টরন্টো থেকে:-
এ বছর মার্চ মাসে আমার কর্মস্থলের সহকর্মী ও বন্ধুদের সাথে ব্রাজিল ভ্রমণে গেছিলাম। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে এটাই আমার প্রথম ভ্রমণ। তাই ভ্রমণের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকেই খুব কৌতূহল ও উত্তেজনা নিয়ে ব্রাজিল যাত্রার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার এ ভ্রমণের মাধ্যমে ব্রাজিল তথা দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানার সুযোগ হয়েছে। ব্রাজিল থেকে ফেরার পর ভাবছিলাম আমার ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করবো। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এ লেখার প্রয়াশ।
ভ্রমণ সঙ্গীদের মধ্যে দুজন ছাড়া আমরা বাকি চারজনই পঞ্চাশউর্ধো বয়সের। তিনজন পুরুষ ও তিন জন মহিলা। আমি,রিনালদো ,মার্গারেট ও এস্থের কাছাকাছি বয়সের এবং জন ও গ্রেসের বয়স ত্রিশের কোঠায়। আমরা ছয়জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক হলেও সবাই কানাডিয়ান। ভ্রমণ সঙ্গীদের মধ্যে ব্রাজিলের অধিবাসী রিনালদো আমার ঘনিষ্ট বন্ধু । মাত্র তিন সপ্তাহের সময়ের মধ্যে এতো বড় একটি দেশের খুব কমই দেখা সম্ভব হয়েছে। তবে ব্রাজিলে যাবার আগেই আমরা রিনালদোর সাথে বসে ভ্রমণের একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। সে জন্য আমরা ব্রাজিলের উল্লেখযোগ্য কিছু এলাকা ভ্রমণ করতে পেরেছি। ব্রাজিলের ভাষা পর্তুগীজ। কেউ ইংরেজি বলতে চায় না। অবশ্য রিনালদো আমাদের সাথে থাকাতে আমরা তার মাধ্যমে দোভাষীর কাজটা চালিয়ে নিতে পেরেছি। আসলে রিনালদো আমাদের সাথে থাকায় আমাদের ব্রাজিল ভ্রমণ অনেক সহজ ও আনন্দদায়ক হয়েছিল।
আমার অভিজ্ঞতা বা ভ্রমণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করার আগে ব্রাজিল সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। ব্রাজিলে তিন সপ্তাহ থেকে উল্লেখযোগ্য শহর বন্দর বা অনন্য স্থাপনা , সেই সাথে ব্রাজিলের জনগণ বা সংস্কৃতি দেখে আমার মনে হয়েছে ব্রাজিল একটি উন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে পড়ে। আমরা সবাই জানি ব্রাজিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশ। ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪৭.৩% এলাকাজুড়ে অবস্থিত। ইকুয়েডোর ও চিলি ছাড়া ব্রাজিলের সাথে সকল দক্ষিণ মার্কিন দেশের বর্ডার রয়েছে। ব্রাজিল ২৬ টি স্টেট বা অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত। ২০১৫ এর জিডিপি হিসাব মতে ব্রাজিলের অর্থনীতি বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম। বিগত ১৫০ বছর যাবৎ ব্রাজিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ কফি উৎপাদনকারী দেশ। আমাজান রেইনফরেস্টের প্রায় ৬০ ভাগ ব্রাজিলের অন্তর্ভুক্ত। ব্রজিলের মানচিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যায় আটলান্টিকের পশ্চিম প্রান্ত ছুঁয়ে ব্রাজিলে রয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মাইলের কোস্টাল বেল্ট। এসব এলাকা জুড়ে শত শত বিচ,রিসোর্ট ও বন্দর নগরী। আমেরিকার পরে ব্রাজিলেই রয়েছে সবচাইতে বেশি এয়ারপোর্ট। বিশ্বের মধ্যে ‘SOLD CARS’ শতকরা ৯২ ভাগই ব্রাজিলে বিক্রয় হয়। আখের রস বা ‘সুগার কেন’ থেকে তৈরি ইথানল ব্রাজিলে গাড়ির জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আমি আমেরিকা কানাডা বা ইংল্যান্ডে যোগাযোগ/পরিবহন ব্যবস্থা,অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যা দেখেছি ব্রাজিলেও সেগুলি দেখেছি। এমনকি কোনো কোনো জিনিস আমার কাছে পাশ্চাত্য দেশের থেকে ব্রাজিলে আরো উন্নত দেখেছি। সেজন্যই আমার মনে হয়েছে ব্রাজিল অব্যশই বিশ্বের অন্য যে কোনো উন্নত দেশের সমকক্ষ।
ব্রাজিল সম্পর্কে আরো অনেক বিষয় আমার ভ্রমণ বিবরণীতে আলোচনা করবো আশাকরি। এখন ব্রাজিলে আমার ভ্রমণের ধারাবাহিক বর্ণনায় চলে যাচ্ছি। মার্চের ৮ তারিখে আমরা এয়ার কানাডার সর্বাধুনিক এয়ারক্রাফট ‘ড্রিম লাইনার’ বিমানযোগে টরন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করি রাত ১১ টায়। ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ নগরী সাওপাওলো এয়ারপোর্ট পৌঁছাই পরদিন বেলা ১০ টায়। সাওপাওলো এয়ারপোর্টটি বিশাল। বিশ্বের আর সকল উন্নত দেশের এয়ারপোর্টের মতোই এখানে সকল আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। ইমিগ্রেশন শেষ করতে পাঁচ মিনিট লাগলো। কানাডিয়ানদের ব্রাজিল ভ্রমণের জন্য ভিসা লাগে। আমরা টরন্টো থেকে ভিসা আগেই নিয়েছিলাম। তাই কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন ও কাস্টম শেষ করে প্রথমেই কিছু কার্রেন্সি চেঞ্জ করে নিলাম। কানাডিয়ান ডলারের সাথে ব্রাজিলিয়ান রিয়ালের বিনিময় হার ঐ সময় ছিল ২.৩০ অর্থাৎ একশত কানাডিয়ান ডলার দিয়ে ২৩০ রিয়াল।
এয়ারপোর্ট থেকে বাহিরে এসেই গরমের ঝটকা চোখে মুখে লাগলো। টরন্টোর সেই দিনের জিরো ডিগ্রি তাপমাত্রা থেকে সাওপাওলোর ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় হটাৎ আগমনের কারণেই এই ঝটকা ! কানাডা থেকে বাংলাদেশে গেলেও হটাৎ করে তাপমাত্রা পরিবর্তনের এ ধরণের ঝটকা সবারই লেগে থাকে।
এয়ারপোর্ট থেকে সাওপাওলো শহর ত্রিশ কিলোমিটার। যাতায়াতের জন্য সব ধরণের যানবাহনই আছে। আমরা উবের ট্যাক্সি নিলাম দুটো। আধা ঘন্টার পথ যেতে দেড় ঘন্টা লাগলো। রিনালদো বললো সাওপাওলোতে এসময় ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে। ডাউন টাউনের ব্যাস্ততম ও বিখ্যাত পলিস্তা এভিনিউয়ের ‘POLISTA TRIANON’ হোটেলে উঠলাম। হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল। এখানে বলে রাখি ,আমরা টরন্টো থেকে যাত্রার আগেই যে সব শহর বা এলাকায় ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলাম সেখানে থাকার জন্য হোটেল বা এপার্টমেন্ট এবং যাতায়াতের জন্য ডোমেস্টিক এয়ার লাইনের প্লেন টিকেট অনলাইনে কিনে রেখেছিলাম।
হোটেলে পৌঁছে রুমের দখল বুঝে নিয়ে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে গোসল সেরে নিলাম। পরে দুপুরের খাবারের জন্য সকলে বাহির হলাম। পলিস্তা এভিনিউ (AVENIDA POLISTA) সাওপাওলোর একটি বড় ও ব্যাস্ততম এলাকা। রাস্তার দুপাশে আধুনিক সব শপিং মল ,দোকান পাট ও ব্যাবসা কেন্দ্র। এ রাস্তাটিকে টরন্টোর বে স্ট্রিট বা ইয়াং স্ট্রিটের সাথে তুলনা করা যায়। আমরা একটি শপিং মলের পঞ্চম তলায় ফুড কোর্টে গেলাম। ফুড কোর্ট গুলি অনেকটা টরন্টোর ফুড কোর্টের মতই। তবে পার্থক্য হলো খাবার ক্রয়-বিক্রয়ের ধরণ। এখানে অনেক গুলি খাবারের রেস্টুরেন্টে কেজি হিসাবে খাবার বিক্রি হচ্ছে। এসব রেস্টুরেন্টে ২০/২৫ প্রকারের খাবার আইটেম আছে। যে কোনো খাবার যত খুশি নেয়া যাবে। সবকিছু একত্রে ক্যাশ কাউন্টারে ওজন করে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ব্রাজিলে এধরণের রেস্টুরেন্ট সব ছোট বড় শহরেই আছে। এগুলিকে বলা হয় “সেলফ সার্ভিস বুফে”। আমি ও রিনালদো যেখান থেকে আমাদের খাবার কিনলাম সেখানে কেজি ৪৮ রিয়াল। আমি ভাত,মাছ ,কয়েক প্রকার ভেজিটেবলস মিলিয়ে প্রায় নয়শো গ্রাম খাবার কিনলাম প্রথম রাউন্ডে। পরবর্তীতে ডেজার্ট ও ফলমূল কিনলাম তিনশো গ্রাম। খাবারের মূল্য ৫৫ রিয়াল যা কানাডিয়ান ২০ ডলারের মতো। এ হিসাবে ব্রাজিলের খাবার মূল্য কানাডা থেকে কিঞ্চিৎ বেশি। তবে খাবারের মান ও খাদ্য চয়নের অবাধ স্বাধীনতা আমার খুব পছন্দ হল ।
ছবি:-পলিস্তা এভিনিউ (AVENIDA POLISTA) সাও পাওলো ,ব্রাজিল
খাবার শেষ করে টরন্টোতে পরিবারের ও বাংলাদেশে আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগের জন্য বন্ধু রিনালদোর পরামর্শ মতে ব্রাজিলিয়ান সিম কিনে ফোনে সেট করে নিলাম। আমার দেখাদেখি ভ্রমণ সঙ্গী কয়েকজনও সিম কিনে যার যার ফোনে সেট করে নিয়েছিল। এতে রোমিং করে ফোনে কথা বলার থেকে অনেক কম খরচে আমরা সর্বত্র কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সাওপাওলো শহর দেখতে দেখতে আসছিলাম আর মনে মনে প্ল্যান করছিলাম কখন শহর দেখতে বের হবো। নুতন নুতন জায়গা বেড়ানো আমার সব সময়ই পছন্দ। তাই খাবার পরে ভ্রমণ সঙ্গীদের উদ্বুদ্ধ করলাম শহর দেখতে যেতে।
ব্রাজিল আসার আগে ইন্টারনেট থেকে সাওপাওলো শহর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি বাস্তবে মনে হলো সাওপাওলো তার থেকে আরো বড় ও ব্যাপক। সাওপাওলো মহানগরী ব্রাজিলের সাওপাওলো স্টেটের রাজধানী। লোক সংখ্যা দেড় কোটি। ১৫৫৪ সালে একদল পর্তুগিজ মিশনারির উদ্যোগে সাও পাওলো নগরীর গোড়াপত্তন হয়। পরবর্তীতে পর্তুগিজ,জাপানিজ ,ইতালিয়ান ও বেশ কিছু আরব বণিক ও নাবিকদের বসবাসের কারণে শহরের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও উন্নতি সাধিত হয়। সাওপাওলো ব্রাজিলের ও দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ নগরী। সাও পাওলো কে অনেকটা মুম্বাই বা লন্ডনের মতো মনে হয়েছে। নগরীটি বিশাল ও জনবহুল হলেও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সাজানো গোছানো।
ছবি:- দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ মহানগরী সাও পাওলো,ব্রাজিল
ঐ দিন সারা বিকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমরা পলিস্তা এভিনিউ ও তার আশপাশের এলাকায় পায়ে হেঁটে দেখলাম। পলিস্তা এভিনিউ প্রায় পাঁচ কিলোমিটার লম্বা ছয় লেন বিশিষ্ট একটি বড় রাস্তা। রাস্তার দুপাশে অনেক সরকারি বেসরকারি অফিস ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। এ এলাকায় আছে ব্রাজিলের বিখ্যাত MASP-মিউনিসিপাল মিউজিয়াম , ফুটবল মিউজিয়াম ,ট্রিয়ানন গার্ডেন পার্ক ও আরো অনেক দর্শনীয় স্থান। তবে ঐ দিন আমরা শুধু ফুটবল মিউজিয়াম ও ট্রিয়ানন গার্ডেন পার্ক দেখার সময় পেয়েছিলাম। ফুটবল মিউজিয়ামটি আসলে দেখার ও শেখার জন্য একটি আদর্শ স্থান। এখানে আছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য ফুটবল খেলার ভিডিও ও ষ্টীল ছবি। বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়দের খেলার কলাকৌশল / নিয়মাবলীর সচিত্র ইতিহাস। আমি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হলাম ফুটবলের সব কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের সচিত্র খেলার দৃশ্য ,তাদের জন্ম-মৃত্যু , উত্থান , ফুটবল খেলায় তাদের অবদান ইত্যাদি সব তথ্য জানতে পেরে। তবে সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে মিউজিয়ামের সব কিছু ভালো মতো দেখতে পারি নাই। ফুটবল প্রেমীদের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। পায়ে হেঁটে আমার সহযাত্রীরা কয়েকজন বেশ ক্লান্ত। তাই আমরা পলিস্তা এভিনিউর একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। শরীর ক্লান্ত থাকায় আর দেরি না করে সবাই ঘুমাতে গেলাম।
ছবি:- পলিস্তা এভিনিউ’তে ‘ সিগারেট ব্রেক’ এ আমি ও রিনালদো
সাওপাওলো ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনেও আমরা পায়ে হেঁটে সকালে শহর দেখতে বের হলাম। প্রথমেই আমরা MASP মিউজিয়াম দেখতে যাই। এ মিউজিয়ামে ব্রাজিলের প্রাচীন কালের ও পরবর্তীতে পর্তুগিজ শাসনামলের অনেক নিদর্শন দেখলাম প্রায় বেলা বারোটা পর্যন্ত। যেসব নিদর্শন এখানে দেখলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্রাজিলে পর্তুগিজ দের আগমন,তাদের শাসনামল ,তার পূর্ববর্তীতে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা প্রণালী ,আমাজন বেসিনের জীবনযাত্রা ও প্রাচীন ব্রাজিলের আরো কিছু তৈল চিত্র ও হাতে আঁকা শিল্পকর্ম। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে ঘন্টা খানেক রাস্তায় হেঁটে প্রচন্ড রোদের তাপ ও গরমে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। রাস্তার পাশে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে আমরা ঠান্ডা কিছু খেতে দাঁড়ালাম। আমি আইস ক্রিম নিলাম। মূল্য মাত্র ২ রিয়াল। অর্থাৎ কানাডিয়ান এক ডলারের চাইতেও কম। একটু ঠান্ডা হয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। সাওপাওলোর ফিনান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট এলাকা ঘুরে আমরা সাবওয়ে ধরে সাও পাওলো সেন্ট্রাল ক্যাথেড্রাল দেখতে গেলাম।
ছবি:-সাও পাওলো সেন্ট্রাল ক্যাথেড্রাল,ব্রাজিল:-
এখানে সাওপাওলোর সাবওয়ে সম্পর্কে দুটি কথা না বললেই নয়। আমি টরন্টো ছাড়াও লন্ডনের টিউব রেলওয়ে ,ও নিউয়র্কের সাবওয়ে দেখছি। আমার মনে হয়েছে সাওপাওলোর সাবওয়ে সিস্টেম সেগুলির থেকে কোনো অংশে কম নয়। বরং আরো সুন্দর ও পরিষ্কার পরিছন্ন মনে হয়েছে। অফিস আওয়ার শেষে সাবওয়েতে প্রচুর লোকজনের যাতায়াত লক্ষ্য করেছি। সাবওয়েতে উঠা নামার রাস্তা ও এলিভেটর গুলি অনেক বড়। ট্রেনের বগি গুলি নুতন ও প্রশস্ত। সাবওয়েতে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা আছে। সব মিলিয়ে আমার কাছে সাওপাওলোর সাবওয়ে সিস্টেম অনেক উন্নত মনে হল ।
সাবওয়ে থেকে নেমেই চোখে পড়লো সেন্ট্রাল মিউনিসিপাল ক্যাথেড্রালের বিশাল ও সু-উচ্চু চুড়া। এটির নির্মাণকাল ১৯১৩। তবে ১৯৬৭ একবার সংস্কার করা হয়। ” NEO GOTHIC STYLE “এর এই ক্যাথেড্রালটি নির্মাণে আট শত টন মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। একসাথে এখানে একসাথে আট হাজার মানুষ বসে প্রার্থনা করতে পারে। ক্যাথেড্রালের ভিতরে ও বাহিরে সুন্দর কারুকাজ লক্ষণীয়। আমার ভ্রমণসঙ্গীরা কেউ কেউ সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা করে ক্যাথেড্রাল থেকে বাহির হলাম আধ ঘন্টা পরে। বাহিরে ক্যাথেড্রালের সামনে বিশাল চত্বর। এ জায়গাটিকে বাংলাদেশের ঢাকার বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনের চত্বরের মতো মনে হয়েছে। তবে আকার-আয়তনে অনেক বড়। ক্যাথেড্রালের সামনের খোলা চত্বরে চলছে ব্রাজিলের বিখ্যাত সাম্বা নৃত্য। আমরা কিছুক্ষন সাম্বা নৃত্য দেখে রাস্তার ওপর পাশে ওপেন মার্কেটে গেলাম। এটি আসলে একটি হকার্স মার্কেটের মতোই। পোশাক-আশাক ,জুতা- সেন্ডেল, ব্যাগ-ব্রিফকেস ,স্যুভেনির বা গিফট আইটেম সহ সব কিছুই এখানে পাওয়া যায়। মার্কেটটি এক কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সাও পাওলো মিউনিসিপাল থিয়েটারের কাছে যেয়ে শেষ হয়েছে। আমরা প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে হেঁটে হেঁটে মার্কেটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গেলাম। ভ্রমণসঙ্গীরা কিছু কিছু স্যুভেনির কিনলো। আমিও সেখান থেকে কয়েকটি টিশার্ট কিনলাম।
মার্কেটের শেষ মাথায় একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান সাওপাওলো মিউনিসিপ্যাল থিয়েটার। এটি ১৯২২ সালে নির্মিত এবং পরে ২০১১ সালে পুনঃ সংস্কার করা হয়। বিল্ডিংটির নির্মাণ কুশলী আমার কাছে অসাধারণ মনে হল । এটি প্যারিসের ” PALAIS GARNIER ” এর ডিজাইনের অনুকরণে তৈরী। এখানে সব ধরণের কালচারাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাঁচ হাজার লোক একসাথে বসার ব্যবস্থা আছে।
সাওপাওলোর বিশাল ও ব্যাপকতা দেখতে দেখতে আমরা সবাই অবিভুত। তাই খাবারের কথাও ভুলে গেছিলাম । তবে একপর্যায়ে পেটে সাড়া দিল। আমরা থিয়েটারের কাছে একটি মলে ঢুকলাম বিকাল তিন টায়। সেখানে একটি সেলফ সার্ভিস বুফে’তে যেয়ে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম ভরপেট। ব্রাজিলিয়ান খাবার খুব আমার খুব পছন্দ হয়েছে। টরন্টো থেকে আসার আগে চিন্তা ছিল কি খাবো ব্রাজিলে যেয়ে । তবে এখানে এসে সেচিন্তা দূর হয়েছে। হারাম হালাল খাবার বা রান্নার বিষয়ে কোনো চিন্তা নাই। যা খুশি তাই খেতে পারছি, যদিও দাম একটু বেশি।
দুপুরের খাবার খেয়ে পুনরায় শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে পরিকল্পনা মাফিক দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য আবার বের হলাম। এখানে উল্লেখ্য ,জাপানের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাপানিজ কম্যুনিটি সাওপাওলো তে অবস্থিত। তাই আমরা বিখ্যাত জাপানিজ ” LIBERDALE SQUARE ” এ গেলাম। জাপানিজ প্রাচীন ও আধুনিক অনেক শিল্পকর্ম ও পণ্য সামগ্রী এখানে পাওয়া যায়। এখানে অনেক বিল্ডিং ও স্থাপনা জাপানিজ স্টাইলে তৈরী। একসাথে এতো জাপানী মানুষ দেখে মনে হলো আমরা জাপানে আসছি। জাপানিজ নিদর্শন দেখে আমরা সাও পাওলো পার্লামেন্ট ভবন ,সেন্ট বেনেডিক্ট চার্চ এন্ড মোনাস্ট্রি ,রিপাবলিক স্কোয়ার ঘুরে রাত দশটায় হোটেলে ফিরলাম। দেখার ও শেখার অনেক কিছুই আছে এ শহরে। সময় সংক্ষিপ্ততার জন্য আমরা তার অনেক কিছুই দেখতে পারলাম না। পরিকল্পনা মাফিক আমাদের আগামীকাল রিও ডি জেনেরিও যেতে হবে। তাই হোটেল সংলগ্ন কনফেক্শনারি থেকে হালকা স্ন্যাকস কিনে খেয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। প্রচুর হাঁটাহাঁটি করে শরীর যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল। তাই বিছানায় যাওয়া মাত্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
মোঃ মনিরুজ্জামান
চলবে…