বই পড়ার তীব্র এক আখাঙ্খা ছিল এক সময়ে। বিশেষ করে গল্পের বই পড়ার। স্কুলের বইয়ের ভিতর  ‘মাসুদ রানা’ র বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে ধরা পড়ার অনেক স্মৃতি রয়েছে। সঙ্গত কারণেই সেই স্মৃতি খুব  সুখকর নয়। আম্মা কখনো চাইতেন না যে পাঠ্য বই এর চাইতে গল্পের বইয়ে বেশি মনোযোগী হই । আম্মাকে দেখতাম অবসর সময়ে বাংলাদেশের ডেল কার্নেগি খ্যাত মুহাম্মদ লুৎফর রহমান সাহেবের বই পড়তে।  আব্বা পড়তেন আরবী, উর্দু, ইংরেজি এবং ফার্সি ভাষাতেও। ঘন্টার পর ঘন্টা নিমগ্ন হয়ে থাকতেন বইয়ের পাতায়। মনে পড়ে অনেক বছর আগে সম্ভবত এসএসসি পরীক্ষার পরে আব্বার হাতে A Short History of the Saracens নামে একটি বই দেখে Saracens শব্দের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে গলদগর্ম হওয়ার কথা। পরে জানলাম যে ক্রুসেডের সময়কালীন ‘মুসলমান’দের বুঝাতে Saracens শব্দটি ব্যবহার করা হতো। ইংরেজিতে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম সেরা বই জাস্টিস সৈয়দ আমির আলীর লেখা “A Short History of the Saracens”। ঢাকায় আব্বার জন্য ইসলামী বইগুলো সংগ্রহ করতাম আব্বার ঘনিষ্ট বন্ধু “মাসিক মদীনা”র প্রতিষ্টাতা সম্পাদক এবং  “তাফসীরে মারেফুল কোরআন” প্রণেতা প্রয়াত মাওলানা মুহীউদ্দিন খান সাহেবের কাছ থেকে।  উনার সংকলিত একটি গ্রন্থ হচ্ছে “কুড়ানো মানিক”। ইসলাম এবং ইসলামের মর্মবাণীকে আত্মস্থ করে যারা নীরবে, নিভৃতে ইসলামের সেবা করে গেছেন, এই বইটি হচ্ছে সেই সমস্ত বুজুর্গদের বাণীর সংকলন। অসাধারণ একটি বই। আলহামদুলিল্লাহ, আশির কোটায় এসেও আব্বা তার বই পড়ার অভ্যাস অব্যাহত রেখেছেন।  যদিও আব্বার এই অভ্যাস আমরা তিন ভাইয়ের কারো মধ্যেই তেমনভাবে সংক্রমিত হয়নি, কিন্তু উনার নাতি, নাতনিদের মধ্যে এটি ভালোভাবেই সঞ্চারিত হয়েছে। পড়ার টেবিল ছাড়িয়ে বইপত্র এখন বাথরুমেও খুঁজে পাওয়া যায়।

কানাডার ব্যস্ত, যান্ত্রিক জীবনে অবসর বের করা আর সেই অবসরে বই পড়ার সুযোগ এখন অনেকটাই দুর্লভ। তারপরে ও সময় পেলেই বই পড়ার চেষ্টা করি। সাবওয়েতে চড়ে কর্মস্থলে যাবার পুরো সময়টাই এই কাজে লাগে।  পেশাগত জীবনে  মাঝে মাঝে “বাধ্যতামূলক বই পড়া”র পরিস্তিতি সৃষ্টি হয়।  যেমনটা হয়েছে এখন। কেস ম্যানেজারদের যে টিমে আমি কাজ করি, সেই টিমের পরিচালক- আমার বস কিছুদিন পর পর মানসিক স্বাস্থ্য এবং আসক্তি বিষয়ক বই কিনে আমাদেরকে পড়তে দেন। শুধু পড়াই নয়, বই পড়ে মাসিক টীম মিটিংয়ে সেই বই নিয়ে আলোচনাও করতে হয়, জবাব দিতে হয় সহকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের। সুতরাং ফাঁকি দেবার উপায় নেই। এই বাধ্যতামূলক বই পড়ার অংশ হিসেবে এখন যে বইটি পড়ছি, সেটার নাম খুবই চমকপ্রদ,  “I Hate You- Don’t Leave Me” । নাম শুনেই আন্দাজ করা যায় যে এটি পরস্পরবিরোধী মনোভাবের পরিচয় বহনকারী মানসিক সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই বইটি Borderline Personality Disorder (BPD) নিয়ে লিখিত সেরা বইগুলোর একটি। লিখেছেন Jerold J. Kreisman এবং Hal Straus। এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন ডক্টর Kreisman । তিনি Bipolar Disorder এ আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার জন্য প্রথম চালুকৃত ”Acute  Care Centre” গুলোর একটির  প্রতিষ্টাতা। এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের সাথে কাজ করা খুব সহজ নয়। কারণ তারা কখন, কেন এবং কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তা বুঝে উঠা কঠিন। BPD  বিশেষজ্ঞ Marsha Linehan একে চমৎকার ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, “Borderline individuals are the psychological equivalent of third – degree burn patients. They simply have, so to speak, no emotional skin. Even the slightest touch or movement can create immense sufferings” । যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। পুরো বই জুড়ে এই বিষয় নিয়েই আলোচনা। খুব মনোযোগ দিয়েই বইটি পড়ছি। আশা করছি সামনের মাসের মিটিংয়ে এ নিয়ে ভালোভাবে উপস্থাপনা করতে পারবো।

জ্ঞানার্জন, বিনোদন এবং ভাষার উপর দখল অর্জনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।  জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এটি একই গুরুত্ব বহন করে।  যে জগতে অন্য আর কোনো কিছুই কাজে লাগবে না এবং সব কিছুর শেষে যার কাছে ফিরে যেতে হবে তাকে জানতে হলেও তার বই পড়তে হবে। রাসূলে পাক (সা) এর কাছে অবতীর্ণ পবিত্র কোরআন এর প্রথম সুরা হচ্ছে সুরা আল আলাক। এই প্রথম সুরার প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দটি হচ্ছে “ইকরা“ অর্থাৎ “পড়ো“। বলা হচ্ছে, “পড়ুন আপনার প্রভুর  নামে, যিনি সৃষ্টি  করেছেন”।  আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি যে আরো অনেক শক্তিশালী, তাৎপর্যপূর্ণ সুরা ত্থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্পাক তার ঐশী বাণী পাঠানো শুরু করেছিলেন  “পড়ো” শব্দযুক্ত একটি আয়াত দিয়ে। কোরআনের সারমর্ম খ্যাত সুরা  ইখলাস বা অন্য কোনো সুরা দিয়ে নয়। ‘পড়ো’ শব্দটি কি তাহলে কোনো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে ? এর রহস্য কি?  তাফসীরবিদরা অনেক রখম ব্যাখ্যা দাড় করালেও এর আসল কারণ একমাত্র আল্লাহপাকই জানেন।  নিগূঢ় এই রহস্য ভেদের প্রজ্ঞা বা সামর্থ্য কোনোটাই মানুষের নেই।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

2 মন্তব্য

  1. ইনশাল্লাহ যোগ্য উত্তরসূরী সৈয়দা মেহজাবিন হাসান লামিয়া।

  2. হাসান ভাই , পড়ার বিষয় ও তার গুরুত্ব নিয়ে আপনার লেখাটি সত্যিই অসাধারণ। আমি কখনও এমন লিখতে পারবো না। আমরাও বাল্যকাল থেকে বই পড়ার প্রতি অনেক নেশা। আমি বেশি ভালোবাসি রহস্য ও রম্য রচনাবলী বিষয়ক বই। আজকাল এগুলির পাশাপাশি কিছু হাদিস-কোরআনের ব্যাখ্যা নিয়েও পড়াশুনা করে থাকি। আপনার কাছ থেকে আরো এধরণের লেখা আশা করি। ভালো থাকুন। ….মনির

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন