ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি

পর্ব ১৯।। 

আধাআধি রোদ, পরিপূর্ণ বাতাসের শূন্যতা, জীবনমুখী বসতঘর, ফুলের হৃদয়, বৃষ্টিবৃন্তের জবরদখলকৃত মাত্রাবৃত্ত ছন্দ দুয়ার খুলে আজো কি দেবে না উঁকি পরমানন্দে? কখনো-কখনো কান পেতে শুনি, এ মন বড়ো কাঁদে। ভালবাসলেই কঙ্কাবতী রমণীমাত্র পাখিপন্থী নদী। তার পাখির মতো আঁখিজোড়া হয়ে ওঠে কবিতাপ্রবণ। কবিতার ডানারা ঝরে গেলে তারা বুঝি স্পর্ধিত পারদ হয়ে যায়? জোছনাভুক রাতগুলো কি চিরকালই বিচলিত মুসাফিরের ঢঙে গম্ভীরা হাওয়ার ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়ায়? ওদের জামদানি ছায়ারা বড্ড হাঘরে।  

মেঘারানি অঝোরে বৃষ্টি ঝরালেও, পোড়াকপালে গোয়ালা দুধ বিক্রি করে সদাই করে আনে গাঁজা আর জর্দার চটকদার সংশ্লেষ। প্রেম কখনো পপি ফুলের মতো বর্ণিল। মতান্তরে, ভিক্ষান্নের ছলে রাজোচিত সাতকাহন? দোকানি কাকতাড়ুয়াও সেই সোহাগী সম্মোহনে জ্বলেপুড়ে মরে। খরচা হয়ে যায় ভালোলাগার জমানো মোহরগুলো সাততাড়াতাড়ি। 

বেশ তো! চিরকালীন আলমারির পকেটে লুকিয়ে-রাখা ফিতে-ক্লিপ সদানন্দ হীরামন পাখির অনুকরণে তোমাকে মহুয়া-মলুয়ার গল্প বলে। সোনালি কাক আর মেরুন কবুতরের মুখরোচক রূপকথা গেরস্থালির একগুচ্ছ গতিসূত্রকেও গভীরতর মাপকাঠিতে হার মানায়। 

তুচ্ছাতিতুচ্ছ অস্থিরতায় ঋণখেলাপি আঁতুড়ঘরে বারুদগন্ধ ছড়ায় শিল্পবিপ্লবজাতক কবিতার শামুক। 

‘কামুক রঙ্গমঞ্চে, কে-কার শত্রুতা হননে কতটুকু পারদর্শী?’– চক ও ব্ল্যাকবোর্ডের এমন বিতর্কে না-জড়িয়ে আঁকিবুঁকি দেহ নিয়ে স্কুলের শেষ-বংশজাত সিঁড়ি একটি সত্য-সারস হতে চেয়েছিল। ভূগোলের রাশভারি শিক্ষক শাহেরা বানু পদ্যের মতো চিত্রল একটি পাঞ্জাবির খুব কাছাকাছি যেতে চায় নি দু’ হাজার দশ সালে? মিসিসিপির তীরে বসে ওইসব এখন কেবলি আত্মার প্রশ্নবোধক আতসবাজি! 

অলস শিলালিপিতে বর্ণিত বসন্তযুগের অতিঘোর বাইসন সুমেরীয় নিষ্ঠতাতে রাতজাগা-পাখিদের প্রশান্ত ঘুম মেখে নেয় নেহাত আড়ষ্টতায়। ঝকঝকে বৃষ্টির মতো দৃষ্টিনন্দন অগণন নক্ষত্রবিন্দু কী দারুণ অনন্য আজ আকাশে-আকাশে। 

প্রণয়-পটীয়সী বাইজীর উচ্ছ্বাসে কোনো এক-বিষণ্ণতা আমাকে আবিষ্ট করে রাখে সারাবেলা! সারাবেলা!  

এবেলা তুমি বললে, ‘কাঠবেড়ালির মতো একটি তুলতুলে ছটফটে কাব্য আমার বড়ো প্রিয়।‘ তবু আমি গেলাম না সোজন বাদিয়ার ঘাটে। মন্দ কপাল ভেবে সম্ভাব্য বিরহের অমূল্য স্বাদ নিলাম না। ভাঙা-কলসির টুকরো কুড়িয়ে হৃদয়ে সেই যে রাখলাম! এখন এ পথে কেবলি সন্ধ্যা নামে।

ভুলের বন্ধ্যা ভ্রূণে ফুলপ্রবণতা বাড়ুক। আমিও শাহ আবদুল করিমের উছিলায় ভোরের ভঙ্গিমায় নতজানু হয়ে কুড়াব কুয়োপাড়ে পড়ে-থাকা শিউলি ফুল। তোমাকে নিবেদিত প্রতীক্ষা-সৈকতে মাকড়সার মতো সুরেলা আবর্তনে থাকি। অযাচিত মৎস্যগন্ধ্যাও কখনো-কখনো মৃগনাভি-ঘটিত লাবণ্য-উপনিষধ। মননের কোষে-কোষে হোক-না বুনন কিছুটা বাদশাহি নিঃসঙ্গতা। ঝুলে থাকব বিমর্ষ পাতায়-পাতায় আলোর সহর্ষ বন্দনা হয়ে। ঘাসের ডগার সাতমহলা কাঁপন হয়ে একেকটি ধর্মপ্রাণ ঋতুকে তাদের কর্মসূচি মনে করিয়ে দেব। 

কাঁঠালমুচিতে অনুরক্ত তৈলাক্ত ঝালের আটপৌরে আচার কতদিন খাওয়া হয় না! বানরখেলার আসর থেকে ডুগডুগির অপভ্রংশ ধ্বনি ভেসে এল। এমনি ডাকসাইটে মুহূর্তে, সাবানের বক্র ফেনাতে ঘষেঘষে শার্টের কলারে জমে-থাকা ঢালু ময়লা মোছার কথা কারো মনে পড়তে পারে। ফেনার সমবেত চোয়ালে গজমোতি হারের জেল্লাতে তাজ্জব-বুদবুদ হয়ে ফোটে আলোর ঝাড়বাতি। যেমন ক’রে আদি বিশ-শতকের নেপথ্য-নাটকে ক্ষীরের পুতুল পাত্রপাত্রীরা বেলুন-ফোলানো ভুলে গাইতে শুরু করত নৈর্ব্যক্তিক কোরাস। একটি চাপকলের রুটিনমাফিক জলপ্রসবের বেদনা কোথাও যেন কলাবতী ফুলের তীক্ষ্ণধার পরিভাষা হয়ে ফুটে রইল।

ফুটফুটে বোতাম ফুলের ঝাড় আর নীলকুঠির সটান চৌকাঠের ব্যবধান বুঝতে-বুঝতে শিখে ফেলি– শাদা দেয়ালের মতো ঝকঝকে গণিত, পিচঢালা রাস্তার আনুগত্য-সনদ সমাজবিজ্ঞান, চিলেকোঠার পরিপূরক সাহিত্য, আমবাগানের ঋতুহীন ইতিহাস। আমার কণ্ঠ ছিঁড়ে শব্দগোষ্ঠী চিৎকার করতে থাকে, ‘এখানে আমি আছি। ছিলাম কখনো পুবে, কখনো পশ্চিমে।’

ঢিমেতালে বেড়ে-ওঠা একটা মাছের সঙ্গোপন জীবন চাইতে গিয়েছিলাম হাকালুকি হাওরে। বারো ভুঁইয়ার মহালে জলের শরীর শুকিয়ে কাঠ। হাটের বারে দেখি, ঝাঁকেঝাঁকে জেলে উদ্বাস্তু কানামাছি হয়ে পাটালি গুড়ের ওপর ঘুরঘুর করছে মেছো গন্ধের সন্ধানে। শুকপাখি বেচতে এসে, নিঃস্বার্থ বুড়ি শেষবিকেলে এমন টানটান আদিভৌতিক দৃশ্যায়ন দেখে কুব্জহীন লোহার খাঁচা কিনে বাড়ি ফিরে যায়। 

অবেলায় দরজা খোলা ছিল। ভেতরে উঁকি দিতেই অজগর সাপের ব্যাপকতা নিয়ে কেউ যেন টেনেটেনে জিজ্ঞেস করল, ‘কে!’ নির্বাক শুয়োপোকাদের কথা বাদই দিলাম। জামের গাছে ঝুলে-থাকা কালোকালো মারবেলের থোকা থেকে একটি গম্ভীর নিঃশ্বাস টুপ করে নেমে এসে আমার হয়ে উত্তর দিল, ‘আমি! এই আমি!’ 

এই আমি খোলা-জানালার তৃষ্ণা নিয়ে হেলেনীয় ফুলবাগানের কাঙাল ছিলাম। প্রতিদিন গোলাপ-বাজারে যেতাম নানারঙের গোলাপদের ঘরসংসার বিষয়ক গল্প শুনতে। একদিন এক-গোলাপ ঘোড়ার পিঠে বসে-থাকা ঘোড়সওয়ারের হাতে চাবুক দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কি?’ আমি বললাম, ‘জোছনাহীন পৃথিবী থেকে সংগৃহীত ওটা একটি নিরেট দাপট!’

অকপট গোলাপের দীপ্ত লাল মুখ নিমেষে বিষণ্ণ হয়ে গেল। কায়মনে প্রার্থনা করল, ‘পৃথিবীর সব কালকূট হিংস্রতা ভোরের শিশির হয়ে উবে যাক।’

মনেমনে আমার-গড়া কাগজের এক-ঝাঁক নৌকার ভিড়ে যখন ভূমধ্যসগার তলিয়ে যায়, তখন হারানো পুরনো হাতঘড়িটার খোঁজে আমি ভূতের গলিতে পায়চারি করছি। ওমন স্বপ্ন প্রায়ই দেখে থাকি মুখোশ-আঁটা ঝড়ের রাত্রে। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পিঁপড়েরা আজকাল অগ্রজ মিছরির ছুরির অম্লত্ব মাপতে ব্যস্ত। (চলবে…)

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন