১
সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানাই। গত কয়েক বৎসর Covid (করোনা ভাইরাস ) জনিত কারণে লোকজন ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিল। এবার সে সব কারণ না থাকাতে ভালোভাবে ঈদ, কোরবানি , ঈদের আলিঙ্গন, এ বাড়ি সে বাড়ি বেড়ানো যাবে। সে যুগে আমরা মাবাবা,ভাইবোন,আত্মীয়স্বজন, গ্রামের বা স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে যেভাবে ঈদের আনন্দ করেছি, তা কি আর ফিরে পাবো ? সেই বয়স,সে মন– মানসিকতা সবই হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া দেশে আপনজনকে রেখে, হাজার হাজার মাইল দূরে, কী আনন্দ উপভোগ করা যায় ?
মনে পড়ে ঈদের দিন, গ্রামের পুকুরে গোছল করে নতুন কাপড় পড়ে, ঘর থেকে ঈদের মাঠের জন্য পাটি, জায়নামাজ নিয়ে ঈদগাহ মাঠে, মাটিতে বিছিয়ে নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। গ্রামের ছোট,বড়ো, গরিব, ধনী একত্রে হয়ে নামাজের জন্য অপেক্ষা করা কত আনন্দ । চারিদিক থেকে লোকজন মাঠে জমা হচ্ছে, আলেমদের কেউ কেউ ঈদের নামাজের বর্ণনা করতেন ; এক সময় নামাজ ও খোৎবা পড়া শেষ হলে দোআ ও সব শেষে ঈদের আলিঙ্গন হতো। এই দিন গ্রামের সব মানুষের মধ্যে থাকতো না কোনো ভেদাভেদ,একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুশির মিলন হতো। সর্ব শেষ গ্রামের মুরুব্বি জমিরউদ্দিন (দাদা ) দাঁড়িয়ে বলতেন “মুসল্লিগণ আপনারা সবাই আমার বাড়ির উঠানে এসে একত্রে খাওয়া দাওয়া করবেন। ” বাড়ির উঠানে পাটি,হোগলা বিছানো হতো, বসে একত্রে খাওয়া দাওয়া ও হইচই করে বাড়ি এসে দেখতাম মা-চাচিরা আজকের দিনের হরেক রকমের খাওয়া তৈরী করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। খাওয়াদাওয়া সেরে এবার গরু, ছাগল জবাই করা, মোল্লা সাহেব কার গরু আগে জবাই করবেন এই নিয়ে হতো প্রতিযোগিতা।
ঈদের মাঠে অনেক সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ও হতো। আমার মনে পড়ে ১৯৭৭ সনে আমাদের গ্রামের ঈদগাহ তে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক থেকে ছোটোখাটো সংঘর্ষ হয়ে ছিল। গ্রামের কোনো এক পরিবারে বিয়ে বিচ্ছেকে কেন্দ্র করে গ্রামে দুই দলের মধ্যে বহুদিনের ঝগড়া। এ নিয়ে এলাকার গন্যমান্য মৌলানাদের ডাকিয়ে কোনো মীমাংসা করা যায় নি। ঈদগাহ মাঠে একদল আর একদলকে নামাজ পড়তে দেবে না – শেষ পর্যন্ত এই গ্রামে ওই দিন কোনো নামাজ হয় নি।
২
হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম স্তম্ভ। মহানবী (সঃ) বলেছেন; পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে;পঞ্চম স্তম্ভ হলো আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা।
আমাদের দেশে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত সবচেয়ে বেশী অবহেলিত : যাকাত আর অপরটি হজ্জ। প্রকৃত যাকাত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ধর্মে জাকাত সম্পর্কে কড়াকড়ি নির্দেশ থাকা স্বত্তেও তা অবহেলিত, জাকাতের অর্থ গরিবদের প্রাপ্য;যদি মালদার বা ধনী ব্যক্তি হিসাব করে দেশের জাকাত ফান্ডে এই অর্থ জমা দিয়ে বিনিয়োগ করে , তা থেকে গরিব কর্মহীন লোকদের উপকার হতে পারে। কিন্তু ও ধরণের সংগঠিত যাকাত তহবিল কোনো দেশে কী আছে ?
হজ্জের তাৎপর্য নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে হজ্জের সফরে রওয়ানা হওয়া আখেরাতের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে ধনী গরিব সব একই পোশাকে মক্কা,আরাফাত,মুজদালেফা ও মিনাতে উপস্থিত হয়ে এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবাদত করে। কি রাজা ,কি ধনী, কী গরিব, সবাই আজ সমান, একত্রিত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ পালন করে।
২. সবাই এহরাম পরিধান করে এক আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিয়ে ” ‘লাব্বাইক’ আমি হাজির ” মুখে বলা ও সমস্ত গুনাহ–পাপ থেকে পবিত্র হয়ে পরকালে আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩. ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে বান্দা আল্লাহর যে কোনো ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা দেয়।
৪. এহরাম অবস্থায় সকল বিধি–নিষেধ মেনে চলা – এহরাম অবস্থায় ঝগড়া করা, স্বামী–স্ত্রী মিলন, কোনো কিছু প্রহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৫. বায়তুল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে মুমিন নিরাপত্তা অনুভব করে- কেননা বায়তুল্লাহকে নিরাপত্তার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন আল্লাহ তা’আলা।
৬. হাজরে আসওয়াদ চুম্বন–স্পর্শ মুমিনের হৃদয়ে সুন্নতের তাজিম–সম্মান বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করে।
৭. তাওয়াফ আল্লাহ-কেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর সাধনাকে বুঝায়- অর্থাৎ একজন মুমিনের জীবন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
৮ . আল্লাহ তা’আলা নারীকে করেছেন সম্মানিতা। সাফা মারওয়ার মাঝে সাত চক্কর, আল্লাহর রহমত–মদদ কামনায় একজন নারীর সীমাহীন মেহনত, দৌড়ঝাঁপকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৯. উকুফে আরাফা (আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি )কিয়ামতের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। যেখানে বস্ত্রহীন অবস্থায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গুণতে হবে অপেক্ষার প্রহর।
৩
সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজ কী অবস্থায় রয়েছে তা আমাদের জানার বাহিরে ; রাশিয়া উক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক মুসলমান মৃত্যুবরণ করেছে এবং হাজার হাজার লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্বিসহ অবস্থায় রয়েছে।এছাড়া সিরিয়া, ইরাক,আফগানিস্তান, লিবিয়া, আরো ও অনেক দেশে যুদ্ধ হওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ দারুন অসুবিধায় রয়েছে যাদের করুন অবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। সুদান,সোমালিয়া এবং আরোও অনেক দেশে মুসলমানগণ আশ্রয়হীন, বস্ত্রহীন, খাদ্যাভাবে কষ্ট পাচ্ছে। মায়ানমারে শত শত বৎসর মুসলমান জনগণ নাগরিকত্ব বিহীন বাস করে আসছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে এক মিলিয়নের ও অধিক মুসলমান রোহিঙ্গা করুন অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
১) ইয়েমেনের শরণার্থী সংকট বিশ্বের নেতৃস্থানীয় মানবিক সংকট- ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে- সহায়তা প্রয়োজন।
২) ২০২৩ সালের সুদান সংঘাত শুরু হওয়ার পর শরণার্থী সংকট শুরু হয়- এর মধ্যে, ৫৩০,০০০ বা তার ও বেশি লোক দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, এবং ২ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
৩) ফিলিস্তিন শরণার্থী সংকট একটি দীর্ঘস্থায়ী ইস্যু যা ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলি সংঘাতের পর থেকে চলছে- এর ফলে অনেক ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ও জীবিকা হারিয়েছে।
এবার হজ পালনের জন্য ১.৫ মিলিয়ন লোক মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন। এ সব লোকদের সবাই এখন মক্কায় উমরাহ ও আল্লাহর ঘর তাওয়াফ নিয়ে ব্যাস্ত। আল্লাহর ঘর তাওয়াফ শেষে সবাইকেই আরাফাত, মুজদলাপা ও মিনাতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের পর মক্কায় বিদায় হজ করে মদিনায় জিয়ারত শেষে হাজী উপাধি নিয়ে ঘরে ফিরবে।
দোআ ,আশীর্বাদ করি সারা পৃথিবীর মুসলমান সুখ শান্তিতে বাস করুক- আমীন ।