গত কদিন হলো অশেষ একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়েছেন। এক্সিকিউটিভ – এডমিনিস্ট্রেশন পদে। নতুন চাকুরী পাওয়ার পর ভীষণ ভালো লাগলেও, এই ভালো লাগা  দেখার মতো  পৃথিবীতে অবশেষের জন্য একজন মানুষও নেই।
ফিরে এসেছে পুরোনো বাসাটিতে। এখানে যাকে মা-বলে জানতেন, তিনিও এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। অশেষ যেন নিঃসঙ্গতার সম্রাট। তবে এই নিঃসঙ্গতা অশেষকে খুব একটা বিচলিত করতে পারে না। অশেষের সব সময়ের সঙ্গী হচ্ছে বই। কোন দ্বীপেও অশেষ একা থাকতে পারবেন, যদি সঙ্গে তাঁর প্রিয় বইগুলো থাকে। ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের সঙ্গে অশেষের নিবিড় সখ্যতা রয়েছে। যে জীবন প্রজাপতির, পাখির- তাঁর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক থাকা আর না থাকা একই কথা।
অফিস থেকে বেড় হয়ে খানিকটা পথ হেটে এসে একটি লেকের ধারে বসলেন। বিশুদ্ধ বাতাসেরা ক্লান্তি কমিয়ে দিতে থাকলো। এতক্ষণ ভ্যাপসা গড়মে ভীষণ অস্থির লাগছিলো। এখন বেশ ভালো লাগছে। হাত-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, ইফতারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। লেকের এপার-ওপার একসূত্রে বেঁধে রাখা দৃষ্টি নন্দন সেতুটি পাড়ি দিয়ে একটি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। থরে থরে ইফতার সাজিয়ে রাখা রয়েছে। অশেষ ইফতারের অর্ডার করতেই দোকানের বিক্রয় কর্মকর্তা বললেন,
-ইফতার কিনতে টাকা লাগবে না। আপনি বসুন ভাই। আমাদের কোম্পানীর পক্ষ থেকে পুরো এক মাস রোজাদারদের জন্য বিনা পয়সায় ইফতার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।
অশেষ চমকিত হলেন, বললেন,
-দারুন-তো! ধন্যবাদ আপনাদের কোম্পানীকে। অফুরন্ত শুভকামনা কোম্পানির  মালিকের জন্যে। ইতিপূর্বে এই দেশে এমন মানবিক কাজ আর অশেষের চোখে পড়েনি। কিছুদিন পূর্বে বাসায় ফেরার জন্য একটি লোকাল বাসে বসে ছিলেন। রাস্তায় তীব্র জানজট থাকাতে গাড়ী ভিড়ের মধ্যে থেমে ছিলো। আচমকা দমকা হওয়ার মতো তিন-চারজন লোক গাড়ীতে উঠে আসলেন। তাঁদের হাতে ঠান্ডা পানির বোতল এবং ইফতার ভর্তি প্যাকেট। অতিথিদের আপ্যায়নের মতো করে তাঁরা প্রত্যেক যাত্রীকে সেই পানির বোতল এবং ইফতার বিতরণ করতে থাকলেন। সবাই হাসিভরা মুখে তা গ্রহন করছিলেন। অশেষ বিস্মিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন,
-এসব কার পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে?
স্বেচ্ছাসেবকদের একজন উত্তর দিলেন,
-পরিবহন মালিক শ্রমিকদের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে।
সেদিনও অশেষের মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিলো। মনে মনে পরিবহন মালিক শ্রেণির প্রেসিডেন্টেকে শ্রদ্ধা জানালেন।
আজকের আয়োজনটি করেছেন একটি বেভারেজ কোম্পানী। আজকেও একই রকমের আনন্দে মনটা ভরে গেলো। তবে আয়োজনের তুলনায় রোজাদারের সংখ্যা খুবই অল্প। এখন মানুষ বোধহয় ফ্রী-তে কিছু পেতে খুব বেশি সস্তিবোধ করেন না। এটি সম্ভবত খানিকটা অস্বস্তিরও ব্যাপার । আবার কোম্পনীর সবকিছু ফ্রী-তে দিচ্ছেন, এমনও না। নির্ধারিত কিছু পণ্য ছাড়া বাকী সবকিছু অবশ্যই পকেটের টাকা খরচ করে কিনে খেতে হবে। অশেষ তাঁর পছন্দের এক বোতল কোমল পানীয় কিনে এগোতে থাকলেন। এই মহতী উদ্যোগ নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির মালিকের প্রতি শ্রদ্ধায় বুকের ভেতরটাতে রক্ত টগবগ করতে থাকলো।
এভাবেই হয়ত একদিন সবার ভেতরে জাগ্রত হবে মানবতা এবং মানবিকতা। আর অশেষ-তো আজন্মই প্রতিটি প্রাণের জন্য সবার হাতটি বাড়িয়ে দেওয়ার নিরন্তর প্রার্থনা করেই যাচ্ছেন। আজকে পথ চলতে চলতে তারই একটা বাস্তব রূপ দেখতে পেয়ে অশেষের মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কভিড-১৯, অশেষের একার জীবনের সবকিছু কেড়ে নেয়নি। অসংখ্য মানুষের বেঁচে থাকার বেসাতী ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। নিঃস্ব করে দিয়েছেন তাঁদের। সেখানে অশেষের মতো একজন অনাথের অবস্থান শূন্যের কাছাকাছি বা সামান্য।
যাকে অশেষ মা-বলে জানতেন, তাঁর আলোকিত মুখটি আজকে বড়ো উজ্জ্বল হয়ে অশেষের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এতো বড়ো মনের একজন মহিয়সী নারী ছিলেন তিনি, যার সম্পর্কে বলার জন্য অশেষ খুবই সামান্য একজন্ন মানুষ। আজ তিনি বেঁচে থাকলে, বাসায় ফিরে এই মানবিক কাজের আয়োজক কোম্পানী এবং কোম্পানীর মালিকের গল্প তাঁকে গর্ব করে শোনাতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি ভীষণ খুশি হতেন। তিনিই একদিন বলেছিলেন,
-অশেষ, আশাহত হোসনে। দেখবি, একদিন প্রতিটি প্রাণের জন্য সবাই তাদের হাত দু’টি বাড়িয়ে দিবেন।
মায়ের কথা মনে হওয়াতে মুহূর্তেই মনটা বিষাদের কালো মেঘে ঢেকে গেলো। কতোদিনের কতো কথা! কতো স্মৃতি! কতো ছবি!  অশেষ টের পেলেন দু’চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। অশেষ তাঁর পকেটে রাখা রুমাল বের৷ করে চোখের পানির জোয়ার থামানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু চোখের জলের বান ছোট রুমাল দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না।
-শেষ-

১ মন্তব্য

  1. শ্রদ্ধেয় হাফিজুর রহমান ভাইয়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি আমাকে তাঁর সম্পাদিত পরবাসী ব্লগ পত্রিকাতে লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে কবি, লেখক এবং অনুবাদক আমার লেখার শিক্ষাগুরু সমতূল্য ফারজানা নাজ শম্পা আপার কাছেও আমি ঋণী আজন্মের জন্য। বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিতে নিরলস চেষ্টাকে আমি শ্রদ্ধা করি। পরবাসী ব্লগ, হাফিজুর রহমান ভাই, ফারজানা নাজ শম্পা আপা সহ সবার জন্য রইল আমার অবিরল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা। ভালো থাকবেন সবাই।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন