লেখক সাংবাদিক জাহানরা পারভীনের হৃদয় থেকে উছলে পড়া আবেগ, অভিমান, প্রেম, স্মৃতি,দর্শন, জ্ঞান এবং অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি “স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি”
বইটির প্রতিটি শব্দকে জীবন্ত করেছে। পৃথিবীর মহামারীর এই অবশ করা দিনগুলোতে, আর্থিক অনিশ্চয়তার ছায়ার আতঙ্কে কাঁপতে থাকা দুর্বিসহ এই মূহুর্তে নিত্যজীবনের টানাপোড়েনের মাঝে স্পর্শকাতর অনুভূতি এবং গভীর জীবনবোধের সতেজ আহ্বান নিয়ে এলো “স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি”। আমার মত নবীন পাঠকের কাছে এটি অবশ্যই একটি কাব্যগ্রন্থ যার অন্তমিল, গঠন, দৈর্ঘ্য কোনওটিই পদ্যের মত নয়, তবু একটি অন্তর্নিহীত অর্থবহ বার্তায় ঠাসা অত্যন্ত শক্তিশালী কবিতার থেকে কোনও অংশে কম নয় এই দীর্ঘ্য কবিতা।
কোনও এক বিরল সৌভাগ্যের বশে বইটির একটি অনলাইন কপি আমার হাতে এসে পৌছে। প্রথমে ভাবছিলাম, এত বড় কাব্যগ্রন্থ- হয়ত কিছুক্ষণ পরেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলব। কিন্তু একটি একটি শব্দ বেয়ে যতই এগিয়ে যেতে থাকলাম ততই মনে হল অনুভূতিহীন রসকষহীন পরিচিত পৃথিবী ভেদ করে যেন এক আবেগপ্রবণ স্পর্শকাতর মায়ার পৃথিবীর দিকে ধাবিত হচ্ছি। শেষ শব্দটি পর্যন্ত ক্ষুধার্ত বাঘের মত হামলে পড়ে গিলে খেয়েছি, তাও দুই বার। জাহানারা পারভীনের সাথে চলে গেছি তাঁর শৈশবে, তাঁর গ্রামে। তাঁর চোখ দিয়ে দেখেছি প্রকৃতি ও গনমানুষের নিত্যজীবনের সৌন্দর্য্য।বুনোহাঁস, শিশু, জেলে, কুমির, পিঁপড়ে, রাজমিস্ত্রী, বাজপাখি আরও কত শত চিত্রকল্প।
চারখন্ডে বিভক্ত বইটির প্রথমেই যে বিষয়টি অনুভূত হয় তা হল অভিমান।প্রতিটি কথায় উঠে এসেছে গভীর প্রেমবোধ, যেখানে ক্রোধের সময় পার করে মন খারাপের পরে কেবল রয়ে গেছে নিরবিচ্ছিন্ন বিষন্ন অভিমান।প্রেম যেখানে মৃত তবু ভালোবাসা হয়ত এখনও প্রানোজ্জ্বল-
“শব্দের বিষাক্ত তীর ছুঁড়েছে যে, সে তুমি নও অন্য কোনও জন।”
হৃদয় নিংড়ানো ব্যার্থ সম্পর্কের শোক পালনে সময় সম্পর্কের সমাপ্তিতে যে অভিমানের রেশ থেকে যায় তারই প্রতিফলন বোঝা যায় পুরো বইটি জুড়ে-
“চলেই তো যাব। আয়নার কাছে রেখে যাব সাদা খাম, অগ্রন্থিত পান্ডুলিপি, স্থাবর, অস্থাবর যত ক্রোধ, প্রেম,ভুল। তার জন্য তুলে রেখ ক্ষমা। যত অবহেলা, ত্রুটির মিনার গুঁড়িয়ে দিও স্নেহে।”
মনের আকাশের এই কাজল মেঘ হৃদয় ভারাক্রান্ত করে। ফেলে আসা সকল সম্পর্কের স্মৃতি উজ্জীবিত করে এক উদাস হাহাকারের সৃষ্টি করে।
“যৌথবাসের দিন ব্যার্থ হলে কী আর থাকে বাকি?”
মনে হয় আমার নিজের না বলা কথাগুলো কবি কোনওভাবে বুঝতে পেরে ঢেলে দিয়েছেন কাগজের গালিচায়। বইটি শেষ করার অনেক পরেও বিষন্ন মুগ্ধতা ডুবিয়ে রেখেছে অনেকটা সময়।
হৃদয়ের কথা, ভালোবাসা ও অভিমানের কথা বলতে বলতে কবি প্রকৃতির সাথে যে একাত্বতার বর্ননা দিয়েছেন তা অসাধারন। মনসপটে এঁকে চলেছেন নগর গ্রামের চিরায়ত ছবি যেখানে স্থান পেয়েছে ফুল, গাছ, পাখি ও মানুষ। চমৎকার চিত্রকল্পের মাধ্যমে বর্ননা করেছেন প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক। গাঢ় অভিমানে বলেছেন-
“যদি পার, সেরদরে বেঁচে দিও সকল অসুখ। আমি কেয়ামত পর্যন্ত শুয়ে থাকব গাবগাছের নিচে। কোন কোন ভোরে এক একটি গাবফুল ঝরে পড়লে ধরে নেব, বৃক্ষরা অন্তত বোঝে কঙ্কালের মন।”
বইটির প্রতিটি পাতা প্রমান করে কবি প্রকৃতিকে তাঁর নিজের একটি অংশ বলে মনে করেন। অত্যন্ত রোমানেটিক কবি তাঁর অনন্য চোখে দেখেন আসলে প্রকৃতি মানবেরই এক অংশ কিংবা হয়ত মানব প্রকৃতিরই একটি অংশ। তাই আপন মনে হয়ত কবিতার পঙক্তির মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর প্রকৃতি স্বত্তার সাথেই কথা বলে চলছেন আর এই কবিতা পড়ে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে আমিও যেন এই অনবদ্য কথপকথনের একটি অংশ।
মানবিকতা এবং মানব সভ্যতার ইতিহাস, গূঢ় বার্তা এবং অন্তর্নিহিত দ্বন্দ কাব্যগ্রন্থটির আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট। সহস্র বছর ধরে মানুষের যে নিপীড়ন, অত্যাচার, যুদ্ধ এবং সংগ্রাম সহ্য করেছে, কবি অত্যন্ত সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন সেই বার্তা।মানুষের অত্যাচারে বিক্ষত মন নিয়ে তিনি বলেছেন-
“হয়ত দেশহীন শিশুদের মৃতদেহ থেকে ফোটা ফুল একদিন ঈশ্বরের ডাকনাম ধরে কেঁদে উঠবে।”
এই বাক্যের সাথে কান্না আর ক্রোধের সংমিশ্রনে আপ্লুত হয়েছে পাঠক মন। অত্যন্ত সরল ভাষায় অকপটে লিখেছেন সাদা চোখে লুকিয়ে থাকা চরম সত্য।
“অক্ষর, জন্ম, মৃত্যু আর ধাঁধার কিহিনি পড়ে জেনেছি মূর্খতাই মূলত জ্ঞান।”
ইতিহাস, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নির্মম ইতিহাস এবং তার ভয়াবহ পরিনাম বর্ননা করেছেন তিনি। আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছেন কত কষ্টে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা এবং আদৌ কি আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি? ধর্ম ও সাপ্ম্রদায়িকতার নামে রাজনৈতিক গদির লোভে যে সংঘর্ষ হয় তাতে করে মরে কেবল সাধারন মানুষ। দেশের বুক ভেঙে অর্থ আদায় করে লোভী ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ।
“আরও কিছু মানুষ ভেসে গেছে সীমান্তবর্তী নদে। কারো হাত নেই, কারো পা, কারো চেরা বুক থেকে বেরিয়ে এসেছে নাড়ি। খড়কুটোর সাথে ভাসছে চোখ। মানচিত্র নয়, ভাগ হয়েছে কপাল। সাম্প্রদায়িকতার জলে ভেসে শেয়াল কুকুরের খাদ্য হওয়া মানুষের কাছে কি উত্তর রেখে গেছে ভারতবর্ষ? ধর্মই জীবন মৃত্যুর নির্দেশক শুধু?”
বাংলার স্বাধীনচেতা সংগ্রামী মানুষের ইতিহাসকে ভিত্তি করে আজকের স্বার্থপর অলস দেশপ্রেমহীন নাগরিকদের প্রতি কবি বলেছেন-
“ অনুজ্জ্বল আলো কুড়াতে কুড়াতে ধরেই নেই বিপ্লব, ভাষাসংগ্রাম আর রক্তাক্ত ৭১ পেরিয়ে আমাদের দেশপ্রেম গনগনে সূর্য থেকে অনুজ্জ্বল চাঁদ।”
হতাশাগ্রস্থ সাধারন জনগনের মনের কথা আর বর্তমান পরিস্থিতি বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন-
“অবসাদ তাড়াত পিছু নিই প্রবাসী বনমোরগের। তার দেশে নাকি মানুষের দুর্গতিতে বুক পেতে দেয় মানুষ।”
কবির মতে মানুষ হয়েও আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের মানবিকতা। কবি একজন কুমিরের চোখ দিয়ে যখন মানুষের দিকে তাকান তখন হিংস্রতা ছাড়া আর কিছুই দেখেন না।আর এই হিংস্রতার ফলাফল যে কি ভয়াবহ হতে পারে তা মানুষের বোধগম্য হয় না।
“কুমিরের লাশ ঘেরা মানুষেরা প্রশংসা করছে হন্তারক জেলের। মাঝরাতে সেই জেলের দরজায় কড়া নাড়ে মা কুমির। বসে থাকে পুত্রশোকে, প্রতিশোধের অপেক্ষায়।”
একইভাবে তিনি পিঁপড়ে, হাঁস, হাতি ও বাজপাখির কথা বলেছেন। তাদের আত্মার সাথে একত্মিত হয়ে রচনা করেছেন তাদের আখ্যান।আমরা সাধারন মানুষ যা চিন্তাও করি না কবি তাই বলে দিয়েছেন। আর এই চিন্তাভাবনা যখন পাঠকের মাথায় ঢোকে তখনই সে তার ব্যাক্তিগত দ্বন্দ থেকে বের হয়ে সেই বৃহৎ পৃথিবীর একটি অংশ বনে যায়। আমিও বনে গেছি।
কবি নজরুলের “বিদ্রোহী” কবিতার পরে আমি অন্তত আর কোনও কবিতা পাই নি যেখানে এত পৌরানিক, ঐতিহাসিক ও নানা ধর্মীয় ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। কবি সেই মানব ইতিহাস ও ধর্মের প্রথমের ভাতৃহন্তক কাবিলের ঘটনা থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্ম, সনাতন ধর্মের নানা ঘটনা, যিশুর জীবনের গল্প, গৌতম বুদ্ধের পরিবারের কথা উল্লেখ করেছেন। গ্রীক মিথলজি থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপকথার রেশ টেনে তিনি সংযোগ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায় যেখানে রয়েছে সূচকুমারের কথা, কাঁকনদাসী, ক্ষুদিরাম,বখতিয়ার,প্রমিথিউস, নিরো, ট্রয়ের ঘোড়া,খনা, ইদিপাস, শশাঙ্ক, সোহরাব-রুস্তম,পিরামিড নেপোলিয়নসহ বহু বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিপ্লবীদের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন সূর্যসেন, বাবরি মসজিদ, রোহিঙ্গা, আনা ফ্রাংক, ম্যান্ডেলা,সীমার, এজিদ বাহিনী, শেরপাদের সহ আরও অনেকের কথা। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের কথা বর্ননা করেছেন নায়াগ্রা, বাগদাদ, চীনের প্রাচীর, বেথেলহেম, ব্যাবিলন, নালন্দা,জিব্রাল্টা, মিশর এবং আরও অনেক স্থানের কথা যা লিখে শেষ করা যাবে না।
তাই একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে বিশ্ব ইতিহাস, দর্শন এবং বর্তমান পৃথিবীর অবস্থানের এক সত্য ও সরল আখ্যান এই ৮৩ পৃষ্ঠার বই এ অত্যন্ত গোছানোভাবে বলা হয়েছে।চমৎকার ঝকঝকে প্রচ্ছদের এই “স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি” বইটি আসলেই যেন একটি পরিপূর্ণ স্কুল। বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ভূবনে এই বইটি অবশ্যই একটি উজ্জ্বল সূর্য হয়ে পাঠকমনকে আলোকিত করবে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারন আমি একজন নিছক পাঠক হিসেবেই আমার মন্তব্য করছি। আমি কোনও সাহিত্য ও কবিতার সমঝদার সমালোচক নই। অনেকদিন পরে এমন একটি বই এর সাথে আত্মার সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
আপনারা অবশ্যই বইটি পড়ে দেখবেন।