[ফুজিরাহ শহর]
বিস্তৃর্ন এলাকা জুড়ে লাল বালি আর উচুনিচু রাস্তার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে মন। জলশূন্য দিগন্ত জোড়া মরুভূমির মরীচিকা। উচু নিচু পথ বেয়ে ছুটে চলছি। গন্তব্য যেন গহিন পাহাড়ের অন্তরালে। কোথায়ও মরুভূমির বুক চিরে ,কোথায়ও পাহাড় কেটে, আবার কোথায়ও সমুদ্রের গা ধরে, সে এক অনুপম রাস্তা। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি পাহাড় মানুষের মনকে উঁচু করে , সাগর মনকে করে বড় আর ধু-ধু মরুভুমি ? জানি না দুবাই থেকে শারজাহ হয়ে আমাদের গন্তব্য -> কালবা ->ফুজিরাহ-> খোর ফাক্কান -> দিব্বা -> মাসাফি।

 

[শারজাহ থেকে যাওয়ার রাস্তার দৃশ্য]

 

 

 

 

 

মরুভূমির তপ্ত বালুতে উটেরা দল বেঁধে ছুটে চলছে। নীলাকাশে ঝকঝকে রোদে দূরে আকাশচুম্বী পাহাড়ের মধ্যে ছবির মতো সাজানো রাস্তাঘাট।পাহাড়ের বুক চিরে উঁচু-নিচু এঁকে-বেঁকে রাস্তা কেটে তৈরি করা হয়েছে শারজাহ-কালবা মহাসড়ক। চারদিকে পাহাড় , সেখানে নেই সবুজের সমারোহ আছে পাথরের পর পাথর দিয়ে সাজানো পাহাড় আর সমতলে ধু-ধু মরুভূমি। গাড়ি ছুটে চলার আওয়াজ ছাড়া চারিদিক নিরব-নিঃস্তব্দ ৷ রাস্তার দু’পাশে গাছপালা নেই বললেই চলে। মহাসড়কের পাশে দৃষ্টিনন্দন বিশাল বিশাল পাথরের পাহাড়গুলো ঐতিহ্যময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

[পাহাড়ের মধ্যে উঁচু-নিচু একে-বেঁকে চলা রাস্তা ]

পাভেল ভাইয়ের কথা বলার দক্ষতা অসাধারণ। যেকোনো বিষয় অনেক সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারেন।ভাইয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। আমরা এখন যাচ্ছি ভুতের সুড়ঙ্গ দেখতে। টানেলের সম্মুখ ভাগে (গাড়ির স্টপেজ) জিন-ভুতের একটা মিথ চালু আছে । দাড়িয়ে থাকলে মনে হবে আপনাকে কেউ টেনে ধরছে। কোথায় ও কেউ নাই কিন্তু মনে হবে জিন-ভূত আপনাকে নিচের দিকে টানছে। অন্যরকম রোমাঞ্চকর ভয়জাগানিয়া অনুভূতি। প্রথমে পাভেল ভাইয়ের কাছ শোনার পর ততটা রোমাঞ্চকর মনে হয় নি কিন্তু গাড়ি থেকে নামার পর মনে হলো এইবুঝি ভূত টেনে ধরছে। জায়গাটা ততটা ঢালু না তারপরও নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যালেন্স রাখাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের তিনজনের একই অবস্থা। বৈজ্ঞানিক ভাবে এটাকে বলে গ্রাভিটি হিল বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড। নতুন অভিজ্ঞতা নিতে পেড়ে বেশ আনন্দিত।

দুপাশে বিশাল পাহাড় আর ভিতর দিয়ে আধা কিলোমিটার ব্যাপী সুড়ঙ্গ পথ। সুড়ঙ্গের ভিতরে আছে সোডিয়াম বাতি , এসি এবং সতেজ বায়ু নির্গমনের ব্যবস্থা। সুড়ঙ্গে প্রবেশের পর মনে হলো গাড়ি শুধু ঢালু পথে নিচের দিকেই নামছে। গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে অপর পাশের রাস্তায় পৌছালাম।

[ম্যাগনেটিক ফিল্ডে দাঁড়িয়ে আবির আর পাভেল ভাই ]                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

[উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি ]

সামনে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি । দিগন্তের নীল ছুঁয়ে মেঘবালিকারা চুমু দিয়ে যায় পাহাড় চূড়ায়। প্রকৃতির এসব মায়াবী পাহাড় আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে আমরা পৌঁছলাম কালবা শহরে। প্রাকৃতিকভাবে মনোমুখদ্ধকর শহরের বুকে ধারণ করে আছে নান্দনিক সাগরসৈকত। যেখানে পাহাড় যেন স্নান করতে নেমেছে সাগরে।নীলাভ আকাশটা যত সুন্দর, তার চেয়ে বেশি সুন্দর তার বিশালতা। সুনীল সমুদ্রটা যত সুন্দর, তার চেয়ে বেশি সুন্দর তার বয়ে নেওয়া ঢেউ । আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল এখানে মিলেমিশে একাকার। ঝিকিমিকি সূর্যের আলো আর তিনিঝিনি মুক্ত ও সতেজ বাতাসের পালকিতে দুলে চলছি। পাহাড় আর নীল আকাশের মিতালী সাথে মৃদু মন্দ বাতাস আর ছন্দময় ঢেউ দেখতে হলে আপনাকে এখানে আসতেই হবে।

[আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল মিলেমিশে একাকার ]

কালবা থেকে আমাদের গন্তব্য ফুজাইরাহ । এটি আরব আমিরাতের একটি প্রদেশ । শহরের চারপাশের নান্দনিক স্থাপত্য নয়নাবিরাম সবুজের সমারোহ চোখে পড়ার মতো। ফুজিরাহ শহরে একটু ঘুরে চলে আসলাম খোর ফাক্কান সমূদ্র বীচে। সুউচ্চ পাহাড় গুলোর কোল ঘেসে বিশাল সমুদ্রের কল্লোলিত তরঙ্গ সংকুল, গর্জন করে ধেয়ে আসা সাগরের ঢেউয়ের সাথে পাথরের লুকোচুরি খেলায় নান্দনিক সৈকতে পরিণত হয়েছে “খোর ফাক্কান”। আকাশ ছুঁয়েছে সাগরকে, মেঘ ছুঁয়েছে পাহাড় আর পাহাড় নেমেছে সাগরে। বিস্তৃত উঁচু পাহাড়। মেলেছে দু হাত প্রকৃতির আধার। সাগরের গর্জন আর মিষ্টি শীতল হাওয়া মনে দোলা দিয়ে যায়।

[খোর ফাক্কান বিচের ফুটপাথ]

[আকাশের রং চুরি হয়েছে যেখানে]

 

সাগর সদা গতিচঞ্চল প্রতীক পৃথিবীর ।
সইতে জানে, বইতে জানে সারা জগৎময়,
সমুদ্র তাই ঐক্যবদ্ধ, পাহাড় ততো নয় ।
***(ঐক্যবদ্ধ জল – নির্মলেন্দু গুণ )***

অনিন্দ্য সুন্দর কবিতায় সাগর যতটা সুন্দর, বাস্তবে বোধহয় তার চেয়েও বেশি সুন্দর।

গাড়ী ছুটে যাচ্ছে দিব্বা-মাসাফি অভিমুখে। পেছনে সাগরের নীল রঙের অথৈ পানি। দিব্বা এবং মাসাফি হচ্ছে ফুজাইরাহ’র দুইটা ছোট উপশহর। মাসাফি তে আছে জুম্মা মার্কেট। কার্পেট , মাটির তৈরি জিনিসপত্রের জন্য বেশ বিখ্যাত।

[জুম্মা মার্কেটে রাস্তার পাশে ফলের দোকান ]

মরুভুমি,সাগর আর পাহাড়ের রাজ্য সারাদিন আনন্দময় সময় কাটিয়ে ক্লান্তিভরা চোখের মাঝে হাজারও সুখস্মৃতি নিয়ে এবার দুবাই ফেরার পালা। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফেলে চলেছি একের পর এক পথের মায়া , পাহাড়ের পর পাহাড় আর ধু-ধু মরু বালির চর…………

ছবি কৃতজ্ঞতা: আবির এবং কিছু ব্লগ থেকে ।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন