ঈদ মোবারক
প্রবাসে মসজিদ বন্ধ থাকায় এবারের ঈদের নামাজ বাসায় পড়ার কথা। ঈদের দিনে সকাল নয়টার মধ্যে জামিল উদ্দিন সাহেব সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গোসল করে জামা কাপড় পরে নামাজের জন্য রেডি হয়ে আসতে বললেন । জামিল উদ্দিন ড্রয়িং রুমের মেঝেতে সাদা বিছানা চাদরের উপর জায়নামাজ পেতে বসে বসে ঈদের নামাজ পড়ার নিয়মাবলী গুগুল করে মুখস্থ করছেন। আজ যে তাঁকেই নামাজ পড়াতে হবে। এত মুখস্ত করার পরেও জামিল উদ্দিন জীবনের প্রথম ঈদের নামাজের ইমামতি করার সময় উত্তেজনার বসে ছোটোখাটো একটি ভুল করে বসলেন। অতিরিক্ত ছয় তাকবীরের যায়গায় এক বার বেশি তকবীর দিয়ে ফেললেন।
সকাল দশটার মধ্যে ঈদের নামাজ শেষ করে সবাই জমিয়ে ঈদের দিনের সকালের নাস্তা খেতে বসলেন। এক মাস রোজা রাখার পরে সকালের নাস্তা খেতে কেমন যেন একটা লাগছে। নাস্তার মেনু হচ্ছে মুগডাল, মসুর ডাল এক সাথে করে পোলাওয়ের চালের খিচুড়ি, কুচি কুচি করে আলু ভাজি, বড়দের জন্য কাঁচা মরিচ ও ধনের পাতা দিয়ে ডিম মামলেট ও বাচ্চাদের জন্য কম মসলা দিয়ে ডিম ভুনা। বাটিতে আলাদা করে রাখা দুই রকমের সেমাই; ঝরঝরে জর্দা সেমাই ও আরেক বাটিতে দুধে ডুবানো লাচ্ছা সেমাই। বাচ্চারা এ ধরণের নাস্তায় একেবারেই অভ্যাস্ত না। জামিল উদ্দিনের প্রবল ইচ্ছার মুখে সবাইকে এ নাস্তা খেতে হচ্ছে। ঈদের দিন নামাজের পরে খিচুড়ি খাওয়া জামিল উদ্দিনের পরিবারের অনেকদিনের ট্রাডিশন। জামিল উদ্দিন খুব বেশি ট্রাডিশনাল টাইপের না হলেও ফ্যামিলির কিছু কিছু ট্রেডিশন এখনোও ধরে রেখেছেন।
খেতে খেতে জামিল উদ্দিন বললেন:
-‘ঈদের দিন, মাংসের কোনো আইটেম দেখছি না যে’।
সাপের মতো ফোঁস করে ঝাঝিয়ে উঠে রুবিনা।
-‘যা রেঁধেছি খাও, রাক্ষুসের মতো সকাল বেলায় কেউ মাংস খায় ?’
জামিল উদ্দিন ঈদের দিনের সকালের আনন্দকে কিছুতেই মাটি করতে নারাজ। তাই, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কথা ঘুরিয়ে ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্যে জামিল উদ্দিন বলে উঠলেন :
-‘বাচ্চারা, নাশতার পরে আধা ঘন্টা বিরতির পরে কিন্তু শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের এবারের ঈদের মূল পর্ব, ঝট পট খেয়ে নাও।
রুবিনা কিছুটা মায়া হয়, ঈদের দিনে এভাবে ঝাঁজিয়ে উঠা উচিত হয় নি। রুবিনা তাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে বেশ মোলায়েম সুরে বললেন :
‘নাস্তার সময় মাংসের কোনো আইটেম রাখা হয় নি, কারণ মাংসের আইটেম রাখা হয়েছে দুপুরের জন্য ও রাতের জন্য। দুপুরের খাবারের বাড়তি আকর্ষণ হচ্ছে বেশী করে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে গরুর মাংস ভাজা ভাজা করে রান্না, তার সাথে দেশী স্টাইলে মুরগির রোস্ট ও খাসির মাংসের কোর্মা । সন্ধ্যার দিকে বাড়ির পিছনে ব্যাক -ইয়ার্ডে বারবিকিউ করা হবে । এর জন্য আলাদা করে গরুর চাপের গোস্ত ও মুরগির রান/থান মশলা ও লেবুর রস দিয়ে মেখে ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়েছে’ কথাগুলি একনাগাড়ে বলে রুবিনা স্বামীকে না জানার ভান করে বললেন:
-‘তো মূল পর্বের পরিকল্পনাটা কি ঠিক বুঝলাম না’
মুখে গভীর রহস্যের হাসি দিয়ে জামিল উদ্দিন উত্তর দিলেন
-‘সময় হলেই বুঝতে পারবে’
টান টান উত্তেজনা নিয়ে জামিল উদ্দিন সাহেব পলিন, তিন্নি, তমালকে নিয়ে নীল রঙ্গের ২০১৮ মডেলের সাত সীটের ডোডজ ক্যারাভান গড়িতে উঠে বসে আছে। দ্বিতীয় সারিতে গাড়িতে ঈদ মুবারক লেখা ব্যানার লেখার সাইডে পলিন বসেছে, পাশে বসেছে তিন্নি। পিছনের সব সীট দখল করে আয়েস করে পি এস ভিটা, ট্যাবলেট প্রভৃতি সরঞ্জামাদি নিয়ে বসেছে তমাল। প্রায় আধা ঘন্টা খানিক আগে, জামিল উদ্দিন রুবিনাকে প্লানের ব্যাপারটি খুলে বলেছেন। রুবিনা যে এত দ্রুত প্লানটি মেনে নিবে সেটা জামিল উদ্দিনের কল্পনার মধ্যেও ছিল না।
ফর্সা মেয়েদের কমলা রং বেশ মানায়। রুবিনাকেও বেশ মানিয়েছে। রুবিনা শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কানের দুল, এমন কি টিকলিও পড়েছে। রুবিনাকে একেবারে বালিকা বধূর মতো লাগছে। জামিল উদ্দিন রুবিনার রূপে অভিভূত হয়ে মুহর্তে অনেক পুরানো দিনের কথা ভাবতে লাগলেন । সেই ফাঁকে রুবিনা কখন যে গজ গজ করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলেন জামিল উদ্দিন টেরই পেলেন না তবে, রুবিনার কথায় জামিল উদ্দিন সম্বিৎ ফিড়ে পেলেন:
‘তোমার পাগলামি কিছুতেই গেলো না। ভাবলম, এবারের লকডাউনের ঈদে ঘড়ে শুয়ে বসে সময় কাটাবো , তা না উনি হৈ হৈ রৈ রৈ করে রাস্তাঘাটে ঈদ মুবারক করে বেড়াবেন।’
জামিল উদ্দিন গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে পাশে বসা রুবিনার দিকে মুচকি হেসে বললেন:
‘পুরুষ মানুষের কিছু কিছু পাগলামি না করলে কেমন যেন নিরামিষ নিরামিষ লাগে। আর তা ছাড়া, পাগলামির তো অনেক টাইপ আছে, এটা হচ্ছে রসিকতা টাইপের পাগলামি। দেখবে, সবাই এটা পছন্দ করবে।
জামিল উদ্দিনের গাড়ি প্রথমে লরেন্সের উপর বন্ধু সেলিমের বাড়ির পার্কিং লটে থামলো । জামিল উদ্দিন ইশারা করতেই সবাই বাঁশি বাজি বাজিয়ে ঈদ মুবারক ধ্বনি দিতে লাগলো । সেলিম আগে থেকেই রেডি ছিল, সেলিম সাহেবের ছেলে মেয়েরাও থালা বাটি বাজিয়ে ঈদ মুবারক ধ্বনি দিতে লাগলেন। পাশের বাড়ি থেকে দুই একজন অবাঙ্গালী প্রতিবেশী উঁকি ঝুঁকি মারছে। পাঁচ/ছয় মিনিট পরেই সেলিমের পরিবার বাহিরে বের হয়ে ওঁদের গাড়িতে এসে উঠলো। এবার দুই গাড়ি মিলে মৃদু হর্ন দিতে দিতে ছুটলো আরেক বন্ধু ইমতিয়াজের বাসার দিকে। এভাবে সাত /আট টি বাড়ি ঘুরে সব শেষে গাড়ির বহর ছুটলো বোরহানের বাসার দিকে। বোরহান অবশ্য বের হতে পারলো না। ওর ছেলে সাত সকালে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। অবশেষে অবশেষে বোরহানকে ছাড়াই জামিল উদ্দিন সহ বাকি বন্ধুরা আট টি গাড়ির হর্ন বাজিয়ে ডানফোর্থ রোড ধরে একেবারে বাঙ্গালী পাড়ার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। গাড়ির বহর ডানফোর্থ/ ভিক্টরিয়া পার্ক ইন্টার সেকশন পার হয়ে এগিয়ে চলছে। আশেপাশে চেনা হোক, অচেনা হোক বাঙ্গালী কাউকে দেখলেই গাড়ির জানালা নেমে চিৎকার করে বাচ্চারা বলছে ‘ঈদ মুবারক’। অনেকেই রাস্তায় আঁনন্দে চিৎকার করে হাত তালি দিচ্ছে। পলিন, তিন্নি, তমাল সবাই বেশ মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। রুবিনা এক সময় হাসতে হাসতে জমিল উদ্দিনকে বললো:
‘তোমার এই রসিকতা টাইপের পাগলামিটা আমার সত্যিই মনে ধরেছে’ ।
বলতে না বলতেই হটাৎ করে একটি পুলিশের গাড়ি লাল/নীল সিগন্যাল লাইট জ্বালিয়ে জামিল উদ্দিনের গাড়ির পিছনে। জামিল উদ্দিন প্রচন্ড ভয় পেয়ে দুরু দুরু বুকে আস্তে করে ডান দিকে সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি পুল করলেন। জামিল উদ্দিনের গাড়ি ছিল দলের একেবারে শেষে। বাকি গাড়িগুলি একটু সামান্য এগিয়ে। জামিল উদ্দিনের জন্য বাকি বন্ধুরা সবাই তাদের নিজ নিজ গাড়ি থামিয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। একটি মহিলা পুলিশ কনস্টেবল গাড়ির জানালার কাছে আসতেই জামিল উদ্দিন রেডি করে রাখা গাড়ির কাগজ পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ইন্সুরেন্স এর কাগজ পত্র সব বের করে মহিলাটিকে দিলেন। মহিলা পুলিশ টি কাগজ চেক করতে করতে জামিল উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘হোয়াটস গোয়িং ওন, হোয়ায় ইউ গাইজ আর স্ক্রিমিং এন্ড ব্রেকিং পাবলিক পিসফুল এনভেরনমেন্ট?’
জামিল উদ্দিন ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় যা বললেন মহিলা পুলিশ কনস্টেবলটি কিছু বুঝতে পারলো বলে মনে হলো না। পাশে বসে থাকা রুবিনা আস্তে ধীরে গুছিয়ে ঈদের কথা বললেন। রুবিনা আরো বললেন, যেহেতু এই লক ডাউনে কেউ কারো বাসায় যাওয়া নিষেধ তাই এভাবে কিছুটা মজা করছে। জামিল উদ্দিনকে সম্পূর্ণ অবাক করে মহিলা পুলিশ কনস্টেবলটি জামিল উদ্দিন কে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করে হাসতে হাসতে পরিষ্কার উচ্চারণে বললেন ‘ঈদ মোবারক’ । জামিল উদ্দিনের গাড়ি ছাড়তেই অন্যান্য বন্ধুরা একের পর এক ফোন করে বিস্তারিত শুনে আবারোও গাড়ির মহড়া শুরু করলো। তবে, আর খুব একটা বেশিক্ষন বাহিরে না থেকে গাড়িতে করে ঈদ মোবারক পর্বের পথ চুকিয়ে যে যার মতো বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আর সেই সাথে শেষ হলো এবারের Drive- through ঈদ মোবারক পর্ব।
ঈদের গাড়ির মহড়া শেষ করে জামিল উদ্দিন নিজ বাড়ির গ্যারেজের সামনে যখন গাড়ি থামালেন প্রায় দুপুর একটা বাজে। হটাৎ করে, জামিল উদ্দিনের ফোনে ফেস বুক মেসেঞ্জার থেকে ফোন এলো।
-‘ভাইযান, আসসালু আলাইকুম। আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।’
যিনি ফোন দিয়েছে তাঁর নাম হচ্ছে সিরাজ আলী, যাঁকে এই কিছুদিন আগে জামিল উদ্দিন দেশে দরিদ্র মানুষদের হেল্প করার জন্য টাকা পাঠিয়ে ছিলেন।
-ভাইজান, আপনার সাথে কফিল ভাই আর উনার পরিবার কথা বলতে চায়’।
জামিল উদ্দিন বিস্ময়ের সাথে জানতে চায়, কোন কফিল ?
সিরাজ আলী সময় নিয়ে বুঝে বলায় জামিল উদ্দিনের মনে পরে যায় কফিল ভাইয়ের কথা।
কফিল হচ্ছে জামিল উদ্দিনের নানার বাড়ির একই গ্রামের পাড়ার বড় ভাই। বয়সে জামিল উদ্দিনের চেয়ে প্রায় বছর দুয়েকের বড় । বেশ ডানপিটে ছেলে। প্রায় প্রতি বছর হাই স্কুলের স্পোর্টসের দিনে অন্তত ৫/৬ টি পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফিরতো। ছেলেরা কফিল মিয়াকে নিয়ে সেসব পুরস্কার হাতে নিয়ে উল্লাস করতে করতে পাড়ার মধ্যে মিছিল করতো। নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে জামিল উদ্দিন কফিল মিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ে বেড়াতো। কফিল মিয়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা ছিল বেশ ভাগ্যের ব্যাপার । কোনো এক কারণে কফিল মিয়া জামিল উদ্দিনকে বেশ স্নেহ করতো। কফিল মিয়া সেসময় চমৎকার ঘুড়ি উড়াতে পারতো। কফিল মিয়া ভাঙ্গা কাঁচের শিশি বোতল গুঁড়া করে ভাতের আঠার সাথে মিশে লাটাইয়ের সুতার মাঞ্জন করতো। অনেক উঁচুতে গুড্ডি তুলে একেকটি গোত্তা খেয়ে ফটাফট অন্যান্য ছেলেদের গুড্ডি অনায়েসে কেটে ফেলতো। জামিল উদ্দিনসহ অন্যান্য বালকেরা দৌড়ে যেয়ে সে সব কাটা গুড্ডি ধরে আনতো। আজ এত বছর পরে কফিল ভাইয়ের কথা শুনে জামিল উদ্দিনের হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলেবেলার কথা মনে হতে থাকে। সিরাজ আলীর কোথায় জামিল উদ্দিন আবার বাস্তবে ফিড়ে আসে।
‘আপনাদের পাঠানো টাকা গুলি গ্রামের দরিদ্র লোকদের কিছু কিছু করে দেয়ার পরেও মোটা অংকের কিছু টাকা ছিল, সেটা কফিল ভাই কে দেয়া হয়েছে। আপনি ভাইজান অনেকদিন দেশের বাইরে থাকেন, তাই কফিল ভাইয়ের অনেক কথাই জানেন না । কফিল ভাইয়ের ভিটেমাটির একটুকরা ছাপড়া ছাড়া আর কিছুই নাই। দূর দুরন্তরে গিয়া কামলা দিয়া উনার সংসার চলতো। এবারের ভাইরাসের ব্যারামের কারণে কামলা দিতে পারেনি, তাই অবস্থা খুবই খারাপ আছিলো । আপনার টাকা উনাদের খুব কাজে দিছে। উনার অনেক দিনের পুরানো ভাঙ্গা খড়ের চাল ফেলে দিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড টিন কিনে ঘড় ঠিক করেছেন, আপনাদের আরো কিছু টাকা দিয়া উনার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কফিল ভাই ও উনার পরিবার আপনাদের এক নজর দেখতে চায় ভাইজান।
জামিল উদ্দিন সিরাজ আলীকে ফোন অফ করতে বলে তমালের বড় ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকে মেসেঞ্জারে সিরাজ আলীকে ভিডিও কল দিলেন। সব ছেলে /মেয়ে সহ জামিল উদ্দিন কম্পিউটারের সামনে। এক সময় রুবিনাও পাশে চলে এসেছে। জামিল উদ্দিন অবাক হয়ে কম্পিউটারের বড় স্ক্রিনে শৈশবের নানা বাড়ির সেই কফিল ভাইয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখ মুখ শুকনা এক বৃদ্ধ লোক টুপি মাথায় দিয়ে জামিল উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কফিল ভাই জামিল উদ্দিন কে সালাম দিয়ে বলে উঠে,
‘ শুনছি, আপনেরা অনেক দূর থাকেন, আল্লায় আপনাদের অনেক ভালো করবি ভাইজান। আপনারা হামাকারেক অনেক উপকার করছেন।
জামিল উদ্দিন আড়ষ্ট হয়ে বলে উঠে, কফিল ভাই, আপনি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেননি, আমি আপনার চেয়ে অনেক বয়সে ছোট, আমাকে তুমি করে বলেন। আর , এই যে আমার পাশে, ইনি হচ্ছে রুবিনা , আমার স্ত্রী, এই হচ্ছে তমাল আমার বড় ছেলে, এ হচ্ছে তিন্নি আমার মেঝো ছেলে আর এ হচ্ছে পলিন আমার সব ছোট মেয়ে। এঁরা সবাই আমার সাথে সবার বন্ধু/বান্ধবের কাছ থেকে যা টাকা তুলেছিল সেটাই আপনাদের হাতে দেয়া হয়েছে। এটা আমার একার কাজ না, এর পিছনে আছে এখানকার অনেক মানুষের সহযোগিতা। আমি সবার কাছে আপনাদের কথা বলবো।
কফিল মিয়া পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপুষ্টিতে ভোগা জীর্ণ শীর্ণ স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। মহিলাটি মুখে কাপড় চাপা দিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে। এটা হচ্ছে আনন্দাশ্রু। মহাজগতের মধ্যে মানুষ খুবই বিচিত্র এক প্রাণী যাঁরা সুখে ও দুঃখে চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে অনুভূতি ব্যাক্ত করে। আর এই অনভূতিগুলির উপলদ্ধি ব্যাস্তমুখর শহরের মানুষগুলিকে আরো বেশি মানবিক করে গড়ে তোলে।
ঘরের মধ্যে পিন পতন নিস্তব্যতায় প্রবাসী জামিল উদ্দিনের পরিবার কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে একটুকরা বাংলাদেশের চিরাচরিত দরিদ্র অসহায় এক পরিবারের দিকে এই পবিত্র ঈদের দিনে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
একসময় সকল নিস্তব্দতা খণ্ডন করে সবাই এক যোগে ভিডিও কলে হাত নেড়ে বলে উঠে ‘ঈদ মোবারক’ ।
——————————————————
পাঠক, লক ডাউনের মাঝে এবারের ভিন্ন মাত্রার ঈদে জামিল উদ্দিনের পরিবারের গল্প এখানে শেষ হলেও আবারোও সামনের দিনগুলিতে ভিন্ন কোনো উপখ্যান নিয়ে আবার হয়তো কর্মমুখর ব্যাস্ত প্রবাসী জীবনে আপনাদের মাঝে হাজির হবো। হয়তো, এই লক ডাউন একদিন উঠে যাবে। করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধকও হয়তো আবিষ্কার হবে। মাঝ খান থেকে হয়তো আরো অসংখ্য পরিবার হারাবে তাঁদের প্রিয় জনদের। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি বা বেঁচে থাকবো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামান্য কিছু আনন্দ যদি আমাদের সজীবতাকে আরো একটু জাগিয়ে তোলে, তাতে ক্ষতি কি । কিন্তু, খেয়াল রাখতে হবে আমাদের আনন্দের মাঝে আমাদের সবার একটুখানি সহানুভূতির ছোঁয়া পেয়ে যেন দরিদ্র কফিল মিয়াদের দুবেলা মোটা ভাত জোটে, তাঁদেরও মুখে হাসি ফোঁটে, এই হোক, আজকের ঈদ মোবারকের সত্যিকারের সার্থকতা।