দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ০৫।।
পাওয়া, না-পাওয়ার মধ্যে গতিশীল ফারাক মাপার জন্যে গজ-ফিতে খুঁজতে গিয়ে হয়ত দেখবে বহুল প্রতীক্ষিত সেই হলুদ পাখিটা আজো হিজলের ডালে বসে নেই। বিপরীতে একটি ঝটিকা হাহাকার ঝরাপাতার অবয়বে মর্মর হয়ে বৃষ্টির দিকে ছুটে গেল। তবে ধ্বংস কি শুধু মূর্তিমান কোনো আসুরিক স্মরণ; স্মরণে ভিটেমাটিহীন হায়নার পরিত্যক্ত উন্মাদনা? মার্জিত মিছিলে মৌলিক ভ্রমররা থাক অগ্রভাগে। তাতে ভিন্নকথার পরস্পরবিরোধী আলসেদের বলার কিছুই থাকবে না। ব্যক্তি-বামুনের জোছনাতে স্নান-সারাকে তুমি সমুদ্রে অবকাশযাপনের সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছিলে। পাপপুণ্যের বিচারে চমক গেঁথে দিতে গাছেগাছে ঝোলানো হল আসন্ন কবিতার বিগত কিছু বেগুনি পাণ্ডুলিপি।
‘বেগুনি রঙ আমার বড়ো প্রিয়!’ – একদিন ফিসফিস করে আমার কানেকানে বলেছিলে তুমি। কেন বলেছিলে ওমন কথা? এরপর যতবারই সর্বানুভূতির দিঘিপাড়ে যেতাম, নিজেকে খুব একলা মনে হত। উঠতি একাকীত্বের সামগ্রিক পোশাক বুঝি খুব আঁটসাঁট? মনে হত– দিঘির নির্জন জলগুলো আজকাল ভীষণ বেগুনি। এমন এক-নির্বেদ কীর্তনখোলা বুকে নিয়ে আমি ক্রমান্বয়ে পিঁপড়ে হয়ে যেতে থাকি।
বিস্বাদ কাস্তে থেকে খসে-পড়া হাতলের খনিজ অস্বস্তিতে কৌতূহলী হয়ে চরে বেড়ায় কয়েকটা হাঘরে পিঁপড়ে। তাহলে খুঁজে বের করা হোক কোনো বহুল-প্রস্তাবিত তীক্ষ্ণ মিশ্রণ যেখানে বিজারতি অর্বুদ অক্ষমতা আশার অগ্নিগর্ভ সঙ্কেতে!
রম্বস-আকারের গুটিকয়েক সঙ্কেত সাজঘরে দ্বীপের মতো ঝিনুক পোষে তরল কাচে। যেমন খুশি তেমন সাজোর আবর্তে কেউকেউ মুখোমুখি হল নির্বাসনে-যাওয়া বিচারপতিদের। ওদের বুকপকেটে অঙ্কিত ফলিত লক্ষ্মীপেঁচার ছবি। দিনের অপেক্ষায় থাকতে-থাকতে যে-সকল পাখির সবাই পেঁচা হয়ে গেছে, তাদের জন্যে উৎসর্গিত হল বিশেষ শরণার্থী শিবির। আয়োজিত হল সৌজন্য-শুভকামনার বহুমাত্রিক প্রার্থনা। তাই বলে সেলাই-করা হল না অস্ফুট কাকতাড়ুয়ার দেহে সুশোভিত জামার ছেঁড়াখোঁড়া হৃদয়। পাশে পড়ে রইল বক্ষভেদী বাতাসের সূচালো অগ্রভাগ, ধাতব অপমানবোধের তুলোট শিরস্ত্রাণ, তুষারপাতের বাণিজ্যিক ইঙ্গিত।
সান্ধ্যভাষার ইঙ্গিতে ছিল পঞ্চডালের কথা। সে ডালে কি জোছনাবরণ কোনো পাখি বসে? চঞ্চল চিত্তে চন্দ্রমুখীর পরাঙ্মুখ উঁকি অমাবস্যার লতাগুল্মে জর্জরিত। আমার করার কিছুই থাকে না। হ্যারিকেনের অদ্বৈত সলতেটা একটু উস্কে দিই। এবার ঘরজুড়ে আলো আরো সহজ-নিঃসঙ্কোচ হল। অঙ্ক-আপার কথাগুলো কানে ভাসল, ‘শুধু দেখতেশুনতে ভালো হলেই চলবে না। পড়াশুনাতেও ভালো হতে হবে!’
অঙ্ক কষে যাচ্ছি খাতাভরে। একটা বানর তৈলাক্ত বাঁশের ছয়ফুট উপরে উঠেই আবার পাঁচফুট নিচে! তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্বাপদ ঘুম আসা-যাওয়া করছে চোখের পাতায়-পাতায়। শঙ্খের মতো সুন্দর অঙ্ক-আপার শাড়ির লাবণ্য আমি কোন গাণিতিক সূত্রে মাপব? নিদ্রার সংক্রমণে বারবার গুবলেট বেঁধে গেল সকল গাণিতিক হিসেবে।
উড়াল-সম্পর্কের সংক্রমণে প্রজাপতি হতেহতে কখন যে কিছু-আকাঙ্ক্ষা রঙিন পেনসিলের এক-পশলা আঁকিবুঁকি হয়ে উঠেছিল– টেরই পাই নি!
মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভিখেরি অক্ষাংশে-আঁকা যাবতীয় অভিযোগের মিনার।
কোন মুখে আসলকে নকল হাত-ধরে নিয়ে যায় অবসরযাপনে? চৌরাস্তার মোড়ে নিঃসঙ্গ পাথরপাখি নিমগ্নে ডুকরে উঠল, ‘পাথর-সময়, তোমার কাছে চাই নি বিবর্ণ অমরতা!’ হাঁটু মুড়ে ব’সে মাদুরের প্রশান্তি আঁজলা ভ’রে নিই। এমন ক’রে একদিন আমার জানালায় উঁকি-দেয়া ডালিমগাছটার সবজে-গোলাপি ভাষাটা মোটামুটি শিখে ফেলি। ক্ষীরের সুগন্ধে সোনার মাছিরা অনবরত ভনভন সঙ্গীতচর্চা করে কিনা জানি না। তবে একেক দিন দিগন্তের একেক রঙ দেখে বলে দিতে পারি আজ কী বার।
সাধারণত প্রতি সোমবারে আমি একটি সবিশেষ ঝড় প্রত্যাশা করি। সে-ঝড়ে পৃথিবীর সকল বাড়িতে বেজে উঠবে সহিংস সংশয়ের বিদায়ঘণ্টা।
মসৃণ সংশয়ের দুখজ ঢাল বেয়ে সুখ কালান্তরে যেতে-যেতে অস্তগামী সূর্যকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘তোমার আরেক নাম রাখলাম উদয়। নদীর ঢেউ কক্ষনো সমাহিত হয় না। সে অন্য সময়ে অন্য রূপে এসে নদীকে আগলে রাখবেই।’
লাঙলই ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম অকর্ষিত জমির বেবাক কামনা-কাতরতা।
আর আকুলতা? মটরদানার চেয়েও অবতল তার অঙ্গ! বৃষ্টির চেয়েও নিম্নগামী মানুষের স্নেহ।
বিতর্কিত মেঘে যেমন বৃষ্টি হয় না, তেমন অতর্কিতে মায়াও ছেড়ে যায় না। কে চায় খাঁচাতে-বন্দি বনের পাখিকে ছেড়ে দিয়ে তাকে আবার খাঁচাতে ভরতে? চাবি তো তালাতে উপগত কোনো অনুগ্রহ নয়। কেবলি একটি চলমান প্রার্থনা! ও বর্ণাঢ্য প্রার্থনাজুড়ে নিশান উড়ায় যুগল সিদ্ধির প্রান্তিক আকাঙ্ক্ষা। গৃহস্থের উঠোনে গাঁয়ের মোড়ল পিঁড়েতে এসে বসলে, উঠোন পিঁড়েকে বলে, ‘আমি তোকে আমার সৌভাগ্যের অংশীদারিত্ব দিলাম।’
যথারীতি বুঝতে শিখলাম, ঘুমন্ত হাতুড়ির সাক্ষ্য থেকে একটি বল্লমের সফল জন্মকথা জানা যায় না।
আসলে আমরা কোনো এক-জাদুমন্ত্রবলে বদলে যাই বলেই সময় বদলে যায়। বদলে যেতে হয়। আমাদের বেকুব পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন দিন আসে পালান্তরে।
শিশিরে অমনোযোগী পা ভিজে গেলে, একটি শিউলি আমার দিকে পাশ ফিরে দেখে। গরুগাড়ির দুলুনি-চুয়ে-পড়া প্রস্থান মুঠিতে পুরি। বাঁশের খুঁটিতে খোদিত পয়সা-জমানোর কোটরে তা যত্নে লুকিয়ে রাখি। যে যায় রেখে যায় তার প্রস্থান মায়ার আলোতে সাঁঝের কালোতে। ওসব কুড়োতে-কুড়োতে আমার অনেক জাফরানি-নীল মারবেল হল। হল স্বল্পপরিচিত কাচপোকাদের সঙ্গে ভালবাসা। ভেলা বেয়ে নদীর মাঝখানে গিয়ে শাপলা তুলতে শিখলাম।
তন্দ্রালস শাপলা কখন উন্নাসিক মেঘের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল? এমন চিন্তার ঘূর্ণি মস্তিষ্কে যখন রাজকীয় উৎসবে ব্যস্ত, তখন সে খুঁজে ফেরে তার সুখদ জন্মদাগ। পানকৌড়ির ঘোরলাগা চাঞ্চল্য থেকে একটুকরো নম্রতা চড়ুই পাখির মতো উড়াল দিল। ঝুপ করে একটি বিঘত কচুরিপাতাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিস্তিতে-কিস্তিতে আকাশ এখন পুরোটা নদীর দখলে। কিচিরমিচিররা বাতাসে আনাগোনা বাড়িয়ে দিলে টাপুরটুপুরদের দেমাক বেড়ে যায়। সময়ে-অসময়ে তাদেরকে এত-এত ডেকে হয়রান করার কোনো মানে হয়? পরক্ষণে আবার ভাবে– আরেকবার ডাকলেই ঝমঝমিয়ে নেমে আসবে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভুবনডাঙার যত অসারতা আর জীর্ণতা।
অনেক পরে জেনেছি– বৃষ্টি-উপযোগী সিদ্ধান্তের দোকানে ঝুলে থাকে কামনাহীন মেঘ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে সহজে বিক্রি হয়ে যাবার জন্যে। মেঘদূতের উপযুক্ততা হারিয়েছে সেই কবে! অবসরে এখন তারা বারাঙ্গনাদের বাড়ির ছাদে এসে ব্যাঙ্গমাবেঙ্গমীর গল্প শোনাতে খুবখুব ভালবাসে। কালেভদ্রে খুঁজতে থাকে উত্তরাধিকারসূত্রে-প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক গুণাবলি, যেগুলো তারা হারিয়েছে পূর্বজন্মের কোনো ক্ষয়িষ্ণু ক্রান্তিকালে। (চলবে…)
অসাধারণ বর্ণনা
তাহলে খুঁজে বের করা হোক কোনো বহুল-প্রস্তাবিত তীক্ষ্ণ মিশ্রণ যেখানে বিজারতি অর্বুদ অক্ষমতা আশার অগ্নিগর্ভ সঙ্কেতে!
রম্বস-আকারের গুটিকয়েক সঙ্কেত সাজঘরে দ্বীপের মতো ঝিনুক পোষে তরল কাচে। যেমন খুশি তেমন সাজোর আবর্তে কেউকেউ মুখোমুখি হল নির্বাসনে-যাওয়া বিচারপতিদের। ওদের বুকপকেটে অঙ্কিত ফলিত লক্ষ্মীপেঁচার ছবি। দিনের অপেক্ষায় থাকতে-থাকতে যে-সকল পাখির সবাই পেঁচা হয়ে গেছে, তাদের জন্যে উৎসর্গিত হল বিশেষ শরণার্থী শিবির। আয়োজিত হল সৌজন্য-শুভকামনার বহুমাত্রিক প্রার্থনা। তাই বলে সেলাই-করা হল না অস্ফুট কাকতাড়ুয়ার দেহে সুশোভিত জামার ছেঁড়াখোঁড়া হৃদয়। পাশে পড়ে রইল বক্ষভেদী বাতাসের সূচালো অগ্রভাগ, ধাতব অপমানবোধের তুলোট শিরস্ত্রাণ, তুষারপাতের বাণিজ্যিক ইঙ্গিত।
অনেক-অনেক ধন্যবাদ আপা। শুভেচ্ছা রইল।