রাতের বাসে করে বোস্টন যাচ্ছি। ভোর রাতে বাসটি এসে সারাক্রুসে থামলো। আমাকে এখানে নেমে যেতে হবে এবং বাস বদল করে অন্য বাসে বোস্টন যেতে হবে । যদিও শুনতে মনে হয় সারা রাতের বাস ভ্রমণ- ক্লান্তিদায়ক, বিরক্তিকর। কিন্তু আমার আসলে একটুও খারাপ লাগছিলো না। বাস ড্রাইভার অনেক দক্ষ হাতে, স্বাচ্ছন্দে গাড়ি চালিয়েছে। একবারও জোরে ঝাকুনি বা ব্রেক কষা বুঝতে পারিনি। নির্ভিঘ্নে ঘুমিয়ে এসেছি সারারাত। সারাত্রুসে নেমে ডানকিন ডোনাটে ঢুকে একটা কফি ও ডোনাট নিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। যদিও ডানকিন ডোনাট কানাডার টিম হর্টনের মতো মজাদার নয়,  তারপরও খেতে হলো।. কফিতে চুমুক দিতে দিতে বেশ কয়েক বছর আগের রোমাঞ্চকর এক বাস জার্নির কথা মনে  পড়লো।

২০০৪ সালের কথা. আমার হাসব্যান্ড ও তিন বছরের মেয়ে লামিয়াকে নিয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরেছি। এবারের গন্তব্য সিলেট। রোজার ঈদের এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। প্ল্যান ছিল ঢাকায় জরুরি কিছু কাজ সেরে মা বাবার সাথে সিলেটে যেয়ে ঈদ করবো। বাঁধ সাধলো সিলেটে যাবার টিকেট নিয়ে। ঢাকায় যারা থাকেন তারা জানেন যে ঢাকা শহরের অর্ধেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে অন্য শহর ও গ্রামে চলে যান পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ করতে। আমরা ভেবেছিলাম প্লেন বা ট্রেনের টিকেট নিয়ে নিব. কিন্তু ঈদের এক সপ্তাহ আগেই প্লেন, ট্রেন বা ভালো এসি বাস কোনো কিছুতেই একসাথে তিনটে টিকেট জোগাড় করা গেলো না। ভীষণ মন খারাপ করা পরিস্তিতি। এতদিন পরে দেশে এসে মা বাবার সাথে ঈদ করতে পারবো না, তা মেনে  নিতে পারছিলাম না। অন্যদিকে আমাদের দুজনের মা বাবার টেনশন আমরা কিভাবে সিলেট পৌঁছবো। কোনো উপায় না দেখে আমরা শেষপর্যন্ত ঢাকা সিলেটের লোকাল বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছাড়লো সকাল আটটায়। বাস ড্রাইভার আমাদের আশ্বস্ত করলো যে সে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই সিলেট পৌঁছুবে। আমরা বাসের সামনের দিকের একটি ভালো সিটেই বসলাম। তখনও বুঝতে পারি নাই যে ড্রাইভার সাড়ে চারটার ঘন্টার মধ্যে হয় সিলেট নয়তো পরপারে পৌঁছাবে। বাস যখন হাই ওয়েতে উঠলো তখন বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বাস ড্রাইভার সাহেব গাড়ি চালাচ্ছেন পাগলের মতো, ওভার টেইক করে যাচ্ছেন বলতে গেলে রাস্তায় থাকা সব কিছুই। আমরা হতভম্ব। বুঝতে পারছিনা এ কোন গাড়িতে উঠলাম। এরখম ভয়ঙ্কর এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম।  ভাবছিলাম যদি বেঁচে থাকি, এটাই হবে শেষ। আমি ও আমার হাসব্যান্ড বার বার ড্রাইভার সাহেবকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম গাড়ি একটু ধীরে এবং সাবধানে চালানোর। কে শুনে কার কথা. তার মাথায় আসলে ঘুরছে সাড়ে চার ঘন্টায় সিলেট পৌঁছুবার পণ। আমাদের তাগাদায় বিরক্ত হয়ে ড্রাইভার একপর্যায়ে বললো, “আপনারা এতো চিন্তা করছেন কেন? তাকিয়ে দেখেন, বাসভর্তি লোক ঘুমাচ্ছে, একমাত্র আপনারা ছাড়া।“  তাকিয়ে দেখি আসলেই সবাই ঘুমাচ্ছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। সবাই এতই নির্বিকার যে মনে হচ্ছে এটাই সত্যিকারের নিরাপদ, আরামদায়ক বাস জার্নি। এভাবে আড়াই ঘন্টায় চলে  আসলাম শায়েস্তাগঞ্জে। আব্বার সাথে কথা ছিল যে শায়েস্তাগঞ্জে এসে আব্বাকে ফোন দেব যাতে উনি বুঝতে পারেন কখন বাস স্টান্ডে গাড়ি পাঠাবেন। আব্বাকে ফোন দিতেই আব্বা অবাক, এতো তাড়াতাড়িই শায়েস্তাগঞ্জে ! আব্বা জিজ্ঞেস করলেন কখন এসে সিলেট পৌছুবো। বাসযাত্রীদের মতোই নির্বিকারভাবে জানালাম,  বেঁচে থাকলে দুঘন্টায়।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমরা নিরাপদেই সিলেট পৌঁছুতে পেরেছিলাম। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু ভয় নিয়ে সাড়ে চার ঘন্টার এই বাস ভ্রমণ আমাদের জীবনের ভীতিকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি।  খুব জানতে ইচ্ছে করে এই ড্রাইভার কি এখনো সেই বেপরোয়া গতিতেই গাড়ি চালায় আর গাড়ি ভর্তি লোকজন সব উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায় ? এই প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেলো। কফি শেষ করে এসব ভাবতে ভাবতেই পা বাড়ালাম বোস্টনের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রস্তুত গ্রে হাউন্ড বাসের দিকে।“জার্নি বাই বাস”

নওশিন হামিদ চৌধুরী

টরন্টো থেকে

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন