পরদিন ১১ই মার্চ আমরা সাওপাওলো থেকে ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী রিও ডি জেনেরিও (RIO DE JENEIRO) যাত্রা করলাম বাস যোগে। সাও পাওলো থেকে রিও ডি জেনেরিও’র দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। ব্রাজিলের এ প্রধান দুটি মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক উন্নত। আমরা আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলাম যে সাওপাওলো থেকে রিও ডি জেনেরিও বাসে যাবো। যাতে করে বিভিন্ন শহর বন্দর ও ব্রাজিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পারি। আমরা হোটেল থেকে উবের ট্যাক্সি যোগে সাওপাওলো কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পৌঁছলাম বেলা ১০টায়। সাও পাওলো সেন্ট্রাল বাস টার্মিনালটি বিশাল । এখন থেকে বাস যোগে ব্রাজিলের প্রধান প্রধান শহরগুলি ছাড়াও পার্শবর্তী দেশ আর্জেন্টিনা ,উরুগুয়ে ,প্যারাগুয়ে ,চিলি ,পেরু যাতায়াত করা যায়। আর্জেন্টিনা যেতে ১০/১১ ঘন্টা, উরুগুয়ে যেতে  ১২ ঘন্টা, প্যারাগুয়ে যেতে ১৩ ঘন্টা ও পেরু যেতে ১৬/১৭ ঘন্টা সময় লাগে বলে জানতে পারলাম। বেলা সাড়ে ১১টায় আমাদের বাস ছাড়লো রিও ডি জেনেরিও’র উদ্দেশ্যে।

এখানে ব্রাজিলের রাস্তায় চলাচলকারী বাসের বর্ণনা না দিলেই নয়। ব্রাজিলের বাসগুলি সুপ্রশস্ত ও অত্যাধুনিক। লোকাল ও দূরপাল্লার সকল বাসেই ফ্রী WIFI , এয়ার কন্ডিশন ও টয়লেট রয়েছে। বাসের ফ্রীজে ঠান্ডা পানির বোতল যা যাত্রীদের জন্য ফ্রি। আমার ভ্রমণসঙ্গীরা সবাই একমত যে কানাডা বা আমেরিকার দূরপাল্লার বাসগুলিও ব্রাজিলের কোনো বাসের  সমতুল্য নয়। সাওপাওলোতে দেখেছি  লোকাল বাসগুলি কানাডার গ্রে হাউন্ড বাসের থেকেও উন্নত। সাওপাওলো-রিও হাইওয়ের দু’পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও শহর দেখতে দেখতে চলেছি আর ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরা বা সেল ফোন দিয়ে ছবি তুলছি। পথে যেতে যেতে ভাবছি  ব্রাজিল এতো সবুজ  ও সুন্দর দেশ !! আমি আসার আগে ব্রাজিল সম্পর্কে যা জেনেছি বাস্তবে তার থেকে ব্রাজিল অনেক সুন্দর। রিনালদো বলল, রিও গেলে তোমার ধারণা আরো পরিবর্তিত হবে। অবশ্য ইতোমধ্যে গত তিন দিনে আমরা যতটুকু দেখেছি ও জেনেছি তাতে সেই রকমই মনে হচ্ছে। আধাআধি পথ পাড়ি দেয়ার পরে ড্রাইভার একটি ‘ধাবা’ বা হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট’এ  গাড়ি থামালো দুপুরের খাবারের জন্য।  এখানেও ‘সেলফ সার্ভিস বুফে’ রয়েছে। এখানকার বুফেতে খাবার প্রতি কেজি ৩৮ রিয়াল। হরেক রকম খাবারের মধ্যে থেকে আমি কয়েক প্রকার সবজি, চিকেন ও পুডিং দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।

বাসে উঠে হালকা রেস্ট নিতে যেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। আমার ঘুমন্ত অবস্থার ছবি তুলে সহযাত্রী বন্ধু রিনালদো ও মার্গারেট আমার ‘হোয়াটস আপ ‘ ইনবক্স এ পাঠিয়ে দিয়ে হাসাহাসি করছিলো। চট করে ঘুম থেকে উঠলেই তারা বললো, তোমার হোয়াটস আপ টেক্সট চেক করো। আমি আমার ঘুমন্ত অবস্থার ছবি দেখে বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। তারা বলল ,আমরা এ ছবি ফেসবুকে পোস্ট করবো। আমি কাতরস্বরে নিষেধ করলাম এ অপকর্মটি না করার জন্য। পরে অবশ্য ছবিটি তারা ডিলিট করে আমাকে আশস্ত করেছিল।

সন্ধ্যা সাতটার সময় বাস রিও রিও ডি জেনেরিও বাস টার্মিনালে থামলো। রাস্তায় একটি এক্সিডেন্টের কারণে আমাদের একঘন্টা বেশি সময় লেগেছে। আমরা উবের ট্যাক্সি করে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া করা এপার্টমেন্টে এসে উঠলাম। এপার্টমেন্টটি রিও’র বৃহত্তম “কাপাকবানা বিচ “(COPACABANA) সংলগ্ন।

এপার্টমেন্টটি আমাদের ছয় জনের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। এটি ফুল ফার্নিশড, চারটি কক্ষ ও লন্ড্রির সুবিধাসহ তিনটি বাথরুম আছে । ফ্রীজ খুলে দেখলাম বিভিন্ন ধরণের ফলমূল ,দুধ ,জুস ,চিজ ,বাটার সহ প্রচুর খাবার। রিনালদো বললো এটা নাকি এক ধরণের ব্রাজিলিয়ান আতিথেয়তা। যে পরিমান খাবার আছে তাতে অন্তত দুদিন ব্রেক ফাস্ট হয়ে যাবে। কিচেনটি আধুনিক ও পরিষ্কার পরিছন্ন। কেউ ইচ্ছা করলে এখানে তিন বেলাই রান্না করে খেতে পারবেন।  এপার্টমেন্টে লাগেজপত্র রেখে যে যার পছন্দ মতো কক্ষ বেছে নিলাম।  আমি ও রিনালদো  বিচ এর দিকে জানালা আছে এমন একটি কক্ষ পেলাম।

ডিনারের জন্য আমরা রাত আটটার একটু পরে বাহিরে আসলাম। হোটেল থেকে মাত্র তিনশো গজের মধ্যেই বিচ। আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্ত শেষ হয়েছে রিও’র এই কাপাকবানা বিচে এসে। বিচ এলাকায় দুদিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য ! অসংখ্য হোটেল রেস্টুরেন্ট, কাফে ,স্ট্রিট ফুডের গাড়ি, হকার ও সুভেনির শপ। আমরা কাছাকাছি একটি রেস্টুরেন্ট’এ ঢুকে খাবার অর্ডার দিলাম। আশেপাশের টেবিলে বিভিন্ন ধরণের খাদ্য খাবারের সমারোহ দেখলাম। তবে সী  ফুড জাতীয় খাবার ও ব্রাজিলের বিখ্যাত বিভিন্ন ধরণের জুস্ ,ফলের রস ও কোকোনাট বা ডাব উল্লেখযোগ্য । আমরা দু’ প্লেট কয়েক রকম সী ফুড ,চিকেন ,বীফ, সসেজ ও সালাদ অর্ডার দিলাম। তিনজনের জন্য একপ্লেট বলা হলেও খাবারের যে পরিমান তাতে একপ্লেট চার জনের জন্য যথেষ্ট। এখানে উল্লেখ্য ,প্রত্যেক হোটেল রেস্টুরেন্ট, সেলফ সার্ভিস বুফে সব জায়গায় ভাত পাওয়া যায়। এছাড়া সবখানে ডাব পাওয়া যায়। ডাবের পানি ব্রাজিলিয়ানদের একটি জনপ্রিয় পানীয়।

ক্যাপকবানা বিচের একটি রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি আমি ,রিনালদো. মার্গারেট ও এস্থের রাতের খাবারের পরে বিচের খোলা হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে আটলান্টিকের পানির স্পর্শ নিলাম। ইতোপূর্বে আমি কখনো আটলান্টিকের পানির সংস্পর্শে আসি নাই। এ কথাটা মনে আসতে শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করলাম। রাত ১১টায়ও দেখলাম বিচে লোকজনের কোনো কমতি নাই। আমরা বিচের খোলা প্রান্তরে একটি বেঞ্চে কিছুক্ষন বসে সমুদ্রের গর্জন ও বিশুদ্ধ বাতাস উপভোগ করলাম। রাত  বারোটায় এপার্টমেন্টে ফিরলাম রাতের ঘুম দেবার জন্য।

পরদিন অর্থাৎ ১২ মার্চ থেকে আমাদের রিও ডি জেনেরিও’র দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখা শুরু করলাম।  প্রথমে ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি রিনালদো ও এস্থের আটলান্টিকের পাড়ে সূর্যোদয় দেখতে গেলাম।  সে এক অপূর্ব দৃশ্য !! সূর্য জেনো মহাসাগরের বিশাল জলরাশি ভেদ করে ধীর গতিতে উপরে উঠে আসছে। সেইসাথে ধীরে ধীরে বাড়ছে তার আলো-তাপের সমারোহ। যারা ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারেন রিও ভ্রমণে গেলে তারা অবশ্যই এ দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ পাবেন।

বিচ থেকে একটু হেঁটে শহরের দিকে গেলাম। উদ্দেশ্য কফি পান করা । রিও শহরের এ বিচ এলাকা আমার কাছে অনেকটা কোলকাতা শহরের নিউমার্কেটের মতোই মনে হলো। রাস্তার দুপাশে শুধু হোটেল,এপার্টমেন্ট ও হরেকরকম রেস্টুরেন্ট। যার সবগুলিই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টুরিস্টদের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে । আমরা রাস্তার পাশে একটি ছোট রেস্টুরেন্টে ঢুকে কফি অর্ডার দিলাম। এখানে উল্লেখ্য, ব্রাজিলে বিভিন্ন ধরণের কফি পাওয়া যায়। স্বাদও  ভিন্নধর্মী। দেখলাম একপ্রকার প্লাস্টিক ‘ওয়ান টাইম ইউস’ কাপে অনেকে কফি পান করছে। আমি রিনালদোকে বললাম , ঐ কফির অর্ডার দিতে। এটি আসলে স্প্রেসো জাতীয় কফি। স্বাদ অত্যান্ত কড়া। চার পাঁচ চুমুকে এক কাপ কফি শেষ হয়ে যায়।  তবে সারাদিনই কফি পানের আমেজ থেকে যায়। কফি পান সেরে আমাদের এপার্টমেন্টে এসে রিও ডি জেনেরিও পরিদর্শনের পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা সকলে  বাহির হলাম।

রিও ডি জেনেরিও দর্শনের আগে এ শহরটি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। বাংলাদেশে থাকাকালীন প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং পরবর্তীতে কানাডায় এসেও আশেপাশের দেশগুলি দেখার সুযোগ হয়েছে। দেশে চাকুরীকালীন সময়ে গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর বন্দরও দেখার সুযোগ হয়েছে। তবে এই প্রথম দক্ষিণ আমেরিকায় অর্থাৎ ব্রাজিলের এই মনোরম সৌন্দর্যের অপূর্ব সমাহার “RIO ” না দেখলে মনে হয় জীবনের অনেক কিছুই দেখতে বাকি থেকে যেতো। রিও ডি জেনেরিও কে সংক্ষেপে ‘রিও’ (RIO) বলা হয়।  রিও ডি জেনেরিও ব্রাজিলের প্রাক্তন রাজধানী। বর্তমানে রিও ডি জেনেরিও স্টেটের রাজধানী ও ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল নগরী।

সুগার লুপ পর্বতের চূড়া থেকে রিও শহরের একাংশ, রিও, ব্রাজিল

‘রিও’  শহরটি আমার দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের অপূর্ব সমন্বয়। রিও ভ্রমণ করে অনেকেই একথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন । আমি ভালো কোনো ভাষা বিশারদ বা সাহিত্যিক নই ,তাই রিও সম্পর্কে ভালো করে হয়তো বলতেও পারবো  না। শুধু এটুকুই বলতে পারি যে ,আমার জীবনে আমি যত পর্যটন নগরী বা শহর বন্দর দেখছি তার মধ্যে রিও কে আমার সর্বশ্রেষ্ট মনে হয়েছে। ২০১২ সালে UNESCO ‘ রিও ‘ কে “WORLD HERITAGE SITE” হিসেবে ঘোষণা করে। তিনদিকে পাহাড়-পর্বত , একদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের মনোমুগ্ধকর বিচ ও লেগুনা সমূহ শহরটিকে সৌন্দর্যের আধারে পরিণত করেছে। সেইসাথে সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট উপলক্ষে শহরটিতে নির্মাণ করা হয়েছে নুতন নুতন রাস্তা ঘাট ,অত্যাধুনিক হোটেল,রেস্টুরেন্ট ও অন্যনো স্থাপনা। রিও শহরের তিনদিকে আছে প্রায় আশি কিলোমিটার বিচ এলাকা। রিও’র আটলান্টিক মহাসাগরের পাড় ঘেঁষে বিশ্বের দীর্ঘতম বিচ COPACABANA ,IPANEMA ও LEBLON এর অবস্থান। শহরের অন্যতম আর এক আকর্ষণ তিজুকা (TIJUCA) ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে কর্কোভাদো CORCOVADO) পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থিত ৩৮ মিটার (১২৫ফুট) দীর্ঘ যীশু খ্রীষ্টের মূর্তি। ‘SHUGARLOOF AND URCA’ পর্বতের মধ্যে স্থাপিত ক্যাবল কার ভ্রমণকারীদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ। । এছাড়াও ছোট বড় পাহাড় পর্বতের ফাঁকে ফাঁকে মনোমুগ্ধকর সব প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপনার সমাহার। প্রতি বছর বিশ্বের ২.৮২ মিলিয়ন পর্যটক ‘রিও’ ভ্রমণ করেন।

রিও ভ্রমণ করে অনেক পর্যটক/টুরিস্ট  বলে থাকেন ” I LOVE RIO ” রিও সম্পর্কে এ কথাটি যারা ব্রাজিল ভ্রমণ করেছেন তাদের সবার কাছেই পরিচিত। রিও’র  বিভিন্ন বিচ, রিসোর্ট ,ব্যাবসা কেন্দ্র বা এন্টিকস / স্যুভেনির শপ, হোটেল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি সব জায়গায় এ জনপ্রিয়টি বাক্য লেখা আছে। এসব জায়গা থেকে কোনো কিছু কিনলেও তাতে বিভিন্ন স্টাইলে লেখা থাকে ” I LOVE RIO ” I পাঁচ দিনের  রিও ভ্রমণ শেষে আমিও সবার সাথে তাল মিলিয়ে  বলেছি ‘ I LOVE RIO ‘ I

রিও ভ্রমণের  প্রথম দিনে আমরা কোপাকাবানা বিচ ,প্রাচীন নেভাল বেইজ ও ডাউনটাউনের কিছু কিছু এলাকা পরিদর্শনের প্ল্যান করেছিলাম। সেমোতাবেক সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমরা কোপাকাবানা বিচ এলাকা দেখতে বাহির হলাম। এটি পৃথিবীর অন্যান্য বিচের মতো হলেও এর বিশালতা বা ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্য। আমি জানিনা এতো বড় বিচ বিশ্বে আর আছে কিনা। কোপাকাবানা বিচ রিও শহরের পূর্ব প্রান্তে প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ। আটলান্টিকের বিশাল জলরাশি প্রতিমুহূর্তে এসে বিচের বালুরাশি ধুয়ে মুছে দিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে হাজার হাজার মানুষ পানিতে নেমে আনন্দ উল্লাসে ব্যাস্ত। আমি কোনো বিচে এতো মানুষ একসাথে দেখি নাই। আমাদের কয়েকজন বিচে নেমে জলকেলিতে মেতে উঠেছে ইতোমধ্যেই। আমি, রিনালদো ও এস্থের পানিতে না নেমে বিচের সমান্তরালে তৈরি বিশাল আটলান্টিকে এভিনিউ’তে হাঁটতে হাঁটতে বিচের একপ্রান্তে চলে গেলাম। রাস্তার কয়েকগজ ব্যবধানে ঝাউ গাছ ও নারকেল গাছের নিচে ছায়ার মধ্যে বসার জন্য চেয়ার টেবিল সেট করা আছে। কিছু দূর পর পর  তৈরি করা হয়েছে ওয়াশরুম ও টয়লেট।  রাস্তার বিশাল ফুটপাথ  জুড়ে  বিভিন্ন শুভ্যেনুর শপ,ফাস্ট ফুড ও কাফে-রেস্টুরেন্ট। সব কিছু আমার মনে হলো পরিকল্পনা মাফিক তৈরি করা হয়েছে। বিচে বেড়ানোর সময় মানুষের যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই এখানে আছে। হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত হয়ে আমরা একটি ফাস্টফুড শপ থেকে ডাবের পানি পান করে আমাদের সহযাত্রীদের খুঁজে বের করলাম। সকলে একত্রে আমরা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুপুরের খাবার খেলাম। প্রচুর পরিমানে সী ফুড, ব্রাজিলের সুবিখ্যাত ব্রয়লার চিকেন লেগ  ফ্রাই ,সালাদ ও প্রত্যেকের পছন্দ মতো জুস্/ডাবের পানি দিয়ে আমরা তৃপ্তি সহকারে দুপুরের খাবার খেলাম। হাঁটাহাঁটি ও জলকেলিতে সবাই  ক্লান্ত ,পরনের পোশাকও ভিজে। এ ছাড়া গরমও প্রচন্ড। তাই একটু আগেভাগেই এপার্টমেন্টে যেয়ে পোশাক পরিবর্তন করে একটু বেশ কিছুক্ষন রেস্ট করে নিলাম।

কোপাকাবানা বিচ ,রিও ডি জেনেরিও ,ব্রাজিল

বিকালে শহরের অন্য প্রান্তে ডাউনটাউন ও নেভাল বেইজ পরিদর্শনের জন্য বাহির হলাম। যাতায়াতের জন্য আমরা পায়ে হেঁটেছি ও সাবওয়ে ব্যবহার করেছি। তিনদিকে বড় বড় বিচ থাকলেও রিও একটি পার্বত্য শহর। শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে প্রচুর টানেল। এর কোনো কোনটি প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ। সাবওয়ে  দিয়ে যাতায়াত করতে যেয়ে লক্ষ্য করলাম রিও সাবওয়ে ব্যাবস্থাপনা সাও পাওলো থেকেও উন্নত। ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্টের সময় সাবওয়ের আরো সংস্কার করা হয়েছে।

রিও ডাউনটাউন বিশ্বের অন্য সব শহরের মতোই। ব্যাস্ততম এভিনিউ বা রোডের পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মল ,দোকানপাট ও বাবসাকেন্দ্র। আমরা হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন মল  ও শুভ্যেনুর শপে ঢু মারলাম। মহিলারা তাদের স্বভাব মতোই বিভিন্ন দোকানে যেয়ে দর দাম জিজ্ঞাসা করলো। যদিও কিনলো সামান্যই। ডাউনটাউন থেকে আমরা হেঁটে নেভাল বেইজ সংলগ্ন সেন্ট্রাল ক্যাথেড্রাল দেখতে গেলাম। এটি একটি প্রাচীন স্থাপনা। ১৫৫২ সালে পর্তুগিজ শাসনামলে তৈরি।  ক্যাথেড্রাল দেখে আমরা রিও’র ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নেভাল বেইজ দেখতে গেলাম। এটিও পর্তুগিজ আমলের স্থাপনা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আটলান্টিকের পাড়ে এটি নির্মান করা হয় বহিঃ শত্রূর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য। সে আমলে ব্যবহৃত সব অস্ত্র শস্ত্র এখনো রাখা আছে। নেভাল বেইজটি তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। নেভাল বেইজ ও জাদুঘর এলাকার চারিদিকে সুন্দর সাজানো গোছানো পার্ক। জাদুঘর ও সংলগ্ন এলাকা বিকাল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। আমরা এখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে আমাদের এপার্টমেন্টে ফিরলাম রাত আটটার দিকে। সারাদিন ঘুরাঘুরিতে ক্লান্ত-শ্রান্ত সবাই। তাই এপার্টমেন্ট সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে সবাই যে যার রুমে রেস্ট নিতে গেলাম।

পরদিন আমাদের কর্মসূচিতে ছিল সকালে রিও’র বিখ্যাত জার্ডিম বোটানিক্যাল গার্ডেন(GARDIM BOTANICAL GARDEN) ও বিকালে ‘ইপানেমা’ ও ‘লেবলন’ বিচ এলাকা বিচ এলাকা পরিদর্শন। বেলা দশটার দিকে আমরা বাহির হলাম জার্ডিম বোটানিক্যাল গার্ডেন পরিদর্শনের জন্য। আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে হেঁটে সাবওয়ে স্টেশন। সাবওয়ে  থেকে বোটোফোগো স্টেশনে নেমে বাসে করে বোটানিক্যাল গার্ডেন যেতে মোট পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগলো। জার্ডিম বোটানিক্যাল গার্ডেনটি আকার-আয়তনে বিশাল। চুয়ান্ন হেক্টর এলাকা জুড়ে এ গার্ডেনে আছে সাড়ে ছয় হাজার প্রজাতির ট্রপিকাল ও সাবট্রপিক্যাল বৃক্ষ ও লতাপাতা। ১৮০৬ সালে পর্তুগিজ রাজা জন-৬ এর আমলে প্রথমে এ গার্ডেনটি প্রতিষ্ঠা করা হয় । এ গার্ডেনে রয়েছে একটি গবেষণাগার ও স্বয়ংসম্পূর্ণ লাইব্রেরী। গার্ডেনটি কে ১৯৯২ সালে  UNESCO থেকে একটি ‘BIOSPHERE RESERVE ‘হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

আমরা গার্ডেনের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলাম। গার্ডেন ঢুকেই বৃক্ষরাজির সুবাস ও সুশীতল পরিবেশে মনটা ভালো হয়ে গেল। আমরা গার্ডেনের ম্যাপ দেখে দেখে প্রধান কয়েকটি স্থান দেখার প্ল্যান করে অগ্রসর হলাম। দুপুরের মধ্যে গার্ডেনের সব কিছু দেখার সময় হবে না বলে আমরা এ ভাবে প্ল্যান করেছিলাম।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চারিদিকে দেখতে দেখতে চললাম। হরেক রকমের গাছপালা। এর অধিকাংশই আমার অচেনা। প্রত্যেক গাছ বা প্লান্টের কাছে তার পরিচয় ও প্রাপ্তিস্থান উল্লেখ করা আছে। এখানে অনেক গাছ আছে যা আমাজন এলাকায় দেখা যায়। আমাদের এশীয় অঞ্চলের অনেক প্রজাতির গাছপালাও সেখানে দেখলাম। ঘুরে দেখতে দেখতে একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গার্ডেনের মাঝে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকলাম হালকা স্ন্যাকস খাবার জন্য। ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে খাবার সময় দেখলাম কাছের গাছে ছোট ছোট একপ্রকার প্রাণী। দেখতে অনেকটা কাঠবেড়ালির মতো মনে হলেও এটি কাঠবেড়ালি নয়। মুখমন্ডল হনুমান বা বানরের মতো। খুব কৌতূহল নিয়ে এই প্রাণীগুলি দেখলাম। আমি এগুলি ইতোপূর্বে দেখি নাই।  ফাস্টফুডের দোকানে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এটাকে ব্রাজিলে ‘SPIDER MONKEY’ বলা হয়।

SPIDER MONKEY ,জার্ডিম বোটানিক্যাল গার্ডের,রিও ,ব্রাজিল

জার্ডিম গার্ডেনে প্রধান প্রধান কিছু এলাকা ঘুরাঘুরিতেই দুপুর হয়ে গেল। দুপুরের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে গার্ডেন থেকে বাহিরে এসে হেঁটে রিও’র রেসকোর্স সংলগ্ন একটি রেটুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। সেখান থেকে আমরা ইপানেমা বিচ দেখতে রওয়ানা হলাম।এবার আমরা লোকাল বাসে করে যাত্রা করলাম। ইপানেমা যেতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। এটা রিও’র দ্বিতীয় বৃহত্তম বিচ। ইপানেমা বিচটি কোপাকাবানা বিচ অর্থাৎ আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে খুব একটা দূরে নয়। কোপাকাবানা ও ইপানেমা বিচ দুটি দূর থেকে দেখলে মনে হয় দুটি অর্ধচন্দ্র যেন পাশাপাশি রাখা হয়েছে। এখানেও প্রচুর হোটেল রেস্টুরেন্ট ,ক্যাফে ও স্যুভেনির শপ রয়েছে।  ইপানেমার  ব্যারন ‘JOSE ANTONIO MOREIRA FILHO’ এর বাড়ি ছিল এ বিচ এলাকায়। বিচের পাড়ে বালুরাশির শেষ প্রান্তে পাহাড় সারির মধ্যে সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর। সন্ধ্যার পর বাড়িগুলির লাইটের আলো সমুদ্রের পানিতে ঝিকমিক করছে। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল সব কিছু যেন চক চক করছে। রিও ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশের ধনী লোকজনের বাড়ি আছে এখানে। এটি রিও’র সবচাইতে ব্যায় বহুল এলাকা হিসাবে পরিচিত।

বিচ এলাকায় নারকেল গাছের ছায়ায় একটি উন্মুক্ত  ক্যাফেতে বসে রাত নয়টা পর্যন্ত কাটালাম। সমুদ্রের বিশুদ্ধ বাতাস শরীরের ক্লান্তি অনেকটা দূর করে দিল। খাবার দাবারের দাম দর এখানে তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকায় আমরা বাসে চড়ে ক্যাপকবানা বিচ এলাকায় চলে আসলাম। আমাদের এপার্টমেন্টের কাছাকাছি একটি রেস্টুরেন্ট রাতের খাবার খেতে ঢুকলাম। ফুটপাথের নিচে উন্মুক্ত সমুদ্রের কাছে বালুময় খোলামেলা জায়গায় নারকেল ও ঝাউ গাছের নিচে রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। আমরা বিভিন্ন প্রকার সী ফুড ,চিকেন ও সালাদ দিয়ে ডিনার করলাম।  সাথে ব্রাজিলের রকমারি জুস ও ঐতিহ্যবাহী কোকোনাট ওয়াটার বা ফ্রেশ ডাবের পানি। বিচের খোলা বাতাস আরো কিছুক্ষন উপভোগ করে এপার্টমেন্টে ফিরলাম মধ্যেরাতে।

-মোঃ মনিরুজ্জামান/টরন্টো..

(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন