গত উইকেন্ডে ছিল আমাদের ২০১৮ এর শেষ ক্যাম্পিং। Turkey Point Provincial পার্কে দৈনন্দিন কাজ, সংসার এবং শহুরে সমস্ত ঝামেলা মুক্ত কিছু সুন্দর দিন পার করে আসলাম আমরা ৪ পরিবার মিলে। স্কারবোরো থেকে তারেক/সুলতানা, ইটোবিকো থেকে আমরা, ব্রান্টফোর্ড থেকে কবির/লাবনী এবং উইন্ডসর থেকে রোকন/সুমি পরিবার। শিশুসহ মোট সদস্য সংখ্যা ১২ জন।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো টরন্টো থেকে। ওদিকে সুমি/রোকন already ব্রান্টফোর্ড কবিরদের বাড়িতে এসে অবস্থান করতে থাকে। আমরা তাই ব্রান্টফোর্ডে লাঞ্চ সেরে সবাই মিলে রওয়ানা হলাম আমাদের গন্তব্য Turkey Point এর দিকে। ব্রানটফোর্ডের থেকে ক্যালিডোনিয়া হয়ে Norfollk কাউন্টির দিল্লী শহর হয়ে যেতে থাকলাম। এই ড্রাইভটি অত্তান্ত দৃশ্যময়। এইদিকের জমি উত্তরের মতো অতো পাহাড়ি বা বন্দুর নয়, কিছুটা ফ্লাট তাই এই এলাকায় ফসল বা সবজির চাষ ভালো হয়। তবে এখানকার, অর্থ্যাৎ দিল্লির আসে পাশের চাষিরা এখানে তামাকের চাষ করে বেশি, কারণ তাদের মতে তামাকের ফলন অন্য ফসলের তুলনায় এখানে খবু দ্রুত উঠে। এই জন্য এখানে রাস্তার দুপাশে জমির পর জমি দেখবেন সুসজ্জিত ভাবে তামাকের গাছ। কোনটি ছোট বা কোনটি বড় নয়, সব এক মাপের; দেখতে বেশ ভালোই লাগে।
যাহোক টেনশন বা স্ট্রেস-ফ্রি ড্রাইভ করতে করতে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। পার্ক গেটে রেজিস্ট্রেশন সারতে খুব বেশি দেরি হলো না কারণ আমাদের ক্যাম্পসাইট আগের থেকে রিজার্ভ করা ছিল। ওদিন অবশ্য ক্যাম্পসাইট ফুল হয়ে যায়। সাইটে ফিরে সবাই মিলে টেন্টগুলি সেট করে ফেললাম। তারপর চলে গেলাম পাশের বিচে সুইমিংয়ে। সুমিং শেষে ক্যাম্পে ফিরে শুরু হলো গ্রিল-চিকেন সুবলাকী বানানোর পালা। তারপর রাতের ডিনার শেষ হলো। ওদিকে কবির ক্যাম্পফায়ারের বেবস্থা করলো। এবার ক্যাম্পফায়ারের চারিদিকে বসে শুরু হলো আড্ডা। তবে এবারের আড্ডাটা ছিল শিক্ষণীয় এবং আমরা আড্ডার টপিক নির্ধারণ করতে দেই বাচ্চাদেরকে। I am so impressed ! ওরা এক এক করে অনেক ক্রিয়েটিভ কিছু করছিলো। যেমন তাৎক্ষণিক ধাঁদা তৈরী করে আমাদেরকে নাজেহাল করছিলো। আবার ওয়ার্ড গেম, দেশের বা শহরের নামের গেম ইত্যাদি। আমাদের চিন্তিত মুখ দেখে ওরা খুব মজা পাসছিলো। এর পর আমাদের ক্ষুদ্র এক সদস্যের আবেদনে আমরা গেলাম লেকের পারে চাঁদ দেখতে। ওখান থেকে এসে রাত ১১টার দিকে আমরা কেউ কেউ হাটতে গেলাম, বাদবাকি ঘুমাতে গেলো। শেষ হলো প্রথম দিন।
দ্বিতীয়দিন নাস্তা সেরে আমরা চলে গেলাম ৪০/৫০ কিঃমিঃ দূরে Port Burwell . এখানকার মূল উদ্দেশ্য ছিল (কানাডিয়ান) একটি Cold War (decommissioned) সাবমেরিন পরিদর্শন করা। ওজিবুয়া নামক সাবমেরিনটি পুরা Cold War পিরোডে স্পায়িং এর কাজে বেবহার হয়। এটির দীর্ঘ অপারেশন জীবনে কোনোদিন শত্রূ পক্ষের কাছে ধরা পড়ে নি। এটি কানাডার একটি গর্ব। আমি এবং আমার সঙ্গীরা কেউই জেমস বন্ড বা অন্য মুভি ছাড়া বাস্তবে সাবমেরিন দেখে নি বা এর ভিতরেও যাই নাই, তাই বিষয়টি বেশ এক্সসাইটিং ছিল। আমরা সবাই মিলে একটি গাইডেড টুরে গেলাম। গাইড লিওন আমাদেরকে ধাপে ধাপে এই বিশাল সাবমেরিনের ভিতরের জিনিসপত্র বর্ণনা করছিলেন। আসলেই অবাক কান্ড পানির নিচে এই ধরণের একটি জটিল মেশিনে মাসের পর মাস থাকে। ওরা কোথায় ঘুমায়, কোথায় রান্না করে, কোথায় গোসল করে, কোথায় টয়লেট করে, অসুখ হলে কি করে ইত্যাদি বিষয় জানা হলো। আর মজার বিষয় হলো বাচ্চারা খুব আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করছিলো। ওগুলি দেখে কানাডিয়ান মেরিনারদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো। যদি কেউ না দেখে থাকেন, আমি মনে করি তাদের জন্য এটি একটি সুন্দর শিক্ষণীয় বিষয়। পুরা ভিতরটা টুর করতে এক ঘন্টার মতো সময় লাগলো।
যাহোক ট্যুর শেষে পাশের গাছের ছায়ায় বসে চিকেন উইংস, BBQ চিকেন দিয়ে লাইট লাঞ্চ সারা হলো। এর পরে ক্যাম্পে ফিরে চেঞ্জ করে আবার সুইমিংয়ে। গোসল সেরে ক্যাম্পে ফিরে ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন, সালাদ, সবজি এবং কবিরদের বাগানের কাঁচা মরিচ দিয়ে দিয়ে সবাই মিলে মজা করে খেলাম। খাওয়া শেষে যথারীতি কবির এবং তারেক ক্যাম্পফায়ার শুরু করলো। আবারো সবাই চারিদিকে বসে আড্ডা। বাচ্চারা কালকের মতো আজকেও গেম খেলতে চাইলো। এক পর্যায়ে তাদের গেমের টপিক চেঞ্জ হলো, তারপর আমাদেরকে বললো। তখন আমরা সবাইকে জিগ্যেস করলাম বিগত দুদিনে এখানে প্রত্যেকের দুটি ভালো লাগার জিনিস বলার জন্য। শুরু হলো।
গড়ে; ফুড, সুইমিং, টেন্টে ঘুমানো, সাবমেরিন ট্যুর এবং পরিবারের সবাই ও অন্য সবাইসহ একসাথে চিন্তামুক্ত সময়কাটানোকে প্রাধান্য দিলো। এভাবে চললো ছেলেমেয়েদের মা-বাবাদের সমন্ধে দুটি ভালো জিনিস বলা, আবার বাবা মাকেও ছেলেমেয়েদের সমন্ধে দুটি কথা বলা। বিষয়টি খুব ইন্টারেস্টিং হলো, বেরিয়ে আসলো অনেক সুন্দর কিছু কথা বার্তা। আজকেও কেউ কেউ রাতের হাটা হাটঁতে গেলো, বাকিরা ঘুমাতে গেলো। সবার ঘুম খুব ভালো হলো।
পরদিন সকালে BBQ বার্গার দিয়ে একটি হেভি নাস্তা হলো কারণ দিনে অনেক এক্টিভিটিস। সবাই মিলে নাস্তা সেরে চলে গেলাম পার্শবর্তী Deer Creek Conservation পার্কে ক্যানুইয়ং করতে। ওখানে সবাই মিলে ক্যানুইয়ং হলো, ছোট খাটো একটি রেস্ হলো, ছবি তোলা হলো, তারপর গরম এবং humidity দূর করতে ice cream খেয়ে সবাই চলে গেলাম পার্শবর্তী Long Point প্রভিন্সিয়াল পার্কার বিচে। sunny এবং warm weather এর কারণে বিচে অনেক লোক দেখা গেলো এবং সবার গোসল করে ভালো লাগলো। গোসল এবং সুইমিং শেষে লাঞ্চ করা হলো লেকের পড়েই। এর পর আবার ক্যাম্পে ফিরে আমাদের এক পার্টিকে বিদায় দিয়ে আমরা চলে গেলাম লেকে। একটি বড়ো পন্টুন বোট ভাড়া করে চলে গেলাম লেকের মধ্যে। আমি পর্যায়ক্রমে ছোট বড়ো সবার একটু করে বোট চালনার হাতে খড়ি দিলাম কারণ এই বোট চালানো খুব সোজা। এদিকে আমাদের বোন বা ভাবিরা বোটের মধ্যেই কফি/নাস্তার আওয়জন করলো।
বেশ কিছুক্ষন লেকের ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরে ফিরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ফিরে এলাম তীরে। এই সন্ধ্যায় গ্রামের রাস্তা ধরে চলে গেলাম দিল্লি শহরে গরম গরম পিজ্জা দিয়ে ডিনার করতে। যাওয়ার পথের ডুবে যাওয়া সূর্যের অভূতপূর্ব দৃশ দেখতে দেখতে চলে গেলাম দিল্লি। সবাই মিলে মজা করে পিজ্জা খেয়ে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আজকেও কবির যথারীতি ক্যাম্পফায়ার করলো। বাচ্চারা সাধারণত আমাদের কাছাকাছি না থাকতে চাইলেও এই ক্ষেত্রে ওরা খুবই সহযোগিতা করছিলো এবং মজাও পাসছিলো। বাচ্চারা সবাই আরো বেশি দিন থাকতে চাসছিলো এবং এই ৩ দিনে ওরা কেউ ভুলেও কার্টুন, ট্যাবলেট বা স্মার্ট ফোনের কথা বলে নি।
ওরা সবাই একে অপরকে সহায়তা করেছে। যাহোক আজকের রাতে ক্যাম্পফায়ারের মূল বিষয় ছিল প্রতিটি husband তার wife এর সমন্ধে এবং প্রতিটি wife তার husband সম্মন্ধে ভালো দুটি কথা বলা। সব শেষে বলা হলো প্রত্যেকে তার নিজের দুইটি দক্ষতার কথা বলতে। Amazingly এক্ষেত্রে বাচ্চারা খুব সুন্দর উত্তর দিলো যাকিনা আমি অনেক সময় আমাদের অ্যাডাল্ট চাকরি প্রাথীদের থেকে পাই না। এভাবে সম্মিলিত আড্ডার মদ্ধ দিয়ে শেষ রাতের ক্যাম্পফায়ার শেষ হলো।
পরদিন আমরা আমাদের ক্ষনিকের ঘরবাড়ি ভেঙে চলে গেলাম পার্শবর্তী ছোট শহর Port Rowanএ। ওখানে কিছুক্ষন ঘোরাফেরা করে চলে গেলাম Long Point Bird Observetory তে। সেখানে bird watch এবং কিছুক্ষন হাইকিং এর পরে রওয়ানা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে কবির এবং লাবনী নিয়ে গেলো একটি সবজি আর ফলের ফার্মে। সদ্য ক্ষেত থেকে তোলা তরমুজ, চিম, ছোট আলু, গ্রীন পেপার, ভুট্টা, টোম্যাটো, পিচ ফল, শশা ইত্যাদি সব কিছু কিনে চলে গেলাম ব্রান্টফোর্ড সি ফুড রেস্টুরেন্টে। লাবনী/কবির কন্যা, আম্মিজান মিস কারিদা আমাদেরকে ফিশ এন্ড চিপস দিয়ে আপ্পায়ন করলো। এর পর বিদায়ের পালা। অত্তান্ত দুঃখের সাথে মিস কারিদার বাড়িতে আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে চলে আসলাম চির চেনা সেই কংক্রিটের শহরে, যেখানে না চাইলেও থাকতে হয় পেটের তাগিদে। তবে আল্লাহ্তালাকে অশেষ ধন্যবাদ আমাদেরকে গত উইকএন্ডের ওই শান্তিপূর্ণ ৩টি দিন উপহারের জন্য।
আমরা ধন্যবাদ জানাই সুমি/রোকন পরিবারকে। তারা বলতে গেলে সবাই একটু অসুস্থ ছিল, তারপরেও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন এবং প্রতিটি ইভেন্ট উপভোগ করেছেন। তাদের ছোট মেয়েটি রাহার ক্রিয়েটিভ riddle তৈরী আমাকে অনেক মুগ্ধ করেছে। আমি নিম্নের সাবমেরিন সংক্রান্ত ভিডিওতে ভুল করে cold war বলতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে ফেলেছি, সে জন্য ক্ষমাপ্রাথী।
ইদানিং দেখা যায় আমাদের বাংলাদেশী ইম্মিগ্রান্টরা প্রায়ই বেরিয়ে যান কিছুটা অবসর সময় কাটাতে, লক্ষণটি ভালো। সময় সুযোগ করে আমাদের সকলেরই কিছুদিন বাইরে থেকে, বিশেষ করে প্রকৃতির মাঝে ঘুরে আশা উচিত। সেটা ক্যাম্পিং হোক, কটেজিং হোক বা কেবিনে থাকা হোক; যেটা যার পছন্দ বা আওতার মধ্যে। এতে করে মন ঝর ঝরে হয়ে উঠেবে এবং আগত শীতের জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নিতে পারবেন।
সবাই ভালো থাকুন।
বি. মুকুল