(ছোট্ট সোনামণিদের জন্যে গল্প)…
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক রাজা আর এক রানী। তাদের সুখের সীমা ছিলনা। গোলা ভরা ধান। গোয়াল ভরা গরু। পুকুর ভরা মাছ আর হাতি শালে ছিল সুন্দর বড় বড় হাতি। মানুষের মধ্যে দুঃখ কষ্ট বলে কিছু-ই ছিলনা। চারদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। রাজার ছিল তিনটি মেয়ে। কিন্তু খুব অবাক করা ব্যাপার ছিল যে, বড় মেয়েটির ছিল শুধুমাত্র একটি চোখ। তা-ও আবার কপালের মাঝখানে। ছোট মেয়েটির ছিল তিনটি চোখ। আর দশজনের মতো স্বাভাবিক দুটি চোখ এবং কপালের মাঝখানে ছিল একটি চোখ। মেজ মেয়ের আর সবার মতোই দুটি চোখ ছিল। বড় মেয়েটি ও ছোট মেয়েটি, এদের দুই জনের-ই কপালে চোখ থাকাতে, এরা নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছিল। যেহেতু মেজ রাজকুমারীর কপালে চোখ ছিলনা। এই কারণে অন্য দুই বোন মেজ বোনকে আলাদা করে ভাবতেন।
রাজা মারা যাওয়ার পর বড় বোন, ছোট বোন ও রানী-মা মিলে মেজ মেয়েটিকে ভীষণ কষ্ট দিতে শুরু করলেন। কারণ তাদের দুই বোনের সঙ্গে তার কোন মিল নেই। বড় মেয়ে ও ছোট মেয়ের সঙ্গে রানী মা-ও যোগ দিলেন। মেজ বোন-কে তারা একা করে দিলেন। তাদের খাওয়া শেষে অবশিষ্ট যে খাবার থাকে, তা-ই মেজ বোনকে খেতে দেওয়া হতো। তাদের একটি ছাগল ছিল। রোজ রানী-মা ও অন্য দুই বোন মিলে মেজ বোনকে ছাগল নিয়ে মাঠে পাঠিয়ে দিতেন। একদিন মাঠের পাশে একটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে মেজ বোন মনের কষ্টে কান্না করছিলেন। মেজ বোনের কান্না শুনে ধবধবে সাদা ঝলমলে কাপড় পরা দেখতে অপূর্ব একজন পরী আকাশ থেকে নেমে এলেন। পরী মেজ বোনের কাছে এসে মেজ বোনকে বললেন,
-তুমি কাঁদছ কেন মেয়ে? তোমার কী হয়েছে?
-আমার অনেক অনেক দুঃখ পরী মা! তাই কাঁদছি । আমার বড় বোনের এক চোখ। ছোট বোনের তিন চোখ। আমার দুটি চোখ থাকার কারণে আমার মা ও বোনে-রা আমাকে আলাদা করে দিয়েছেন। তাদের নষ্ট খাবার আমাকে খেতে দেয়। আমার সঙ্গে মা ও বোনে-রা কোন কথা বলেন-না। রোজ আমাকে ছাগল দিয়ে মাঠে পাঠিয়ে দেন। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর সমস্ত কাজ আমাকে দিয়ে করান। আমি অনেকটা চাক-রানীর মতো জীবন-যাপন করি।
কথা গুলি শোনার পর পরী মায়ের মেজ বোনের জন্য খুব মায়া হলো। মাথায় হাত দিয়ে আদর কর চোখের পানি মুছে দিলেন। তারপর বললেন,
-আজকে থেকে তোমার আর কোন কষ্ট থাকবেন শোনা মনি! এখন থেকে আমি-ই তোমার মা আর তুমি-ই আমার মেয়ে। আমি তোমাকে কিছু মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি রোজ খাওয়ার সময় এই মন্ত্র পাঠ করবে কেমন! তোমার যখন ক্ষুধা পাবে তখন তুমি বলবে, “ছাগল ছানা জলদি বোলাও, চলে আসো কোর্মা পোলাও”। তখন দেখবে, তোমার জন্যে অনেক মজার মজার খাবার চলে এসেছে। খাওয়া শেষ হলে বলবে, “ বলে দাও ছাগল ছানা, চলে যাও খাঞ্চা খানা”। তখন সমস্ত থালা বাসন চলে যাবে ।
তারপর পরী মা মেজ বোনকে অনেক অনেক আদর করে সাদা ধবধবে ডানা মেলে উড়ে চলে গেলেন। পরী মা চলে যাওয়ার পর মেজ বোন বলতে শুরু করলেন,
“ছাগল ছানা জলদি বোলাও। চলে আসো কোর্মা পোলাও”।
মন্ত্র বলা শেষ হতেই মখমলের গালিচায় করে, সোনার তৈরি থালা বাসন ভর্তি পোলাও কোর্মা আরো নানা ধরনের মজার মজার খাবার চলে এলো। মেজ বোন খুব মজা করে খাবার খাওয়া শেষ করে বললেন,
“বলে দাও ছাগল ছানা, চলে যাও খাঞ্চা খানা”। বলতেই গালিচা সহ থালা বাসন উড়ে চলে গেলো।
বাড়িতে ফিরে এসে মেজ বোন দেখলেন, তার জন্য পোড়া ভাত। মাছের কাটা ও নষ্ট খাবার রেখে দিয়েছেন। এসব দেখে আজকে আর মেজ বোনের কোন কষ্ট হলোনা। কারণ সে-তো আজকে পরী মায়ের দয়ায় পেট পুরে মজার মজার খাবার খেয়ে এসেছেন। এভাবে কিছু দিন চলার পর রানী-মা, বড় বোন ও ছোট বোনকে ডেকে বললেন,
-মেজ, বাড়িতে এসে কোন খাবার খাচ্ছে-না। অথচ দিন দিন সে আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। তার স্বাস্থ্যও ভালো হচ্ছে। ছোট, আগামী কাল তুমি মেজর সঙ্গে মাঠে যাবে । দেখবে সে কী-খায়। কেন সে বাড়িতে ফিরে এসে খাবার খায়-না।
পরের দিন মেজ বোনের সঙ্গে ছোট বোনও মাঠে ছাগল নিয়ে গেলেন। মাঠের নির্মল বাতাসের প্রশান্তিতে ছোট বোন গাছের গুঁড়িতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়েছে। মেজ বোন ছোট বোন জেগে আছেন কিনা পরীক্ষা করার জন্য বললেন,
-ছোট বোন, ছোট বোন, দেখ-তো দক্ষিণ কোন?
ছাট বোন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এই সুযোগে মেজ বোন পরী মায়ের শেখানো মন্ত্র পড়ে খাবার খেয়ে নিলেন। এর পর ছোট বোনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাড়িতে ফিরে এলেন। বাড়িতে আসার পর রানী মা ও বড় বোন, ছোট বোনকে জিজ্ঞাসা করলেন।
-কিছু দেখতে পেলি?
-জী-না, মা। আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম ।
মা বললেন,
-তুই আসলে একটা বোকা মেয়ে। কাল তোর বড় বোনকে পাঠাবো।
পরের দিন বড় বোন মেজ বোনের সঙ্গে গেলেন। বড় বোন ছিলো খুব দুষ্টু বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ । সে ঘুমের ভান করে জেগে রইলেন। বড় বোনকে ঘুমাতে দেখে মেজ বোন বললেন,
-বড় বোন, বড় বোন, দেখ-তো দক্ষিণ কোন?
বড় বোন জেগে থাকা সত্ত্বেও চুপ করে থাকলেন। এতে মেজ বোন মনে করলেন, বড় বোন ঘুমিয়ে পরেছে। এই সূযোগে, সে মন্ত্র পড়ে খাবার খেয়ে নিলেন। তবে বড় বোন সম্পূর্ণ ব্যাপারটা-ই দেখলেন। কিন্ত মেজ বোনকে কিছুই বুঝতে দিলেন-না। বাড়িতে ফিরে বড় বোন, রানী-মা ও ছোট বোনকে বিস্তারিত খুলে বললেন। রানী-মা কথা গুলো শুনে খুব রেগে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছাগলটিকে হত্যা করে ফেললেন। এতে মেজ বোন কষ্টে ও দুঃখে একা একা আবার সেই নির্জন মাঠে যেয়ে, সেই গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। মেজ বোনের কান্না শুনে পরী মা আবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে উড়ে নেমে এলেন। এসেই মেজ বোনকে বুকে জড়িয়ে আদর করে বললেন,
-ওগো, মেয়ে! তোমার কি হয়েছে? এভাবে কান্না করছো কেন? কেঁদো-না সোনামণি! তোমার কান্না আমি সইতে পারিনা!
মেজ বোন বললেন,
-পরী মা, গতকাল আমার সঙ্গে আমার বড় বোন এসেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, সে ঘুমিয়ে পরেছেন। আসলে সে ঘুমের ভান করে জেগে ছিলেন। আমি তোমার শেখানো মন্ত্র পড়ে যেভাবে খাবার খেয়েছি, তার সবটাই সে দেখে রানী মায়ের কাছে বলে দিয়েছেন। এসব শুনে রানী মা রেগে ছাগলটিকে হত্যা করে ফেলেছেন। এখন আমি কি করবো পরী মা? আমার এখন কী হবে পরী মা?
পরী মা বললেন,
-তুমি শান্ত হও মা-মণী। কেঁদো-না। আমি একটা উপায় বের করছি। যাতে তুমি এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারো।
পরী মা, তার নরম ঝলমলে কাপড় দিয়ে মেজ বোনের চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন। বুকে ভিতরের সবটুকু মমতা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-তুমি বাড়িতে যেয়ে মায়ের কাছ থেকে ছাগলের কলিজা-টা চেয়ে নিবে এবং সেটা তুমি তোমার ঘরের সামনে পুঁতে রাখবে। এরপর দেখবে তোমার এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি মিলবে।
পরী মায়ের কথা মতো মেজ বোন মায়ের কাছে ছাগলের কলিজা-টা চাইলেন। মা কলিজা-টা মেজ বোনের দিকে ছুড়ে দিলেন। মেজো বোন অনেক যত্নে কলিজা-টা কুড়িয়ে নিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। যেনো এটা তার সেই ছাগল ছানা। তার সন্তান। তারপর কলিজা-টা অনেক যত্ন করে তার ঘরের সামনে পুঁতে রাখলেন। পরের দিন সকালে মেজ বোন ভীষণ ভীষণ অবাক হলেন । যেখানে ছাগলের কলিজা পুঁতে ছিলেন সেখানে এক অপরূপ গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছের পাতা রূপার। ফুল সোনার আর ফল হিরার। এই অপূর্ব গাছটি দেখে রানী মা, বড় বোন, ছোট বোন মহা উল্লাসে ছুটে এসে বলতে শুরু করলেন,
-এ-গাছ, আমাদের। আমরা এর ডাল ভাঙবো। পাতা ছিঁড়বো। ফুল তুলবো। ফল পারবো। যখন তারা গাছের দিকে হাত বাড়ালেন, তখন গাছ তাদের নাগালের বাইরে আরো অনেক অনেক উপড়ে উঠে গেলো। মেজ বোন গাছের কাছে এসে দাঁড়াতেই আবার গাছ নিচে নেমে এলো। মেজ বোন ছিল খুবই উদার মনের একজন মানুষ। সে তখন রানী মা ও দুই বোনকে ইচ্ছে মতো ফুল ও ফল পেরে দিলেন।
রাজ বাড়ির পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এক রাজ কুমার যাচ্ছিলেন। এমন অদ্ভুদ ধরনের গাছ দেখে, সে গাছের কাছে এসে বললেন ,
-এমন সুন্দর গাছের মালিক কে? আমাকে একটি ছোট ডাল দিবেন?
বড় বোন আর ছোট বোন এসে বললেন,
-এই গাছ আমাদের। আমরা আপনাকে এর ডাল ভেঙ্গে দিব ।
দুই বোন গাছের দিকে হাত বাড়াতেই, গাছ আবার উপড়ে উঠে গেলো। মেজ বোন এসে বললেন,
-এই গাছ আমার । আমি আপনাকে এর একটি ডাল দিব।
মেজ বোন গাছের দিকে হাত বাড়াতেই গাছ নিচে নেমে এলো। মেজ বোন তখন অনেক সুন্দর একটি ডাল ভেঙ্গে রাজ কুমার-কে উপহার দিলেন। রাজ কুমার মেজ বোনের এমন ভদ্র ব্যাবহার ও এতো সুন্দর একটি গাছের ডাল পেয়ে খুবই মুগ্ধ হলেন। মেজ বোনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন ,
-আমি আপনার সৌন্দর্য ,সুন্দর ব্যাবহার ও এই উপহার পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। আপনি আমার কাছে কী চান বলুন?
মেজ বোন বললেন,
-আমি এখান থেকে মুক্তি চাই। আমাকে আপনি মুক্তি করে দিন।
রাজ কুমার প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন এবং মেজ বোনকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে রাজী হলো। ঠিক সে সময়ে আকাশ আলো করে নেমে এলেন সেই পরী মা। পরী মাকে দেখে রানী মা, বড় বোন, ছোট বোন খুবই অবাক হলেন। পরী মা এসে বিস্তারিত ভেঙ্গে রাজ কুমার-কে খুলে বললেন। পরী মায়ের কথা শুনে মেজ বোনের প্রতি রাজ কুমারের মায়া আরো বেড়ে গেলেন। পরী মা তখন অপরূপ রূপের বিয়ের পোশাকে মেজ বোন ও রাজ কুমারকে সাজিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। রাজ কুমার, ময়ূর-পঙ্খী ঘোড়ায় চড়িয়ে, মেজ বোনকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। পরী মা বিদায় জানিয়ে চারদিকে আলো ছড়িয়ে আকাশে উড়ে গেলেন। মেজ বোন ও রাজ কুমার চলে যাওয়ার পর রানী মা, বড় বোন ও ছোট বোন মিলে আনন্দ করতে থাকলেন। তারা বলতে থাকলেন,
-আপদ বিদায় হয়েছে। আমরা এখন ইচ্ছা মতো এ গাছের ফুল ও ফল পারতে পারবো। পরের দিন ঘুম থেকে জেগে রানী মা, বড় বোন ও ছোট বোন দেখতে পেলেন যে, গাছের জায়গাতে কিছুই নেই। তারা তখন তাদের ভুল বুঝতে পেরে কান্না শুরু করে দিলেন। আর সেই গাছ মেজ বোনের প্রাসাদের সামনে এসে উঠে দাঁড়িয়েছে । এই অপরূপ সুন্দর গাছ দেখে রাজ কুমার ভীষণ ভীষণ খুশি হলেন । এর পর থেকে মেজ বোন রাজ কুমারের সঙ্গে সুখে দিন যাপন করতে থাকলো। সাত রাত, সাত দিন বিয়ের আনন্দ ও খানা-পিনা চলতে থাকলো ।
‘ পরবাসী ব্লগ.কম ‘, তোমাকে অভিবাদন, আমাকে তোমার ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে।
হাফিজ ভাই, অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন। ধন্যবাদ আমার শ্রদ্ধার বোন, ফারজানা নাজ শম্পাকে। এতো আলোকিত ও বড় হৃদয়ের মানুষ তিনি যা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আর হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল। সত্যি-ই আমি ভাগ্যবান, এতো ভালো ভালো কিছু আলোকিত মানুষদের সান্নিধ্যে আসতে পারার জন্যে। মানবিকতা আর সহমর্মিতা বিহীন অবহেলা আর অবজ্ঞার মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা আর পথ চলা। আজকে ভীশন ভালো লাগছে! ভীশন!
ধন্যবাদ ও শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় হাফিজ ভাই, ফারজানা নাজ শম্পা, পরবাসী.কম-এ যুক্ত সকল ভাই-বোন, বন্ধু ও পাঠকদের জন্যে।
মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির
বাংলাদেশ
মোবাইল নং +৮৮০১৮৩২৮৩৭০৯৩