ফারজানা নাজ শম্পা
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া কানাডা
বাঙালি ও বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিক্রমায়ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দূর্গা পুজো l হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই উৎসব বর্তমানে শুধুমাত্র কোন ধর্মীয় উৎসব নয় বরং তা আমাদেরআবহমান বাংলার সংষ্কৃতির একটি সর্বজনীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে l ভৌগোলিক বা কোন সাংষ্কৃতিক সীমারেখা মাধ্যমে এই উৎসবের গন্ডি টানাযায়না l আবহমান কাল ধরে ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় , পুরান গ্রন্থে , দুর্গা পূজা উদযাপনের দেবী মা দূর্গা সঙ্কট মোচনের ও অশুভ শক্তি বিনাশের অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভুত হন lকথা সাহিত্যিক অর্ঘ্যরায় চৌধুরী র দশ প্রহরণকারী জানান দেবী মা দশ দিক হতে সব অপশক্তি র অবসান ঘটিয়ে রক্ষা করেনসবাইকে l
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্প্ৰতি দূর্গা পূজা জাতিসংঘের ইউনেস্কো ‘ইন্টেন্জিবেল হেরিটেজ র ‘স্বীকৃতি দান করে বাঙালির এক শ্রেষ্ঠ উৎসব রূপে অভিষিক্ত করেছে l সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের মতোই কানাডায় এবছরের দুর্গা পূজা পালনে কোন অন্যথা হয়নি , বর্ণাঢ্য ভাবে কানাডায় বিভিন্ন শহরে উদযাপিত হয়েছে দূর্গা পুজো l উদযাপনেরএই পরম্পরা র রেশ ধরে প্রবাসী হিন্দু ধর্মালম্বী বাঙালি রা কানাডার পশ্চিমে আটলান্টিক তীরবর্তী শহর নোভা স্কোশিয়া র প্রভিন্সের রাজধানী হ্যালিফ্যাক্স বর্ণাঢ্য আবহে আর আয়োজনে মেতেছিলেন আটলান্টিক কানাডার ঐতিহ্যবাহী “শারদীয় সোসাইটি’ শারদ আলোর ছোঁয়ায় গত ২০ এবং ২১ এবং ২২ শে অক্টবরের ধর্মীয় রীতি ও ভাবগাম্ভীর্যের আবহে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে দুগা পুজোর সামগ্রিক আয়োজন সুসম্পন্ন করেছে l শারদীয় সোসাইটির সকল নিবেদিত সদস্যদের অক্লান্ত ১৯ ৭৬ সাল হতে দূর্গা পুজোর উৎসব পালিত হচ্ছে l এই বছর আটলান্টিক কানাডায় ছিল ৪৭ তম পুজোর উদযাপন l হ্যালিফ্যাক্সের ৩৬ হল্যান্ড এভিনিউতে লাবার্ন রিক্রিয়েশন সেন্টারে তিনদিন ব্যাপী চলে এই বর্ণাঢ্য আয়োজন l ইস্ট এন্ড্রুজ কমিউনিটি হলের কিচেনে শারদীয় সোসাইটির নিবেদিত সব সদস্যরা ১৯ সে অক্টবর হতে তিনদিনের খাবার প্রস্তুতির পর্ব শুরু করেন এবং সেই অনুসারে প্রায় সাতশোর অধিক নিমন্ত্রিত অতিথিদের বাঙালি ও ধর্মীয় ঘরানায় খাবারের আয়োজন করা হয় l কানাডায় প্রবাসে পুজোর আয়োজন করা হয় সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে শনি ও রবিবারে সেই অনুসারে অক্টবরের শুক্র শনি ও রবিবারে তিনটি দিন পুজা পালনের জন্য নির্ধারিত হয় ,এই তিনদিনেই পর্যায়ক্রমে মহাসপ্তমী , অষ্টমী ও মহা নবমী , দেবী দর্শন এবং বিজয়া দশমী পালিত হয় l
এই বছরের দুর্গা পূজা র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হালিফ্যাক্সের মেয়র মাইক স্যাভেজ ২০ শে অক্টবর আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেন l তাঁর সাথে ছিলেন এম পি লিনা দিয়াৰ , এছাড়া হালিফ্যাক্সের কানাডার মূলধারার অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যাঁরা এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন এম এল এ কেলি রেগান এবং এম এল এ জন এ ম্যাকডোনাল্ড , তাঁরা প্রদীপ জ্বালান এবং তাঁদের আলোকদীপ্ত পবিত্র মুহূর্তে সমবেত কণ্ঠে অসাধারণ ভঙ্গিমায় গেয়ে উঠেন ‘ আগুনের পরশমনি ‘ এই গান টি l
২০ ও ২১ ,২২ তারিখে তিনদিন ধর্মীয় প্রার্থনারসব রীতি র পাশাপাশি ব্যাপী চলে বর্ণাঢ্য সাংষ্কৃতিক আয়োজন , যার অন্তর্গত ছিল ভরত নাট্যম নৃত্য , গান , দলীয় সংগীত , আবৃত্তি , নাটক ইত্যাদি l শিল্পীদের প্রাণবন্ত পরিশীলিত পরিবেশনায় ছিল বাংলা র সংষ্কৃতি ও হিন্দু ধর্মীয় রীতির এক অপুর্ব মেলবন্ধন l মহামারী কালীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে একটি হাস্যরসাত্মক নাটক উপস্থাপিত হয়েছিল’ জুম আলোয় কেলেংকারী’ আর গণেশ ঠাকুর কে ঘিরে একটি বিশেষ নাটক ছিল l এবারের পুজার আরেকটি বিশেষ আকর্ষন ছিল ‘ঢাকের তালে নৃত্য ‘উপস্থাপন l
তিনদিনের পুজা আয়োজনের এই বর্ণিল সমারোহে কয়েকশো অতিথি র সমাগম ঘটে এবং বাংলাদেশের এসোসিয়েশন সহ অন্যান্য কয়েকটি কমিউনিটি সংগঠন হতে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অতিথি সমাগম ঘটে মুখরিত এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় l হ্যালিফ্যাক্স সহ আটলান্টিক প্রদেশের ফ্রেড্রিকটন , মঙ্কটন , বিভিন্ন শহর হতে নিষ্ঠাবান হিন্দু ধর্মাবলম্বী অতিথির সমাবেশ ঘটে l
হালিফ্যাক্সে ১৯৭৬ সাল হতে শারদীয় সোসাইটি সুষ্ঠু ধর্মীয় রীতি অনুসারে আটলান্টিক কানাডায় বা মেরিটাইমসে পূজা সম্পন্ন করে আসছে l সর্বপ্রথম আয়োজন টি হয় মঙ্কটনে এবং সেই ধারাবাহিকতায় নব্বই সালের পূর্ব পর্যন্ত মঙ্কটন ,পি ই আই , হ্যালিফ্যাক্সে পর্যায়ক্রমে সুষ্ঠু ভাবে দূর্গা পুজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে l ১৯৯০ সালে হতে হালিফ্যাক্সে ‘মেরিটাইম শারদীয় সোসাইটি ‘ তাঁদের নিয়মিত পূজার আয়োজন করছেনi
‘মেরিটাইম শারদীয় সোসাইটির ‘এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি মূল উদ্যোক্তা ও রূপকার ছিলেন কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব l তাঁরা হলেন কল্যাণ অধিকারী , শতদল দাসগুপ্ত , পার্থ গঙ্গোপাধ্যায় ,বনজ ভট্রাচার্য প্রমুখ l এই নিবেদিত ব্যক্তিবর্গের ঐকান্তিক ইচ্ছে , ধমীর্য় নিষ্ঠা , অক্লান্ত কর্মউদ্যোগে শারদীয় সোসাইটি বর্তমানের পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে দীর্ঘ সময় ব্যাপী হিন্দু ধমীর্য় ভাবাদর্শের পূর্ণ রূপ ধরে রেখেছ শীতল আটলান্টিক তীরের কানাডার এই পূর্বের ভূখণ্ডে এই প্রান্ত l শারদীয় সোসাইটি আরো অনেক নিষ্ঠাবান নিবেদিত সদস্যের হলেন অরুন ও কবিতা দস্তিদার , অমূল্য ও পূর্ণিমা চ্যাটার্জি , দেবব্রত ও দীপ্তি ভট্রাচার্য , রামজীবন ঘোষ ও বন্দনা ঘোষ , কনক মজুমদার , শংকর দাস , অরুন ও গৌরী মুখোপাধ্যায় , প্রশান্ত ,দেবব্রত ও ছুটি রায় , তরুণ ঘোষ , ক্রিস্টিনা সামেক , বিমল দাস ও ডায়ান দাস , সানি দাসগুপ্ত ও ডলি দাসগুপ্ত , ধীমান চৌধুরী ও স্মৃতি চৌধুরী সহ আরো অনেকেই l
উল্লেখ্য যে ‘শারদীয় সোসাইটি ‘আটলান্টিক কানাডায় সত্তর দশকে মধ্যম পর্যায়ে তাঁদের পুজোর আয়োজনের সূচনা লগ্ন হতেই পুজা ও ধমীয় আরাধনার পাশাপাশি নিয়মিত ভাবে বাংলা সাহিত্য সংষ্কৃতি ও ঐতিহাসিক ভাবধারার আবহে মনোজ্ঞ সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছেন l একই সমান্তরালে সবার লেখা , নিবদ্ধ নাটিকা , গল্প স্মৃতিচারণ , পরিচিত সহ স্ব উদ্যোগে পুজার বিশেষ স্মারক পত্রিকা প্রকাশ করে আসছেন l ধর্মীয় সম্প্রীতির ও বাংলার সংষ্কৃতির আলোকে শান্তি ও সহনশীলতার আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক দেশে ও প্রবাস আমাদের সবার মাঝে সেই প্রতাশ্যায় সবার জন্য শারদীয় শুভেচ্ছা l আমাকে বৈচিত্রময় এই আয়োজন বিষয়ক বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সঞ্জয় চৌধুরী তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি l