তেনজিং শেরপার ভাস্কর্য ও এডমন্ড হিলারি!

মিউজিয়ামের বাইরেই খোলা একটা জায়গা।ওই জায়গায় পাথর কেটে বানানো হয়েছে হিমালয়ের প্রতিকৃতি।ওই প্রতিকৃতির উপরে পতাকা হাতে দাডিয়ে আছেন তেনজিং শেরপা!মুখে বিজয়ের হাসি।ওই হাসি ছডিয়ে পডেছে দার্জিলিং খেকে নেপাল পর্যন্ত!আমার মনে হলো এই হাসি শুধু তার নয়,এই হাসি পুরো মনুষ্য প্রজাতির!

তেনজিং শেরপার এই ভাস্কর্যটি উম্মোচন করেন তার হিমালয় জয়ের সংগী এডমন্ড হিলারি!তেনজিং শেরপা ১৯৭৬ সাল পর্য্যন্ত হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনষ্টিটিউটের ফিল্ড ডিরেক্টর ছিলেন।তারপর তিনি অবসরে যান।অবসরে যাওয়ার পরেও তিনি আমৃত্যু এই প্রতিসঠানের উপদেসঠা পদে ছিলেন।

আমাদের গাইড বললেন, ‘ওটা ছিল ১৯৫৩ সালের মে মাসের ২৯ তারিখ।সকাল সাডে এগারোটা।ওই সময়ই তেনজিং শেরপা ও এডমন্ড হিলারি এভারেস্ট-এর চুঁডোয় উঠেন। কিনতু আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি যে, হিমালয়ের চুঁডোর তারা ছিলেন মাত্র পনের মিনিট’!
আমি জিজ্ঞেস করলাম,’মাত্র পনের মিনিট’?
গাইড বললেন,’হ্যাঁ,মাত্র পনের মিনিট।আরো বেশি সময় থাকার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না।কারন মজুদকৃত অকসিজেন পরিমান কমে আসছিলো খুব দ্রুত’!

গাইড বললেন,’এডমন্ড হিলারি এভারেস্ট-চুঁডোয় দাঁড়ানো তেনজিং শেরপা’র একটি ছবি তোলেন। এভারেস্ট-চুঁডোয় দাঁড়ানো এডমন্ড হিলারির কোন ছবি নেই।কারন তেনজিং শেরপা জানতেন না কিভাবে ক্যামেরা চালাতে হয়!

হিমালয়ের চুঁডোয় তারা দু’জনেই দু’টো জিনিস রেখে আসেন।যিশুকে উদদেশ্য করে এডমন্ড হিলারির রেখে আসেন একটি ‘ক্রস’। আর
তেনজিং শেরপা রেখে আসেন কিছু চকোলেট!
২৯০২৮ফিট উঁচু খেকে তারা যখন মাটিতে নেমে এলেন তখন তাদের গরম স্যুপ দিয়ে অভ্যরথনা জানিয়েছিলেন এডমন্ড হিলারির বনধু জর্জ লোয়ি।
মাটিতে নেমেই এডমন্ড হিলারির উক্তি ছিল:
‘Well, George, we knocked the bastard off’!

হিমালয় জয়ের জন্যে এডমন্ড হিলারিকে,কুইন এলিজাবেথ-টু ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।’নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন তেনজিং শেরপাকেও।কিনতু ভারত সরকার এই শিরোপা নিতে চায়নি’!

এডমন্ড হিলারির ও তেনজিং শেরপা’র এভারেস্ট-জয়ের ৩৭ বছর পর, ১৯৯০-এ এভারেস্ট-চুঁডোয় উঠেন এডমন্ড হিলারির পুত্র পিটার হিলারি!তার ছ’বছর পর ১৯৯৬-এ এভারেস্ট-চুঁডোয় উঠেন তেনজিং শেরপা’র পুত্র জেমলিং শেরপা!

এই অভিযান নিয়ে ১৯৯৮ সালে একটি IMAX মূভিও তৈরি হয়েছিল। ছবিটির নাম,’Everest’! ২০০১ সালে তেনজিং শেরপার পুত্র
জেমলিং শেরপা একটি বই লিখেন।বইটির নাম:
‘Touching My Father’s Soul: A Sherpa’s Journey to the Top of Everest’!

বইটি পরে ১৮ টি ভাষায় অনূদিত হয়!বইটি নিউইয়রকের টাইমসের সেরা বইয়ের তালিকায় ছিলো। ‘Touching My Father’s Soul: A Sherpa’s Journey to the Top of Everest’!কানাডা, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় তিনটি পুরস্কারের জন্যেও মনোনীত হয়েছিল!

বই লিখেছিলেন এডমন্ড হিলারিরও।তার বইয়ের নাম
‘View from the Summit: The Remarkable Memoir by the First Person to Conquer Everest’! এবং ‘High Adventure: The True Story of the First Ascent of Everest’!

১৯৮৫ সালে এডমন্ড হিলারি ভারতে নিউজিল্যান্ড-এর হাইকমিশনার নিযুক্ত হন।একই সময়ে তিনি নেপাল ও বাংলাদেশেও হাইকমিশনার দায়িত্বে পালন করেন।জীবদদশায় নিউজিল্যান্ডের পাঁচ ডলারের নোটে তার ছবি ছিল।

এডমন্ড হিলারি সবসময় বলতেন:
‘People do not decide to become extraordinary. They decide to accomplish extraordinary things.It is not the mountain we conquer but ourselves’!

তেনজিং রক!
তেনজিং শেরপার ভাস্কর্যের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এলাম তেনজিং রকের সামনে। পাশাপাশি দু’টো রকি মাউন্টেইন। এ দু’টো মাউন্টেনকে একত্রে বলে ‘মাংকি রক’। এখানেই হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয় পর্বত আরোহনের যাবতীয় বেসিক কলাকৌশল। বেশ কয়েকজন হবু পর্বত আরোহীর ট্রেনিং সেশন অবলোকন করলাম আমরা দূর থেকে।

এর পাশেই রয়েছে ছোট্ট রিপ্লিকা মাউন্টেইন রক। ওই রকে উঠে কিছুক্ষণ লাফালাফিও করলাম আমরা ১৫/২০ জনের একটি দল।

রিপ্লিকা মাউন্টেইন রকে লাফালাফি করে আমরা যখন মোটামুটি থিতিয়ে এসেছি তখনই গাইড ঘোষণা করলো- ‘আমরা এখন যাবো পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্কে।’
আমি বললাম- ‘এত জায়গা থাকতে চিড়িয়াখানায় কেন?’
আমাদের গাইড বললো- ‘সেটা গেলেই বুঝবে’। এই চিড়িয়াখানা আর আট দশটা চিড়িয়াখানার মত নয়। এখানে দেখা পাবে, বিরল প্রজাতির, বিলুপ্তপ্রায় লাল পান্ডা ও শুভ্র চিতার’! হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনষ্টিটিউট আর পদ্মজ্যা নাইডু জুলজিক্যাল পার্ক একই কমপ্লেক্সে। কাজেই দ্বিমত করলাম না।

লাল পান্ডা ও শুভ্র চিতার মুখোমুখি!

sinha14b

১৯৫৮ সালে এই পদ্মজ্যা নাইডু জুলজিক্যাল পার্কটি তৈরি করা হয়।পার্কটি সমুদ্র পৃসঠ থেকে ৭০০০ ফিট উপরে।এটি হচছে ভারতের সর্ব বৃহৎ হাই অলটিচিউড চিডিয়াখানা! প্রতি বছর এখানে প্রায় তিন লক্ষ দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন।সরোজীনি নাইডুর কন্যা পদ্মটা নাইডুর নামানুসারে এই চিডিয়াখানার নামকরন করা হয়।সবোজীনি নাইডু একজন কবি ও রাজনীতিবিদ।তিনি ছিলেন আগ্রা ও আউধের প্রথম গভর্নর।তিনি ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন। তার আরের নাম ছিল ‘Nightingale of India’!

জুলজিক্যাল পার্কে পা দিয়েই বুঝলাম-গাইডের কথা সত্যি। পাহাড়ী উপত্যকা, বিশাল বিশাল গাছ আর সবুজের পটভূমিতে চমৎকার এই পার্কের ল্যান্ডস্ক্যাপিং। প্রতিটি প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে যে যার মতো করে। ওদেরকে রাখা হয়নি খাঁচার ভেতরে। তবে যার যার জন্য বরাদ্দ রয়েছে নির্দিষ্ট জায়গা। ঐ জায়াগর চারপাশে দেয়া হয়েছে লোহার জালি দিয়ে সীমানা।

এরকমই এক সীমানার কাছাকাছি এনে গাইড আমাদের বললো- ‘এটা হচ্ছে রেন্ড পান্ডার এলাকা। রেড পান্ডাকে খুঁজে বের করো।’
আমরা সবাই তাকালাম সামনে, ডানে, বায়ে এবং উপরে। কোথাও কোন পান্ডার দেখা পেলাম না। মিনিট দুয়েক পরে একজন বিদেশী পর্যটক উত্তেজিত হয়ে বললেন- ‘দেয়ার হি ইজ!

সবাই ওর চোখ অনুসরণ করলাম। দেখলাম মাঝারি গোছের একটি গাছের মগডালে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঈষৎ লাল শরীরের আভাস। পান্ডার প্রিয় কাজের একটি হচ্ছে গাছের ডালে হেলান দিয়ে বসে থাকা। আস্তে আস্তে ওটা মগডাল থেকে নেমে আসলো, আর আমাদের অবাক করে দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটলো দ্বিতীয় পান্ডার! আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির দুটো প্রাণী খেলা করছে আমাদেরই চোখের সামনে। বিরল এক দৃশ্য!

এরপর আমরা দেখলাম হিমালয়ান ভল্লুক ও তিব্বতীয় নেকড়ে। সবশেষে আমরা এসে দাড়ালাম স্নো ল্যাপার্ড এর সীমানায়। কি সুন্দর! শান্ত, শ্বেত শুভ্র বেশ একটা ঋষি ঋষি ভাব! অথচ ক্ষিপ্রতা ও গতিতে এই চিতা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।

স্নো ল্যাপার্ডের প্রজাতিও বিলুপ্তির মুখে। গাইড জানালা এই চিড়িয়াখানায় স্নো ল্যাপার্ড এর আর্টিফিসিয়াল ব্রিডিং করা হয়। যা পৃথিবীর আর কোথাও করা হয় না। বিরল প্রজাতির দুটো প্রাণী দেখানোর জন্য আমি গাইডকে বললাম- ‘তোমাকে ধন্যবাদ’।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন