকে নিয়ে বের হয়েছে। আসে পাশে বাড়িওয়ালারা বাড়ির সামনে সুন্দর করে ক্রিস্টমাস /হ্যাপি নিউ এয়ারের আলোক সজ্জা সুন্দর করে সাজিয়েছে। দেশ থেকে আসার সময় বঙ্গ বাজার থেকে কেনা ভারী জ্যাকেট পরে মাথায় টুপি দিয়ে গলা মাথা ঢেকে তিতাস সহ সবাই বেশ কয়েকদিন পর আজ বাহিরে হাটতে বের হয়েছে।

আবাসিক এলাকার সরু রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে ওরা এগিয়ে চলছে পাড়ার একটি শপিং মলের টিমহর্টনের দিকে। তাপমাত্রা শূন্যের নীচে। বেজমেন্ট থেকে বের হয়ে বাহিরে মুক্ত পরিবেশে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা কিছুটা ফ্রেস লাগছে। থেমে থেমে হালকা তুষার পড়ছে। চৈত্র মাসে শিমুল গাছ থেকে যেমন ফল ফেটে তুলে বের হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়ায় অনেকটা সেরকম ভাবে বাতাসে অসংখ্য তুলার মতো তুষার পড়ছে। রাস্তায় লাইট পোস্টের আলো ঝলমল করছে। তিথিদের জ্যাকেট এর উপর, মাথার টুপির উপর হালকা তুষার পড়ায় একবারে সাদা তুষার মানবের মতো দেখাচ্ছে। তিতাস রাস্তার পাশ থেকে তুষারের দলা বল বানিয়ে মায়ের দিকে ছুড়ে মারছে, আর মা খিল খিল করে হেসে উঠছে। বেশ কয়েকদিন পরে তিথির মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে এই আনন্দে তমাল জ্যাকেটের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। শীতের সময় এসব দেশে সিগারেট খাবার এই এক ঝামেলা, ঠান্ডায় হাত জমে যায়। হাত জমে বরফ হয়ে যাক, তাতে তমালের কিছুই এসে যায় না, অনেকদিন পরে তিথির হাসি তমালকে এক অন্যরকম জগতে নিয়ে যায়।
—————————————
(চলবে)
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, ২০২১

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের সংগ্রাম-পর্ব ১০
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ নরওয়ের সুন্দর একটি শহর-ফারসুন্ড
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন