শম্পার বাবা মুখাবয়বে একটি পরিচ্ছন্ন ব্যাক্তিত্বের ছাপ ফুটিয়ে ভদ্রতা সূচক মৃদু হেসে আমার দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ কি অবাক হয়েছো বুঝি, আমাকে দেখে , আমি শম্পার বাবা, তুমিতো কাল ঢাকা থেকে আসার পথে ফুডভিলেজে আমার মেয়ের ফেলে আসা ব্যাগ দৌড়িয়ে আমার হাতে ফেরত দিলে?’

আমি তড়িৎগতিতে হাত এগিয়ে হ্যান্ডশেক করতে করতে দ্রুত পরিস্থিতে বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম। তারমানে ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে, ভদ্রলোক যেহেতু মুখে হাসির একটি সুক্ষ রেখা ঝুলিয়ে রেখেছেন, ওদিকে শম্পা শুখনা মুখে গাড়িতে বসে আছে যার মানে হতে পারে উনি গতকালের শম্পার ব্যাগের মধ্যে আমার চিরকুট লেখার ব্যাপারটি জেনে গেছেন এবং হয়তো কৃতজ্ঞতা সূচক এসেছেন আমাকে নাটক/সিনেমার মতো বলবেন , ‘তুমি আমার মেয়ের ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে অনেক উপকার করেছো, এই পাঁচ শো টাকার নোট দুটি রেখে দাও। শুনেছি বগুড়া শহরে ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়, বন্ধুদের নিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিও, আর হ্যা, এই আমার বিজনিস কার্ড টি যত্ন করে রেখে দাও চাকরির সমস্যা হলে দেখা কর। কিন্তু খবরদার, আমার মেয়ের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাবে না।’

শম্পার বাবা এবার আগের চেয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে আরো খানিকটা হাসিমুখে আমাকে যা বললেন তা শুনে আমি আরও খানিকটা কনফিউসড হয়ে ধন্দের মধ্যে পড়ে গেলাম। উনি বললেন, ‘এসো বাবা, গাড়িতে উঠে এসো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা না বলে ওই মিউজিয়ামের পাশেই রেস্ট হাউজ আছে ওখানে যেয়ে ধীরে সুস্থে কথা বলা যাক।’ আমি অসহায় কোরবানির গরুর মতো বন্ধু নান্টুর খোঁজে আসে পশে তাকিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। নান্টু জ্বলন্ত সিগারেট হাতে রেখে মুখ হা করে হতবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নান্টুকে আমি সুদূর বগুড়া শহর থেকে ট্যাম্পতে চড়িয়ে এই মহাস্থান গড়ের কাছে নিয়ে এসেছি যাতে কিছুটা মনে সাহস বাড়ে, অপরিচিত জায়গায় প্রেম করতে যেয়ে ঝামেলা টামেলা হলে যেন ম্যানেজ করতে পারে। ওর সাথে গাড়ি ভাড়া নেই। তাই হয়তো আমাকে শম্পাদের গাড়িতে উঠতে যেয়ে ব্যাচারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে।

মহাস্থানের মিউজিয়ামের পাশে যে এতো সুন্দর একটি রেস্ট হাউজ আছে ভিতরে না ঢুকলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। লোহার গেট পেরিয়ে চারিদিকে রকমারি মনমাতানো বাহারি সব ফুলের চমৎকার বাগান। বাগানের মাঝের দিকে সামিয়ানার মতো শেডের নিচে বসার জন্য সফা বিছিয়ে রেখেছে। আমরা মানে আমি শম্পার বাবা, শম্পা সেই শেডের কাছে আসতেই দেখি এক সুন্দরী ভদ্র মহিলা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে একটি ম্যাগাজিন পড়ছিলেন, আমরা আসতেই আমাকে বসার ইঙ্গিত করে বললেন, ‘বসো বাবা, আমাকে নিশ্চয় চিনতে পেরেছো, আমি শম্পার মা, গতকালই আমরা একই বাসে ঢাকা থেকে বগুড়া এলাম।

গতকাল ঢাকা থেকে আসার পথে ফুড ভিলেজে শম্পাকে খুব কাছ থেকে দেখার পরে এবং আমার দিকে তাকিয়ে ওর সেই অনিন্দ্য সুন্দরী মুখে মিষ্টি হাসি দেখে আমার শরীরে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিলো তার চেয়ে শত সহস্র গুন্ বেশি বিদ্যুৎ আজ আমার মাথায় প্রবাহিত হতে লাগলো, কোথা থেকে কি হতে চলেছে আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। শম্পার বাবা শম্পার মায়ের পাশে বসে পড়েছেন, পাশের সোফাটিতে শম্পা বসেছে। আর কোনো তৃতীয় সফা এখানে নেই। অর্থাৎ আমাকে বসতে হলে শম্পার পাশেই বসতে হবে। শম্পা থেকে ভদ্রতার  দূরত্ব বজায় রেখে আমি বসতেই বসন্তের হালকা বাতাসে দামি মেয়েলি সেন্টের সুবাসের মৌমৌ গন্ধে আমার মাথা আরও খানিকটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো।

শম্পার বাবা হাতে ইশারা করতেই রেস্ট হাউজের একটি বয় তড়িঘড়ি করে ছুঁটে এসে বললো এলো, ‘জি স্যার কিছু লাগবি হামাক খালি কন, হামি এক ঘুড়িত লিয়া আসিচ্চি।’
-‘ভিতরে যেয়ে বলো, আমি আগেই বলে রেখেছি সেই মতো লাঞ্চ রেডি করে যেন এখনই এখানে পাঠিয়ে দেয়, আর এই ছেলেকে সাথে নিয়ে হাতের ডান দিকে ভি আইপি রুমটি দেখে দাও।’
শম্পার বাবা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা, ওর সাথে রুমে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এসো, আমরা লাঞ্চ খেতে খেতে গল্প করি। এবার শম্পা আমার দিকে তাকিয়ে আবার সেই মিষ্টি করে মুখ টিপে হাসলো। আমি এই অচেনা ছেলেটির সাথে ভি আইপি রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছি খেলার মোড় সম্ভবত ঘুরে গেছে, শেষ ওভারে ছয় বলে তিন রান দরকার, রানের চেয়ে বলের সংখ্যা দ্বিগুন, বাউন্ডারি না হাঁকিয়ে হেসেখেলে ধীরে সুস্থে সিঙ্গেল নিয়ে ম্যাচ জেতা সম্ভব।

লাঞ্চের বিশাল আয়োজন। মোরগ পোলাও, ভাজা ইলিশ মাছের বড় বড় পেটির ওপরে কিছুটা পিঁয়াজের কুচি বেরেস্তার মতো করে ভেজে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে, একটি বড় ডিশে আস্ত মুরগির রোস্ট, আরেক ডিশে খাসির মাংসের রেজালা, আরেক ডিশে ইয়া বড় বড় চিংড়ি মাছের ভুনা, আরেক প্লেটে পটল লম্বা লম্বা করে ভেজে সুন্দর করে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। আরেক ডিশে ভেজিটেবল আর মুরগির বুকের দিকের মাংস দিয়ে রান্না করা পাস্তা, আরেক বড় ডিশে চিকন চালের সাদা ভাত, আরেক বাটিতে কাঁচা আম দিয়ে ঘন ডাল, আর সব চেয়ে কোনার দিকে একটি বাটিতে লাল মরিচ দিয়ে করা আলু ভর্তা।

শম্পার মা খানিকটা সাদা ভাত আর পটল ভাজি আর একটুকরা খাসির মাংস প্লেটে নিয়ে কাটা চামিচ দিয়ে খাওয়া শুরু করে আমাকে বললেন,’ বাবা, লজ্জা করবে না তোমার যেটা পছন্দ সেটাই ইচ্ছামতো নিয়ে খেতে থাকো, আর হ্যা কাটা চামিচ দিয়ে খেতে অভ্যাস না থাকলে হাত দিয়েই খাও, কোনো অসুবিধা নেই। ওদিকে নান্টু যে কোথায় কি করছে আমার কোনোই ধারণা নেই, বেচারা হয়তো না খেয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে হর হর করে বমি করছে। আমি প্লেটে বিরানি, আলু ভর্তা আর একটি ইলিশ মাছের ভাজা পেটি নিয়ে খেতে খেতে ভাবছি, এদের ভিতরের অভিসন্ধি কী, আমাকে জব্দ করার কোনো বড়লোকি ফাঁদ নয়তো !!’

শম্পার বাবা শুরু করলেন, ‘তুমি হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছো, আমরা কেনইবা তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি। তার আগে আমাদের বিষয়ে কিছুটা বলে রাখি। আমরা কানাডার টরেন্ট শহরে থাকি। বগুড়ার মালতি নগরে আমার বাবার বাড়ি। এখন অবশ্য আমাদের সেই বাড়ির কোনো চিহ্ন নেই, আমি দেশে টাকা পাঠিয়ে বাড়ি করেছি। এছাড়া, ঢাকাতেও আমাদের একটি ফ্লাট আছে শ্যামলীতে। আমার একছেলে একমেয়ে। ছেলেটিই বড়, ও ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিটার ইঞ্জিনিয়ারিং পরে একটি ক্যারাবিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে বোষ্টনে থাকে। সংসারে আমার স্ত্রী আর আমার এই ছোট মেয়ে শম্পা। তোমার ব্যাপারে কিছুই শুনলাম না, কিছু বলবে বাবা, তোমার বাসা কোথায়, কোথায় বা কি করো, বাড়িতে কে কে আছে, খেতে খেতে বলো শুনি।

বহুদিন এতো আয়োজনের খাবার খাইনি। এতক্ষনে আমি কিছুটা আঁচ করতে পারছি, এরা আমার কাছে কিছু একটা গুছিয়ে দিতে চাচ্ছে। বড়লোকদের এই এক বদ অভ্যাস। চান্স পেলেই অন্য মানুষদের কিনতে চায়। হয়তো একটু পরে বলবে ,’বাবা আমার এই মেয়েটির একবার বিয়ে হয়েছিল, ওদের বিয়ে ভেঙে গেছে, তার পর থেকে আমার মেয়ে সব সময় ডিপ্রেশনে থাকে। তুমি যদি আমার মেয়েকে বিয়ে করো বাবা আমরা দুই / তিন মাসের মধ্যে তোমাকে কানাডায় নিয়ে যাবো, তোমার কি মত বাবা, কিছু একটা বলো।

আমি খাসির মাংস দিয়ে মোরগ পোলাও খেতে খেতে নিজের সম্পর্কে কী বলা যায় তা দ্রুত চিন্তা করে ফেললাম। যা বলবো গুছিয়ে বলতে হবে। কথাবার্তা এমনভাবে বলতে হবে যাতে শম্পাকে ও শম্পার বাবা মা -কে একসাথে ইম্প্রেসড করা যায়। বাবা মা জাতীয় মুরুব্বিদের ইমপ্রেস করতে হবে ইমোশোন্যাল কথাবার্তা বলে, আর শম্পার জন্য কিছুটা হিউমার মিশিয়ে কথা বলতে হবে। আমি শুরু করলাম:
,’আমার নাম আশিকুজ্জামান হৃদয়। আমার বাবা মনিরুজ্জামান বগুড়া ডিসি অফিসের এসিস্ট্যান্ট ক্লার্ক ছিলেন। ঠিক রিটায়ারমেন্ট যাওয়ার ছয় মাস আগে আমার অনেস্ট বাবাকে হেড ক্লার্ক পদে প্রমোশন দেওয়া হলো। সেদিন আমাদের বাসায় মুরগি জবাই করে পোলাও মাংস খেয়ে প্রচুর আনন্দ উৎসব হলো। খাওয়াদাওয়ার পরে বাবা আমার বুবুকে একটি গান গাইতে বললেন। বুবু ‘আয় খুকু আয় … আয় রে আমার কাছে আয় মা মুনি ..’ গান গেতেই আমাদের সহজ সরল বাবা কেঁদে ফেললেন। বাবার কান্না দেখে বুবুও গানের মাঝে কেঁদে ফেললেন, আমি, বড়ভাই, মেঝোভাই সবাই চোখ মুছতে লাগলাম। পাশের রুমে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মা চিৎকার করে বলছেন, ‘ কিরে খোকা তোরা এই হাসি ঠাট্টা করে মজা করছিস, এর মধ্যে আবার কান্নাকাটি কেন ?’

আমার বড় ভাই রোকনুজ্জামান ওরফে খোকা ইসলামিক হিস্ট্রিতে এম পাস্ করে বগুড়ার সপ্তপদী মার্কেটের উপরতলায় ফটোস্ট্যাটের ব্যবসা করতেন, ব্যাবসা তেমন ভালো না চলায় দোকানে কম্পিউটার বসিয়েছেন, মানুষ্য ইন্টারনেট ব্যাবহার করে, প্রিন্ট করে স্ক্যান করে ইত্যাদি। মেঝো ভাই রফিকুজ্জামান দুবার দুবার বি এ পরীক্ষায় ডাব্বা মেরে এক বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে মুরগির ব্যাবসা করে। বগুড়া থেকে মুরগি বাসের মাথায় করে নিয়ে ঢাকায় পাইকারি বিক্রি করে, ভালোই পয়সা। একবার হয়েছে কি, মেঝো ভাই আর সেই বন্ধু ঈদের আগে এক বিরাট চালান নিয়ে ট্রাক ভাড়া করে ঢাকায় যাচ্ছিলো, পথে এক ভ্যান গাড়িকে সাইড দিতে যেয়ে ট্রাকটি কাত হয়ে যেতেই ট্রাক থেকে কয়েকটি খাঁচা দড়ি ছিঁড়ে রাস্তায় পড়ে গেল। খাঁচাগুলি নিচে পড়ে শত শত মুরগি মহাসড়কে যে যেদিকে পারলো ছুঁটে পালাচ্ছে আর মেঝো ভাই আর উনার বন্ধু পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে, এই বলে আমি নিজের কথায় নিজেই বোকার মতো হাসতে লাগলাম কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম শম্পা হাসছে না। এমনকি মনোযোগ দিয়ে কথা না শুনে অনতি দূরে মহা সড়কে রংপুরের দিকে শো শো করে যাওয়া বাসগুলির দিকে তাকিয়ে আছে ।

এবার নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে আমার শেষ অস্ত্র ব্যাবহার করলাম। আমি কাচুমাচু করে বলা শুরু করলাম, ‘আমাদের ব্যাচে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে একমাত্র আমি একই সঙ্গে বুয়েট, সলিমুল্লাহ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কলেজে চান্স পেলাম। বুবু বললেন ডেন্টাল নিয়ে পড়তে। বিদেশে ডেন্টিস্টদের নাকি অনেক দাম। আমার আবার ওসব বিদেশ টিদেশ তেমন পছন্দ না, তাই পরে, বাবার কথা শুনে বুয়েটে ভর্তি হলাম।

কথার মাঝে শম্পার মা বললেন, ‘কেন বাবা, বিদেশের প্রতি তোমার এতো অপছন্দ কেন, জানতে পারি ? আমি মনে মনে খুশি হলাম। আমার ওষুধে কাজ হয়েছে। এঁরা এখন আমাকে বিদেশ সম্পর্কে অনেক পজিটিভ তথ্য দিয়ে আমাকে উল্টা ইমপ্রেস করতে চাইবে। আর তাই যদি হয় তাহলে এদের বড়লোকি গ্যাম প্ল্যান আমার কাছে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

আমি বিরানির পাঠ শেষ করে খানিকটা সাদা ভাত আর ডাল নিয়ে আলুভর্তা দিয়ে কায়দা করে দলা মেখে মুখে দিতেই শম্পা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আস্ত মুরগির রোস্টটি চাকু দিয়ে বিভিন্ন পিস পিস করে আমার প্লেটে একটি টুকরা তুলে দিলো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, আমার সামনে এই এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ, মেয়েটির মুখের একটি কথাও এখন পর্যন্ত শোনা হয়নি এ ভারী অন্যায়, আমি ভদ্রতার খাতিরে না না বলে বললাম,’আপনি নিন, আপনার প্লেটেতো, শুধু সাদা ভাত।

শম্পার বাবা আমার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললেন, ‘বাবা, আমার এই রূপবতী মেয়ে কথা শুনতে পায় না , জন্মের পর থেকেই ও বোবা। তোমাকে আমার এই মেয়েটির পছন্দ হয়েছে, সারা জীবনের জন্য ওর দায়িত্ব নিতে পারবে বাবা ?

আমার মাথায় যেন আস্ত আকাশ ভেঙে পড়লো। খাওয়া বন্ধ করে শম্পার দিকে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কতক্ষন তাকিয়ে থাকলাম জানি না, শম্পার বাবার কথা শুনে হুশ ফিরে পেলাম,’বাবা, তোমাকে আজকেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এমন না, বাসায় যাও, ধীরে সুস্থে তোমার বাবা, মা ভাইবোনদের সাথে কথা বলো, বন্ধু /বান্ধবদের সাথে কথা বলো তারপরে আমাকে জানাবে। আমার ফোন নাম্বার, বগুড়ার বাসার ঠিকানা তোমার জন্য আগে থেকেই এই কাগজে লিখে রেখেছি, পকেটে রেখে দাও, খাওয়া শেষ করে গাড়িতে ওঠো, তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিবো।

শম্পাদের গাড়ি মিউজিয়ামের গেট দিয়ে ধীর লয়ে বের হয়ে বগুড়ার দিকে এগিয়ে চলছে। মহাস্থানের মাজার পাশ কেটে যাওয়ার পথে দেখি নান্টু প্রানপনে হাত উঠে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে, বেচারার কাছে বাড়িও ফিরে যাওয়ার পয়সা নেই। কথা ছিল, ওকে আমি টেম্পো করে নিয়ে এসেছি আবার আমার সাথেই ফিরে যাবে। কিন্তু আমার শম্পাদের গাড়িতে ওঠায় ওর এখন চরম বিপদ। আমি শম্পার বাবাকে রিকোয়েস্ট করলাম, আমার সাথে আমার এক বন্ধু এসেছিলো, ওই যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ওকে সঙ্গে নেয়া যাবে?

শম্পার বাবা নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে নান্টুর কাছে যেয়ে গাড়ি থামালেন।

নান্টু গাড়িতে উঠেই কি বলতে চাচ্ছিলো, আমি সাথে সাথে মুখে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ওকে থামিয়ে দিলাম। দুপুর গড়িয়ে বেলা প্রায় তিনটার মতো বাজে। সূর্যের তীব্রতা কিছুটা কমে আসছে। তবে আমার – আর শম্পার সদ্য গড়ে ওঠা ভালোবাসার তীব্রতা হঠাৎ করে শম্পার বাবার শুধুমাত্র একটি কথায় হৃদয় থেকে উঠে এসে কণ্ঠনালীর কাছে এসে স্থবির হয়ে আছে। মাথার মধ্যে অজস্র প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।

আমার মনের মধ্যে এক আমি বলছে ‘ গাড়ি থামিয়ে নান্টুকে নিয়ে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে সোজা দৌড় দিয়ে পালিয়ে যা, এদের ত্রিসীমানা আর মারবি না , এই বোবা মেয়েটিকে চিরদিনের জন্য ভুলে যা’। আবার পরক্ষনেই, আবার আরেক ‘আমি’ মনের ভিতর থেকে বলে উঠছে ,’ কি যা তা ভাবছিস, তুই না লেখা পড়া জানা মেধাবী ছেলে, এই তাবৎ দুনিয়াতে কত অনাচার, অত্যাচার, অপকর্ম চলছে আমরা সবাই কী বোবার মতো অভিনয় করে যাচ্ছি না, তবে এই ফুলের মতো মেয়েটির কথা বলতে পারা কী সমস্যা?’

আবার আমার ভিতর থেকে অন্য ‘আমি’ বলছে,’ ভালোবাসা হচ্ছে স্বর্গীয় ব্যাপার, তবে, সাবধান, এর মাঝে কখনো ‘করুণা’ ঢুকাবি না, করুণা ভালোবাসাকে ক্যান্সারের মতো গিলে ফেলে, তোর কোরুনা না, এই মেয়ে তার যোগ্যতা নিয়েই তোর হৃদয় আসনে গেড়ে বসেছে, এই মেয়ে তোকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে। একে বিশ্বাস করা যায়, ভালোবাসা যায়, অতকিছু না ভেবে মত দিয়ে দে, গাধার মতো কী এতো ভাবছিস হাদারাম, দেখবি ওকে নিয়ে অনেক সুখী হবি ?’

ঠিক পরের মুহূর্তেই আবার আরেক ‘আমি’ বলে উঠছে ‘খবরদার বড়লোকদের এসব পাতানো খেলায় পা বাড়াবি না, মত বদলাতে এদের সময় লাগে না, সম্পর্ক গড়া এবং ভাঙা এদের কাছে ছেলে খেলা, আর তাছাড়া, এসব মানুষেরা বিদেশ থেকে দেশে এসে যেমন জায়গা জমি কেনে, ফ্লাট কেনে একইভাবে জামাইকেও কিনে ফেলে, তোর অসুস্থ মা, রিটায়ার বাবা, বুবু , বড় ভাই.মেঝো ভাই এদের ফেলে ছেড়ে থাকতে পারবি ? যে তোর মনের কথা কানে শুনতে পারবে না, মুখ ফুটে তোকে ভালোবাসার কথা, আবেগের কথা বলতে পারবে না , তার সাথে বন্ধুত্ব করা যায় কিন্তু ঘর বাধা যায় না।

মহাস্থান থেকে বগুড়া শহর সারা রাস্তা বাড়ি ফেরার পথে শম্পাদের গাড়িতে আমার ভিতরের এতগুলি ‘আমি’-র সাথে যুদ্ধ করতে যেয়ে আমি গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে যেয়ে এক সময় আমি আমার বাসার সামনে চোলে এলাম। নান্টুর বাসা আরও খানিকটা দূরে বলে ও শম্পাদের সাথে গাড়িতেই বসে আছে, ওঁরা ওকেও ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিবে। শম্পাদের সাথে এই সংক্ষিপ্ত জার্নিতে নিজের মনের সাথে, বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে যেয়ে আজ আমার একটি সুবিধা হয়েছে। আজ আমি বড়োলোকের এক সুন্দরী বোবা মেয়ের ভালো বাসার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিবেকের মুখোমুখি হয়ে আমার শিক্ষা/দীক্ষা, রাজনৈতিক দর্শন প্রভৃতিকে অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। গাড়ি থেকে নামার ঠিক আগমুহূর্তে শম্পার দীঘির মতো দুই চোখের নিষ্পাপ অনুচ্চারিত ভাষা ও সেই ভুবনময়ী মিষ্টি হাসি আমার হৃদয়ে ঝড় তুললো।
———————————–
চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৃদি পেন্ডুলাম
পরবর্তী নিবন্ধমাতৃভাষা বা নিজের প্রথম ভাষা ভালো করে না জানলে অন্য কোনো ভাষাও ভালো করে জানা যায় না !
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন