হামিদ ও আফজাল দুইজনই ডানপিটে,স্কুল পালানো  ঘনিষ্ট বন্ধু । পড়াশুনায় দুইজনই অমনোযোগী এবং স্কুল ফাঁকি  দিয়ে গ্রাম্য যাত্রা, কবি গান,পুঁথিপাঠ, পূজা পার্বনে সময় অতিবাহিত করে ।  এরা দু’জনে গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের উৎসাহিত করে  রাত   জেগে বাংলা যাত্রা পালা দেখতে যেতে । বাংলাদেশের পল্লীতে সামাজিক ও ঐতিহাসিক মিশ্রিত যাত্রা পালা “রূপবান” ভালোবাসে না এমন লোক পাওয়া যেতো না ।  সে যুগে মানুষ অল্প পরিশ্রম করে ফসল ফলাতো এবং হাতে অফুরন্ত সময় ছিল পল্লীর কবি গান,যাত্রা,পূজা,নাটক ,পুঁথিপাঠ  ও  অন্যান্য ইভেন্টস  উপভোগ করা।  আজকাল ছেলেমেয়েরা যেভাবে পড়াশুনায় মনোযোগ দিয়ে থাকে  ,সে যুগে তা ছিল না।  লোকজন মোটামোটি খেয়ে দেয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতো । ১৯৬০ এর দিকে আমরা গ্রামে গঞ্জে দূর দূরান্তরে পায়ে হেটে  গিয়ে পড়াশুনা করতাম এবং আমাদেরই জানাশুনা অনেকেই পড়াশুনার উপর গুরুত্ব দিতো না । গ্রামে হাই স্কুল অনেক দূরে দূরে ছিল, যে সব ছেলেরা পড়াশুনায় আগ্রহী,কারো বাড়িতে ছেলেমেয়ে পড়াশুনার বিনিময়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে হাই স্কুলে ভর্তি হতো,নতুবা পড়াশুনা বন্ধ করে কৃষিতে সাহায্য করতো ।  গ্রামের পল্লীতে অনেক ধরণের যাত্রা হতো,তার মধ্যে ” রূপবান ” যাত্রার কাহিনী ও গান পল্লীর জনগণের প্রাণ কেড়ে নিতো ।  রাজা নিঃসন্তান, দরবেশ বলেছে তার এক পুত্র সন্তান হবে তবে  এই সন্তানকে বাঁচাতে হলে বারদিনের শিশুর সঙ্গে  বার বৎসরের মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। বার বৎসরের মেয়ে খুঁজে বের করে বিয়ে না দিলে শিশুকে বাঁচানো যাবে না । তাই বাদশাহ তার রাজ্যে  ঢোল পিটিয়ে  খবর দিয়েছে বার বৎসরের মেয়ে খোঁজে বের করে তার শিশু রহিমকে বিয়ে দিয়ে বনবাসে  পাঠাবে ।  এর  কাহিনী ও মন মাতানো গান আজ ও বাংলার মাঠে ঘাটে   অতি পরিচিত। এই যাত্রার কিছু গান সে যুগে লোকের মুখে মুখে শুনা যেত যেমন  ক) শুনো তাজেল গো মন না জেনে প্রেমে মঈজ না  খ) সাগর কূলে নাইয়া রে ওপার বেলা .. গ) আমার প্রাণ বিনোদিয়ারে ,আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে ..  এ ছাড়া আরো অনেক চমৎকার যাত্রা এবং সিনেমা কিশোর  ও যুবক ছেলে মেয়েদের সে যুগে আকর্ষণ করতো । হামিদ ও আফজাল ঘরের ধান,চাল, পাট  বিক্রি করে এ সবের পিছনে সময় নষ্ট করতো ।

হামিদের বাবা ধর্য্য ধরে তার ছেলেকে তিনবার পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের বোর্ড ফাইনাল পাশ করিয়েছে । তার বাবা ছেলের পাশের খবর শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলে এবং বলে খোদা আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করিয়েছে। ওই যুগে পড়াশুনার পরিবেশ এমনই ছিল, গ্রামের অনেক স্কুল থেকে  (দশম শ্রেণীর )৩০ জন বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা দিলে ৫  জন পাস্ করতো এবং বাকি ২৫ জন হয় পুনরায় পরীক্ষা দিতো ,নতুবা গ্রামে কৃষিকাজে বা কলে কারখানায় কাজ করে জীবন নির্বাহ করতো । এখানে উল্লেখযোগ্য যে তখন একটি মাত্র পূর্ব পাকিস্তান সেকেন্ডারি স্কুল বোর্ড ,ঢাকা ছিল ।

কিন্তু আফজাল সমূলে বই পড়া বন্ধ করে দিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা এবং গ্রামের নানাহ কুসংস্কৃতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে।  হামিদ পাশ  করার পর তার পছন্দের যাত্রাগানের দলে যোগ দেয় এবং এক বৎসর বিভিন্ন দলে ঘুরাঘুরি করে  শেষে নিরুপায় হয়ে  ছেড়ে দিয়ে ঢাকা এক মুদি দোকানে কাজ নিয়ে টাইপিং শিক্ষার কাজে নিজেকে মনোনিবেশ করে। হামিদ বাড়ি গেলে আফজালকে বলে , আমি না বুঝে এর পিছনে অযথা সময় নষ্ট করেছি, তুমি স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে ঢাকা চলে আসবে এবং দু’জনে চাকরি  করবো।  আফজাল বলে আমার পড়াশুনায় মনোযোগ নাই এবং আমি অনেকদিন স্কুলে যাই না ,সে জন্য স্কুল থেকে আমার নাম কেটে দিয়েছে । হামিদ তাকে বুঝিয়ে বলে তুমি স্কুলে গিয়ে বলো   ,” আমি মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবো।” তুমি যদি প্রতিজ্ঞা করো যে ভালো ভাবে পড়াশুনা করবে, স্কুলে তোমাকে নিয়ে নেবে । সে বলে আমার পড়াশুনার কোনো আগ্রহ নাই । সে একদিন বাড়ি থেকে কাজের নাম করে ঢাকা হামিদের   ঠিকানায় এসে উঠে । সে আফজালকে বলে তুমি পড়াশুনা করতে চাও না ।এটা কি তোমার শেষ কথা ? সে বলে, আমি অনেকদিন পড়াশুনা করিনি এখন আমার পড়ার মতো মন নাই । হামিদ বলে,তুমি আমার এখানে দুই একদিন থাকতে পারবে । তুমি বুঝ না আমার নিজের ও কাজ নাই।  সারা দিন মুদি দোকানে ব্যাস্ত  এবং একটু সময় পাইলে টাইপ শিখি।  মুদি দোকান  থেকে আমাকে যা পয়সা দেয় তা দিয়ে কোনো রকমে  মেসে থাকা খাবার ব্যবস্থা হয়। এই করে তো আর মানুষ বাঁচতে পারে না । তুমি বরং গ্রামে চলে যাও এবং স্কুলে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে পাশ করে এখানে এস আমি ততদিনে চাকরি নিয়ে ঠিক হয়ে যাবো এবং তোমাকে কিছু ব্যবস্থা করে দেব ।

আফজাল গ্রামের অন্যান্য বখাটে ছেলেদের সঙ্গে ঘুরাঘুরি করে   এবং মাবাবা তাকে দিয়ে জমির চাষাবাদ  কাজ ও করাতে পারে না । এ ছাড়া সে কোনো রকমে প্রমোশন নিয়ে ক্লাস পার হয়েছে ,তবে পড়াশুনা করে নি।  স্কুলে যাওয়া আসা করলেই পড়াশুনা হয় না।  নিয়মিত পড়াশুনা করতে হয় । ঘরের পাট,ধান  বিক্রি করে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে লোকজনকে বন্ধু বানানো হয়তো সহজ।

হেডমাস্টার আতিক  সাহেব একদিন তাকে ডেকে বলে ,” মানুষ চেষ্টা করলে সবই করতে পারে।  “নেইল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে।“ তুমি সামান্য পড়াশুনা করতে পারোনা ?  আফজাল বই দেখলে ভয় পায় এবং ২/৩ বৎসর পড়াশুনা করেনি।  তার সাথের ছেলেরা হয় বোর্ড ফাইনাল পাশ করেছে অথবা আফজালের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।  হামিদ তার ছেড়ে দেয়া যাত্রা পার্টির মালিককে  অনুরোধ করে বলে,” আমার এক বন্ধু আছে ,” তুমি বা তোমরা কি তাকে সাহায্য করতে পারো ? তারা বলে তার পড়াশুনা কি ? হামিদ বলে ওর পড়াশুনা দশম ক্লাস এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা দেয় নি।  যাত্রার মালিক বলে আমার নিকট পাঠিয়ে দিয়ো, দেখবো রিহার্সাল দিয়ে যদি কাজে লাগানো যায় । একদিন  হামিদ তাকে নিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করে কাজে লাগানোর জন্য অনুরোধ করে।  মালিক কিছুদিন তাকে ট্রায়াল দিয়ে বার্থ হয়ে বলে ,” তোমার দ্বারা এ কাজ সম্ভব না।   এতে অনেক ধর্য্য ও মেধা দরকার যা তোমার নাই।  সে মন খারাফ করে হামিদের নিকট চলে আসে।   হামিদ বলে তুমি আমার অবস্থা দেখো , আমরা কয়েকজন মিলে  মেস করে থাকি ।তাছাড়া আমার কোনো রোজগার নাই যে আমি তোমাকে রাখবো । তুমি বাড়ি যাও, আমি দেখবো যদি কিছু করতে পারি তাহলে চিঠি দিয়ে জানাবো।  সে বাড়ি চলে যায়, মা বাবা অতিষ্ঠ, তাকে ঘর থেকে বিদায় দিতে পারলেই বাঁচে ।

আফজালের বাবা আমজাদ হোসাইন গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ এবং চাষাবাদ করে কোনো রকমে সংসার পরিচালনা করে।  আফজাল গ্রামে অন্যান্ন ছেলেদের সঙ্গে দল বেঁধে গ্রামে অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে । গ্রামের লোকজন খেপে গিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন মেম্বার ও চেয়ারম্যানের নিকট অভিযোগ   করে  তার বাবা আমজাদ হোসাইনকে চাপ দিয়েছে, তার ছেলেকে সংশোধন করতে।    গ্রামে উঠতি বয়ষ্কা মেয়েরা বাহিরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না।  অনেকেই এ নিয়ে তার বাবা এবং মেম্বার ও চেয়ারম্যানের নিকট অভিযোগ করেছে ।  আমজাদ হোসাইন আফজালের বন্ধু হামিদকে কয়েকবার অনুরোধ করেছে তাকে নিয়ে কোথায় ও কোনো কাজে লাগিয়ে দিতে।  হামিদ বলেছে চাচা,আমি চেষ্টা করে দেখবো যদি কোনো কাজে সাহায্য করতে পারি ।

হেডমাস্টার আতিক সাহেব সদ্য  স্কুল থেকে অবসর নিয়েছে এবং রোজ সকাল বেলা  ফজরের নামাজ পড়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে।  মসজিদে গিয়ে আজান দিয়ে অন্যান্ন মুসল্লিদের জন্য অপেক্ষা করে এবং নামাজ পড়া শেষ হলে সে গ্রামে হাটতে বের হয়। গ্রামের লোকজন তাকে একজন শিক্ষিত ও সমাজ সেবক হিসাবে শ্রদ্ধা করে ।সবাই দেখলে সালাম দিয়ে কেমন  আছেন খোঁজ খবর নেয়।

বর্ষার মৌসুম, সারারাত বৃষ্টি হয়েছে এবং  আতিক  সাহেব চিরাচরিত নিয়মে সকালে নামাজ শেষ করে  এক হাতে জুতা জোড়া অন্য হাতে ছাতা নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে।    আফজাল সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়েছে এবং সামনে আতিক সাহেবের সঙ্গে দেখা।  আফজাল সালাম দিয়ে দাঁড়ায়।  আতিক তাকে বলে তুমি এত সকালে কোথায় যাবে ? সে বলে আমি ঢাকা যাবো। আতিক  সাহেব  বলে কেন ঢাকা যাবে ? সে কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে । আতিক বলে , বয়স কোনো ব্যাপার না ,তুমি যদি পড়াশুনা করতে চাও ,আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আমি অবসর মানুষ , কাজ কর্ম তেমন কিছু নাই।  তুমি মনস্থির করে বলো  পড়াশুনা করবে কি না । আফজাল এক নজরে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে । আমি তোমার বাবা মাকে বলে কহে তোমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।  আফজাল বলে স্যার  ,আমি আর পড়াশুনা করবো না ,এই বলে সে আতিক সাহেবের পায়ে ছুঁয়ে সালাম করে বলে আমার জন্য দো’আ করবেন।  আতিক বলে আমি সব সময় তোমাদের সব ছেলে মেয়েদের জন্য দো’আ করি।  আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি, দেশের কিছু জনহিতকর কাজ করতে চাই।  গ্রামে রাস্তা নাই ,স্কুল, মাদ্রাসায় ভালো শিক্ষক নাই।  এ সব নিয়ে কাজ করা দরকার । টাকা পয়সা নাই, কি দিয়ে কাজ করবো। আমি কয়েকবার স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের সঙ্গে  আলাপ করেছি।  আমার ছাত্রদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করেছি ,তাদের সবাইকে অনুরোধ করে বলেছি সাহায্য করতে । আমাদের  উপজেলাতে কিছু জনহিতকর কাজ করতে হবে।  আমি অচিরেই আমার ছাত্রদের নিকট সাহায্যের জন্য যাবো এবং শেষ  বয়সে কিছু জনহিতকর কাজে হাত দেব ।
আফজাল তোমার ট্রেন ক’টায়? স্যার, ট্রেন  ১০ টায়।  এখনো অনেক সময় আছে ,এত সকালে স্টেশনে গিয়ে কি করবে ? স্যার,আরো দু’একজন ঢাকা যাবে ,তাই সকাল সকাল যাইতেছি।  আচ্ছা,যাও দো’আ করি। আতিক  মনে মনে বলে ,এ’টা অশিক্ষা/ কুশিক্ষার  জন্য হয়েছে। এখন বাজে ৭টা, আর ট্রেন ধরবে ১০টা বাজে। স্টেশনে যেতে লাগবে বড়ো জোর আধ ঘন্টা। তা’ছাড়া সকালের বৃষ্টি ছাড়বে বলে মনে হয় না।  আফজাল ভিজে ভিজে স্টেশনে যাইতেছে । সে জানে সকালে বৃষ্টি হবে, অথচ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্টেশনে যাইতেছে।

আতিক দীর্ঘ নিঃশাস ছেড়ে  জুতাজোড়া হাতে নিয়ে কাদামাটিতে হাটতে হাটতে বাড়িতে পুকুরে পা ধুয়ে  আমজাদ হোসেনকে ডাকে ” আমজাদ ঘরে আছো ? ” আমজাদ আতিক সাহেবের ডাক শুনে ঘরের বাহির হয়ে বলে , স্লামালাইকুম স্যার! আপনি এত সকাল সকাল এদিকে কি মনে করে ? আতিক বলে ,তোমার ছেলে আফজাল এত সকালে ট্রেন ধরার জন্য যাইতেছে ,সে বলে “আমি ঢাকা যাবো। ” আমজাদ বলে ,কি বলবো স্যার,সে তো পড়াশুনা করলো না।  তার  বন্ধু হামিদ  বলেছে তাকে কাজ দেবে। তাই সকাল সকাল চলে গেলো।  আতিক বলে ,সবই কপাল ,চিন্তা করে কি করবে ? দো’আ করা ব্যাতিত আর কিছু করার নাই।

আমজাদ বলে স্যার,ঘরে আসেন এবং সকালের নাস্তা করে যান। আতিক  বলে ,আমার অনেক কাজ ,ঘরে গিয়ে আমার পুরানো ছাত্র ও বন্ধুদের চিঠি লিখতে হবে, এই বলে সে বাড়িরদিকে চলে গেলেন । আতিক  এই এলাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন, অনেক ছেলেমেয়েরা তার চেষ্টায় পড়াশুনা করে মানুষ হয়েছে ।

আজকাল সে ধর্মীয় সভাসমিতি গুলিতে গিয়ে লোকদের দেশের কাজ করার জন্য অনুরোধ করে । অনেকে তার কোথায় অনুপ্রাণিত হয় । যাকেই দেখে জনহিতকর  কাজের জন্য আহবান করে।  বৃষ্টি ও ঝড়ে গরিব মানুষের ঘরের চালা  উড়িয়ে নিয়েছে শুনলে আতিক বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঁশ ,চোন এনে নিজের স্কুলের ছেলে বা গ্রামের সাহায্য নিয়ে  ঘর উঠিয়ে দেয়।  তা’ছাড়া গ্রামে কারো ঘরে খাওয়া নাই , বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা নিজের ঘর থেকে  চাল, ডাল  এনে সাহায্য করে ।   অনেকে বলে আপনি দেশে অনেক ভালো কাজ করেন । ইলেকশন করতে চাইলে আমরা আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবো ।  সে বলে,” ভালো কাজ করার জন্য ইলেকশন বা নেতা হওয়ার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না ।”  এলাকাতে অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ মাস পয্যন্ত প্রতিটি ইসলামী মাদ্রাসা বা মসজিদে ওলামা ডেকে ওয়াজ মাহফিল করানো হয়, এ সব মাহফিলে গিয়ে সে সাধারণ মানুষকে সমাজ উন্নয়নের কাজে এগিয়ে আসতে  অনুরোধ করে।  সে মনে করে সমাজ কল্যাণ  কাজের জন্য কোনো বাধা নিষেধ নাই এবং ভালো কাজ যে কেউ করতে পারে । স্থানীয় স্কুল গুলির বড়োই দুরবস্থা।  সে স্কুল গুলিতে মাঝে মধ্যে গিয়ে ভলান্টারিলি ক্লাসে পড়াশুনা করায়,  এ দেখে স্থানীয় লোকজন উৎসাহ পায়।

হামিদ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা  এক মেসে আরো কয়েকজনের সঙ্গে থাকে।  আফজাল গিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে।  ভবঘুরে  আফজালের না আছে পকেট খরচ করার মতো টাকা , না আছে কোনো সঠিক চিন্তা।  সে মনে করে ঢাকা গেলেই কাজ পাওয়া যাবে।  হামিদ তাকে দোকানে কাজ দেয়ার  জন্য চেষ্টা করে ও ব্যার্থ হয়েছে।  শেষে আফজালকে কোনো এক বাসায় কাজ করার জন্য লাগিয়ে দিয়ে মাথার বোঝা হালকা করে।  সে সেখানে নূন্যতম বেতনে কাজ করে যা দুই পয়সা জমায়  তা  সিগারেট ও  সিনেমা দেখে শেষ করে বসে থাকে।   এ দিকে তার মা বাবা মনে করে যে তার ছেলে তাকে চাকুরী করে টাকা পাঠাবে । মা বাবা মাসে এক/ দুটি চিঠি দিয়ে সংসারের অভাব অভিযোগ জানায় । কিন্তু আফজালের অবস্থা পেটেভাতে এবং এক বৎসরে ও সে কোনো স্থায়ী কাজ করতে বা পয়সা জমাতে  পারে নি।   আফজালের মা পুত্র শোকে মৃত শয্যায় । সে ছেলেকে দেখার জন্য প্রতিনিয়ত কান্নাকাটি করে ।হামিদ দেশে গেলে তার মায়ের কান্না দেখে স্থির থাকতে পারে না।  মাবাবা  ছেলেকে ক্রমাগত চিঠি দিয়ে যাচ্ছে দেশে এসে  মাকে দেখে যাবার জন্য ।  আফজালকে যে বাসায় কাজ দিয়েছে সে বাসা পাল্টিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে এবং হামিদ তার কোনো খোঁজ খবর জানে না।  হামিদ বাড়ি গেলে আফজালের মাবাবা কান্নাকাটি করে বলে আমার ছেলেকে তুমি কি করেছো ? হামিদ বলে ,চাচা আমি তাকে যে বাসায় কাজ দিয়েছি ,সে ওই বাসা থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারে না । তা’ছাড়া সে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে ও আসে নাই । আপনারা যে সব চিঠি দিয়েছেন তার সবই আমার নিকট পড়ে আছে । আমি কি ভাবে তার চিঠি দেব ? ঢাকা অনেক বড়ো শহর ,সে নিশ্চয়ই অন্য কারো বাসায় বা কিছু করে । আপনারা কান্নাকাটি করলে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করি । সে যেখানেই থাকুক ,আপনাদের নিকট ফেরত আসবে ।আপনারা শুধু ওর জন্য দো’আ করবেন ।   আমি যদি দেখা পাই, আপনাদের খবর দেব ।

হামিদ তাকে যে বাসায় কাজ দিয়েছে , তার পছন্দ হয় নি ।  সে অন্যত্র কাজ জোগাড় করে নিয়েছে  এবং হামিদকে বা তার আগের মালিকে বলে নি । সে অনেক ধাক্কা খেয়ে এখন বুঝতে পারছে যে সে মাবাবা ,স্কুলের হেডমাস্টার এবং বন্ধু হামিদের কথা না শুনে  ভুল করেছে ? স্কুলের পড়াশুনার মনোযোগ নাই এবং ফেরত গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করা উচিৎ হবে না । কাজেই কিছু একটা করে দাঁড়াতে হবে ।সে সময় পাইলেই বাহিরে গিয়ে দোকানদার বা রিক্সাচালকের সঙ্গে আলাপ করে এবং  কে কি বলে মনোযোগ দিয়ে শুনে ।

এ বাসায় ফুলমতি নামে এক মেয়ে কাজ করে এবং ওরা দুইজনে গোপনে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে । তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দু’জন্যে বিয়ে করবে এবং পরিশ্রম করে দাঁড়াবে । আফজাল যে  ভুল করেছে তা উপলব্দি করে প্রতিজ্ঞা করেছে জীবনে যা কিছু করে মনোযোগ দিয়ে করবে । সে জীবনে কারো কথা শুনে নি এবং সে জন্য সারা জীবন ভুলের মাসুল দিতে হবে ।

আফজাল  নিজের ঠিকানা ব্যবহার করে না । সে মনে করে মাবাবা  দুঃখ করে চিঠি লিখবে এবং সে নিজেও দুঃখ পাবে । হামিদ টাইপ শিখে বিভিন্ন অফিসে দরখাস্ত করে শেষে বাংলাদেশ সচিবালয়ে কাজ নিয়ে যে মেসে ছিল তা থেকে সরে পড়েছে ।  অনেকদিন পর আফজাল অনেক খুঁজে হামিদের সঙ্গে দেখা করে । হামিদ এক গাদা চিঠি দিয়ে গালিগালাজ শুরু করে,তুমি বাড়ি গিয়ে মাবাবার সঙ্গে দেখা করে  আসা দরকার । সে বলে আমি বাড়ি গেলে বাবা আমাকে পিটাবে, সে ভয়ে আমি বাড়ি যাই  না । আমি পড়াশুনা করিনি ,তাছাড়া এলাকার অনেকেই নানাহ কারণে আমার উপর ক্ষেপা । কাজেই কিছু করতে না পারলে আমি আর দেশে যাবো না । হামিদ বলে তোমার মা তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ,কাজেই তুমি একবার গিয়ে দেখা করে আসা উচিৎ ।

আফজাল হামিদকে বলে যে সে বাড়ি যাইবে যদি কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পারে । হামিদ বলে তুমি এত দিন  ঢাকা আছো ,কোনো টাকা পয়সা জমাতে পারো নাই ? সে বলে সামান্য টাকা আমি পাই এ দিয়ে আমার নিজের খরচ ও চলে না ।

শেষে একদিন সে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে বাড়িতে গিয়ে দেখে মা অসুস্থ । মা তাকে কাছে পেয়ে কেঁদে বুকে জড়িয়ে বলে “আমার সোনা মানিক তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?”  আফজাল মায়ের করুন অবস্থা দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে  বলে,” মা তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না । “ মা বহুদিন পর ছেলেকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে । অনেক সময় মায়ের বেডের পার্শে বসে থেকে মাকে সান্তনা দেয় । সে রাতে গিয়ে আতিক  সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়িয়ে থাকে । আতিক সাহেব আফজালকে  দেখে বলে,” তুমি কেমন আছো ? “ তোমার মায়ের শরীর অনেক খারাফ ,তুমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করো । জ্বি স্যার ,আমি করবো । অনেক সময় বসে থেকে শেষে বলে স্যার আমি এখন যাই । আতিক  বলেন তুমি আবার আসবে, আমার সঙ্গে দেখা করে যাবে ।

আতিক  সাহেব সারাদিন গ্রাম ও স্থানীয় বাজারে ঘুরাফেরা করে । সে যাকেই দেখে ,তাকেই বলে তোমরা গ্রামের কুশিক্ষা দূর করো । প্রতিটি গ্রামকে সাবলম্ভি করে তোলার জন্য চেষ্টা করো । তোমরাইতো গ্রামের যথা দেশের প্রাণ । তোমরা এগিয়ে আসলে দেশ আপনা আপনি এগিয়ে আসবে । অনেকে আতিক সাহেবের কথা শুনে, আবার অনেকেই পিছনে পিছনে বলে আতিক  সাহেবের মাথা ঠিক নাই । যাকে দেখে তাকেই ডেকে কথা বলতে হবে কেন ? গ্রামের মানুষ এ সব উপদেশ শুনতে চায়  না । আবার কেউ কেউ বলে , সে ভালোর জন্য সব সময় উপদেশ দিয়ে থাকেন । কাজেই তাকে উপহাস করা ঠিক না ।

ঢাকা চলে যাবার পূর্বে আফজাল আর একবার আতিক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে বলে ,” তুমি আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে এক বৎসর পড়াশুনা করে পরীক্ষা দাও ,আমি তোমাকে পড়াশুনায় সাহায্য করবো এবং তুমি পাশ  করবে । সে বলে স্যার , আমি সবই ভুলে গেছি , এখন আর কিছুই মনে নাই । আপনি আমার জন্য দো’আ করেন যাতে এ ভাবেই ভালো করি । ঢাকা চলে যাবার পূর্বে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে , মা ! আমি আবার আসবো । সে বলে আমি ফুলমতিকে  ভালোবাসি এবং তাকে বিয়ে না করে পারবো না । মা বলে তুমি যদি কাউকে ভালোবাস, বিয়ে করো এবং আমাদের দেখিয়ে নিয়ে যাবে । আফজাল তার মাকে কথা দিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকা রওয়ানা হয় । বিকেলে সে ঢাকা পৌঁছে এবং বাড়িয়ালীকে বলে মা অনেক অসুস্থ ,সে জন্য আমি এক সপ্তাহ মায়ের কাছে ছিলাম । মাকে ফেলে আসতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে । বাড়িওয়ালি বলে,সব মা তার ছেলেমেয়েকে ভালো বাসে । কিন্তু ছেলেমেয়েরা মা বাবাকে ভুলে যায় । শেষ জীবনে তারা মা বাবাকে অনেকেই অবহেলা করে ।
ক্রমশ :

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের খেরোখাতাঃ এলোমেলো পংক্তিমালা-পর্ব ২২
পরবর্তী নিবন্ধজাদুঘর থেকে বলছি – পর্ব ১৫
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন