নিউ ইয়র্ক থেকে:-

শান্তিনিকেতনের মূল ক্যাম্পাসে!
ছাতিমতলার দক্ষিণের জায়গাটি হচ্ছে ‘বকুলবীথি’। এখানে রয়েছে অনেকগুলো বকুল গাছ। প্রতিটি গাছের মূলকে ঘিরে গোলাকার জায়গা। এখানেই উন্মুক্ত আকাশের নীচে শ্রেণীকক্ষ।

5mansur2

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটা আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বাল্যকালে তাঁকে যেসব স্কুলে পাঠানো হয়েছিল সেগুলি সম্পর্কে তিনি প্রীত ছিলেন না। তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজি স্কুলগুলি ছিল ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি ও জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। শান্তিনিকেতনকে বেছে নেওয়ার পেছনে তাঁর তিনটি স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল: সেগুলো হচছে:

এক. প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা।
দুই. পরিবর্তনশীল ভারতে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে শিক্ষা দান করা।
তিন. বৃহত্তর বিশ্বকে গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য জ্ঞানদান করা।

5mansur1

আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী শুরু হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথের মনে এই সমগ্রতার চিন্তা ছিল। ১৯১৬ সালে তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন:

‘পৃথিবীর সঙ্গে ভারতকে সংযুক্ত করার সূত্র হিসেবে শান্তিনিকেতন স্কুলকে গড়ে তুলতে হবে। সেখানে আমাদের পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবাদী গবেষণার জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।আমার শেষ কয়েক বছরের কাজ হবে জাতীয় অন্ধ স্বদেশপ্রেমের কুন্ডলী থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা’!

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আরো লিখেছিলেন:
‘সেবা করতে ও পেতে, দিতে এবং নিতে, বিশ্বের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার থেকে ভারত, বিচ্ছিন্ন শিক্ষার নামে যা পায় তা সামান্য। বিশ্বের তুলনায় ভারতের শিক্ষা প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের। আমরা এখন এই আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবমাননা থেকে মুক্তি চাই।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন শিশুর শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতিটা হবে এমন, যাতে মনের আনন্দে শিশু জ্ঞান আহরণ করবে। এই শিক্ষা হবে প্রকৃতিনির্ভর। তাই তিনি শান্তিনিকেতনে ছাতিম গাছের নিচে পাঁচজন ছাত্র নিয়ে ‘গুরুকুল শিক্ষালয় নামে ব্রহ্মচর্য আশ্রম বিদ্যালয়’ শুরু করেছিলেন।এখানকার শিক্ষা গ্রহণ প্রকৃতিনির্ভর!

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের সীমিত সঙ্গতি দিয়ে মাত্র পাঁচজন ছেলে নিয়ে বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলেন। শান্তিনিকেতন স্কুলের শুরুতে এর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী নিজের সমস্ত অলংকার বিক্রি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পুরীতে তাঁর বাংলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পিতার শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট থেকে আসা বছরে আঠারশ টাকার উপরই তিনি প্রধানত নির্ভর করতেন। পরে তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ স্কুলে দান করেন। ১৯২২ সালে তিনি তাঁর বাংলা গ্রন্থাবলির গ্রন্থস্বত্ব বিশ্বভারতীকে দান করেন।

বিশ্বভারতীর কতগুলো স্তর রয়েছে।এগুলো হচছে:পাঠশালা,বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয় এবং স্নাতকোত্তর ও গবেষণা স্তর।এখানে পাঠশালা বিভাগকে বলা হয় ‘মৃনালীনি’। বিদ্যালয় বিভাগকে বলা হয় ‘পাঠভবন’।মহাবিদ্যালয় বিভাগকে বলা হয় ‘শিক্ষাভবন’।স্নাতকোত্তর ও গবেষণা বিভাগকে বলা হয় ‘বিদ্যাভবন’।বিশ্বভারতীতে সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি, অসমীয়া, উড়িয়া, সাঁওতালি, মারাঠি, তামিল, উর্দ্দু, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, চীনা, ইতালিয়, তিব্বতী, রুশ, আরবী ও ফারসী ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। পাঠশালা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত নেওয়া যায় বিশ্বভারতী থেকে !

‘বকুলবীথি’ পেরিয়ে আমরা এলাম ‘উত্তরায়ন’!

উত্তরায়ন: রবীঠাকুরের দ্বিতীয় বাড়ী!
শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তরে ‘উত্তরায়ন’ কমপ্লে­ক্স। ১৯১৯ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ এই কমপ্লেক্সে বসবাস শুরু করেন। উত্তরায়নে রয়েছে পাঁচটি ছোট ছোট বাড়ী। প্রথম যে বাড়ীটি তৈরী করা হয় তার নাম কোনার্ক। এরপর তৈরী হয় আরো চারটি ছোট ছোট বাড়ী।
বাড়ীগুলোর নাম রবীন্দ্রনাথের নিজেরই দেয়া। ভারী সুন্দর ও কাব্যিক চারটি নাম-উদয়ন, শ্যামলী, পুনশ্চ আর উদীচি। উদয়নে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দীর্ঘদিন।

শ্যামলীর বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ কাদা ও আলকাতরার সংমিশ্রণে তৈরী। বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু ও রামকিংকর এর ত্বত্তাবধানে তৈরী হয় ‘শ্যামলী’। নিজের ৭৪ তম জন্মদিনে কবি এখানে উঠে আসেন।‘শ্যামলীর’ পূর্বেই ‘পুনশ্চ। উত্তর পশ্চিমে উদীচি। ‘উদীচির আদি নাম ‘সেজুঁতি’। যেহেতু উত্তরায়নের উত্তরে তাই রবীন্দ্রনাথ এর নাম দেন ‘উদিচী’।

5mansur3

উদীচিতে রবীন্দ্রনাথ নিজ হাতে একটি গোলাপ বাগান করেছিলেন। বাগানটি এখনো আছে। আছে সেই মাটি।আছে সেই গোলাপ গাছের বংশধরেরা!নেই শুধু সেদিনের সেই মালী!মা আর আমি দু’জনে মিলে বাগানে ঘোরাফেরা করছি। আমার মনে পড়লো রবী ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গান:

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে’!

পাখি উড়ে যায়-পালক পড়ে থাকে। রবীঠাকুর নেই- আছে তার কীর্তি, আর তাঁর সাজানো বাগান! এই সাজানো বাগানে হাঁটতে গিয়ে আমার মনে হলো এই শান্তি নিকেতনে বসেই রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন তার শ্রেষ্ট কিছু রচনা। এই মূহুর্তে এমনই একটি রচনার কথা আমার মনে পড়লো।

সে অনেক যুগ আগের কথা, রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে এসেছেন শান্তিনিকেতনে, পরে সফর সঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছেন চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং অমল বোস। এই ভ্রমন সম্পর্কে চারু চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় তার এক লেখায় বলেছেন:

‘কোন এক উৎসব উপলক্ষ্যে আমরা বহু লোক বোলপুরে গিয়েছিলাম। খুব সম্ভব ‘রাজা’ নাটক অভিনয় উপলক্ষ্যে। বসন্তকাল, জোছনা রাত্রি। যত স্ত্রীলোক ও পুরুষ এসেছিলেন তাদের সকলেই প্রায় পারুল ডাঙ্গা নামক এক রম্য বনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কেবল আমি যাইনি রাত জাগবার ভয়ে।

গভীর রাত্রি। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, মনে হল যেন ‘শান্তিনিকেতনের’ নীচের তলায় সামনের মাঠ থেকে কার মৃদু মধুর গানের স্বর ভেসে আসছে। আমি উঠে ছাদের ধারে গিয়ে দেখলাম, কবি গুরু জোছনা প্লাবিত খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন আর গুন গুন করে গান গাইছেন! আমি খালি পায়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলাম, কিন্তু তিনি আমাকে লক্ষ্য করলেন না! আপন মনে যেমন গান গেয়ে গেয়ে পায়চারি করছিলেন তেমনি পায়চারি করতে করতে গান গাইতে লাগলেন। গান গাইছিলেন মৃদুস্বরে। তিনি গাইছিলেন:
‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরনে……!’

এ বিষয়ে অমল বোস পরে তার এক লেখায় লিখেছেন:
‘অনেক বছর আগেকার কথা। শান্তিনিকেতনে গিয়েছি অগ্রজ প্রতিম পরলোকগত চারু বন্দোপাধ্যায় মশায়ের সঙ্গে। কবি আছেন তখন মহর্ষির তৈরী শান্তিনিকেতনের সেই আদিভবনে। আজকাল যার নাম হয়েছে ‘শান্তিনিকেতন ভবন’।খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ খানিকটা রাত্রি পর্যন্ত কবির গল্প শুনে শুয়ে পড়েছি। তিনি শুয়েছেন দোতালার সিড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকের ছোট ঘরটিতে। বরাবরই তার পছন্দ ছিল ঐ ছোট ঘরটি। তার পাশের ঘরটিতে আছি চারুবাবু ও আমি।

কতক্ষন ঘুমিয়েছিল জানি না, হঠাৎ চারুদা আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললেন-‘অমল, শুনচো ?’
শুনলাম কবির কন্ঠ – ‘সুরালাপ করছেন’।
উঠে দেখি বসন্তের চাঁদের আলোয় শান্তিনিকেতনে দিগন্ত বিস্তারী প্রান্তর প্লাবিত! গাড়ি বারান্দার ছাদে একটি সাদা পাথরে বড় জলচৌকির উপরে বসে কবি গান করছেন।

চারুদা আর আমি পা টিপে টিপে এসে চুপি চুপি বসে পড়লাম কবির পেছনে। একটু পরেই বুঝতে পারলাম সুরের আলাপের সঙ্গে কথা বসিয়ে হচ্ছে নতুন গানর সৃষ্টি!
‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’
সুরের নীহারিকাপুঞ্জ থেকে বেরিয়ে এল একটি পরিপূর্ণ জ্যোতির্ময় নক্ষত্র! আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন নিরন্তর সংগীত সৃষ্টির আনন্দে তাঁর দিন রাত্রি উঠত উদ্বেল হয়ে!’

এভাবেই চারু চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় আর অমল বোস এর চাক্ষুস সাক্ষীতে সে রাতে তৈরী হয়েছিল বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতাটি!এ দুজন মানব সাক্ষীর সাথে আরো সাক্ষী ছিল শান্তিনিকেতনের মাতাল হাওয়া আর বসন্তের মাতাল জোছনা!

চলবে… … …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন