নিউ ইয়র্ক থেকে:-

উত্তরায়ন থেকে কিছুদূর এগিয়েই কলা ভবন আর্ট গ্যালারি। ১৯৮১ সালের ১২ই ডিসেম্বর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এই ভবনের উদ্বোধন করেন। কলাভবনে রয়েছে হোষ্টেল যার নাম ‘ব্ল্যাক হাউজ’। আর্ট গ্যালরির উল্টোদিকেই নাট্যমঞ্চ ‘নাট্যঘর’। ব্ল্যাক হাউসের পেছনে ‘সংগীত ভবন’। এই সংগীত ভবনে সংগীতের উপরে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন বাংলাদেশের অনেক গুণী শিল্পীরা।

সংগীত ভবন পেরিয়ে আমরা এলাম ‘রবীন্দ্র ভবন’। এখানে করা হয়েছে রবীন্দ্র যাদুঘর। এই যাদুঘরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র,স্বহস্তে আঁকা শিল্পকর্ম, দেশবিদেশ থেকে পাওয়া সম্মানের দলিল দস্তাবেজ। এখানে আরো রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাপড়চোপড়, জুতো ও আরো কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র।

২০০৪ সালের ২৫ মার্চ রাতে রবীন্দ্র যাদুঘরে একটি চুরি সংগঠিত হয়।রহস্যজনক ভাবে ‘নোবেল পদক’ চুরি যায়!পদকের সাথে চুরি যায় সোনার আংটি,সোনার বোতাম, কাফ লিঙ্ক, মৃণালিনী দেবীর শাড়ি, সোনা-বাঁধানো নোয়া, রুপোর রেকাবি, রুপোর কফি কাপ, সামুরাই তরবারি, কফি কাপ রাখার তেপায়া, চৈনিক চামুচ, কোবে শহর থেকে পাওয়া হাতির দাঁতের ঝাঁপিসহ আরও ৩৭টি জিনিস।

চুরির দিন অর্থ্যাৎ ২৫ মার্চ, ২০০৪ ছিল বুধবার।শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন। মঙ্গলবার দুপুর ১টায় বন্ধ হয়ে যায় শান্তিনিকেতন। বৃহস্পতিবার রবীন্দ্র ভবন খুলতেই ধরা পরে চুরির ঘটনা। মঙ্গলবার বিশ্বভারতী বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই চোরেরা ভেতরে ঢুকে অবস্থান নেয়। সারা রাত ধরে মালপত্র সরাতে থাকে।

রবীন্দ্র ভবনের পেছনের জানালা ভেঙে ফেলে চোর, দেয়ালের নিচে পাওয়া যায় ভাঙা গ্রিল। এই জানালা দিয়ে তারা মালপত্র সরিয়ে নেয়। পুলিশ বলে চোর জানালা দিয়ে ঢোকেনি। কারণ, সে ক্ষেত্রে জানালার পাল্লা ভেঙে ফেলতে হতো। উত্তরায়নের এই বিশাল এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল মাত্র দুজন এনডিএফ কর্মী। তদন্ত করে পাওয়া গেছে ২৮ জোড়া পায়ের ছাপ। তার মধ্যে আবার দুজনের পায়ে চটি ছিল। কিন্তু সেই রহস্য আজও যেমন উদ্ধার হয়নি, তেমনি খুঁজে পাওয়া যায়নি কবির পদকও।

পদক চুরির খবর ছড়িয়ে পরার পর সারা ভারত জুড়ে উঠে ক্ষোভ। বিশ্বভারতীর আচার্য ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করা হয়। তৃণমূল কর্মীরা অনশনে বসে। প্রধান বিচারপতির আদালতে তিনটি আলাদা মামলা হয়। অমর্ত্য সেন, মহাশ্বতা দেবী ও শঙ্খঘোষ সবাই অবিলম্বে পদক উদ্ধারের দাবী জানান।

sinha6a

২০০৪ সালে যখন এই পদক চুরি যায়, তখন সেখানে উপাচাযের্র দায়িত্বপালন করছিলেন ড. সুজিত কুমার বসু। তিনি এই ঘটনার প্রবল তোপের মুখে পড়েন। প্রশাসন চুরির ঘটনার কিছু দিন পর তাকে সরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব দেয় ড. রজতকান্ত রায়কে।

বিশ্বভারতীর উপাচার্য ড. সুজিত কুমার বসু চোরদের কাছে আবেদন জানান, ‘ওরা ওই সব মূল্যাবান বস্তু আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিক ওদের ক্ষমা করে দেয়া হবে। ওদের পরিচয় গোপন রাখা হবে, এটা জাতীয় লজ্জা’!

নোবেল পদকের সোনা যাতে গলিয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য রাজ্য জুড়ে সকল স্বর্ণকারদের অনুরোধ জানানো হয়। ওদিকে বীমা কোম্পানী ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স কোম্পানী বলেছে তারা ১০ বছর আগেই বলেছে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা পর্যাপ্ত নয়।

মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে খবর পৌছানোর সাথে সাথে তদন্তের নির্দশ দেন সি.আই.ডিকে। হতাশা প্রকাশ করেন বিশ্বভারতীর আচার্য ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। ফোনে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে, আশ্বাস দেন সর্বোচ্চ সহযোগিতার।

চুরি যাওয়া নোবেল পদক সম্পর্কে তথ্য দিতে পারলে ১০ লক্ষ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। সাহায্য চাওয়া হয়েছিল ইন্টারপোল-এর। তবে তাতেও কাজ হয়নি। সিবিআইয়ের এক কর্তা জানিয়েছিলেন তাঁদের অনুমান ছিল— ভিনদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে নোবেল পদক।পদকটি হয় গলিয়ে ফেলা হয়েছে বা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ২০০৪ সালে নোবেল চুরি যাওয়ার পরে এই ঘটনা নিয়ে ছবিও তৈরি হয়েছিল টলিউডে।

পরে সেই চুরির ঘটনায় এক বাউল শিল্পীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। বিশেষ তদন্তকারী শাখার পক্ষ থেকে জানানো হলো যে,তাঁরা প্রায় নিশ্চিত যে,২০০৪ সালের ২৫ মার্চ ‘নোবেল পদক’ চুরির ঘটনার সঙ্গে প্রদীপ বাউল নামের এই বাউল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনায় বাকি অভিযুক্তদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রদীপ। চোরেদের পালানোর সুযোগও তিনিই করে দিয়েছিলেন। সূত্রের খবর, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরির মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর কথা থেকে জানা গিয়েছে যে, মহম্মদ হোসেন শিপুল নামে এক বাংলাদেশের নাগরিক এই চুরির মাস্টারমাইন্ড। দুই ইওরোপীয় ব্যক্তিও এই ঘটনায় জড়িত বলে দাবী করা হলো।

শান্তিনিকেতন থেকে চুরি হওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদকটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়ে ঢাকার এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর হাতে গেছে। চোরেরা নোবেল পদকটি স্রেফ পানির দামে ওই ব্যবসায়ীকে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মূল প্রশাসনিক দফতর নবান্ন সূত্রের বরাতে এ খবর প্রকাশ করেছে কলকাতার দৈনিক ‘বর্তমান’। তবে সরকারিভাবে এমন কথা স্বীকার করা হয়নি।

রবীন্দ্রভবন থেকে আমরা এলাম ‘আম্রকুঞ্জে’। এখানেই বিশ্বভারতীর বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন এই আম্রকুঞ্জেই কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। শান্তিনিকেতনের এই আম্রকুঞ্জেই গানধিজি ও রবীন্দ্রনাথে দেখা যেত গল্পে মেতে উঠতে!

এর পরে আমরা দেখলাম আরো দু’টি ইমারত। একটির নাম ‘চায়না ভবন’ অপরটি ‘নিপ্পন ভবন’। চায়না ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মাইলষ্টোনে লেখা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৭ সালের এপ্রিলে এই ভবন উদ্বোধন করেন। আবারো মনে পডলো,পাখি উডে যায় পালক পড়ে থাকে।শান্তিনিকেতনের সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের ঝরা পালক!

চিয়াং কাইসেক ছিলেন বিশ্বভারতীয় অধ্যাপক। তিনি ও তার স্ত্রী তান ইয়ান ‘চায়না ভবন’ নির্মাণে বিস্তর সহায়তা করেন। চিয়াং কাইসেক ও তান ইয়ান দু’জনে মিলে এই ভবনের লাইব্রেরীর জন্য প্রায় চব্বিশ হাজার পুস্তক উপহার হিসেবে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এই লাইব্রেরীতে চৌত্রিশ হাজার বই উপহার হিসেবে পাঠান। এই ভবনে চীনা সাহিত্যের উপর উচ্চতর গবেষণা হয়ে থাকে।

১৯৫৪ সালে বিশ্বভারতীতে জাপানি বিভাগের খোলা হয়।আর ১৯৯৪ সালে ‘নিপ্পন ভবন’ উদ্বোধন করা হয়।যার নিরলস প্রচেষ্টায় বিশ্বভারতীর ‘নিপ্পন ভবন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি হচ্ছেন প্রফেসর কাজুও আজুমা।প্রফেসর কাজুও আজুমার আরেকটি কীর্তি রয়েছে।তিনি জাপানি ভাষায় ১২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলির সম্পাদনার কাজটিও করেছেন।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়,পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং জাপান সরকার জীবিতকালেই তাকে যথাক্রমে ‘দেশিকোত্তম’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ এবং ‘পার্পল রিবন’ (কোক্কা কুনশোউ) পদক প্রদান করে তার বিশাল কর্মযজ্ঞের সম্মাননা দিয়েছেন।

ক্যাম্পাস শান্ত হয়ে এসেছে, সূর্য ডুবিডুবি করছে। আমরা ফিরে এলাম ট্যুরিষ্ট লজে। নাওয়া খাওয়া শেষে এবার বিশ্রামের পালা।

চলবে… … …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন