অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মের ছুটির সময় মেজো সম্মন্ধি ও তার বন্ধুদের  সাথে যশোরের বেনাপোলে স্থল বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়া প্রবেশ করলাম। জীবনে প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছি ,তাই বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলাম। বর্ডার থেকে ভাড়া করা টাটাসুমো জিপ গাড়িতে কলকাতা পৌছালাম রাট নয়টায়। কলকাতা নিউমার্কেটের কাছে একটি হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। নিউমার্কেটের কাছে বিখ্যাত আমানিয়া হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে পায়ে হেটে হোটেলে আসলাম। কলকাতার প্রসিদ্ধ নিউমার্কেট এলাকা দেখতে দেখতে হোটেলে পৌছালাম রাত এগারোটায়। প্রথম দিনের মত কলকাতা দর্শন শেষ করে ঘুমানোর আয়োজন করলাম।

দুইদিন কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর পর তৃতীয় দিন আমি পীর সাহেবের খানকায় যাবার প্রস্তুতি নিলাম। সফর সঙ্গীদের বললাম আমি কোথায় যেতে চাই। তারা আমার কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিল এবং বলল, এই বয়সে পীর ধরেছো ! যাইহোক, তাদের কথা উপেক্ষা করে আমি বেলা দশটার দিকে হোটেল থেকে পীরের খানকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাবার সময় তাদের বলেছিলাম আমি হয়তো সেদিন পীর সাহেবের খানকায় থেকে যেতে পারি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সেখানে যাবার জন্য। প্রকৃতপক্ষে, যতটা না ছিল পীর ভক্তি তার চেয়ে বেশি ছিল কৌতহল। মজিদ সাহেবের নিকট থেকে পীর সাহেবের বাড়ি, সেখানকার পরিবেশ ও যেসব অলৌকিক ঘটনাবলী  বা কেরামতের কথা শুনেছিলাম সেটা কাছে থেকে নিজ চোখে দেখার প্রচন্ড আগ্রহ জন্মেছিল। সে কারণেই সেখানে যেতে আগ্রহী ছিলাম।

কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাসে করে দমদম হয়ে হাতিয়াড়া পৌঁছে রিক্সা ওয়ালাকে হাতিয়াড়া পীর সাহেবের খানকার কথা বললে সে চিনলো এবং আমাকে নিয়ে রওয়ানা দিল। কলকাতা মহানগরীর ব্যাস্ততা ছাড়িয়ে শহরতলীর অপেক্ষাকৃত হালকা জনবহুল এলাকায় চলে এলাম। পীর সাহেবের নাম অনুসারে এ এলাকার নাম এখন গহমারী নগর। বেশ কিছুক্ষন পরে আমি বহুল প্রতীক্ষিত আমার পীর সাহেবের বাড়ি বা খানকা শরীফে এসে পৌছালাম। সম্ভবত তখন দুপুর বারোটা বেজেছিল। রিক্সা থেকে নেমে রাস্তার পাশেই দেখতে পেলাম বিরাট এক দুর্গ সাদৃশ বাড়ি।  তার আশেপাশে আরো কিছু দোতালা-একতালা বাড়ি, কিছু চালাঘর ও স্কুল ঘরের মত কিছু বাড়ি। চারিদিকে বেশ কিছু লোকজনের সমাগম লক্ষ্য করলাম। আমার মনে হয় এদের অনেকেই তথাকথিত খাদেম  যাদের প্রায় পীরের খানকায় দেখা যায়।  একনজরে আমি যতটুকু দেখলাম তাতে এটাকে একটি বেশ বড় প্রতিষ্ঠান মনে হল। 

আমি রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়াতেই একজন খাদেম এসে সালাম দিয়ে দাড়াল। আমি তাকে বললাম যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং পীর সাহেব হজরত হামিদ গহমারীর সাথে দেখা করতে চাই। তিনি সাদরে আমাকে প্রধান গেট দিয়ে খানকার ভিতরে নিয়ে গেলেন। তিনি আর একজন সিনিয়র খাদেমের সাথে আমার আগমনের হেতু জানালেন। সিনিয়র খাদেম বা পীর ভাই (পীরের মুরিদগণ এক অপরকে পীরভাই বলে থাকেন) আমাকে খানকার ভিতরের দিকে অর্থাৎ পীর সাহেবের দুর্গ সাদৃশ বাড়ি ঢোকার গেটের কাছে বিশাল ব্যালকনির একপাশে পীর সাহেব যেখানে বসে তার মুরিদদের সাথে সাক্ষাৎ করেন সেখানে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার বাড়ির মধ্যে ঢোকার দরোজার সাথে নির্মিত একটি অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু বেদিতে বসে পীর সাহেব সবার সাথে  কথা বলেন। এই বেদিটি বা পীর সাহেব হুজুরের বসার স্থানটি বেশ সুরক্ষিত। বেদির দুই দিকেই দেয়াল ঘেরা ও ওপর দিক ( তার বসার স্থানের  পিছনের দিক ) তার বাসভবনে ঢোকার রাস্তা যেটা একমাত্র তিনিই ব্যবহার করতে পারবেন। শুধু মাত্র বেলকনির সামনের দিকে খোপ খোপ বিশিষ্ট বাঁশের বেড়া যার ভিতর দিয়ে ভক্তদের সাথে তিনি মোসাহাফা (করমর্দন ) করেন। অনেকটা জেলখানায় আসামির সাথে তার সাক্ষাৎকারীগণ যেভাবে সাক্ষাৎ করে দেখেন ও কথা বার্তা বলেন এ রকম পীর সাহেব বাঁশের বেড়ার ভিতর থেকে ভক্ত ও মুরিদদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন। দেখতে পেলাম অনেক লোকজন পীর সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য বসে আছেন এবং পীর সাহেব হুজুর তাদের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন। ইতোপূর্বে  আমি কোনো পীর সাহেব হুজুরের দরবারে যায়নি। তাই এসব কিছুঁই  আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম।

আমার সেই সিনিয়র পীর ভাই সবাইকে পাশ কাটিয়ে পীর সাহেবের কাছে যেয়ে সম্ভবত আমার আগমন সম্পর্কে পীর সাহেবের কাছে কিছু বললেন। পরে এসে আমাকে নিয়ে পীর সাহেবের বেদির সন্নিকটে বসিয়ে দিয়ে গেলেন এবং বললেন ,হুজুরের সাথে কথা শেষ হলে তিনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন ও আমার থাকার ঘর দেখিয়ে দেবেন। তার  আচরণে মনে হল আমি এসব সেটা যেন তারা জানতেন। কিংবা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তাই খাতির যত্ন একটু বেশি করছেন। 

যাইহোক,এই প্রথম আমি পীর সাহেব কে দেখতে পেলাম ! দেখলাম মাঝ বয়সী একজন লোক বেশ মোটাসোটা ও  গায়ের রং কালো। তার দাড়ি ও মাথার চুলও খুব ছোট করে কাটা। তিনি খালি গায়ে ঘাড়ের উপর একটা গামছা রেখে পা অর্ধেক ঝুলিয়ে বসে আছেন। তখন গরমকাল চলছি।  তার বসার স্থানে উপরে সিলিঙে একটি ফ্যান চলছে যথারীতি। তারপর এভাবে তিনি খালি গায়ে বসে ছিলেন কেন সেটা আমার বোধগম্য হল না। আমাকে দেখে খুবই সাদরে আমন্ত্রণ করে মোসাহাফা করে বসতে বললেন। কবে ও কখন আসছি  সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। আমার পরিবার ও কি করি সবকিছু তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার সব কথার জবাব দিচ্ছি আর তাকে দেখছি। তিনি আমার সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলছিলেন।  আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম তিনি বাঙালি নন। সম্ভবত তিনি বিহারি বা কালকেশিয়ান বলে আমার মনে হল। আমি বললাম, বাংলাদেশে মজিদ সাহেবের মাধ্যমে আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু মুরিদ হয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর  আগে। সময় সুযোগের অভাবে আসতে পারি নাই। পীর সাহেব মজিদ সাহেব কে চিনলেন এবং বললেন তিনি বাংলাদেশে তাদের একজন ভক্ত  ও তার বাবা পীর হজরত ফরওহা গহমারীর (র) একজন মুরিদ। এভাবে আরো কিছুক্ষণ তার সাথে কথা হল। তিনি আমাকে আপাতত একপাশে বসতে বললেন এবং বললেন দুপুরে খেয়ে রেস্ট করতে। পরে আমার তার সাথে দেখা  করতে বললেন। আমি আরো কিছুক্ষন সেখানে বসলাম এবং দেখলাম লোকজন সারিবদ্ধ ভাবে এসে তার সাথে মোসাহাফা বা করমর্দন করছেন ,নিজেদের সমস্যার কথা বলছেন। সেই সাথে দেখলাম সবাই তাকে হাতের মুঠির মধ্যে টাকা গুঁজে দিচ্ছেন। তিনি টাকাগুলি না দেখেই তার  আমি বসার  স্থানে চটের তোষকের নিচে রেখে দিচ্ছেন। আমার হটাৎ করে মনে হল আমি তো তাকে কোন টাকা পয়সা দেয়নি। আমি  ভাবছিলাম তিনি কি এ জন্য আমার প্রতি নাখোশ হলেন নাকি ? 

আমি একপাশে বসে আগ্রহভরে চারিদিকে দেখছিলাম। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে কোন মাজারে গেলেও কোন জীবিত পীর সাহেবের সান্নিধ্যে যায়নি। তাই যা কিছু দেখছি তার সব কিছুই আমার কাছে নুতন অভিজ্ঞতা। আমি লক্ষ্য করলাম সেখানে স্থানীয় পীর ভাই বা খাদেমরা প্রায় সবাই হিন্দি/উর্ধুতে কথা বলছে। তবে ভারতের কোন বাংলাভাষী বা আমার মত বাংলাদেশী আসলে তার সাথে আবার বাংলাতেই কথা বলছে। একটু পরে আমার সিনিয়র পীর ভাই আমাকে এসে নিয়ে যেতে চাইলেন। পীর সাহেব তখন অন্যানদের সাথে কথা বলছিলেন। তবে তাকে দেখে বললেন, আমার থাকা খাওয়ার যত্ন নিতে। 

পীর সাহেব হুজুরের থেকে বাইরে এসে দেখলাম অনেক লোকজন সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করছেন । আমার গাইড পীর ভাই জানালেন এখন দুপুরের খাবার সময়। সামনের বড় টিনের ছাউনির ঘরের একপাশে বিরাট একটি খাবারের ডেগচি থেকে সবাইকে খাবার দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেকটা লঙ্গরখানায় মত। পীর ভাই কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম প্রতিদিন এভাবে এখানে দুইবেলা সবাইকে খাবার দেয়া হয়। বাৎসরিক ওরশের সময় নাকি প্রতিদিন শত শত লোকের খাবার রান্না হয় এবং এভাবে সেগুলি পরিবেশন করা হয়। আমি ভাবছিলাম আজ এই খাবারই খেতে হবে নাকি !! মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন আমার সঙ্গী পীর ভাই।  তিনি জানালেন , অতিথিতিদের জন্য আলাদা খাবার দেয়া হয় তাদের ঘরে। তিনি আমাকে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত একতালা টিনশেড বিল্ডিঙের একটি ঘরে পৌঁছে দিলেন। মেস স্টাইলের একটি এ ঘরটিতে একটি সিঙ্গেল চৌকি ছিল। বিল্ডিঙের শেষ প্রান্তে টিউব অয়েল ,গণবাথরুম ও গোসলখানা। অবশ্য গোসলের জন্য একটি বড় পুকুর আছে যেটা পরে  দেখেছিলাম। গোসলখানা ও বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে তিনি বললেন , কিছুক্ষন পরে তিনি আমাকে খাবার দিয়ে যাবেন। আমি  গোসল সেরে ঘরে এসে দেখলাম একটি টিনের প্লেটে মোটা লাল চালের ভাত ,এক বাটিতে ডাল ,কিছু সবজি ও গরুর মাংস দিয়ে গেছেন। বুঝতে পারলাম ঐ লঙ্গর খানার খাবার নয় , এটা স্পেশাল অতিথিদের জন্য আলাদা ভাবে রান্না করা। খাবার ততটা সুস্বাদু না হলেও তখন যথেষ্ট ক্ষুধার্থ ছিলাম ,তাই আর কিছু চিন্তা না করে  খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে ভাবছিলাম, এখানে ভক্তদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ আছে। যারা নুতন এসেছে বা যারা একটু বেশি টাকা পয়সা দেয় তাদের জন্য স্পেশাল খাতির যত্ন করা হয় ।

দুপুরে খাবার পর যখন বাসনপত্র নিতে আমার বয়সী এক পীর ভাই আসলো তখন তাকে বললাম, “ভাই আমি তো এখানে প্রথম আসছি তাই কিছুই এখনো চিনি না। তুমি কি আমাকে বিকালে একটু সঙ্গ দেবে সব কিছু ঘুরে দেখার জন্য ?” সে সানন্দে রাজি হল এবং বললো  আসর নামাজের পর বিকালে আসবে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার সাথে থাকবে। সে আরো বললো ,পীর সাহেব হুজুর আসর নামাজের পর আবার বসবেন ভক্তদের সাথে সাক্ষাতের জন্য।  আমি যেন তখন আবার হুজুরের সাথে দেখা করি। সে চলে গেলে আমি বিছানায় কিছুক্ষন রেস্ট নিতে গেলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ছোট পীরভাই এসে আমার ঘুম ভাঙালো। আমি পূর্বের প্ল্যান মতে তার সাথে পীর সাহেবের খানকা ও আসে পাশের এলাকা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। ছেলেটি আমাকে ঘুরে দেখতে শুরু করলো। দেখলাম অনেকগুলি টিন শেড ঘর (স্কুল ঘরের মত ) চটের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে ওরশের সময় ভক্তরা এসে থাকে। তবে এ সময় সেগুলি ফাঁকা পরে আছে। পাশে বিরাট পুকুর দেখলাম। পুকুরের পাড় ও আসে পাশে অনেক তালগাছের লম্বা সারি। এখন থেকে পীর সাহেবের বাড়িটা ভালো মত লক্ষ্য করে দেখলাম। উঁচু দেয়াল ঘেরা একতালা বাড়িটা অনেকটা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের বিল্ডিঙের মত  ,যদিও সে তুলনায় আকারে অনেক ছোট। তবে ঢোকার কোন গেট আমার নজরে পড়ল না। সাথের পীর ভাই কে জিজ্ঞাসা করলে সে বললো ,পীর সাহেবের নাকি অনেক শত্রূ আছে। এমনকি তার ভাইদের মধ্যেও মিলমিশ নাই। তাই প্রধান গেট দিয়ে বাহিরের থেকে খানকার ভিতরে এসে বেলকনির কাছে পীর বাড়িতে ঢোকার রাস্তা। পীর বাড়ির লোকজন ছাড়া অন্য কারো বাড়ির অভ্যান্তরে প্রবেশ নিষেধ। তার কাছে আরো জানতে পারলাম ,পীর সাহেবের এখন চার স্ত্রী আছেন এবং তাদের একজন নাকি বাঙালি।

পীর সাহেবের খানকার বিভিন্ন দিক ঘুরে ঘুরে দেখছি সঙ্গী পীর ভাইয়ের সাথে। এক সময় সে আমাকে  বড় হজুর হজরত ফরওহা গহমারী (র 🙂 এর মাজার মাজার দেখতে নিয়ে গেল।  খানকা শরীফের এ জায়গাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলে মনে হল। এখানে বেশ কিছু লোকজনের আনাগোনা দেখলাম। 

                              বড় পীর হজরত ফর ওহা গহমারী (র) এর মাজারে প্রবেশ পথ

মাঝারি সাইজের একটি একতালা ঘরের মধ্যে হুজুরের মাজার। একটি লাল কাপড় দ্বারা কবরটি ঢাকা রয়েছে। কিছুটা উঁচু করে কবরটা ইট দ্বারা বাঁধানো। দেখতে পেলাম মুরিদ বা ভক্তরা কবরের চারিপাশ দিয়ে ঘুরে দেখে কবরের পাশে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর যাবার পথে দরোজার কাছে বড় দুটি বাক্স রাখা আছে। সবাই সেখানে টাকা পয়সা দিয়ে চলে যাচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখলাম অনেকে মাজারকে সেজদা করছে। মুরিদ বা ভক্তদের এ সেজদা করার বিষয় দুয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করলে বলল, এটা তাদের হুজুরের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন ! আমি বললাম ,কিন্তু সেজদা তো আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে করা নিষেধ  !! তারা আমার কথার কোন সদুত্তর দিতে পারলো না। বরং আমার কথায় যেন একটু বিরক্ত হল। মাজারের আশে পাশের লোকজনদের কর্মকান্ড দেখে আমার মনে হয়েছিল যে সব মাজারের পরিবেশ একই রকম। কিছু সময় সেখানে ভক্তদের কার্যকলাপ দেখে মাজার জেয়ারত করে আমি বাইরে এসে দাঁড়ালে পীর ভাই বললো আমি বার্ষিক ওরশ মাহফিলের ময়দান দেখতে যাবো কিনা। পীর সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য হাতে সময় ছিল ,তাই ওরশ মাহফিলের ময়দান দেখতে চললাম। সেটি খানকা থেকে কাছেই রাস্তার অপরপাশে অবস্থিত। তার সাথে যেতে যেতে আমি ভাবছিলাম মাজারে সেজদা করার বিষয়টি নিয়ে। সেসময় ধর্ম বিষয়ে খুব বেশি জ্ঞান না থাকলেও এটা বুঝতে পারছিলাম যে এখানে ভক্ত ও মুরিদরা যেটা করছে সেটা ঠিক নয়। আমি এটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। 

যায়হোক, আমার পীর ভাই বার্ষিক ওরশ মাহফিলের যে বিশাল ময়দান সেখানে নিয়ে এলো। সেটি বড় একটি ফুটবল মাঠের মতই। রাস্তা সংলগ্ন মাঠের একপাশে দূর দিয়ে কিছু বাড়ি ঘর এবং ওপর পাশে জঙ্গলাকীর্ণ। তবে সেদিকটা দেখলাম বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। এ মাঠে প্রতি বছর ওরশ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত ও মুরিদগণ এতে যোগদান করেন। এ সময় দেশ-বিদেশের ভক্ত ও মুরিদগণ খানকা শরীফে প্রচুর অর্থ দেন করে থাকেন। এ সব অর্থ পরে খানকা শরীফের ব্যাবস্থাপনা কমিটির ফান্ডে জমা হয়। ওরশ মাহফিলের দুসপ্তাহ আগে থেকে এ ময়দান পরিষ্কার ও সুসজ্জিত করা হয় রং বেরংএর ধর্মীয় শ্লোগান সম্বলিত পতাকা ও ফেস্টুন দ্বারা। সে জানালো এ ওরশে নাকি অনেক জ্বীনও অংশগ্রহণ করে। অনেক জ্বীনও নাকি তাদের পীর সাহেবের মুরিদ !! আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনছিলাম। তাদের এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তখন আর কিছু বললাম না।

                                   হাতিয়ার শরীফে বার্ষিক ওরশের সময়ের একটি ছবি

খানকা শরীফের আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতে করতে গেট পেরিয়ে আবার খানকার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। মাগরেবের নামাজের এখনও বেশ কিছু সময় বাকি। পীর সাহেবের সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাতের জন্য বেলকনিতে যেয়ে অন্যানোদের সাথে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষন পরে পীর সাহেবের সাথে দেখা হলে তিনি বললেন এখানে এসে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। তার পর জিজ্ঞাসা করলেন খানকার আসে পাশে ঘুরে দেখেছি কিনা । তিনি এ ধরণের টুকিটাকি আরো কিছু কথা বললেন। আমাকে নিয়মিত নামাজ পড়ে অজিফা পড়তে বললেন। বড় হুড়ুরের মাজারে সিজদা করা বা আরো কিছু বিষয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা  থাকলেও তখন আর বললাম না। আমার ও আমার পরিবারের জন্য  দোয়া চেয়ে তার  হাতে কিছু টাকা দিলাম। অন্যানো দর্শনার্থীদের তুলনায় কিছু বেশি টাকা দিয়েছিলাম। তিনি সেট না দেখে তার  বসার স্থানে চটের  তোষকের নিচে রেখে দিলেন। আমি তাকে জানালাম সকালে আমি চলে যাবো। তিনি আমাকে বার্ষিক ওরশ মাহফিলের সময় আবার আসতে বললেন।

পীর সাহেবের সাথে দেখা শেষে অতিথিশালায় নিজের ঘরে আসলাম। ঘরে এসে সারাদিন যেসব জানতে পেরেছিলম্ তা নিয়ে বসে বসে ভাবছিলাম। বৈকালিক ভ্রমণের সময় ঐ পীর ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম পীর সাহেব নাকি কোন সময় মসজিদে নামাজে শরীক হননা। তিনি  শুধুমাত্র ভক্ত বা মুরিদদের সাথে নির্ধারিত সময় দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং বার্ষিক ওরশের সময় ছাড়া বাড়ির বাহিরে যান না। এরকম আরো কিছু নিয়ম নীতি এখানে প্রচলিত যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বর্তমান পীর সাহেবের পিতা বড় পীর হজরত ফরওহা গহমারী (র) সাহেব একজন কামেল ব্যাক্তি ছিলেন মনে হয়। তবে তার মাজারে সেজদা করা কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। এ ছাড়া এখানে থাকা খাওয়া ও ভক্ত বা মুরিদদের কিছু কিছু কর্মকান্ড ও বাড়াবাড়ি এবং অন্যানো আরো কিছু বিষয় আমার ভালো লাগেনি।

রাতের খাবারও এক পীর ভাই এসে দিয়ে গেল এবং খাবার শেষে যথারীতি এটো বাসনপত্র নিয়ে গেল। রাতে ঘুমানোর আগেও ভাবছিলাম পীর সাহেব হুজুরের খানকা বিভিন্ন সব বিষয় নিয়ে। মজিদ সাহেবের কাছে যা শুনেছিলাম তার সব কিছুই তখন ভালো লেগেছিল। মনের মধ্যে একটা বাসনা ছিল কখন সেখানে যাবো আর নিজ চোখে সব কিছু দেখতে পারবো। তার কাছে শুনে মুরিদ হওয়ার প্রায় তিন বছর পর এখানে এসে সব কিছু সরেজমিনে দেখে কেন যেন আজ আমার পীর সাহেব বা তার খানকা সম্পর্কে ভক্তি শ্রদ্ধা বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে যাচ্ছে !! এখানে আসার আগের যা আমি কল্পনা করেছি সেটার সাথে বাস্তবতার মিল না থাকার জন্য আমার এ ধরণের চিন্তা ভাবনা।

পরদিন  সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে আর একবার একা একা বাহিরে ঘুরে এলাম। চারিদিকে আবার একরাউন্ড মর্নিং ওয়াক করে আসলাম। গতকাল ঐ পীর ভাই বলেছিল আশে পাশের সব জায়গা জমিন  নাকি পীর সাহেব ও তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর। এখানকার সব কিছু পর্যালোচনা করে আমার মনে হল পীর সাহেব বা তার খানকা বেশ ধনী একটি প্রতিষ্ঠান। ঘুরে ফিরে নিজের ঘরে এসে দেখি আমার সকালের নাস্তা দিয়ে গেছে। দুই পিছ রুটি,ডিম্ ও ছোলার ডাল । আমার জানা হল না অন্যানদের সকালে কি খেতে দেয়া হয়। যাইহোক, আমি কলকাতা ফিরে যাবার জন্য তৈরী হয়ে পীর সাহেবের বসার বেদির কাছে এলাম। সেখানে কেউ নাই। এক পীর ভাই কে জিজ্ঞাসা কে জানতে পারলাম হুজুর বেলা দশ-এগারো টার আগে বাহিরে আসবেন না। সে বললো হুজুর আমাকে চলে যেতে এজাজৎ দিয়েছেন কিনা ! আমি তাকে বললাম গতকাল বিকালে আমি হুজুরকে আমার যাবার কথা জানিয়েছি। তিনি বললেন, হুজুর যদি এজাজৎ বা আমার যাবার বিষয়ে সম্মতি দিয়ে থাকেন তবে আমি যেতে পারি। আমি তখন চিন্তা করে দেখলাম আমি গতকাল চলে যাবার কথা বললে পীর সাহেব তো না বলেননি। কাজেই আমি চলে যেতে কোন অসুবিধা আছে মনে হয় না। তাছাড়া এ পরিবেশে আমার আর থাকতেও ইচ্ছা করছে না। পীর ভাই কে বললাম আমার যাবার বিষয়ে হুজুর না বলেননি। তার সাথে করমর্দন ও কোলাকুলি করে আমি কলকাতা যাবার উদ্দেশ্যে খানকা থেকে বেরিয়ে আসলাম। এইসাথে সরেজমিনে আমার পীর সাহেব ও তার খানকা শরীফ দেখার সমাপ্তি হয়েছিল।     

কলকাতায় আমার সম্মন্ধিও তার বন্ধুদের সাথে আরো ২/৩ দিন বেড়িয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসলাম। কিছুদিন পর ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলাম। কয়েকমাস পর তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়ে ক্লাস করা শুরু করলাম। তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়ার চাপ তুলনামূলক ভাবে বেশি। মাঝে মাঝে শুক্রবারে জুম্মার নামাজের সময় পীরের দেয়া অজিফা পড়ার কথা মনে হত। তবে তার খানকা শরীফে যা দেখেছি সেটা মনে হলে আর আগের মত ভক্তি শ্রদ্ধা জাগতো না। 

এভাবে জীবন চক্রের আবর্তে চলতে চলতে লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী জীবনে পদার্পন করলাম। চাকুরী করতে ঢাকা থেকে চলে গেলাম বাগেরহাট, খুলনা ও পরে নব্বই দশকে আবার ঢাকা প্রত্যাবর্তন।  ইতোমধ্যে আরো কয়েকবার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এবং বন্ধুদের সাথেও কলকাতা বেড়িয়ে এসেছি। তবে পীর সাহেবের আর দেখা করতে যায়নি । অতঃপর  আমার পীর ভক্তি বা মুরিদ হওয়া ধীরে ধীরে তখন স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন