তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে প্রায়শঃই সরকার ও বিরোধী শক্তির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধ লেগে থাকে। এর একমাত্র কারণ এ সব দেশে নামে গণতন্ত্র,কাজে অগণতন্ত্র, অর্থনৈতিক হতাশা, ক্ষমতাসীন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সুবিধাভোগী কার্যকলাপে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বল্গাহীন অবস্থায় পৌঁছে । প্লেটোর ভাষায় “গণতন্ত্র গরিব ও অশিক্ষিত সমাজে অযোগ্য। ” গরিব দেশে মানুষের প্রথম চাহিদা হলো ভাত (রুটি) ,অতি সাধারণ পরিধেয় বস্ত্র এবং বেঁচে থাকার জন্য চিকিৎসা, ও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সবার জন্য মুক্ত শিক্ষানীতির প্রবর্তন করা। অনুন্নত দেশগুলিতে এই তিনটি অধিকারের কোনটিই পুরাপুরি নেই। এক শ্রেণীর লোক ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুবিধা ভোগ করে; কিছু লোক সরকারের ধামাধরা সহযোগিতা করে নিজেরা ও সুবিধা ভোগী। বাকি জনতা এ সব সুবিধাভোগীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নিয়ে গণমিছিল, জ্বালাও পোড়াও থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

প্লেটোর মতে গণতন্ত্র বলতে জনগণের অনিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা , অনাকাঙ্খিত বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বুঝায় । স্বৈরাচারী সরকার জনগণকে মিথ্যা প্রতিচ্যুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করে যে তার শাসনামলে গণতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটাবে। কিন্তু তা বাস্তবে সম্ভব হয় না । অনুন্নত দেশগুলিতে শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়া হয় না ; তাছাড়া জনগণের শিক্ষার প্রতি মনোভাব ও পাল্টায় না । গরিব ঘরের যেখানে দুবেলা রুটির ব্যবস্থা নেই,ওদের পক্ষে ছেলেমেয়েদের সময় নষ্ট করে স্কুলে পাঠানো দরকার নেই বলে অনেক বাবামায়ের অভিমত । এক যুগে আমাদের সমাজে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করানো বিলাসিতা বলে গণ্য হতো , অনেকেই মনে করতো অযথা অর্থ ও সময়ের অপচয়। যে সমাজের মানুষ অশিক্ষিত,ওরা গণতন্ত্রের মূল্য বুঝবে না। যে সমাজে অর্থের বিনিময়ে ভোট বিক্রি হয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে লোক ফাঁসানো হয়, খুন হলে খুনির শাস্তি হয় না ; সে সমাজে গণতন্ত্রের সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না।

অনেক জল্পনা কল্পনার পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ০৭ই জানুয়ারী ২০২৪ নির্বাচন হবে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে । এরই মধ্যে সরকারি আওয়ামী লীগ দল এর সমর্থনে দেশ ব্যাপী আনন্দ মিছিল ও নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অপরদিকে বিনপি ও অঙ্গ সাংগঠনিক দলগুলি নির্বাচনের তফসিল বর্জনের ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় মিছিল — “বিনা ভোটে,রাতের ভোটে,না ভোটে নিবার্চন বর্জন করুন ” স্লোগান দিচ্ছে । বিনপি ও আওয়ামী লীগ দুই মেরুতে বাস করে , এক দল সরকার, এর এক দল রাস্তায় এই হলো বাংলাদেশের অবস্থা। দেশের আপামর জনতা সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করছে।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট ‘ :
১৯৪৭ সনের ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানের ২৩ বৎসরের ইতিহাসে একটি মাত্র নির্বাচন (১৯৭০ ) সঠিক ভাবে হয়েছিল যা তৎকালীন পাকিস্তান সরকার মেনে না নিয়ে ৯ মাস পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ বেঁধে দেয়ার ফলে ১৯৭১ সনে দেশ ভাগ হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সন থেকে দেশে দুর্ভিক্ষ,অনাবৃষ্টি ,অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা, খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগেছে। পাকিস্তানী শাসক গুষ্ঠি সম্পদের ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে আমাদের ঠকিয়েছে। দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ, খাদ্য সমস্যা তো ছিল ; উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে দুর্ভিক্ষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা , সেনা অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছিল । এ সব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লেগেছে।

১৯৪৭ সনে পূর্ব বাংলা শিক্ষা, শিল্প,কল- কারখানায় অনগ্রসর এবং ব্রিটিশ আমলে যা কিছু উন্নতি হয়েছিল কলিকাতা ভিত্তিক। ভারতের হিন্দু মাড়োয়াড়ি ও মধ্যম শ্রেণীর ব্যাবসায়ী যা কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেছে ,সবই পশ্চিম বঙ্গে তথা কলিকাতায় । মুসলমান মেজরিটি হলেও -গরিব মজুর, রিকশা চালক, খেটে খাওয়া বাঙ্গালী। এমন একটি ভূখণ্ড নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান তৈরি হলো যার হৃদপিন্ড পশ্চিম বঙ্গে ; এ নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সারওয়ার্দী বলিষ্ঠকণ্ঠে আপত্তি জানিয়ে ছিলেন। ১৯৪৬ সনের কলিকাতার হিন্দু -মুসলমান দাঙ্গায় দশ থেকে পনোরো হাজার মুসলমান প্রাণ দিয়েছিলো ; তা কোনোদিন ভুলে যাওয়ার মতো না। গানের ভাষায় বলা হতো “রানাঘাট, শিয়ালদহ আজ ও আছে ভাই ,আমি যাবো আমার দেশে সোজা রাস্তা নাই। ” এ সব সমস্যা কাটিয়ে আজকের বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, রাস্তাঘাট এবং শিল্পে অনেকখানি এগিয়েছে- এই অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হলে, দেশে আস্থাশীল সরকার থাকা দরকার।

ক) দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট বিদ্যমান থাকলে বিদেশী বিনিয়োগ ক্রমেই হ্রাস পাবে। রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো ছায়া ফেলছে। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং অর্থনীতিবিদরা উদ্বিগ্ন যে রাজনৈতিক দলগুলি রাস্তায় নেমে যেভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাতে ব্যবসা, বাণিজ্য এবং শিল্প কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হচ্ছে।
খ ) হরতাল,অবরোধ অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর- যদি এখনই গণতান্ত্রিক সরকার না আসে,এতে পুরো দেশ আরও বড় সমস্যায় পড়বে।
গ ) আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির উপর নির্ভর করছে দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা। আজকের দুনিয়া একে অপরের দেয়া- নেয়া, একের প্রতি অন্যের বিশ্বাস স্থাপনের উপর নির্ভর করে। যদি দেশে রাজনৈতিক শান্ত পরিবেশের অভাব হয়,তা বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের উপর প্রভাব পড়বে , এতে দেশের ক্ষতি ও জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। সবাইকে নিয়ে “হারিজিতি নাহি লাজ ” পলিসি নিয়ে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে নেয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই।

পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে, যে সব দেশে স্বৈরাচার ও অনভিজ্ঞ সরকারের দরুন জনগণের দুর্ভোগ চরমে -তাদেরই একটি সুদান। সুদান উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত, আয়তন ১,৮৮৬,০৬৮ বর্গ কিলোমিটার বা ৭২৮,২১৫ বর্গমাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। দেশটির দুই অংশের লোক সংখ্যা ৫০ মিলিয়ন , যার ১০ মিলিয়ন দক্ষিন সুদানে এবং ৪০ মিলিয়ন উত্তর সুদানে। ব্রিটিশ ও মিশরীয় উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়; সুদান তেল সম্ব্রিদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও নানাহ সমস্যার মধ্যে তেল উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।

১৯৫৬ সনে সুদান ব্রিটিশ ও মিশরীয় উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।স্বাধীনতার ৬ মাসের মাথায় এই দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। জনসংখ্যার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে উত্তর সুদানে 97% মুসলিম এবং দক্ষিন সুদানে ৬১% খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। দুই অংশের মধ্যে বহুদিনের ধর্ম ও নানাহ দিক নিয়ে সমস্যা ও গৃহযুদ্ধ চলে আসছে। সুদানের প্রথম গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যখন ব্রিটিশ ও মিশরীয় শাসকরা এই অঞ্চলকে উপনিবেশ মুক্ত করে। দক্ষিন সুদানের জনগণ উত্তর সুদানের কতৃত্ব মেনে নিতে পারে নি যার ফলে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং দক্ষিন সুদান ২০১২ সালে সমগ্র সুদান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর নিজেদের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে সুদান রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। সামরিক ও বেসামরিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সামাজিক এবং আরও নানাহ কারণে সুদানে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। সুদানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জাতিগত সংঘাত গুলির উল্লেখযোগ্য হ’ল দারফুর সংঘাত এবং দক্ষিণ সুদানের গৃহযুদ্ধ । দারফুর সংঘাত ২০০৩ সালে শুরু হয়েছে এবং এর ফলে লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
দুর্বল প্রশাসন : দেশে সঠিক আইনের প্রয়োগ নেই । অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি এবং সামাজিক অস্থিরতা দেশে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করেছে। সরকার ও বেসরকারি গুষ্ঠির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধ বহুদিন থেকে চলে আসছে ।

তেল সম্পদ ব্যাবস্থাপনার সমস্যা : সঠিক ব্যাবস্থাপনার অভাবে সুদান তেল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদনের সঠিক অর্থ দেশের কাজে ব্যবহৃত না হয়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তি বা ব্যক্তিবর্গের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ক্ষমতালোভীদের সংঘাত : সুদানে ক্ষমতার লড়াই সামরিক বাহিনী এবং প্যারামিলিটারি বা রেপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) মধ্যে দীর্ঘদিনের সমস্যা। দুটি গোষ্ঠী রাষ্ট্র এবং এর সম্পদের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে।

দক্ষিণ সুদানের গৃহযুদ্ধ, সরকার, বিরোধী বাহিনীর মধ্যে একটি বহুমুখী দ্বন্দ্ব এবং এই সংঘাতের ফলে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ মারা যায় ; বহু লোক দেশের ভিতর ও বাহিরে আশ্রয় নিয়েছে।
দারফুর সুদানের একটি অঞ্চল যা সামাজিক বৈষম্য, পরিবেশগত সংকট, প্রাকৃতিক সম্পদ কে নিয়ন্ত্রণ করবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা, এবং বিরূপ শাসনের একটি জটিল ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছে। এই অঞ্চলটি মিলিশিয়াদের সহিংসতায় ভুগছে ;যারা গ্রামগুলি পুড়িয়ে দিয়েছে, লুটপাট করছে । আইনের শাসন, নিরাপত্তা এবং মানবিক সহায়তার অভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন প্রত্যাহারের ফলে এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির সঠিক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে । এ সব দেশে শিক্ষা নিম্নমানের, গণতন্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে । ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজেদের ও সরকারি শক্তি কাজে লাগিয়ে শাসনের নামে শোষণ করে। দেশের মঙ্গলের চেয়ে নিজের আত্ত্বতৃপ্তির কথা ভেবে পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি দিয়ে দেশ পরিচালনা করে।

সমাপ্ত

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন