‘মকবুল সাহেব, কোরবানির কী ডিসিশন নিলেন ? আপনি আছেনতো আমাদের সাথে ? আজকের মধ্যে অবশ্যই জানাবেন, না হলে হেড মাস্টার সাহেবের মেয়ে জামাই আরেক ভাগ নিবে।’ বগুড়া পৌর উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মওলানা রিয়াজ উদ্দিন একই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক মকবুল সাহেবকে প্রশ্নটি করে জবাবের জন্য উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। অনেকটা মাছ ধরার জন্য ছিপ ফেলে মাছের অপেক্ষায় যেভাবে আমরা তাকিয়ে থাকি তিনি ঠিক সেভাবে তাকিয়ে আছেন মকবুল সাহেবের দিকে।

একটু পরেই মকবুল সাহেবের ক্লাস সেভেনে দিল্লির সুলতানি আমল সম্পর্কে পড়ানোর কথা। শিক্ষক মকবুল সাহেব একটি হাতে লেখা কাগজের নোটে আজকের ক্লাসের বিষয়বস্তু ও পটভূমিকা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। সেই নোটের কাগজ থেকে মাথা তুলে তিনি রিয়াজ সাহেবের দিকে লাজুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘জি ভাই, একটু ঝামেলায় আছি তো, বাসায় আলাপ করে আজ রাতের মধ্যেই জানাবো।’

হেড মওলানা এবার কিছুটা উদাস হয়ে বললেন, ‘আরে ভাই, ঝামেলা /টামেলা এসব রাখুন। একবার চিন্তা করেন, আল্লাহ্পাক যদি হযরত ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে ফেরেস্তাদের দিয়ে দুম্বা কোরবানি না দিতেন, তাহলে আমাদের অবস্থা কি হতো ? আমাদের সবার একেকটি প্রিয় সন্তানকে প্রতি বছর আল্লাহর ওয়াস্তে কোরবানি করতে হতো। তাই বলছিলাম কি, ঈমান শক্ত করুন, ঝামেলা সবসময় থাকবেই, কোরবানি কারো উপর ফরজ হলে আমার মনে হয় কোরবানি দিয়ে দেয়াই ভালো।’ মওলানার এই কথার জবাবে মকবুল মাস্টার আর কথা না বলে ঘড়ির দিকে দেখলেন। ক্লাস শুরুর আর দু মিনিট বাকি। তিনি হেড মওলানাকে সালাম দিয়ে ক্লাসের দিকে এগুলেন ।

সপ্তম শ্রেণীর ক্লাসের ছাত্ররা বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান , অংক, এমন কি আরবি ক্লাসে যতটা স্যারদের ভয়ে তটস্থ থাকে, ইতিহাসের ক্লাসে সেরকম থাকে না । মকবুল স্যারের ক্লাস মানেই তাদের কাছে এক ধরণের বিনোদনের সময়। স্যার কি বলছেন সে দিকে কারো মনোযোগ নেই। নিজেরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, চোর পুলিশ খেলছে, স্যারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মকবুল স্যার প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে দিল্লির সুলতানি আমল নিয়ে লেকচার শুরু করলেন,’বুঝলে বাবারা, সুলতানি আমল হচ্ছে ভারতে ক্রীতদাসদের শাসনকাল। কুতুব উদ্দিন আইবেক ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তিনি ১২০৬ থেকে ১২১০ পর্যন্ত দিল্লির সুলতান ছিলেন । এর পরে আরেক ক্রীতদাস সামসুদ্দিন ইলতুৎমিসকে তিনি ক্রয় করেন। এই ইলতুমিস ছিলেন বেশ সুদর্শন, সাহসী, এবং বলিষ্ঠ যুবক । কুতুব উদ্দিন তাকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলেন, নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলেন। সে ঘরেই জন্ম হলো এই উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম রমণী শাসনকর্তা সুলতানা রাজিয়া।’

হাইস্কুল হোক বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হোক, সারা পৃথিবীতে স্কুল কলেজগুলিতে সহজ সরল শিক্ষকদের উপর ছাত্ররা নানান ধরণের তামাশা করে এক ধরণের বিকৃত উল্লাসে মেতে উঠতে দেখা যায়। আজ বগুড়া পৌর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ক্লাসেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেলো। পিছনের বেঞ্চ থেকে এক ছাত্র বলে উঠলো, ‘স্যার সুলতানা রাজিয়া কি গান গাইতে পারতেন? অমনি ক্লাস শুদ্ধ ছেলেরা হোহো করে হেসে উঠলো। মকবুল মাস্টারের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। অনেকক্ষন লেকচার দিতে যেয়ে মকবুল মাস্টার সাহেবের গলা কিছুটা শুকিয়ে গেল। তিনি ভাবলেন একটু পানি খেলে খুব ভালো হতো। তিনি সেই পানি খাবার ইচ্ছাকে দমন করে, ক্লাসের উচ্ছৃঙ্খল কিশোরদের তাচ্ছিল্য উপহাস অগ্রাহ্য করে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে যেয়ে দেখলেন পকেটে রুমাল নেই। অতঃপর তিনি হাতের তালুর উল্টাপিঠ দিয়ে সেই ঘাম মুছে পুনরায় বিপুল উৎসাহে কথা বলতে শুরু করলেন:
‘ঐতিহাসিকগণের মতে ভারতের মধ্যযুগ বলতে বুঝানো হয় ভারতবর্ষে মুসলিম অভিযান ও আরবদের সিন্ধু বিজয় থেকে শুরু করে মুগলদের শাসন আমল পর্যন্ত। আর এই ভারতের মধ্যযুগে সুলতানদের শাসনকাল অনেকে গুরুত্বপূর্ণ…।’ মকবুল মাস্টারের কাছে ইতিহাসের এসব তথ্যাবলী গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও আজ এই কিশোরদের কাছে এসব যে একেবারেই অর্থহীন তা ক্লাস চলাকালীন সময়ে এদের গল্প গুজব ও কলরব দেখে অতি সহযেই  বুঝতে কারো সমস্যা থাকার কথা না।

হেড মওলানা রিয়াজ উদ্দিন যে কোরবানির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, এটি মূলত সাত ভাগে ঠিক করা হয়েছে। এই সাত ভাগের বৃত্তান্ত হচ্ছে হেড মওলানা সাহেব নিবেন এক ভাগ, হেড মাস্টার সাহেব ইদ্রিস আলী দুই ভাগ, স্কুলের ক্যারানি সাহেব এক ভাগ, ড্রিল মাস্টার ইফতেখার সাহেব এক ভাগ এবং স্কুলের দফতরি মোবারক আলী একভাগ। এখনো এক ভাগ বাকি আছে। হেড মওলানা সাহেব ইতিহাসের শিক্ষক মকবুল সাহেবকে শুরুতে যে বলেছিলেন মকবুল সাহেব এক ভাগ না দিলে হেড মাস্টার ইদ্রিস সাহেবের মেয়ে জামাই সেই ভাগ নিবে, এই তথ্যটি সঠিক না। হেড মওলানা কথাটি কথার ছলে বললেও তিনি আসলে অনুমান থেকে বলেছিলেন। তিনি শুনেছেন এবার হেড মাস্টার ইদ্রিস সাহেবের মেয়ে জামাই, বাচ্চাকাচ্চা সহ ঈদ করতে বাপের বাড়িতে এসেছেন। মওলানা সাহেব এই প্রসঙ্গটি টেনে এনে আসলে মকবুল মাস্টার সাহেবের ওপর একটু মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন যাতে তিনি এক ভাগ কোরবানি দেন। হেড মওলানা এই শেষ এক ভাগ নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। সাত ভাগের ছয় ভাগ পর্যন্ত হয়েছে কিন্তু বাকি আর একটিমাত্র ভাগ কিছুতেই হচ্ছে না।

হেড মওলানা বাংলার হিন্দু শিক্ষক সতীশ বাবু ছাড়া বাকি সবাইকে এই এক ভাগ নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছে, এমন কি নিজের পাড়ার আশেপাশেও এই এক ভাগের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে, কিন্তু কিছুইতেই এই শেষ এক ভাগের ফয়সালা হচ্ছে না। এরকম অবস্থায় তিনি টার্গেট করেছেন নিরীহ মকবুল মাস্টারকে। এদিকে মকবুল মাস্টারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন সুবিধার না। বগুড়া পৌর উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজির শিক্ষকেরা স্কুলের বেতনের পাশাপাশি বাসায় প্রাইভেট টিউটোরিং করে করে কিছু বাড়তি রোজগার করে থাকেন। এমন কি হেড মওলানাও নিজ বাড়িতে কোরান শিক্ষার আসর থেকে কিছু বাড়তি আয় করেন । কিন্তু,ইতিহাসের শিক্ষক মকবুল মাষ্টারের সেই কায়দা নেই। ছাত্ররা নিশ্চয় ‘ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাঃ বখতিয়ার খিলজি ত্রয়োদশ শতকে নদীয়া পথে তৎকালীন বাংলা রাজা বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনের বাংলা আক্রমণ করেন’ এসব তথ্য জানার জন্য তার বাসায় প্রাইভেট পড়তে আসবে না।

সুতরাং, স্কুলের বেতনের পাশাপাশি মাদলা ইউনিয়নের ঢাকন্তা গ্রামে আড়াই বিঘা ধানী জমি মকবুল মাস্টারের সাত জন মানুষের সংসারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হয়ে এতদিন ভূমিকা রাখছিলো। গতমাসে মকবুল মাস্টারের বড়ো ছেলে আনোয়ার সেই দুই বিঘা জমিয়ে থেকে বিঘা খানিক জমি বেঁচে দিয়ে শ্রমিক হিসাবে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জোর তদবির করে যাচ্ছে। আনোয়ার বি এ পরীক্ষায় দুইবার ফেল করে এবং এলাকায় ডিসের ব্যাবসায় লস খেয়ে শ্রমিক হিসাবে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার মতলব এঁটেছে। হেড মওলানা, মকবুল মাস্টারের এসব হাঁড়ির খবর সবই জানেন। তিনি মকবুল মাস্টারের জমি বিক্রির টাকার ওপর ভরসা করে মকবুল মাস্টারকে ছলেবলে কৌশলে মন নরম করে তাদের শেষ সাত ভাগের এক ভাগ গোছানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এক পর্যায়ে সেই চেষ্টায় সফলতাও পেলেন।

কোরবানি ঈদের আগের রাতে বগুড়া শহরের সূত্রাপুর এলাকায় একটি বাসা থেকে বেশ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলে এই শোরগোলের উৎস মকবুল মাস্টারের বাসা। মকবুল মাস্টারের স্ত্রী তহমিনা বেগম চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। তার ছেলে আনোয়ার যে দালালকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য আড়াই লক্ষ টাকা দিয়েছিলো, সেই টাকা পুরোটাই মারা পড়েছে। কারণ, দালাল অফিসে তালা ঝুলিয়ে নিরুদ্দেশ। মকবুল মাস্টার সন্তানদের কখনো শাসন করতে দেখা যায়নি। তার কোন ছেলে মেয়ে কি করছে, কোথায় পড়ছে, এসব নির্বাহী কর্মকান্ডের ভার স্ত্রী তহমিনা বেগমের ওপর অলিখিত ভাবে এ সংসারে পালিত হয়ে আসছে। আনোয়ারের এই বিদেশ যাওয়া বাবত এতগুলো টাকা গচ্চা দেয়ার পরিপেক্ষিতে তহমিনাকে চিৎকার, শোরগোল, কান্নাকাটি করে যেভাবে রিএক্ট করতে দেখা যাচ্ছে মকবুল মাস্টার-কে সেভাবে দেখা গেল না। তাঁকে শুধু নির্বিকারভাবে জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল যেন রহস্যময় এই অন্ধকার বিশাল রূপ-সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে।

মকবুল মাস্টার এশার নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে পড়েন। জামাতের পরে তিনি দুই রাকাত সুন্নত পড়ে বেতের নামাজ না পড়েই সাধারণত বাসায় চলে আসেন। পরে গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তিনি তাহাজ্জদ নামাজ আদায় করেন এবং তারপরে বেতের নামাজ শেষ করে ঘুমিয়ে আবার ফজর নামাজের জন্য ভোরে উঠে পড়েন । গভীর রাতের সুনসান নীরবতায় এবাদতে বেশ একাগ্রতা আসে। আজ গভীর রাতে তাহাজ্জদ নামাজের পরে মকবুল মাস্টারকে সেজদায় কাঁদতে দেখা গেল। নফল নামাজের সময় সেজদায় দোয়া করা যায়। আজ সেই দোয়া করার সময় কিছু আরবি শব্দাবলী উচ্চারণ করার সাথে সাথেই মকবুল মাস্টারের দুই চোখে কান্নার বান ডাকলো। নিস্তব্দ নিশুতি রাতে মকবুল মাস্টারের শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বগুড়া রহমান নগর এলাকায় এমুহুর্তে লোডশেডিংয়ের কারণে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তীব্র গরমের এই রাতে হ্যারিকেনের আলোয় নিরীহ মকবুল মাস্টারের ক্রন্দনরত এই যে দৃশ্যটি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা শুধুমাত্র যে তার ছেলের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন নষ্ট হলো তার জন্য না। নিজের সরলতার জন্য ঘরে ও বাইরে অহরহ চরম অসম্মান, শিক্ষক হয়েও একটি ছেলে -মেয়েকেও মানুষ না করার ব্যার্থতা ও গ্লানি আজ মকবুল মাস্টারের শরীরে কান্নার ঝড় তুলেছে। নিস্তব্দ নিশুতি রাতে এবাদত করে প্রায় ভোরের আগে দিয়ে মকবুল ঘুমাতে গেলেন । মাত্র ঘন্টা খানিক ঘুমিয়েই ফজর নামাজ পড়ার লক্ষে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে ধড়ফড় করে তিনি ঘুম থেকে উঠলেন।

হেড মওলানা ভাগে কোরবানির গরু নিয়ে এবার বেশ শিক্ষা পেয়েছেন। সেই সাত ভাগ সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে, সবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করা, কালিতলা হাট থেকে গরু কিনে এনে পায়ে হেঁটে সেই গরু নিজ বাসায় রেখে গরুর যত্ন-আত্তি করা সবকিছুই প্রায় এক হাতেই তাঁকে করতে হচ্ছে। ছাগল /খাসি হলে আলাদা কথা ছিল। নিজের গাছ থেকে কাঁঠালের পাতা খাইয়ে দিলেই লেঠা চুকে যেত। গরুর ক্ষেত্রে খাবারের অনেক যন্ত্রনা। প্রত্যেকদিন সকাল বিকাল গবর পরিষ্কার করতে হয়। ভুসি পানিতে গুলে তার মধ্যে আবার খৈল দিয়ে, বিশেষ ঘাসের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়। তিন দিন তিন রাতের গরুর এই খাওয়াদাওয়ার খরচ হেড মওলানা আলাদা করে একটি নোটবুকে লিখে রেখেছেন। গরু কাটাকাটির পরে হিসাবনিকাশ সব হালনাগাদ করা দরকার। গরু কিনতে সর্বমোট খরচ হয়েছে সাতাত্তর হাজার টাকা। এই পরিমান টাকাকে সাত দিয়ে ভাগ করলে একেকভাগের জন্য দাঁড়ায় ১১৪২৮.৫৭ টাকা।

এখনকার বাজারে দশ /এগারো হাজার টাকা হয়তো অনেকের কাছেই কিছুই না, তবে আমাদের গল্পের কিছু চরিত্র যেমন ইতিহাসে শিক্ষক মকবুল মাস্টার, এমন কি হেড মওলা রিয়াজ উদ্দিনের কাছেও এই টাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি হেড মওলানা বেজোড়া ঘাটের কাছে আধা বিঘা ধানী জমি কিনেছে। তার আশা, এই জমির পাশ দিয়ে ৫/৭ বছর পরে পাকা সড়ক হবে। জমির দাম দ্বিগুন বেড়ে যাবে। হেড মওলানা নিজের তহবিলে যা ছিল ঝেড়ে মুছে সেই জমি কেনা বাবদ খরচ করে অনেক কষ্টে এই এগারো হাজার টাকা জোগাড় করে এবারের কোরবানি ব্যাবস্থা নিয়েছেন। এত কষ্ট হলেও হেড মওলানার আফসোস নেই। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ত্যাগের কাছে এসব ত্যাগ অতি তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু, আজ এই ঈদের দিনে নামাজের পরে মওলানার মেজাজ বেশ তেতে আছে। সাত ভাগের মালিকানাদের কারো কোনো পাত্তা নেই। হেড মওলানা নিজেই গরু জবেহ করার কথা। কিন্তু, গরু জবেহ ছাড়াও গরু মাটিতে ফেলে চার পায়ে শক্ত করে ধরে থাকা, মাংস কাটা-কাটির লোকজন ঠিক করা ইত্যাদি হাজার রকমের কাজ আছে। এদিকে হেড মাস্টার সাহেব ফোন করে বলে দিয়েছেন তার আসতে দেরি হবে। মকবুল মাস্টার, ক্যারানি সাহেব, ড্রিল মাস্টার কারো কোনো পাত্তা নেই। শুধু দফতরি মোবারক আলী নামাজ শেষ করেই চলে এসেছে।

রাতে মকবুল মাস্টারের মোটেই ঘুম হয়নি। কোনোরকমে বড়ো মাঠে ঈদের দুরাকাত ওয়াজিব নামাজ শেষে রিকশায় চেঁপে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে সরাসরি বাড়ি এলেন। কোরবানি ঈদের নিয়ম হচ্ছে ঈদের নামাজ শেষে কোরবানি দেয়ার ব্যাপার ব্যস্ত থাকতে হয়। কোরবানি হয়ে গেলে তার পরে বাসায় নাস্তা-পানি, সেমাই প্রভৃতি খাওয়া হয়। আজ মকবুল মাস্টার সেই নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটালেন। মাথায় তিব্র যন্ত্রণার কারণে তিনি নামাজ শেষে কোরবানির যায়গায় না যেয়ে সরাসরি বাসায় এলেন। নাস্তার পরে দুটি প্যারাসিটামল একসাথে খেয়ে মকবুল মাস্টারের একটু ঝিমুনির মতো এসেছিলো। ঘড়ি দেখে সকাল সাড়ে দশটা বাজে। চায়ে চুমুক না দিয়ে কোরবানির উদ্দেশ্যে তিনি রিকশা নিয়ে ছুটলেন হেড মওলানার বাসার দিকে।

হেড মওলানা ততক্ষনে দফতরি মকবুল এবং পাড়ার কিছু ছেলেপেলের সহায়তায় গরু জবেহ পর্ব সম্পন্ন করেছেন। গ্রাম অঞ্চল থেকে আসা তিন জনের একটি দল ইতিমধ্য্যে গরুর চামড়া ছেলার কাজে লেগে পড়েছেন। হেড মওলানা নিজেদের সাত ভাগের কোরবানির গরু নিজেই জবেহ করায় তাঁর সাদা পাঞ্জাবিতে গরুর রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। জবেহ করার ছুরি বদনার পানি দিয়ে ধুয়ে তিনি বাসার ভিতরের দিকে কাপড় চেঞ্জ করার জন্য ঢুকবেন , ঠিক এমন সময় মকবুল মাস্টার হন্ত দন্ত হয়ে হাজির। ঝড় বৃষ্টির পরে গাছের বড়ো বড়ো ডালপালা অক্ষুন্ন থাকলেও ছোট ছোট ডালপালাকে গাছের নিচে এলোমেলো ভাবে পরে থাকতে দেখা যায়। ঝড়ের তাবৎ শক্তি যেন এই ছোট ডালপালার উপর দিয়েই বয়ে যায়। ঠিক একই ভাবে,  মকবুল মাস্টার যখন মওলানার সামনে পড়লেন মওলানার সকল ক্রোধ গিয়ে পড়লো তাঁর উপর। হেড মাস্টার, ড্রিল মাস্টার, ক্যারানি কাছে না থাকায় হেড মৌলানা এই নিরীহ মানুষটির সাথে প্রচণ্ড দুর্ব্যাবহার করলেন। সাত ভাগের শরিক মকবুল মাস্টারের দিকে চেয়ে ক্রূদ্ধ মওলানা চিৎকার করে বললেন,
‘আপনারা মানুষ না কি, মাস্টারি করেন এই সেন্স নাই আমি একা এক হাতে এই কোরবানি কিভাবে করবো? দফতরি না থাকলে তো আরো বিপদ হয়ে যেত। কোরবানি মাংস খাবেন, আর কোরবানি করার দায়িত্ব নিবেন না, এসব হয় ?
কথা বলতে যেয়ে হেড মওলানা আরো কিছু বেফাঁস ভাষা ব্যবহার করলেন। সারা রাত জেগে থেকে মাথার ব্যাথায় কাতর মকবুল মাস্টারের দুই চোখ নেকড়ের মতো জ্বলে উঠলো। যে কাজ তিনি জীবনে কোনোদিন করেননি আজ তা করলেন। মকবুল মাস্টার রেগে গেলেন। তিনি বললেন,’ আমি তো এসব ঝামেলা নিতেই চাইনি, আপনিই তো জোর করে আমার নাম লিস্টে ঢুকালেন ‘। হেড মওলানা আরো এক ধাপ চড়া গলায় বললেন, ‘নাম দিয়েছি, এটাই আমার জন্মের ভুল হয়েছে, আপনাদের মতো বিবিবেকহীন মানুষদের সাথে আমি আর নেই।’ এই বলে হেড মওলানা  বাড়ির ভিতরের দিকে চলে যেতে উদ্যত হলেন।  নিরীহ মানুষেরা সাধারণত সহজে রাগ করেন না। রেগে গেলে কীভাবে কি করতে হয়, কীভাবে সামাল দিয়ে উঠতে হয় এসব তাঁদের অভ্যাস নেই। তাই, এনারা সহসা রেগে গেলে বেফাঁস সব কান্ড করে থাকেন । আমাদের মকবুল মাস্টার তাই করলেন । তিনি রেগে গিয়ে বললেন,’থাকুন আপনারা কোরবানি নিয়ে, আমার ভাগের মাংস গরিব মানুষদের মধ্যে  বিলিয়ে দিয়েন ‘ এই বলে মকবুল মাস্টার রিকশা ডেকে নিজ বাড়ির দিকে রওনা হলেন।

মকবুল মাস্টার বাসায় যাওয়ার আগে রিকশা ঘুরিয়ে ফত্তে আলী বাজারের দিকে গেলেন। বাচ্চারা আশা করে বসে আছে কোরবানির মাংস দিয়ে ভাত খাবে। মকবুল মাস্টার বাচ্চাদের জন্য অল্প করে গরুর মাংস কিনতে যেয়ে দেখলেন আগুনের মতো দাম। এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে সাড়ে সাত শো টাকা দরে। মকবুল মাস্টার ভাবলেন, মাংস বাদ দিয়ে মাছ কিনলে কেমন হয়, এবারের কোরবানির ঈদ হোক মাছ দিয়ে। মকবুল সাহেব ইলিছ মাছের দিকে না এগিয়ে পাঙ্গাস মাছের দিকে এগুলেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে পাঙ্গাস মাছের দাম খুব বেশি একটা বাড়ে না, অথচ এই মাছ তার খুব প্রিয় একটি মাছ। মকবুল সাহেবের ধারণা কোনো পুণ্যের কারণে সে যদি বেহেস্তে যায় তবে ফেরেস্তাদের সে বলবে তাঁকে যেন আগুন গরম ভাতের সাথে পাঙ্গাস মাছের পেটি দেয়া হওয়া । সেই মাছ রাঁধতে হবে বেশি করে পিঁয়াজ আর সর্ষের তেল দিয়ে। পাঙ্গাস মাছের তরকারিতে বেশি ঝোল করা চলবে না। মাছের গায়ে গায়ে অল্প ঝোল থাকবে, ফালি করে কাঁচা মরিচ ঝোলের মধ্যে ভাসবে , ঝোলের ওপর বেছানো থাকবে জিরা বাজার গুঁড়া।

মকবুল সাহেবের আজ মন্দ ভাগ্য । ঈদের দিনে বাজারে তেমন একটি ভিড় নেই, কিন্তু একটি মাত্র লোক পাঙ্গাস বিক্রি করছে তাও মাছের মান তেমন ভালো না। মকবুল সাহেব আড়াইশো টাকা কেজি দরে দুই কেজি ওজনের একটি মাঝারি সাইজের পাঙ্গাশ মাছ কিনে বাসায় ফিরলেন। বাসায় এতো দ্রুত ফিরতে দেখে শ্রী তহমিনা অবাক হয়ে বললেন , ‘কি ব্যাপার এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে, কোরবানির মাংস কোথায় ? তুমি দেখি পচা পাঙ্গাশ মাছ কিনে এনোছো ?

তহমিনা কিছুটা মুখরা টাইপের মহিলা হলেই পবিত্র ঈদের দিনে তিনি স্বামীর সাথে তেমন একটা খারাপ ব্যাবহার করলেন না। এমনিতেই গত রাতে বড়ো ছেলের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি অনেক কান্নাকাটি করে বেশ কিছুটা ক্লান্ত। তহমিনা  স্বামীর মুখে কোরবানির সব কথা মন দিয়ে শুনলেন। সৃষ্টিকর্তা মহিলাদের বিশেষ কতগুলি এক্সট্রা গুণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মহিলারা অভাবের সংসারেও কিভাবে যেন সবকিছু সামলিয়ে নিতে পারেন, সংসারের ছোটোখাটো ঝক্কি ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন এবং যত্ন করে পচা মাছ, লেবু পাতা ধোনে পাতা, কাঁচা মরিচ দিয়ে রেঁধে সেই মাছকে অনায়াসে সুস্বাদু পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তহমিনার মধ্যে এসব গুণাবলী সৃষ্টিকর্তা ঢেলে দিয়েছেন। শুধু গতরাতে বড়ো ছেলের ব্যাপারে এতগুলো টাকা নষ্ট হওয়ায় তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন ।

আজ তহমিনা স্বামীর কাছে সকালের কোরবানির ঝামেলার কথা শুনে নিঃশব্দে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলেন। পরম যত্নে সেই পচা পাঙ্গাস মাছটিকে চমৎকার তরকারিতে রূপান্তরিত করে দুপুরে সবাইকে খেতে ডাকলেন। কোরবানি ঈদের এই দুপুরে মকবুল মাস্টারের বাসায় ঈদ উপলক্ষে দুপুরের খাওয়া- দাওয়ার সাদামাটা আয়োজন। পোলাওয়ের চাল দিয়ে খিচুড়ি, আর পাঙ্গাসের তরকারি। বড়ো একটি বাটিতে পাঙ্গাস মাছের পেটি যেন মকবুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। এই খাবারের মেনুর সাথেই একটু এদিক ওদিক করলেই রাজা বাদশাদের মতো খাবারের মেনু হতে পারতো। খিচুড়ির সাথে বেশি করে কাঁচা মরিচ, ধোনের পাতা দিয়ে কড়া করে ভাজা ডিমের ওমলেট, আলু কুচি কুচি করে ভাজা অথবা নিদেন পক্ষে তরকারির সাথে সাপ্লিমেন্ট হিসাবে ঝাল ঝাল করে আলু ভর্তা থাকলে খাওয়া জমে যেত। মকবুল মাস্টার তবুও আজকের খাবারের মেনু নিয়ে আফসোস করলেন না। স্ত্রীর ওপর তিনি বেশ মায়া অনুভব করলেন। গত রাতে ব্যাচারা অনেক কান্নাকাটি করেছে। তুবুও যে সে আজ রেধেঁছে এটাই বিরাট পাওয়া।

মকবুল সাহেব গরম ভাতে পাঙ্গাস মাছের পেটি নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলেন। তহমিনা নিজের খাওয়া ফেলে স্বামীর খাওয়া দেখছেন ।মানুষটা খাবার পেলে বেশ তৃপ্তির সাথে হাপুস হুপুস করে খায়, খেতে যেয়ে হেঁচকি তোলে, তহমিনার মানুষটার প্রতি সব মমতা ঢেলে দিয়ে তাকিয়ে থাকে। জগ থেকে দ্রুত পানি ঢেলে স্বামীর দিকে এগিয়ে দেয়। তহমিনা আজ তাই করলেন। মকবুল সাহেব যথারীতি হেঁচকি তোলায় তহমিনা দ্রুত স্বামীকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। মজার ব্যাপার হলো কোরবানি ঈদের দিনের আজকের এই খাবার টেবিলে যে মাংস নেই এটি নিয়ে কোনো বাচ্চা-কাচ্চাকেই প্রতিবাদ করতে দেখা গেল না। খাবার টেবিলে মন্টু, রঞ্জু, টুটুল,পারুল, চম্পা সবাইকে মাথা নিচু করে খাবার খেতে দেখা গেলেও ডাইনিং টেবিলে অথবা বাসার কোথাও আনোয়ারকে দেখা গেলো না।

মকবুল সাহেবদের দুপুরের খাবার পর্ব যখন প্রায় শেষের দিকে তখন পর পর দুটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে, আনোয়ার দৌড়ে  বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার করে বললো ,’ মা , আমার সিঙ্গাপুরের ভিসা হয়ে গেছে। আনোয়ার এতটাই উত্তেজিত যে কথা গুছিয়ে বলতে পাচ্ছে না । তবুও হাপাতে হাঁপাতে যা বললো তার সারাংশ হচ্ছে, ‘মা আমি যে দালালকে টাকা দিয়েছিলাম ও আসলে তালা ঝুলিয়ে দেশের বাড়ির জমিজমা নিয়ে কি যেন বিরোধ হচ্ছিলো সেই বিরোধ মেটাতে গিয়েছিলো। এদিকে আমরা ভাবলাম, কি না কি।’

মকবুল মাস্টার সাহেবের বাসায় কোরবানি ঈদের দিনের দ্বিতীয় আশ্চর্যজনক ঘটনা জানতে হলে ড্রয়িং রুমের দরজা খুলতে হবে । বেশ কিছুক্ষন ধরে কলিং বেল বেজে চলেছে অথচ উত্তেজিত আনোয়ারের সুসংবাদে বাসায় কারো কলিং বেলের শব্দ কানে বাজেনি। মকবুল সাহেব দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তার সামনে বালতিতে করে মাংস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হেড মওলানা রিয়াজ উদ্দিন, তার পাশেই হেড মাস্টার ইদ্রিস আলী, ড্রিল মাস্টার ইফতেখার এবং এমন কি দফতরি মোবারক আলী। সবাই তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি
হাসছেন। ইদ্রিস আলী বললেন,’ভাই, ঈদের দিনে রাগ বিরাগ করতে নেই। আপনার ভাগের মাংসগুলি এই বড়ো বালতিতে এনেছি , ভিতরে রেখে দিন।’ হেড মওলানা খপ করে মকবুল মাস্টারের দুই হাত ধরে বললেন, ‘ভাইসাহেব, রাগের মাথায় কি বলতে কি বলেছি, মাফ করে দিন।’

কোরবানি ঈদে বৃষ্টি হলে মাংস বিতরণের ক্ষেত্রে ঝামেলা হলেও একটি ব্যাপারে খুব ভালো হয়, তা হচ্ছে রাস্তা ঘাটে, জবাই করা ছাগল, গরুর রক্ত সব প্রাকৃতিক ভাবে ধুয়ে দূর হয়। আজও তাই হলো। বগুড়া শহরে আষাঢ় মাসের মুষলধারে  বৃষ্টি হচ্ছে। আনোয়ার বাসার ভিতরের দিকের বারান্দায় পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর কোরবানির মাংস প্রবল উৎসাহে তিন ভাগ করছে। আনোয়ার প্রতিটি ভাগে হাড়, মাংস, কলিজা প্রভৃতি সমান ভাবে বন্টন করার চেষ্টা করছে। তার পাশে সে ছোট একটি জলচকির ওপর ক্যসেট প্লেয়ার দিয়ে ইংরেজি গান দিয়েছে। সেখান থেকে কি সব ইংরেজিতে গান হচ্ছে তহমিনা কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না। শুধু ছোট ভাই রঞ্জু ও মন্টু মাঝে মাঝে গানের তালে মাথা নাড়ছে। আনোয়ারকে হেল্প করছে মন্টু। রঞ্জুকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রান্না ঘরের চিপা চাপা থেকে ড্রয়ের ঘেটে পলিথিন ব্যাগ বের করে সেগুলিকে ধুয়ে মুছে ঠিক করে রাখা। সেই পলিথিন ব্যাগগুলিতে আনোয়ারের মাংস ভাগ হয়ে গেলে আত্মীয় স্বজনদের জন্যে মাংস বিলিবন্টন করা হবে।

তহমিনা ইতিমধ্যে কিছু মাংস সসপ্যানে রান্না ঘরের খড়ির চুলায় বসিয়েছেন । এই রান্না ঘরের একটি মাত্র ছোট জানালা দিয়ে বাইরের বাতাস তেমন একটা আসে না । প্রচন্ড গরমে ঘেমে একাকার হয়ে তহমিনা ক্রমাগত জ্বাল ঠেলে যাচ্ছেন, মাঝে মাখে চোঙ্গায় ফু দিয়ে আগুনকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছেন। ঘরের বাইরে সসপ্যান থেকে চমৎকার ঘ্রান আসছে। কখন সেই মাংস রান্না শেষ হবে মকবুল সাহেবের যেন তর সইছে না। তিনি রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন । এক সময় তিনি পাতিলের ঢাকনা খুলে বড়ো হাত ওয়ালা চামুচে আধা সেদ্ধ মাংসের টুকরা নিয়ে গোগ্রাসে খাচ্ছেন । অন্য সময় হলে তহমিনা ঝাঁঝিয়ে উঠতো। আজ তহমিনা তা করলেন না । তিনি বাটিতে করে কিছু হাড় মাংস নিয়ে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে শুধু বললেন, ‘দেখেন তো লবন হয়েছে কি না ? তরকারিতে লবণের পরিমান নিয়ে তহমিনার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবুও তিনি অভিনয় করে স্বামীকে যে লবন চাখার নাম করে মাংস খেতে দিলেন এর মধ্যে লুকিয়ে আছে চরম মমতা। মকবুল মাস্টার সেই মমতা টের পেলেন না।

একটানা বৃষ্টিতে আনোয়ারদের উঠোনে পানি জমে যাচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। মাঝে মাঝে আবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পারুল, চম্পা, টুটুল বারান্দায় বাবাকে ঘিরে বসে থেকে বৃষ্টি দেখছে। মকবুল মাস্টার অনেকদিন তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসাথে এভাবে গল্প করে না। আজ তিনি গল্পের ঝুলি নিয়ে বসেছেন। তবে তার শুরুটা ছিল সেই ইতিহাসের ক্লাসের মতো। তিনি পারুলকে বললেন, আচ্ছা মা, বলতে পারবি এই যে বগুড়ার মহাস্থান গড় এটির আগে কি নাম ছিল? মকবুল মাস্টার সাহেব হয়তো আরও কিছু তথ্য উজাড় করে সরবরাহ করতেন, কিন্তু দুই বোন পারুল ও চম্পা এক সাথে বলে উঠলো, ‘না বাবা, আজ আর কোনো লেখা পড়া না , ইতিহাসের কথা না, আজ তুমি তোমার ছেলেবেলার গল্প বলবে।’ মকবুল সাহেব লজ্জিত হয়ে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে বাচ্চাদের সাথে তার ছেলেবেলার গল্প করছেন,  আর বাচ্চারা শব্দ করে হাসছে। সেই হাসির শব্দ আনোয়ারের ক্যসেট প্লেয়ারের ইংরেজি গানগুলোকে ছাপিয়ে তহমিনার কানে রিন্ রিন্ করে বাজছে। তহমিনা মাংস রান্না শেষ করে একটি চেয়ার টেনে এনে স্বামীর পাশে বসলেন।

বাসার পেছনের দিকের প্রাচীরের ওপারে লিচু গাছের ওপর ঝাঁক বেঁধে প্রায়ই কিছু কাক কে দেখা যায়। বিশেষ করে , সন্ধ্যা বেলায় এই কয়েক দিন দেখা গিয়েছে, কাকগুলি সমানে কা কা করছে আর উঠোনের পেয়ারা গাছের সাথে বেঁধে থাকা কোরবানির গরু হাম্বা হাম্বা করছে। আজ এই মুহূর্তে দেখা গেলো কাকের ঝাঁক নেই। শুধু দুটি ভেজা কাক পাশাপাশি বসে আছে। নেহায়েত দরকার ছাড়া কাক দুটি কা কা করে ডাকছে না । তবে কি গরুটিকে না দেখতে পেয়ে তারা মন খারাপ করেছে ? বারান্দার এক কোনায় বাসায় পালা লাল মোরগ, আরো কয়েকটি মুরগি ভেজা গায়ে ঝিম ধরে কাক দুটির মতো বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কত কি উথাল পাতাল ভাবছে। ঈদের আনন্দ করার অধিকার পশুপাখিকে দেয়া হয়নি। ঈদের আনন্দ জমা করে রাখা হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ সম্প্রদায়ের জন্য। তবুও মানুষেরা মাঝে মাঝে একে অন্যের সাথে কলহ করে, ঝগড়া করে, একে অপরকে ঠকিয়ে আনন্দ পায়।

তহমিনা স্বামীকে বললেন, ‘আনোয়ারের সেই আদম ব্যাপারী যদি সত্যিই টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যেত এতগুলো টাকার শোকে হয়তো এ বাড়িতে আজ ঈদের আনন্দ তো পরের কথা এতগুলো টাকার শোক কাটিয়ে উঠা অনেক কঠিন হয়ে যেত, কি বলেন ? মকবুল বললেন , ‘তাতো বটেই, ওদিকে সকালের কথাই ধরো, হেড মওলানা আমার সাথে কি ব্যবহারটাই না করলেন, আরেকটু হলে তো হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যেত। উনিই জোর করে আমাকে ওনাদের সাথে সাত ভাগের কোরবানির শরিক করে নিলেন। আনোয়ারের ব্যাপার নিয়ে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি, একটু না হয় দেরিতেই ওখানে গিয়েছি তাই বলে মুখে যা তা বলবে ? তহমিনা বললো, ‘ওসব বাদ দিন, উনি বাসায় এসে মাফ চেয়ে গেছে, এটাই মন্দ কী!?

এ বাড়িতে বাচ্চারা অনেকদিন পরে তাদের বাবা মা-কে পাশাপাশি চেয়ারে বসে গল্প করতে দেখে অবাক হলো। সৃষ্টিকর্তার কল্যানে মকবুল মাস্টারের এবারের সাত ভাগের কোরবানির ঈদের দিন আনন্দ, উচ্ছলতায় ঝলমলে ভাবে কাটলো।

পুনশ্চ: ভাগে কোরবানি দিলে প্রত্যকের সাথে মিলেমিশে কোরবানি দেয়ার নিয়ম। ভাগের কোনো শরিকের মনে কষ্ট দেয়া উচিত না। এ বিষয়ে আমার ছেলেবেলার কিছু কষ্টের স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতিতে আজকের এই গল্পের মতো এতটা আনন্দজনক সমাপ্তি ঘটেনি । আমি এতকাল সেই কষ্টের স্মৃতি মাথায় নিয়ে আজ এই ঈদের বড়ো গল্প লিখছি। বাস্তব জীবনে যা ঘটেনি তা অনায়াসে গল্পে মিটিয়ে এক তৃপ্তি অনুভব করলাম । ঈদ মানে আনন্দ, খুশি। আসুন, আমরা নিজ নিজ ক্ষুদ্র অথবা বড়ো বড়ো দুঃখ কষ্ট ভুলে অন্তত ঈদের দিনের আনন্দ আমাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজন সবার সাথে ভাগাভাগি করে একটি চমৎকার ঈদ উজ্জাপন করি !!!!!

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল আজহা
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন