বহু বছর আগে সেই যে শুরু হলো আমাদের যুগল দৌড় এক অদ্ভুত মায়াবী আমেজে
মাঘ মাসের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় জন্মানো সেই যুগল দৌড় যা অদ্যাবদি চলছে, ছুটছে
এই সুসভ্য শীতের দেশে, ভিন্ন বেশে, ব্যাস্ততার লেবাসে তবে সুশৃঙ্খল গতিতে
সেল ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে ওঠো, লাঞ্চ রেডি করো, আবার সেই দৌড়
কখনো বাসে, কখনোবা গাড়িতে, পায়ে হেঁটে দৌড় আর দৌড়।

হাইস্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমার ডান পা রনজুর বাম পায়ের সাথে
পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে ছুটলাম জোড়া পায়ে দৌড়, অন্যপ্রান্তে ড্রিল স্যার, পন্ডিত স্যার
নিরীহ মওলানা স্যার ফিতা ধরে অপেক্ষায় থাকে ফাস্ট সেকেন্ড থার্ড -কে কে হয় ধরবে,
জীবনে কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় ফাস্ট সেকেন্ড থার্ড হতে পারিনি, দৃঢ প্রত্যয়ে
দাঁতে দাঁত চেপে রনজুর সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াই, আরও জোরে আরও জোরে,
মাঝ মাঠে কারো ল্যাং খেয়ে হোক বা মাঠের অমসৃণতার কারণে হোক অথবা
ভুল স্ট্রাটেজির কারণে হোক, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম মুখ ধুবড়ে
যুগল দৌড়ে আমার আর রনজুর পুরস্কার পাওয়া হলো না।

সংসারের জুগল দৌড়ে উইকেন্ডেও দম ফেলার সময় নেই, ঘরদোর পরিষ্কার করো,
লন্ড্রি করো, হয় ঘরে গেষ্ট এন্টারটেইন করো নয়তো গেস্ট হয়ে এটেন্ড করো বন্ধুদের বাসায় আড্ডায়,
এমনকি দূরে বিচের শান্ত নীল পানিতে সানসেট দেখতে যেয়েও থাকতে হয় দুশ্চিন্তায়
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরো, খাবার রেডি করো পরের দিন আবার সেই দৌড়।
তবে, এই সংসার মাঠের ওপর প্রান্তে সেই হাইস্কুলের মতো স্যারেরা ফিতা ধরে
ফাস্ট সেকেন্ড থার্ড ধরার জন্য সার বেঁধে বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে না, এখানে মাঝ মাঠে
হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ছেলেবেলায় স্কুল মাঠের পাশে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বড়লোকদের বাগান থেকে
শহীদ মিনারের ফুল চুরি করে ধরা না পড়ার ভয়ে ভোঁ দৌড়, প্রজাপতি পেছনে
অথবা খাল বিল পেরিয়ে দলবল বেঁধে হাপাতে হাপাতে কাটা গুড্ডির পেছনে দৌড়
তবে, সবাইকে অবাক করে সেই গুড্ডি কিনা গোত্তা খেয়ে ভাসতে ভাসতে পড়লো
প্রাচীর ঘেরা চৌধুরী বাড়ির সীমানায় যেখানে বারান্দায় ফর্সা মানুষেরা বেতের চেয়ারে বসে
চা খেতে খেতে আমাদের হতাশার দৌড় উপভোগ করে। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো
চৌধুরী বাড়ির মেঝো ছেলে অলস ভঙ্গিতে চেয়ার থেকে উঠে কাটা গুড্ডিটি সহজেই ধরে ফেললো।
নীল বেদনায় অতৃপ্ত আমরা আবার নতুন করে শুরু করি বাড়ি ফেরার দৌড়।

বহুদিনের তামাকের আচড়ে আমার কালচে ফুসফুস, মেদে স্ফীত নাড়িতে রক্তে
কোলেষ্টলের নাচন, মূত্রের সাথে সুগারের হুমকি, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পূর্বাভাস
আমার দৌড়কে সাময়িকভাবে পাওয়ার সেভিং মোডে স্ট্যান্ডবাই করে রাখলেও ভেতরে ভেতরে
আমার দৌড়ের প্রস্তুতি চলে, সরবে অথবা নীরবে। তবে মাঝে মাঝে ছোটবেলার সেই
চৌধুরীর বাড়ির প্রাচীর ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো করে আবারো থমকে দাড়াই,
COVID -এর করাল থাবায় যদি তলিয়ে যাই অতল গহব্বরে, আর যদি ছিড়ে যায়
আমাদের বহু বছরের যুগল দৌড়ের শক্ত বন্ধন ???

এক থেকে দুই অথবা দুই থেকে এক হওয়ার দিনে মনে পড়ে কত শত প্রতিশ্রুতি
একটিও পারিনি মেটাতে, মনের ভিতরে গুমরে উঠে আরও বেঁচে থাকার লোভী আকুতি
দৌড়াতে থাকি, আরও জোরে আরও জোরে পৌঁছাতে হবে দুজনে একসাথে সঠিক গন্তব্যে,
শান্তির নীড়ে, শ্রেণীহীন এক সমাজ কাঠামোর ঠিকানায়,দৌড়, আরও জোরে আরও….

(ছবিঃ -সৌজন্যে Google)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকানাডা ইমিগ্রেশন প্রসেসিং এর দীর্ঘসূত্রিতা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
পরবর্তী নিবন্ধকিছু ভাবনা-পর্ব ২
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন