এবারের রোজা ও ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে বিশেষ মতবিরোধ দেখা দেয় নি। সাবানের চাঁদ ২৯ দিনে ছিল, যে জন্য রমজান ৩০ দিন পূর্ণ হওয়াতে কারো মনে সন্দেহ দেখা দেয় নি। তবে বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার ৪০-৪২ টি গ্রামে বরাবরের মতো এবারও একদিন আগেই ঈদ করে ফেলেছে।

চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, মতলব ও তৎসংলগ্ন উপজেলার ৪০-৪২ টি গ্রামে রোববার ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে যদি ও সারা দেশে মঙ্গল বারে হয়েছে। শুনা গেছে বহু বৎসর থেকে ওরা স্থানীয় পীর সাহেবের নির্দেশে রোজা রাখা ও ঈদ করে থাকেন।

এসব গ্রামের মানুষ পীর সাহেবের অনুমতি ক্রমে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আগাম রমজান ও ঈদ উদযাপন করে আসছে । যদি ও এবার এরা সৌদি আরবের এক দিন আগে ঈদ করেছে। এদের মতে নাইজার বা মালি বাহিরের কোনো দেশে চাঁদ দেখেছে; কাজেই সৌদি আরবকে এবার অনুসরণ করে নি।

বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং সরকারী ভাবে আল- হেলাল কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে রোজা এবং ঈদ উদযাপন করে। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭-১৯৭১ সরকার প্রধান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মীয় আল- হেলাল কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতো। সে যুগে অনেক সময় পূর্ব পাকিস্তানে চাঁদ না দেখলেও পশ্চিম পাকিস্তানে মুলতান , পেশাওয়ার বা অন্য কোনো স্থানে চাঁদ দেখা গেলে ধর্মীয় আল- হেলাল কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঘোষণা দিয়ে রোজা রাখা বা ঈদ উদযাপন করা হতো ।

কানাডা ও আমেরিকায় এবার সোমবারে ঈদ হয়েছে। তবে এখানেও স্থানীয় চাঁদ দেখা কমিটি এবং সৌদি আরব চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে রোজা ও ঈদ করে থাকে; যদিও এবার মত-বিরোধ হয় নি। এক দল সরাসরি সৌদি আরব এবং অন্য দল আল- হেলাল কমিটির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
রমজানের বৈশিষ্ট্য :

ক) রমজান হচ্ছে ক্ষমা ও রহমতের মাস। এটি এমন একটি মাস যেখানে রমজানের মাসে মুসলমানরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং আশা করে যে তাদের পূর্ববর্তী পাপ যত বড়োই হোক না,আল্লাহ ক্ষমা করবেন।
খ) রমজান মাসে আল্লাহ পবিত্র কোরান হজরত মোহাম্মদ (সা: আ: ) নিকট জিব্রাইল ফেরেস্তার মাধ্যমে অবতীর্ণ করেছেন যা সমগ্র মানবজাতির জন্য হেদায়েতের সুস্পষ্ট দলিল ।
গ) এই মাস মুসলমানদের জন্য শ্রেষ্ঠ মাস :
এই মাসে রোজা ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ যার উপর ভিত্তি করে ইসলাম ধর্ম নির্মিত হয়েছে।
তদুপরি, এটি সবচেয়ে উদযাপিত এবং সম্মানিত মাসগুলির মধ্যে একটি কারণ এটি প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি অন্যান্য মাস থেকে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা পৃথক করা হয়েছে:
রমজান হচ্ছে সেই মাস, যে মাসে কোরানের কয়েকটি আয়াত সর্বপ্রথম নবী মুহাম্মাদ (সাঃআ:) এর প্রতি অবতীর্ণ হয়।

রমজানের আর একটি গুন্ হচ্ছে , রমজানকে আল্লাহ লাইলাতুল কদর দিয়ে এক মহান মর্যাদা দিয়েছেন ।
রমজানে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে সুন্দর কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যারা রোজা রাখছেন এবং গরীব লোকদের খাওয়া দিয়ে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।

রোজা শিক্ষা দিয়ে থাকে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান:
রোজার মাসে কী গরীব , কী ধনী সারা দিন(ভোর থেকে সন্ধ্যা ) না খেয়ে থাকে। এতে একজন ধনী উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়ে থাকে একজন দরিদ্র না খেয়ে থাকলে কত কষ্ট হয়।

রোজা ব্যক্তি জীবনকে সুন্দর ও সংযমী হতে শিক্ষা দেয় :
পুরা এক মাস ধরে দিনের আলোতে খাবার থেকে নিজেকে অস্বীকার করার পরে মুসলিম তাদের রোজা (ইফতার) ভাঙার সময় গরীব কে খাওয়া দিয়ে নিজেরাও আনন্দিত হয় ।
এই সুদূর কানাডা ও আমেরিকাতে বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিরা সবাই একত্রে ইফতার ও খাওয়া দাওয়া করে থাকে। সারাদিন রোজা রাখার ফলে সন্ধ্যায় ইফতার সামনে নিয়ে বসে থাকার আনন্দ অতি চমৎকার। কী ছোট, কী বড়ো সবাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে কখন মাগরিবের আজান দেবে এবং খুরমা ও বিভিন্ন রকমারি খাওয়া দিয়ে ইফতার করবে।

ভুলভ্রান্তি ক্ষমা চাওয়া এবং প্রতিজ্ঞা করা যে আর জীবনে অপরাধ করবো না :
ধনী, গরিব প্রতিটি মানুষ মনে করে বৎসরের ১১ টি মাসের ভুলত্রুটি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে নেয়ার এটি একমাত্র সময় যা মহান আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। সে জন্য দেখা যায় লাইলাতুল কদর রাত্রে বা মসজিদে ইতিকাফে মুসল্লিরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে বেশি বেশি কান্নাকাটি করে। সবাই মনে করে আল্লাহ পাক এই রাত্রে জীবনের গুনাহ মাফ করে দেবেন।

তাকওয়া – সিয়াম সাধনা, পাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখা :
তাকওয়া শব্দটি প্রায়ঃশই ‘ধার্মিকতা’ বা আল্লাহর ভীরুতা’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়, তবে এর চেয়ে ভাল অর্থ হবে ‘আল্লাহর -চেতনা’। এটি একজন মুমিনের অপরিহার্য গুণ । একজন মুমিনের তাকওয়াকে তার জীবনের সমস্ত দিক দিয়ে আলোকিত করা উচিত; তাকওয়া, যখন ইমান এর সাথে মিলিত হয়, তখন বিশ্বাসী করে তোলে।
প্রতিটি মুসলমান রোজা বা নামাজ পড়ে প্রার্থনা করে,” আল্লাহ আমাদের পাপ মার্জনা কর”।
এক বৎসর পর আমরা কি আর একবার এই মহা রাত্রি পাবো ?
হে আল্লাহ আমাদের নেক হায়াৎ দান কর।

যাকাত একটি পবিত্র স্তম্ভ:
যাকাত শুধু ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ নয়; এটি একটি বৈপ্লবিক ধারণা, এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করার সম্ভাবনা রয়েছে। রমজানের মাসে প্রতিটি আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সঞ্চিত সোনা গহনা বা টাকাপয়সার শতকরা ২.৫০% জাকাত গরিবদের নির্দেশ রয়েছে।
ঈদ : সর্বোপরি এক মাস রোজা রাখার পর ঈদ বয়ে আনে সীমাহীন আনন্দ। এই মাসে মুসলমান সারা বিশ্বের মানুষের জন্য দোআ বা প্রার্থনা করে।
ঈদুল ফিতর যার আক্ষরিক অর্থ রোজা ভাঙার উৎসব। ঈদুল ফিতর মানে শুধু রোজা ভঙ্গ করা নয়; এটি একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন মজবুত করে। সকল সক্ষম মুসলমানকে রমজানে রোজা রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা রোজাদার মুসলমানদেরকে তাঁর মহান রহমতের মাধ্যমে প্রতিদান দেন।

রমজানে রোজা রাখার কয়েকটি উপকারিতা:
ক) ব্লাড সুগার : এই পবিত্র মাসে রোজা রাখার মাধ্যমে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রিত হতে পারে; কারণ আমাদের খাবার নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকা লোকেরা রোজাকে শরীরের জন্য খুব উপকারী বলে মনে করেন।
খ) পুরো মাস জুড়ে রোজা রাখা ভাল স্বাস্থ্যের কারণ; এটি আমাদের দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করে। যদি কেউ শরীরের ওজন কমাতে চান, এটাই একমাত্র সুযোগ যার মাধ্যমে আপনি নিজের শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
স্থূলতা (Obesity ) :
স্থূলতার লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

ক) শরীরের ওজন বেশি হলে ঘুমের সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে।
খ) স্লিপ অ্যাপনিয়া- এমন একটি অবস্থা যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত হয় এবং ঘুমের সময় পর্যায়ক্রমে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া নিয়ন্ত্রণে থাকলে ঘুমে কষ্ট হ্রাস পায়।

গ) শরীরের বেশি ওজনের জন্য পায়ের জয়েন্টগুলিতে অস্টিওআর্থারাইটিস দেখা দেয় , এর ফলে স্বাভাবিক হাঁটা ও চলাচল কষ্টকর।
ঘ) অনেকে রমজান মাসের নিয়মিত রোজার পরেও প্রতি সোম ও বৃহস্পতি রোজা রাখে , এর ফলে শরীরের অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পায়।
ঙ ) রোজা রাখার ফলে হৃদস্পন্দনের হার এবং রক্তচাপের পাশাপাশি কোলেস্টেরলের মাত্রাও উন্নত হয়।
চ) হজমী শক্তি বৃদ্ধি পায় : সারাদিনের রোজা রাখার ফলে খিদা বাড়ে এবং শরীরে হজমী শক্তি বৃদ্ধি পায়।
সারা মাসের রোজার কারণে খাদ্যাভ্যাস এবং ভালো ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তিত হয়। পবিত্র রমজান মাস জুড়ে রোজা রাখার ফলে, মানসিক চাপের মাত্রা হ্রাস করে স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।

ইচ্ছাশক্তি বাড়ায় (increase will power):
রমজানের সময় রোজা রাখার জন্য মানসিক দৃঢ়তা এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপভোগ ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রয়োজন। পুরো এক মাস রোজার আনন্দ , মনোযোগ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুভূতিকে প্ররোচিত করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি জীবনের ব্রত হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পরোপকার ইচ্ছা শক্তিবৃদ্ধি পায় :
এই মাসে গরীবদের সাহায্য করার প্রবণতা বাড়ে। এ ভাবে দাতব্য উপহার দিয়ে গরিবের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারা যায়। আপনি যাদের ভালবাসেন, তাদের আর্থিক সমর্থন দিতে পারেন । অনেকের সামর্থ্য আছে এবং ব্যক্তিগত সম্পদের কিছু অংশ (জাকাত) বিতরণের মাধ্যমে অন্যের আর্থিক পরিবর্তন আনতে পারেন।

মেজাজকে উন্নত করে:
মুসলমানরা ঘন্টার পর ঘন্টা রমজানের রোজা রেখে পুণ্য অর্জন , আল্লাহর পুরষ্কার, অনুভূতি অনুভব করে। রমজানের রোজার মাধ্যমে আত্ম-সম্মান এবং অন্তরের অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
সমাপ্ত

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়িয়ে দাও হাত – শেষ পর্ব
পরবর্তী নিবন্ধ“প্রাপ্তি”
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন