দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ০৪।।
পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আলস্যের দোসর পাললিক নিদ্রা বাউরি ঘাসদের দুলুনিতে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু কে, কার কথা শোনে? খোঁজ! খোঁজ! খোঁজ! বাতাসি খুরের আঘাতে নিষ্পেষিত হল শিশিরের সৌন্দর্যবোধ। তর্কাতীত বীজতলা থেকে খোদ রসুনের যুদ্ধংদেহী ঘ্রাণ ভেসে এল। মাটির অনার্য ঢেলাদের অনেক দিনের ক্ষোভ– তারা কেন শুধু লাঙলের খোঁচাতে ক্ষতবিক্ষত হবে? সে-প্রতিবাদে আলের ধুলোবালিরা সামিল হয় নি। তারা কেবল মুসাফির হাঁসদের ফেলে-যাওয়া পালকের উম ভাড়াটে ইঁদুরের পোড়োগর্তে লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিল।
চড়ুইভাতির আমেজে লুকিয়ে-থাকা সুবর্ণ নদী শেষমেশ এসে বেতস ঝোপে জড়িয়ে যায়। কুরুশ কাঁটার দক্ষতা নিয়ে তরল রুপোর পরবাসে নীল বেতফুলকে করেছে যথার্থ একগুচ্ছ পাতার সপ্রতিভ সবুজ।
শর্করার মতো সাবলীল পঞ্জিকার পাতা থেকে অকাতরে খসে-পড়া দিনগুলো কি নবায়নযোগ্য নয়? ঝকঝকে মাছের রঙচঙে ছবিতে জিভ বুলিয়ে কি প্রতিষ্ঠিত বেড়ালের জাগতিক খিদে মেটে? তারপরেও ধান ভানতে ব্যস্ত ঢেঁকির অলৌকিক নৃত্যমুদ্রায় হয়ত নেচে উঠবে ঘরের তাকে সাজানো মাটির কনে পুতুলটাও।
পুতুলের মতো একটি সুন্দর মুখ হৃদয়ের কোণে উঁকি দিল সন্ধ্যার ক্ষণে। যেন কোনো শুকতারা। নানা উছিলায় কতবার গিয়েছি তোমাদের বাড়িতে। উড়কি ধানের মুড়কি, নারকেলের নাড়ু অথাবা কিছু একটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঝটিকা বেগে নিমিষে উবে গেলে তোমার পড়ার ঘরে! দস্যু বনহুরের লোমহর্ষক গল্পের কুপে ডুবে গিয়ে ভুলে গেলে আমার কথা। একবারো উঠোনে এসে বললে না, ‘তুমি তো মাঝেমধ্যে আসতে পারো!’
হে আমার হৃদয়, আমাকে তুমি হারিয়ে ফেলো না। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি– আমার শূন্যতা আসন্ন সুসংবাদের পরিপূর্ণতায় চিত্রল। কত যে ভুল করে ভুল করেছি! ওরাই আমার জীবনে কখনো এনে দিল তীক্ষ্ণধার সৌভাগ্য। অবিশ্বাসী দুর্ভাগ্য শুধু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে কটাক্ষে তাকিয়ে থেকেছে আমার দিকে।
তুমি জানো নাই, আমি তোমার দিকে নিয়ত চলেছি।
লালন ফকিরের প্রত্যয়ে, পালকির নিপুণ ভূমিকায় কালাকাল আমাকে নিয়ে চলল আধখানা আয়নার পাদদেশে।
জ্যোতিষীর ঘোড়া ত্রিকালদর্শী হিসেবে রাজখেতাব পেয়েছে। মফস্বলের হাটগুলোতে গাধার সঙ্কট দেখা দিল। খাদ্যপরিবহণ বাধাগ্রস্ত। ছোঁয়াচে রোগের মতো দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ল এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ের স্নায়ুতন্ত্রে। কুঁজোরা আরো কুঁজো হল। ভিন্নমত পোষণের উদাহরণস্বরূপ উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে শীর্ষক নাটক লেখা সমাপ্তির পথে। কিন্তু মঞ্চস্থ হবে কোথায়? উজিরের খাস সামন্তরা আবার প্রত্যেকেই জাতিস্মর। কার শরীরে কেমন সুড়সুড়ি তা মেপে বলে দিতে পারে এবার খরা দীর্ঘস্থায়ী হবে, না অঢেল বর্ষায় লবণ-বোঝাই কয়েক শ’ নৌকা বিনা নোটিশেই উত্তাল নদীতে তলিয়ে যাবে!
একটা শাদা নদী রাধার অভিপ্রায়ে আমার হৃদপিণ্ডে একদিন সোনালি সেতার রেখে গেল। সে দিন নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর আর ঋণী মনে হয়েছিল।
তোমাকে যতই ভালবাসলাম ততই নিজেকে ভালবাসতে শিখলাম। মধ্যদুপুরে অনেক দূর থেকে ডাহুকের চক্রাকার ডাক আমার কানে ভেসে আসত। তন্ময় হয়ে ভাবতাম– কতদিন আলিমদের আমবাগানে গ্রাহ্য পাঁচিলে বসে বিকেলে বাদাম চিবানো হয় নি। একটা লাইনটানা কাগজে তোমার নাম এক শ’ এক বার লিখে তোমাকে দিলাম। পরের দিন ইশকুলে যাবার পথে আবার দেখা হল। বেশ গম্ভীর মুখে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে দয়ার্দ্র ভঙ্গীতে বললে, ‘হাতের লেখার প্রতি আরো যত্নশীল হতে হবে।’
বালখিল্যের উদয়াস্ত আর্দ্রতা পুঁজি করে ভেসেছিল ময়ূরপঙ্খি। হারাধনের দশটি ছেলে দিক-বিজ্ঞানে ছিল যার-পর-নাই পটু। নায়ের পাটাতনে খোলা হল পাঠশালা। দুর্ভাগ্যক্রমে দশটি মৎস্যকুমারী সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কী আর করা! অবশেষে দশ ভাই দশ মৎস্যকুমারীকে বিয়ে করে গাঁয়ে ফিরে থিতু হয়। ফলাফল যা দাঁড়াল– জেলেরা একে-একে গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশে পাড়ি জমাতে লাগল।
নিরঙ্কুশ অবজ্ঞা চিরযুবা নয়! এটা জেনেও বর্ণহীন যজ্ঞ দক্ষ কসাইয়ের মতো আমাদের হৃদয় থেকে দৈবিক আলঙ্কারগুলো সিঁদ কেটে নিতে সদা উদগ্রীব।
রাতের আঁধারও তোমার অবজ্ঞা পেতে বারবার ঘুরে আসে। কখনো-কখনো মৃগনাভির ঘ্রাণ বৈঠার ছপাতছপাত সুর। তোমার মুখে স্নিগ্ধতা নিভে গেলে, লাবণ্য জ্বলে ওঠে। মগজের আঁতুড়ঘরে জন্ম নিতে লাগল বিবিধ বিকেল, নীল জলের দুরন্ত পোকা, সাজানো ডাকঘর কিংবা একটি চনমনে চিবুকের চমক। তোমাকে চিরন্তন রূপে যখনি বুঝতে শিখেছি, তখনি বুঝলাম সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। গোলক ধাঁধার রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণে সুখ তো ঝরাপাতার একটুকরো চঞ্চলতা। একটু দমকা বাতাসেই নদীতে পিছলে পড়ে হারিয়ে যায় ব্যস্ত নায়ের উচ্ছ্বাসে অচেনা দিগন্তে।
চিতার-পিঠে-সওয়ার-হওয়া ব্যস্ততা আর কাকে বলে? আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে রাজধানীর নেতারা বধিরদের বন্দরে গেল ভোট ভিক্ষা চাইতে। গাঁয়ের লোকরা এই প্রথম দেখে ডুমুরের গাছেগাছে শোভা পাচ্ছে থোকাথোকা অগণন ফুল। লোকমুখে শোনা গেল – গঠিত হচ্ছে সার্বজনীন প্রতিশ্রুতিরক্ষা-কমিটি। এক-জাহাজ সোনার পাথরবাটি ইতোমধ্যেই পেলব বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। সবচেয়ে ঢ্যাঙা লোকটা বলল, ‘ও-বাটিতে করে আমরা কি টাকার গাছ লাগাতে পারি?’
দপদপে চুল্লির মদ্যপ পালঙ্ক থেকে উঠে-আসা সদ্য-কয়লা হাড়-জিরজিরে টাকার টকটকে ময়লার সৌন্দর্যে মুগ্ধ। মুগ্ধতার নিয়ামককে কেউ কি গেঁথে দিয়েছিল বিগলিত হওয়ার কাষ্ঠল অম্লত্বে? রসুইঘর পর্যটনে এসে ইরানি গোলাপের বহুভাষাবিদ সংগ্রহশালাটাকে দেখা হল না। ব্যঘ্র আফসোসের স্বর্ণলতাতে ঘুরেঘুরে আটকা প’ড়ে কোণঠাসা তৃপ্তির ত্রিভূজ। ভালোলাগারা কি হাজার-দুয়ারি? তবে আত্মাহুতি দিই খৈয়ামের মতো আত্মতৃপ্তিতে। অভিমানী প্রিয়ার কালো চোখের ফসিল-দূরত্ব সে তো আরাধনার বিবর্ধিত উৎস-প্রতিরূপ!
ধ্রুপদী দূরবীনের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে, অন্ধরাও একদিন দেখতে পারবে দুর্বোধ্য আঁধারের মনন, মননের অপর পৃষ্ঠে আশ্রিত হননের ডোরাকাটা চৌকাঠ। তোমাদের পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে আগন্তুক কিছু-চোখ, চোখদের অশ্রু আর অশ্রুদের সলাজ বোতাম। কর্জ করতে পারো বিষাদের মোসাহেব কালো পোশাক! নপুংসক নখ ও প্রিয় চুলদের শবযাত্রাতে ও-আসবাব নিশ্চিত প্রয়োজন। তাছাড়া মানানসই বলে কিছু কথা আছে তো! একদিন আমাকেও বলতে পারো, ‘বলুন, কী চাই!’ (চলবে)