রমিজ  সকালে রাতের  পান্তা ভাত,পোড়া মরিচ দিয়ে খেয়ে গ্রামের বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানের পার্শে  ঘুরা ঘুরি করে – কেউ যদি কাজের জন্য ডাকে । তার সব চেয়ে বেশি খেয়াল রাইসুদ্দিনের রিক্সা গ্যারাজ । সে প্রতিদিন একবার করে গ্যারেজে গিয়ে দেখে যদি কাজ পায় । আজ গ্যারাজে গিয়ে দেখে একটা রিক্সা কেউ নেয় নি । রমিজ রাইসুদ্দিনকে সালাম দিয়ে বলে, চাচা-আপনার একটা  রিক্সা তো আজ কেউ নেয় নি । রাইসুদ্দিন  বলে মন্টু আজ কাজে আসে নি ,তুই কি রিক্সা চালাতে পারবি?
রামিজ বলে, চাচা – আপনি অনুমতি দিলে আমি চেষ্টা করে দেখবো  । রহমত ভাই  আমাকে রিক্সা চালান শিখিয়েছেন । তুই দেখ যদি পারিস- আজ তোকে ফ্রি চালাতে দেব । শুনে সে খুশি হয়ে রিক্সা নিয়ে চালাতে চেষ্টা করে । রাইসুদ্দিন  খানিক তাকিয়ে থেকে বলে তুই মনে হয় চালাতে পারবি । রমিজ বলে, চাচা- আমি রিক্সা চালাতে পারি । রাইসুদ্দিন বলে দেখিস,এখানে – সেখানে ধাক্কা লাগিয়ে রিক্সা ভেঙে ফেলিস না যেন ।  না ! চাচা- আমি যত্ন সহকারে চালাবো । আচ্ছা -ঠিক আছে ।

সকাল ৮টা থেকে- বিকাল ৬টা পয্যন্ত চালিয়ে সে রিক্সা জমা দিতে গিয়ে বলে, চাচা-  আমি  আজ ৫৫টাকা রোজগার করেছি । রাইসুদ্দিন বলে, বেশ ভালো ।  আমাকে আজ দিতে হবে না । কাল সকালে আসবি- মন্টু যদি না আসে, তোকে চালাতে দেব । রমিজ দোকান থেকে চাল,ডাল কিনে মনের আনন্দে  ঘরে গিয়ে ঝর্নাকে বলে আমি আজ সারাদিন রিক্সা চালিয়েছি । রাইসুদ্দিন বলেছে কাল রিক্সা দেবে এবং সকাল সকাল যাবো । নতুবা, কেউ আবার রিক্সা নিয়ে নেবে । ঝর্ণা বলে, সারাদিন মাঠে কষ্ট করার চেয়ে রিক্সা চালানো ভালো । মাঝে মাঝে একটু রিক্সায় বসে আরাম করা যায় । সোহেল ও লতা বলে কি মঝা! আব্বু, আমরা তাহলে তোমার সঙ্গে এখানে -সেখানে যেতে পারবো । রমিজ বলে ঠিক আছে ।

পরদিন সকালে গ্যারাজে গেলে রাইসুদ্দিন বলে তোকে  আজ  রিক্সা দিতে পারবো না । এই রিক্সা মন্টু  চালায় ।  সে কাল চালাতে পারে নি -অসুস্থ ছিল । আজ বলেছে চালাবে । ওই দেখ মন্টু  আসতেছে , শুন  সে কি বলে । মন্টু  সালাম দিয়ে বলে আমি আজ রিক্সা চালাবো । রমিজ চুপ করে থাকে , রাইসুদ্দিন  বলে তুই আমার জমিনে ধান কাটতে পারবি? পারবো চাচা । ধান কাটতে যা ,আরো ২-৩ জন  আছে ওদের সঙ্গে গিয়ে ধান কাট । আমার রিক্সা ৫টা , কোনো দিন  কেউ উপস্থিত না থাকলে  , তোমাকে  ডেকে দেব । রমিজ বলে ঠিক আছে, চাচা । এটা অগ্রহায়ণ মাস, ধান কাটা শুরু হয়েছে । রমিজ   ধান কেটে  আটি বেঁধে বাড়িতে নিয়ে গেলে ঝর্ণা ধান মাড়ানোর কাজে সাহায্য করবে । ঝর্ণা কাজের বিনিমিয়ে কিছু চাল বা ভাত নিয়ে ঘরে এসে  ছেলে -মেয়েদের খেতে দেয় । ঝর্ণা সারা দিন কাজ করলে ও মালিক তার বিনিময়ে  চাল বা ভাত  দিয়ে বিদায় করে । তাকে কাজের বিনিময়ে পয়সা দেয় না । এ নিয়ে তার আপত্তি থাকলে ও কেউ শুনে না ।

রমিজ ধান কাটতে কাটতে এক পর্যায়ে দেখে ইঁদুর গর্তে করে ধান লুকিয়েছে । ইঁদুর তাকে দেখে দৌড়ে গর্তে লুকিয়েছে । রমিজ একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ইঁদুরের খেলা দেখে । গর্ত থেকে ইঁদুর মাথা বের করে রমিজকে দেখে – আবার ভিতরে লুকায় । সে এই খেলা দেখে আপন মনে হাসে আর মনে মনে বলে- ইঁদুর  তুই বুঝিস না – মালিক গর্ত খুঁড়ে ধান উঠিয়ে নেবে আর তোর ও জীবন  এখানেই শেষ । এক পর্যায়ে রাইসুদ্দিন  এসে গর্ত খুঁড়ে ইঁদুরকে মেরে ধান উঠিয়ে নিয়ে যায় ।

রমিজ বলে চাচা – ইঁদুর তো আমার ঘরে ও আনাচে কানাচে থাকে । ভাত খেতে বসলে এগিয়ে আসে খাবারের জন্য ।  সে বলে ঘরে বিড়াল নাই? বিড়াল দেখলে ইঁদুর পালায় । রমিজ বলে ,চাচা কোত্থেকে একটা বিড়াল মাঝে মধ্যে  আসে এবং একটা ইঁদুর ধরে চলে যায় ।  ঘরে অসংক্ষ ইঁদুর, সারা রাত দৌড়া -দৌড়ি করে এবং আমরা ঘুমাতে পারি না । রইসুদ্দিন বলে  বাজার থেকে ইঁদুরের ঔষুধ কিনে খাবারের  সঙ্গে মিশিয়ে  দিলে ইঁদুর খেয়ে মারা যায়  । রমিজ বলে- চাচা আমি বাজার থেকে ইঁদুরের ঔষুধ নিয়ে দিয়ে দেখেছি , তেমন কোনো কাজ হয় নি ।

সোহেল স্কুল থেকে মন খারাপ করে আজ  ঘরে এসে বলে  আম্মু, স্কুলে খেলতে গিয়ে  আমি জামাটা ছিড়ে ফেলেছি । দেখি – কি ভাবে ছিঁড়লি! আম্মু , একটা ছেলে আমার জামা ধরে টান দিলে – ছিড়ে যায় । দে খুলে আমি সেলাই করে দেব ।  লতা বলে আব্বু আমরা বাজার থেকে পুরাতন কাপড় কিনে পড়ে স্কুলে যাই আর অন্যান্য  ছেলে মেয়েরা আমাদের দেখে মিচকি মিচকি হাসে ।  আবার কেউ কেউ  বলে -তোমরা  পড়া শুনা না করে কাজ করলে  ও  পারো ।    কাজ করলে পয়সা আসবে ,মা-বাবার সাহায্য হবে । ঝর্ণা বলে ,এ সব লোকদের কথা শুনবে না । এরা দুই মুখী লোক- সামনে একরকম বলে এবং পিছনে পিছনে আর এক রকম বলে । তোমরা তোমাদের হারু ভাই ও রেনু অপার মতো পড়াশুনা করে ভালো করবে । রমিজ বলে, মানুষের  নিন্দা, তোমাদের জন্য  আশীর্বাদ ।   তোমরা ভালো ভাবে পড়াশুনা করে বড়ো  হলে , দেখবে তোমাদের সবাই সন্মান করবে । আমাদের দুঃখ -কষ্ট ,তোমাদের পথের দিশা – তোমাদের এগিয়ে নেবে । সোহেল ও লতা বাবার মুখের  দিকে ফ্যাল ফ্যাল  করে  তাকিয়ে থাকে । রমিজ বলে, তোমরা পড়া শুনা শেষ করে-  চাকুরী  করে  সাবলম্ভি হবে -এটা-ই আমাদের কাম্য ।
৬-৭টা মুরগি  ও হাঁস  ঘরের  বাহিরে  খাঁচা  করে রাখা  হয়েছে । মাসে ১-২ বার ডিম্ বিক্রি করে ছেলে মেয়েদের জন্য কাগজ কলম  কেনা হয় ।  ঝর্ণা রান্নার সময়  প্রতিদিন এক মুষ্টি চাল জমা করে সময়- অসময়  ব্যবহারের জন্য । টানা-টানির সংসার,কোনোদিন প্রয়োজনে রান্না করা যায় -এই ভেবে সে জমা করে ।

এক দিন রাতে,  বাহিরে হাঁস -মুরগির কক,কক আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় । মনে হয় শিয়াল এসে হাঁস মুরগিকে  আক্রমণ করছে । ঝর্ণা   বাতি নিয়ে বাহিরে গিয়েছে. দেখে শিয়াল দৌড়ে পালাচ্ছে । সোহেল লাঠি নিয়ে শিয়ালকে তাড়া করছে , শিয়াল বেশি দূরে যায় না – ফিরে আসে । প্রতি রাতে-ই শিয়াল আসে মুরগির লোভে । সাপ ও ডিম্ খাবার লোভে মুরগিকে আক্রমণ করে । চারিদিক থেকে তারের জালি  দিয়ে ঘেরাও করে রেখে ও রক্ষা পাওয়া যায় না ।  শিয়ালের শক্ত দাঁত, কামড়িয়ে খাঁচার দরজা ভেঙে ভিতর থেকে কয়েক বার মুরগি ধরে নিয়েছে ।

গ্রামে বিদ্যুৎ আসে নি । ছেলে -মেয়ে  ঘরে ঘুমাতে যেতে চায়  না – বলে আম্মু , দেখো বাহিরে কি সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদের আলো!  চারিদিক কি সুন্দর আলো ঝল-মল করছে !  চলো- আমরা একটু বাহিরে বসি এবং চাঁদের সোনালী আলো দেখি ।  ঝর্ণা কিছুক্ষন ঘরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে থেকে বলে,বাজার থেকে কে যেন টর্চ মেরে মেরে আসতেছে । চলো,আমরা ঘরে যাই । এই বলে ছেলে মেয়েরা ঝর্ণার সঙ্গে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ।

রমিজের চার জনের সংসার , কোনোদিন আধ -পেটা খেয়ে  ও  দিন যাপন করতে হয় ।   প্রতি দিন কম খেয়ে খেয়ে ছেলে -মেয়েদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে ।  রাস্তার আনাচে -কানাচে গিয়ে কচু পাতা, মাঠ থেকে  শাপলা, শালুক ,পাট শাক এনে রান্না করে  ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খেয়ে- না খেয়ে কোনো রকমে দিনের পর দিন পার করছে । ছেলে-মেয়েরা প্রায়-ই সর্দি-কাশি এবং জ্বরে ভোগে ।  রহমত বলেছে বাড়ির কেস মীমাংসা হলে, রমিজকে ঢাকা নিয়ে ওদের সঙ্গে  রিক্সার ব্যবস্থা করে দেবে  – এতে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসবে ।

ঘরের সামনেই একটা প্রকান্ড তালগাছ, গাছের তালগুলি বেশ  ভালো জাতের ।তাল পাকার সময় হলে একটা-দুইটা করে তাল প্রতি রাতে গাছ থেকে পড়ে । ঝর্ণা বা ছেলে-মেয়েরা ভোরে  তাল কুড়িয়ে আনে এবং বাজার দিনে বিক্রি করে এটা সেটা কিনে নিয়ে আসে ।
তাল গাছে ছোট ছোট  বাবুই পাখি  বাসা বেঁধেছে- সোহেল ও লতা তাকিয়ে বলে, দেখো কি সুন্দর পাখির বাসা!  কি অপূর্ব যত্ন করে পাখিরা বাসা বেঁধেছে যা ঝড়ে ও নিচে পড়ে না ।  আচ্ছা মা, দেখো  বাবুই পাখির এ অপূর্ব  সুন্দর বাসা অন্য কোনো গাছে দেখা যায় না কেন ?
ঝর্ণা বলে , তাতো বলতে পারিনা । হয়তো অন্য কোনো গাছে ও বাসা বাধে -আমরা জানি না । সর্বত্র তো আর তাল গাছ নাই ।  ওরা মনের আনন্দে সে-ই কবিতার  কয়েকটা লাইন আওড়ায়   ,” তালগাছ এক পায়ে দাড়িয়ে , সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে …”  শকুন এই গাছকে পছন্দ করে , অনেক উঁচু থেকে ওরা  খাবার প্রত্যক্ষ করে । সর্বদা গাছে বসে নিচে খাবারের খোঁজে তাকিয়ে থাকে । জীবন্ত সাপ ও অন্য কোনো প্রাণী দেখলে চোঁ মেরে তুলে নিয়ে গাছে বসে ।  মৃত গরু, ছাগল বা অন্য কোনো প্রাণী দেখলে সব কটা শকুন উড়ে গিয়ে পেট ভরে খেয়ে গাছে বসে থাকে ।

আজ সন্ধ্যার পর  সোহেল ও লতা ঘর থেকে বাহিরে  তাকিয়ে দেখে কেরামত আলী মিয়া বাজার থেকে টর্চ মেরে মেরে রাস্তা দেখে  বাড়িতে আসে ।  রাস্তার দুইদিকে ধান ক্ষেত,  সাপ রাতে গর্ত থেকে বের হয়ে পোকা মাকড় খায় ও রাস্তায় শুয়ে থাকে । সোহেল বলে মা -সে দিন সন্ধ্যার সময় বাজার থেকে আসার সময় আমি সাপ, দেখেছি রাস্তায় শুয়ে আছে । ঝর্ণা বলে, রাতে আলো ব্যাতিত ঘর থেকে বাহিরে যাবে না । আমি হাঁস মুরগির বাসার  নিকট কয়েকবার  সাপ দেখেছি ।

রাতের অন্ধকারে  সিঁদেল কেটে  চোর কেরামত আলী মিয়ার ঘরে ঢুকে হাঁটা হাঁটি করার সময় রাবেয়া বেগম- কে কে বলে চিৎকার শুরু করলে ওরা দৌড়ে পালিয়ে  যায় । কাজের লোকেরা দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের পিছনে কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসে । কেরামত আলী মিয়া সন্দেহ করে রমিজ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে । পর দিন সে থানায় গিয়ে কেস করে এবং রমিজকে সন্দহ করে – জানিয়েছে । পুলিশ রমিজকে  থানাতে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে । রমিজ বলে স্যার ,আমি গরিব মানুষ, কেরামত আলী মিয়া আমাকে এখান থেকে সরানোর জন্য বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করে । সে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্য আমার বিরুদ্ধে এই কেস করেছে । আমার বিরুদ্ধে  কোর্টে কেস দিয়েছে,  ফন্দি করে আমাকে আর একটা কেসে ফেলেছে । ওর স্ত্রী ও মেয়ে রাতে আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে –  আমরা স্যার এ ব্যাপারে কিছুই জানি না ।  রাবেয়া বেগম এবং তাদের কাজের লোকেরা বলে আমরা যেই লোক দেখেছি ,ওরা রমিজের মতো লোক নয় এবং দিলারা বলে আমি এবং মা দুই জনে রমিজের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি ওরা ঘুমানো ছিল এবং ওরা দরজা খুলে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে ।

দিলারা স্কুল থেকে যাওয়ার পথে ঝর্ণা তাকে ডেকে নিয়ে কাঁন্না  কাটি করে বলে আমরা গরিব মানুষ  – তোমরা আব্বু  বেরহম লোক । তোমরা এসে দেখেছো আমরা ঘুমিয়েছিলাম । তোমার আব্বু কি ভাবে রমিজের নাম সন্দহ করে থানাতে দেয়- এই  বলে ঝর্ণা দিলারাকে জড়িয়ে কাঁন্না কাটি করে । দিলারা বাড়িতে গিয়ে বলে -আব্বু তুমি কি ভাবে রমিজ আঙ্কেলের নাম সন্দহ জনক ভাবে দিতে পারো? তুমি এই কাজ করতে পারো ভেবে আমি ও আম্মু ওদের বাড়িতে গিয়ে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়েছি । দিলারার চেঁচা -মেছি শুনে  কেরামত আলী বলে, আমি ওদের নাম থানায় গিয়ে কেটে দেব । আব্বু তুমি যদি এ সব অন্যায় বন্ধ না করো , আমি না খেয়ে মরবো । রাবেয়া বেগম বলে আমি ও তোর সঙ্গে না খেয়ে মরবো – আমরা মরলে তোর আব্বু  শান্তিতে থাকবে । কেরামত আলী মিয়া বলে  রমিজ যদি এ কাজ না করে থাকে – এই কাজ কে করলো ?  দিলারা বলে আব্বু, প্রতি বৎসর গ্রামে ২-৪ টি এ জাতীয় চুরি হয়ে থাকে । এ কাজ কি রমিজ আঙ্কল করে ? তুমি কেন নিরহ মানুষেকে সন্দহ করো ?
কাজের লোক আজিম ও রফিকুল্লাহ বলে দাদা ওই লোকগুলি বাজারের দিকে গিয়েছে । আমরা যখন ফিরে আসতেছিলাম, তখন দাদি ও দিলারা ওদের সঙ্গে কথা  বলতে দেখেছি  ।

কেরামত আলী মিয়া বলে এমন ও তো হতে পারে, রমিজের -ই কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র ছিল ।  দিলারা বলে , ও অসহায় নিরীহ মানুষ- কোনো দিন ও এ কাজ করবে না, কি ভাবে তুমি সন্দহ কর?
কেরামত আলী মিয়া বলে যার মাল হারা যায়- তার ঈমান ও হারা যায় । যে পয্যন্ত প্রমান না হবে আমি যে কোনো লোককে সন্দহ করতে পারি ।
দিলারা বলে ,সারা গ্রামে প্রতি বৎসর চুরি হয় । তুমি কি  রমিজকে আঙ্কলকে-ই  সন্দহ কর ?
তুই এত তর্ক কোত্থেকে শিখলি ?
তুমি আমাকে শিখিয়েছো ।.
এ সময় থানা থেকে সেকেন্ড অফিসার এসে ওদের বৈঠক খানায় বসে কেরামত আলী মিয়াকে ডেকে পাঠিয়েছে । কেরামত আলী মিয়ার সঙ্গে দিলারা ও রাবেয়া বেগম গিয়ে উপস্থিত হয়েছে । সেকেন্ড অফিসার বলে আমি আপনাদের ডাকি নি । ওরা বলে স্যার ,আমাদের এই কেসে বক্তব্য আছে, সে জন্য আমরা এখানে থাকতে চাই । অফিসার বলে বলুন আপনাদের বক্তব্য আগে শুনবো । রাবেয়া বেগম বলে এই কেস- এ রমিজকে সন্দহ করে নাম দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভুল ।এই নাম কেটে দেবেন । দিলারা বলে এটা আমার ও বক্তব্য স্যার ওরা সম্পূর্ণ নির্দোষ ।
পুলিশ অফিসার বলে,  এর স্বপক্ষে আপনাদের কি কি বক্তব্য আছে ?
রাবেয়া বেগম বলে স্যার, চোর যখন ঘরে ঢুকে  ,আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়ে কে কে বলে চিৎকার করতে শুরু করি । সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সব লোক ঘুম থেকে উঠে চিৎকার শুরু করে এবং চোর  দুইজন  দৌড়ে পালিয়ে যায় । আমাদের কাজের লোক আজিম ও রফিকুল্লাহ বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে তাদের পিছনে পিছনে ধাওয়া  করে ।
আপনারা কি লোক দুইটাকে চিনতে পেরেছেন?
না- ঘরে অন্ধকার ছিল আমরা ওদের চিনতে পারি নি । তা ছাড়া আমরা   ঘর থেকে বের হওয়ার  পূর্বে-ই চোর দৌড়ে পালিয়েছে ।
আপনারা রমিজের বাড়ি কেন গিয়েছেন?
দিলারা বলে রমিজদের বাড়ি রাস্তার পার্শে ।  আব্বু রমিজ আঙ্কলকে  সন্দেহ করতে পারে এই ভেবে  আমরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই বাড়িতে গিয়েছি ।
আজিম ও রফিকুল্লাহ যখন চোরের পিছনে দৌড়াচ্ছিলো ,আমরা দুই জন তখন ওই বাড়িতে গিয়ে ওদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়েছি । রমিজ ঘুম থেকে উঠেছে । কাজেই ওকে কোনো ক্রমেই দোষী বলা যাইতে পারে না । রাবেয়া বেগম বলে -আমি জানতাম ,আমার স্বামী  রমিজকে আসামি করে থানায় কেস দিতে পারে – সে জন্য আমরা ওই বাড়িতে প্রথম-ই গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছিলাম ।
পুলিশ অফিসার- আজিম ও রফিকুল্লাহ -কে প্রশ্ন করে, তোমরা কি লোক দুইটাকে  চিনতে পেরেছো ?
স্যার,না ।  আমরা ঘুম থেকে উঠতে উঠতে চোর অনেক দূর চলে গিয়েছে এবং আমরা অন্ধকারে চিনতে পারি নি ।
পুলিশ অফিসার বলে, আচ্ছা-আমি রমিজের নাম কেটে দেব । দিলারা ও রাবেয়া বলে স্যার ,আপনি দয়া করে ওর নাম কেটে দেন – আমরা দুই জন ওর স্বাক্ষী হবো । অফিসার বলে , আমি কেস রেজিস্ট্রি এখানে আনি নি , পরে অফিসে  গিয়ে ওর নাম উইথড্র করে দেব ।
রাবেয়া ও দিলারা বলে স্যার, আপনি এখানে অপেক্ষা করেন । আমরা দুই জন গিয়ে ওদের ডেকে নিয়ে আসবো,প্রয়োজনে আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করেন । পুলিশ অফিসার বলে আপনারা যদি ওদের সন্দহ না করেন -ওদের জিজ্ঞাসা করার দরকার নাই । এই বলে পুলিশ অফিসার তার ডিউটি শেষ করে চলে যায় ।
রমিজের নামে কেরামত আলী মিয়া কোর্ট কেস দিয়েছে – ওদের বাড়ি কেরামত আলী মিয়ার বাবা নেয়ামত আলী মিয়া, রমিজের বাবার কাছে থেকে কিনেছে । কিন্তু তারা বাড়ি ছাড়ে নি , বহু বৎসর থেকে রমিজের বাবা ও রমিজ এই বাড়িতে আছে । বাড়ির খাজনা কেরামত আলী মিয়া ও তার বাবা দিয়ে আসতেছে । সে খাজনার কাগজ পত্র দেখায় ,কিন্তু বেচা কেনার দলিল দেখাতে  পারে নি । AC ল্যান্ডের অফিস এই কেসের রায় রমিজের নামে দিয়েছে এবং কেরামত আলী মিয়া চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে কেস দিয়েছে এবং একটা দলিলের কপি ও   বের করে কোর্টে দাখিল করেছে ।

দুই পক্ষকে কাগজ নিয়ে যাওয়ার জন্য কোর্টে থেকে নোটিশ দেয়া হয়েছে । কেরামত আলী মিয়া একজন উকিল নিয়োগ করেছে । বিবাদী পক্ষ রমিজ মিয়া তার বন্ধু রহমতকে এই ব্যাপারে বলেছে । রহমত – আফজালের হেডমাস্টার আতিক সাহেবকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছে । আতিক একজন অবসর প্রাপ্ত  হেডমাস্টার এবং সে দেশে জনহিতকর কাজ করে । সে  রমিজের কাছ থেকে কাগজ পত্র বুঝে নিয়ে  কেসের দিন কোর্টে সাহায্য করবে বলে অঙ্গীকার করেছে ।
কেরামত আলীর স্ত্রী রাবেয়া ও মেয়ে দিলারা বলে ,তুমি কি কোর্টে যাবে  রমিজের বিরুদ্ধে?
তোমার কি হলো- তুমি কি বুঝ না যে লোকজন তোমাকে কে কি বলে?
কেরামত আলী বলে আমি বাবার কেনা জমি উদ্ধার করতে যাইতেছি । দিলারা বলে দাদা যে জমি কিনেছে তার কি প্রমাণাদি আছে ?
হ্যাঁ ! আমি দলিলের কপি বের করেছি ।  তা ‘ ছাড়া  জমির খাজনার কাগজ  আমাদের নাম আছে ।
দিলারা বলে ,  তুমি কোত্থেকে দলিল বের করলে- আব্বু ?
তুই এত কথা কেন বলিস ?
আব্বু আমি তোমাকে তো চিনি ,সে জন্য জিজ্ঞাস  করি । কোর্টে তুমি যদি অপমানিত হও,ওটা আমাদের গায়ে লাগবে ।
আমি Lawyer  নিয়োগ করেছি । রমিজ কোনো Lawyer  নিয়োগের মতো ক্ষমতা নাই । কাজেই আমি এই কেস পাবো । আব্বু ,তুমি এই গরিব লোকটাকে  এই বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ- তাই না ?
আমাদের দুই ভাই  ঢাকা থাকে ,ওরা কোনোদিন ও দেশ গ্রামে আসবে না । তুমি কার জন্য এ সব করতেছো ?
বাড়িটা সুন্দর করা আমার একটা স্বপ্ন । আমি তাই করবো । আমি যতদিন বেঁচে থাকবো- সুন্দর ভাবে থাকবো ।
আব্বু, আমি যা বুঝি – দাদা হয়তো কিছু টাকা রমিজ আঙ্কেলের বাবাকে দিয়েছে । কিন্তু হয়তো সব টাকা দেয় নি, আর বাড়ি রেজিস্ট্রি ও করে নি । তাছাড়া , দাদু বেঁচে থাকতে তুমি কিছু বলোনি-তুমি এখন এ সব নিয়ে কেন হই- চৈ করো ?
এ সব ছেড়ে দিয়ে তুমি লোকজনের সঙ্গে ভালো হয়ে চলো । তোমার মৃত্যুর পর এ বাড়িতে কেউ থাকবে  না, এই বাড়ি খালি পড়ে  থাকবে  ।
তুমি কি সারা জীবন বেঁচে থাকবে ?
দিলারা তুই আমার সঙ্গে সারা দিন তর্ক করিস । আমি যদি হেরে যাই ,যাবো এতে তোদের কি ?
আব্বু ,এটা আমাদের ইজ্জতের ব্যাপার । মানুষ তোমাকে খারাপ বলবে, এটা আমাদের গায়ে লাগবে ।
রহমত আঙ্কেল  বাড়ি-ঘর হারা মানুষ, আমাদের এত গুলি ঘর একটু জায়গা দিলে কি কোনো ক্ষতি হতো ?
রমিজ আঙ্কেল নিজে খাইতে পায় না ,উনি ৫-৬ মাস  ওদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে শেষে ঢাকা পাঠালেন । গ্রামে আমাদের মতো কত কত লোক  যারা অবস্থা সম্পন্ন এবং থাকার জায়গা আছে ,কিন্তু কেউ  তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নি । আব্বু তোমাদের এত  অহংকার , মানুষকে তোমরা একটু সাহায্য করতে চাও না ।
চরের জমি “জোর যার মুল্লক তার ” দখল করে নিতেছে । এই যে রহমত আঙ্কলের মতো গ্রামে অনেক অসহায় লোক আছে ,তাদের জমি ও চরে জেগে উঠেছে । তুমি যদি একটু সাহায্য করতে ,তাহলে সে ও তার জমি পেতো ।
রহমত তো আমার ধরে কাছে ও আসে না । আমি কি ভাবে তাকে সাহায্য করবো ।
রহমত আঙ্কল আসলে -তুমি কি সাহায্য করবে ?
আরে পাগল মেয়ে !  ওরা আমাকে দেখলে অন্য দিকে ফিরে চলে যায় । আমি তাকে কি ভাবে সাহায্য করবো । তুমি সাহায্য করতে চাইলে আমি গিয়ে রমিজ আঙ্কলকে দিয়ে খবর দিলে অবশ্যই আসবে ।
হ্যাঁ ! করবো । ঠিক আছে তুই বল কাগজ নিয়ে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে ।

কেসের দিন কেরামত আলী মিয়া একজন উকিল নিয়ে কোর্টে উপস্থিত । রমিজ পূর্ব থেকে এই কেস নিয়ে রহমতের সঙ্গে আলাপ করলে মাস্টার আতিক নামের এক সমাজ সেবক কে কেস পরিচালনা করতে অনুরোধ করে । আতিক সাহেব কারো কাছ থেকে কোনো পয়সা কড়ি না নিয়ে ভলান্টিয়ার হিসাবে কেস করে দেবে বলে আগে থেকে অঙ্গীকার করেছে । কেরামত আলী মিয়া আতিক সাহেবকে কোর্টে দেখে হকচকিয়ে  যায় এবং ভাবে এই কেসে হয়তো সে জিততে পারবে না- সে তার উকিল দিয়ে আতিক সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে । আতিক সাহেব বলে কেরামত আলী মিয়া যদি কেস না করতে চায় , আমরা লিখে কোর্টে কেস  উইথড্র করার জন্য অনুরোধ করবো । কিন্তু কেরামত আলী মিয়া সে ধরণের কোনো অঙ্গীকার করবে কি ?
জজ  এজলাসে উঠে  কেস পড়ে কাগজ পত্র  দেখে সিদ্ধান্ত দেবে বলে বৈকালিক আর একবার দুই পক্ষকে উপস্থিত হওয়ার জন্য আদেশ দিয়ে কেস  সাময়িক মুলতবি করে ।
বৈকালিক অধিবেশন বসলে জজ  দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে -AC ল্যান্ডের আদেশ বহাল রেখে কেস মীমাংসা করে দুই পক্ষকে রায় মেনে নিতে আদেশ দিয়ে কেস মীমাংসা করে ।
কেরামত আলী মিয়া এগিয়ে এসে আতিক সাহেব কে বলে, আমার ছেলে মেয়েরা কেউ কেস চালাতে রাজি নয় এবং আমি এ নিয়ে আর কোনো কেস করবো না ।
দিলারা বলে আব্বু তুমি রাজি হয়ে একটা ভালো কাজ করেছো এবং আমরা অনেক আনন্দিত । গ্রাম ও এলাকার লোক তোমাকে অনেক সন্মান করবে – তুমি এই সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে ।

দিলারা বলে , হাসি, আন্টি, হারু ভাই এবং রেনু আপুকে নিয়ে বেড়াতে আসলে আমরা তোমাকে তাদের খাওয়ার জন্য পুকুর থেকে একটা মাছ দেয়ার জন্য অনুরোধ করে ছিলাম । কিন্তু তুমি  শুনো নি । ওরা রমিজ আঙ্কেল  সহ মাঠে গিয়ে মাছ ধরেছে । আমি ও ওদের সঙ্গে গিয়েছিলাম মাছ ধরা দেখতে । আমরা খুবই আনন্দ করেছি ,তোমাকে ভয়ে বলি নি ,শুনে তুমি হয়তো অনেক রাগ করবে । আজ যেহেতু কেসের রায় হয়েছে, তাই তোমাকে বললাম ।
আব্বু, তুমি চেষ্টা করে চরে ওদের জমি বের করে দিও । বললাম তো আমি চেষ্টা করবো । ওদেরকে বলবে আমাকে কাগজ দিতে ,আমি এখানকার চরের কিছু প্রতাপশালী লোকদের চিনি এবং ওদের কে দিয়ে চেষ্টা করে দেখবো যদি কিছু করতে পারি ।

রমিজ পর দিন ঢাকা গিয়ে বলে, জজ AC ল্যান্ডের আদেশ বহাল রেখেছে । আমি কেস পেয়েছি এবং কেরামত আলী মিয়া স্বীকার করেছে- এ নিয়ে আর কোনো বাদানুবাদ করবে না ।
রাহমাত ভাই ,তুমি সাহায্য না করলে আমি এ কেস কোনো দিন পাইতাম না ।
ক্রমশ :

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধশিকারী-পর্ব ১
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন