অফিসে লাঞ্চ ব্রেকের আগে খুব মনোযোগ দিয়ে ফ্যাক্টরির অডিট রিপোর্টগুলো দেখছিলাম। এমন সময় পিয়ন জাহিদ এসে বললো “ জিএম স্যার আপনাকে সালাম দিছেন ।” জিএম স্যারের রুমে ঢুকতেই দেখি তাঁর সামনে খুব সুন্দর একটি মেয়ে বসে আছে বেশ হাসি হাসি মুখে। আমি স্যারকে সালাম দিতেই তিনি মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন “ ও জয়া । আজ জয়েন করলো আমাদের উত্তরা ফ্যাক্টরির ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসাবে। আপনি ওকে কাল থেকে আপনার দায়িত্বে থাকা ফ্যাক্টরিগুলো দেখাবেন আর ওর কাজগুলো বুঝিয়ে দিবেন ।” আমি মনে মনে একটু খুশিই হলাম। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ না করে ঠিক আছে স্যার বলে বেরিয়ে নিজের রুমে এসে বসলাম।

কিছুক্ষন পর দেখি জয়া আমার রুমে এসে হাজির । “ আমি কি আপনার রুমে বসতে পারি?” আমি বললাম “ হা বসতে পারেন। এখন তো লাঞ্চ ব্রেক । আপনি কি খাবার নিয়ে এসেছেন?”

জয়া বলল “ না । খাবার আনিনি। আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না আমাকে কতক্ষন থাকতে হবে আজ ! আর আমার এখন ক্ষুধাও পায়নি । আপনি খেতে পারেন।” জয়া খুব খুটিয়ে খুঁটিয়ে আমার রুমের ওয়াল , শেল্ফ আর পেইন্টিং দেখছিল । আর আমি দেখছিলাম বিধতার সৃষ্টি এক অসামান্য রূপবতীকে । আমি বললাম ,” অফিসে আজ আপনার প্রথম দিন । আপনি আজ আমাদের গেস্ট । আপনাকে তাই আমার উচিত আপ্যায়ন করানো ।”  পিয়নকে দিয়ে জয়ার জন্য খাবার আনিয়ে নিজে খেতে বসলাম। খাওয়ার সময় তার সম্পর্কে জেনে নিলাম। আগে কোথাও কাজ করেছে কিনা । বাসা কোথায়?

জয়া জানালো এটা তার প্রথম চাকুরি। মাস্টার্স করেছে কয়েক মাস আগে। ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না তাই চাকুরি খুঁজছিল। ইন্টারভিউতে হয়ে গেল এখানে তাই জয়েন করা। আমি জয়াকে পরের দিন কোথায় কিভাবে যাব বুঝিয়ে দিলাম । আর তার কাজের দায়িত্ব সম্পর্কে ছোটখাট ধারনা দিলাম। সে কোন রকম প্রশ্ন না করে শুনে গেল মনোযোগ দিয়ে । এক সময়ে সে আমাকে বলল “ স্যার আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি অনেক ছোট ।“ অল্প সময়ের পরিচয়ে জয়াকে  আমার খুব আপন পরিচিত মনে হতে লাগলো । সেটা হতে পারে ওর সরল হাসির জন্য অথবা আন্তরিকতার জন্য ।

পরের দিন থেকে জয়াকে কাজ বুঝিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ফ্যাক্টরিগুলো আর সেখানকার ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে শ্রমিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা ভাল ভাবেই করে যাচ্ছি । অফিসে সবাই জানে আমাকে কাজ পাগল মানুষ হিসাবে । আর এমন সুন্দরী একজন মেয়ে পাশে থাকলে কাজের কথা বলতে কার না ভাল লাগে। কিন্তু আমি জয়াকে বুঝতে দেই না সেটা ।  ফ্যাক্টরির অনেকেই তাকায় আমাদের দিকে একটু বাঁকা চোখে । জয়া অস্বস্তিবোধ করে। আমি বলি কাউকে পাত্তা দিবে না। আর অন্যায় কাজের সাথে কখনো আপোষ করবে না। জয়া হাসে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। অবশেষে আমার দায়িত্ব শেষ করে আমি ওর কাজের স্থান ওকে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসি নিজের ডেস্কে। জিএম স্যার আমার কাছ থেকে খোঁজ নেন জয়ার কাজ শেখার অগ্রগতি সম্পর্কে। আর সাথে দিয়ে দেন আরো কিছু নতুন কাজ। কাজের প্রেসারে আমি আর জয়ার কোন খোঁজ নেয়ার সময় পাইনি সপ্তাহ খানেকের মধ্যে। কাজ করছিলাম ফ্যাক্টরিগুলোর নতুন অডিটের জন্য । হঠাৎ জিএম স্যার রুমে এসে বললেন “ আসিফ সাহেব এখনি উত্তরার ফ্যাক্টরিতে যান তো। ওখানে বায়ারের অডিটর এসেছে।” আমি আর অফিসে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটলাম ফ্যাক্টরিতে। ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে পরলাম অডিটরের সাথে ।  তাদেরকে বিদায় দিতে দিতে প্রায় সন্ধ্যা। ততক্ষণ ফ্যাক্টরি ফাঁকা প্রায় । আমাকে রুম থেকে বের হতে দেখেই জয়া এগিয়ে এসে বলল “ আপনি ভাল আছেন? আমাকে সেই যে এখানে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন আর একবারের জন্য খোঁজও নিলেন না!” জয়ার কণ্ঠে অভিমানের সুর ঝরে পড়ছে । আমি রীতিমত বোকা বনে যাই। নিজেকে কেমন অপরাধী লাগতে থাকে । আসলেই তো একজন নতুন মানুষকে এভাবে রেখে গিয়ে খোঁজ না নেয়াটা ভীষণ খারাপ হয়েছে । আমি বললাম, “ আসলে কয়েকদিন হেড অফিসে না থাকায় এত কাজ জমে গিয়েছিল আমি ঠিক সময় করে উঠতে পারছিলাম না। তোমার কোন অসুবিধা হয়নি তো ?”

 জয়া বলে “ না না কোন অসুবিধা হয়নি। এখানে সবাই খুব আন্তরিক। সবাইভাবে আপনি আমার আত্মীয় হোন । তাই তারা কথা বলার সময় বুঝে সুঝে কথা বলে। “ আমি হাসি। জয়া বলে “ প্রায় দুই সপ্তাহ আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন । আপনি এখানে এখন আমার অতিথি । আপনি আমার সাথে এখন চা খাবেন।” আমাকে কিছু বলার সুজোগ না দিয়ে জয়া হাটতে থাকে আমার আগে আগে। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটতে থাকি ওর পিছু পিছু ।  ঢুকে যায় ছোটখাট ছিমছাম একটা রেস্টুরেন্টে। জয়া খুলে বসে ওর এক সপ্তাহের কাজের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি। আমি শুনতে থাকি একনিষ্ঠ শ্রোতা হিসাবে । আমি চেষ্টা করি জয়ার আবেগটাকে বোঝার । ওর কাজের শুরুতে আমাকে পেয়েছে মেন্টর হিসাবে। সেই প্রথম দুই সপ্তাহ এক সঙ্গে সময় পার করার জন্য ওর মধ্যে থেকে জড়তা কেটে গেছে। ওর কাছে আমি হয়ে উঠেছি নির্ভরতার প্রতীক । যাকে সে অনায়াসে বলতে পারে তার যত কথা। আমাদের মধ্যে গড়ে উঠে চমৎকার বন্ধুত্ব আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক।

মাঝে মাঝে জয়া হেড অফিসে ফোন দিয়ে জেনে নেয় আমার ওর কাজের জায়গায় যাওয়ার তারিখ। সেভাবে তার কাজগুলোকে আগে থেকেই আপডেট করে রাখে। যেন আমার পাশে কাজের উছিলায় হলেও একটু বেশি সময় কাটাতে পারে। আর ফ্যাক্টরির লোকজনও আমাকে একটু বেশি সমীহ করতে থাকে জয়ার জন্য। এদের অনেকের ধারনা আমি বললে জয়া তাদের দিকে কৃপার দৃষ্টি মেলে চাইবে । আমি জয়াকে তার অন্য কলিগদের কথা বললে বলে “ কি যে বলেন? কলিগদের সাথে কখনো প্রেম হয় নাকি? আমি বলি কেন হয় না? জয়া চোখ নামিয়ে লজ্জাবনত মুখে বলে “ আমার যে একজন ভালবাসার মানুষ আছে ।” আমি তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। আমার ধারনা ছিল ও হয়তো আমার কথা বলবে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল করে দিয়ে জয়া বলে “ওর নাম সঞ্জয়। আমরা একই সাথে পড়াশুনা করেছি। কিন্তু আমার বাবা মা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছে না। ও হিন্দু বলে।” আমি জিজ্ঞেস করি “ এখন তুমি কি করতে চাও? জয়া বেশ দৃঢ়তার সাথে বলে “ আমি ওকেই বিয়ে করবো।” আমি জিজ্ঞেস করি “ ছেলেটা কি খুব হ্যান্ডসাম?” জয়া হেসে বলে “ হ্যান্ডসাম কিনা জানি না । তবে সে আমাকে বুঝতে পারে । আর ভালবাসার মানুষের দোষগুলো আমার চোখে পরবে না এটা স্বাভাবিক । “

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না । শুধু বলি যেটা ভাল হয় কর।  আমি জয়াকে শুভ কামনা জানিয়ে চলে আসি ওর অফিস থেকে । এত অল্প সময়ে একজন মানুষ যে আমার মধ্যে এতটা জায়গা করে নেবে সেটা বুঝতে পারিনি । আমার কাছে তখন সমস্ত পৃথিবীটাকে ধুসর মনে হচ্ছিলো । আমি কোনভাবেই আর কাজে মন বসাতে পারছিলাম না।  আমি শরীর খারাপের অজু হাতে অফিস থেকে নিয়ে নেই সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি । খুঁজতে থাকি অন্য চাকুরী । চাকুরি পাল্টাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না । অন্য অফিসে থেকেই খবর পাই পারিবারিক কারনে জয়া চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়েছে। মনটা ভরে যায় বিষণ্ণতায়। আমি আবারো ডুব দেই কাজের মাঝে । এভাবেই পার হয়ে যায় কয়েকটি বছর।

আজ শুক্রবার । বন্ধের দিন। গিয়েছি বই মেলায় ।হাটছি টিএসসির আগে থেকে । রাস্তার দুপাশে বসেছে খাবারের স্টল,  ভিউ কার্ড ,ক্যাসেটের স্টল । ফুটপাথে কিছু লোক বসেছে ইন্ডিয়ান লেখকদের বই এবং বাঙালী নামকরা লেখকদের পুরানো বই সাজিয়ে। অনেকেই আবার সাজিয়েছে বাচ্চাদের খেলনার পশরা। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্র সঙ্গীত, ব্যন্ডের গান।  শিমুল মোস্তফা , জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় , মাহির ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তি। বই প্রেমিদের পদচারনায় বাতাসে উড়ছে ধুলো । একটু দূর পর পরই দেখা মিলছে চানাচুর , ঝাল্মুড়ি আর বাদাম ওয়ালাদের।  জনসমুদ্র ঠেলে সামনে এগুতেই থাকি । দূর থেকে চোখে পড়ে  জয়া একটি ফুটফুটে প্রজাপতির মতো মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বই দেখছে এক স্টলের সামনে। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বলে উঠে “ আপনি আসিফ স্যার না! ভাল আছেন?”  আমি হাঁ সুচক উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করি “ তোমার বর আসেনি ? একা কেন?” সে বলে “এসেছে। একটা বইয়ের স্টলে বসে আছে । আমি মেয়েকে নিয়ে ঘুরছি। আমাদের ঘোরা দেখা শেষ হলে তাকে নিয়ে বাসায় যাব। আপনি হঠাৎ করে চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন? কোন সমস্যা হয়েছিল?”

 আমি বললাম “ না অফিসে কোন সমস্যা ছিলো না । আমার আসলে নিজেরই এই অফিসে কাজ করতে ভাল লাগছিলো না । তাই চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলাম । তুমি চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?”   জয়া বলতে থাকে “ স্যার মনে আছে আমি আপনাকে আমার ভালবাসার কথা বলেছিলাম ? সঞ্জয়ের সাথে আমার বিয়েটা হয়নি ওর বাবা মায়ের আপত্তির মুখে । আমাকে বিয়ে করলে ওর বাবা মাকে ত্যাগ করতে হতো । ও ওর বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ছিল । আমি পরে আর চাইনি ওকে ওর সমাজ সংসার থেকে আলাদা করতে । আমার বাবা মা আমাকে বাধ্য করেছিলেন চাকুরি ছাড়তে । কেননা আমার বাবা মা  যে ছেলে দেখছিলেন আমাকে না জানিয়ে, তারা আমার চাকুরি করাটা পছন্দ করছিলেন না । পরিবারের মান সম্মানের কথা ভেবে আমি বিয়েতে মত দেই । আমার বিয়ে হয়ে যায় খুব ধনী পরিবারে । আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করছিলাম সবকিছু। ” জয়ার কণ্ঠ আটকে আসে । আমি দেখি ওর দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে । ও হাতের তালু দিয়ে নিজেকে সংবরন করার চেষ্টা করে । আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারি না । আমরা হাটতে থাকি । আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলি “তোমার বরকে পরিচয় করিয়ে দিবে না ?” জয়া আমার দিকে না তাকিয়েই বলে “ আসেন পরিচয় করিয়ে দেই।” আমি হাটতে থাকি জয়ার মেয়েটিকে কলে নিয়ে। জয়া একটা বইয়ের স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায় । বলে “ স্যার , আমার স্বামী  । আমি হাত বাড়াতেই স্ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক আমার সাথে হাত মেলানোর জন্য। বললেন “ আমি পিয়াল । আপনার কথা অনেক শুনেছি জয়ার মুখে। অবাক হচ্ছেন আমাকে দেখে ? আমাদের বিয়ের বছরখানেক পরে কন্সট্রাকশনের কাজ দেখতে গিয়ে আমি পড়ে যাই তিন তলার ছাদ থেকে। তখন আমার ডান পাটা এমনভাবে ভেঙ্গে যায় যে ডাক্তাররা পরে পা কেটে ফেলতে বাধ্য হয়।” আমাকে কোন কথা বলার সুজোগ না দিয়ে জয়া ওর বরকে বলে “ সন্ধ্যা হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।” আমাকে আসি বলে ওরা পা বাড়ায় সামনের দিকে। আমি তাকিয়ে থাকি ওদের পথের দিকে। জয়া তার পঙ্গু স্বামীর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ভীড় ঠেলে।।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন