বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের কারণে পেয়েছি দীর্ঘতম ছুটি ! ইহজীবনের দীর্ঘতম ছুটি !! ছাত্রজীবনের শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের পর এতো বড় ছুটি তো আর কখনও পাইনি। তবে ছুটি কাটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকা ,খাওয়া আর টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগ রাখাই এ সময়ের কাজ। সর্বত্রই করোনা ভাইরাস নিয়ে কথাবার্তা। তাই এখন আর খুব বেশি সময় টিভি নিউজ বা অন্যানো সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ করি না। এ অখণ্ড অবসরে অন্য কিছু নিয়ে লেখার ইচ্ছে করছিল। তবে কোন সমসাময়িক বিষয় নয়, আমার ছাত্রজীবনের একটি স্মরণীয় অধ্যায় সকলের সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি ।
প্রত্যেকের জীবনেই অতীত অনেক স্মৃতি আছে যা মাঝে মাঝে মনকে নাড়া দিয়ে যায়। অতীত জীবনের অনেক বিষয়ই আছে যা আত্মীয় বা বন্ধু–বান্ধব কিছু কিছু জানলেও অন্যানোদের জানানো হয়নি। আজকাল বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগে এসব বিষয় নিয়ে লেখার মাধ্যমে অন্যানোদের জানানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। লেখার বিষয় বস্তূ ও মতামত একান্তই আমার ব্যাক্তিগত। কারো ধর্মীয় অনুভতিকে ছোট করার কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। এ উদ্দেশ্যই লেখাটির মাধ্যমে অতীত জীবনের কিছু স্মৃতি সকলের সাথে শেয়ার করতে চাই । ঘটনাবলীর বিস্তারিত বর্ণনার জন্য লেখার পরিধি একটু দীর্ঘ হয়েছে। তাই সমগ্র লেখাটি আমি দুই পর্বে ভাগ করেছি।
যে বিষয় নিয়ে আজ লিখতে যাচ্ছি সেটা মনে হলে এখন একা একাই হাসি ! সেটি ছিল ছাত্রজীবনে আমার পীরের মুরিদ হওয়া নিয়ে ! পীর সাহেবকে না দেখেও তার মুরিদ হওয়া ও পরে সেটা ত্যাগ করা সবই ছিল আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শুরু থেকেই বলি…………….
যশোরের শার্শা পাইলট হাই স্কুল থেকে এস এস সি পাশ করে যশোরের মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ে (এম এম কলেজ ) ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭৬ সালে। এম এম কলেজে যখন লেখাপড়া করি তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় চলে আসতাম মা বাবার সাথে দেখা করতে। এছাড়া অন্যানো যেকোন ছুটি পেলেই যশোর থেকে দর্শনা চলেআসতাম। ট্রেনে যশোর থেকে দর্শনা আসতে সময় লাগত দুই ঘন্টা। বাবা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করতেন এবং তার পোস্টিং তখন কুষ্টিয়ার দর্শনা পুলিশ অউটপোস্টের ওসি। দর্শনায় এলে আমি আমাদের প্রতিবেশী পটু চাচার ফার্মাসিতে বসে সময় কাটাতাম। পটু চাচা ছিলেন অতীব বিনয়ী ও ভদ্র। তার ফার্মেসিটি ছিল দর্শনার অভিজাত আবাসিক এলাকায় গার্লস স্কুলের গেটের একদম পাশেই। এ সময় আমাদের প্রতিবেশী লিমটন,আজাদ,মেঘু, আলতাফ, হামিদ, এদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আমি সবাই আমার সমবয়সী ও উচ্চ মাধ্যমিক বা এইস এস সি ক্লাসের ছাত্র। অবশ্য ,পটু চাচা ছিলেন আমাদের ৫/৬ বছরের সিনিয়র এবং তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছেন দু‘বার এইস এস সি পরীক্ষায় ফেল করার পর।
পটু চাচার সমবয়সী আমাদের আর একজন সিনিয়র বন্ধুর নাম ছিল তাজুল ইসলাম। সে পটু চাচার ফার্মাসির ওপর পাশে কয়লা পরিদফতরের কেরানির চাকুরী করতো। সেসময় দর্শনা বর্ডার দিয়ে ভারত থেকে রেল পথে কয়লা আমদানি হত বাংলাদেশে। এ জন্য একজন কয়লা পরিদর্শকের অফিস ছিল দর্শনায়। কয়লা পরিদর্শক জনাব আব্দুল মজিদ সাহেব পুরাতন ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি সপ্তাহে ২/৩ দিন অফিস করতেন এবং বাকি সময় তাজুল ভাই একই অফিস সামলাতেন। কয়লা পরিদফতরের অফিসটি ছিল দুই রুম বিশিষ্ট ছোট একটি বাড়ি। এক রুমে অফিস ও আর একরুমে তাজুল ভাইয়ের বাসা। তবে মজিদ সাহেব আসলে তাজুল তার রুম তার ” বস” কে ছেড়ে দিয়ে নিজে অফিস রুমে ওপর একটি সিঙ্গেল কাঠের তক্তপোশের ওপর ঘুমাতেন। মজিদ সাহেব যে সময়টা ঢাকায় থাকতেন তখন তার অফিসের সবটাই ছিল আমাদের একটি আড্ডাস্থল। পটু চাচার ফার্মাসিতে বসে চা সিঙ্গারা খাওয়া ও তাজুল ভাইয়ের রুমে তাস খেলা ও আড্ডা ছিল আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। তবে মজিদ সাহেব দর্শনা আসলে সেখানে একটু কম যেতাম ।
মজিদ সাহেব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। তিনি ছিলেন ছোট খাট ও নাদুশ -নুদুশ টাইপের একজন মানুষ। তার গোলগাল মুখমণ্ডলে চোখ দুটি ছিল ছোট দুটি মার্বেলের মত। তিনি আলাপ ব্যাবহারে অনেক ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন। তিনি নিজেকে বাঙালি বললেও সম্ভবত বিহারি বা ভারতীয় বাঙালি (কালকেশিয়ান) ছিলেন। বাংলায় কথা বললেও সেটার মধ্যে পুরাতন ঢাকাইয়া টান দেখা যেতো। তিনি জানতেন তার অবর্তমানে অফিসে চলতো আমাদের নিয়মিত আড্ডা। তবে তিনি এজন্য আমাদের বা তাজুলকে কখনো রাগ করেননি। তিনি যখন থাকতেন তখন আমরা বেশিরভাগ সময় পটু চাচার ফার্মাসির সামনেই বসে থাকতাম। তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে যাবার সময় আমাদের আমন্ত্রণ জানাতেন নামাজ পড়ার জন্য।
তো এই মজিদ সাহেবের মাধ্যমেই আমি ও আমার বন্ধুদের পীরভক্তি ও পরবর্তীতে পীরের মুরিদ হওয়া ! সে প্রসঙ্গে আসছি এখন। একবার কলেজ থেকে গ্রীষ্মের ছুটি পেয়ে দর্শনা এসেছি পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। বাসায় সকালের নাস্তার পর নিয়মিত আড্ডাস্থল পটু চাচার ফার্মেসি ও তাজুল ভাইয়ের অফিস। মাজিদ সাহেবও এখন আমাদের সবার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করছেন। তাই বৈকালিক আড্ডা অনেক সময় মজিদ সাহেবের অফিসেই দেয়া যাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বিষয়ে আমাদের সাথে গল্প করছেন। সেইসাথে বৈকালিক চা-নাস্তাও তিনি পার্শবর্তী দোকান থেকে এনে আমাদের আপ্যায়ণ করছেন। তবে নামাজের সময় হলে যথারীতি নামাজ পড়তে চলে যাচ্ছেন। অনেক সময় মসজিদে না যেয়ে অফিসেই পড়তেন। সে সময় আমাদেরও তার সাথে নামাজে শরিক হতে আমন্ত্রণ জানাতেন। প্রথমদিকে আমি ও লিমটন সন্ধ্যার তার সাথে মাগরেবের নামাজে শরিক হতে শুরু করেছিলাম। পরে তাজুল ভাই ও আমাদের সাথে নামাজ পড়তে শুরু করে। তিনি নামাজের ইমামতি করতেন আর আমরা তার পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তাম।
আমাদের ঐ বয়সের ছেলেদের গল্প গুজবের মাধ্যমে ধর্মীয় দিকে উদ্বুদ্ধ করা ছিল তার একটি বিরাট সাফল্য । লক্ষ্য করেছি, নামাজ শেষে তিনি মোনাজাত একটু ভিন্ন ধরণের করতেন। অর্থাৎ একটি ভিন্ন ধরণের দোয়া-দরূদ ও তার পীরের দেয়া অজিফা পড়তেন। তিনি সুন্দর করে মোনাজাত করতেন এবং সেসময় আগে তার পীর মুর্শিদ ও পরে অন্যানদের জন্য দোয়া করতেন। একদিন কৌতূহল বশত: মজিদ সাহেবকে তার পীর মুর্শিদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম।
তিনি খুব আগ্রহ সহকারে আমাদের কে তার পীর সাহেব সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। তাজুল ভাই বললেন আমাদের জন্য চা-নাস্তা আনতে। তিনি বললেন, বিশ / একুশ বছর আগে তিনি পীরের মুরিদ হয়েছিলেন। তার পীরের নাম হজরত ফরওহা গহমারী (র) । তার খানকা শরীফ কলকাতা শহরের অদূরে দমদম এলাকা ছাড়িয়ে শহরতলীর শেষ দিকে হাতিয়াড়া গ্রামে। খানকা শরীফের নাম হাতিয়াড়া শরীফ। হজরত ফরওহা গহমারী (র) বেশ কয়েক বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন। তার মৃত্যুর পর ছেলেদের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দেয় কে তার উত্তরসূরি বা গদ্দিনশীন হবেন সেটা নিয়ে। তবে সেসব অবসান হলে ভক্তদের কাছে সব চাইতে গ্রহণযোগ্য তার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ( আমার সঠিক মনে নাই ) ছেলে হজরত হামিদ গহমারী (র) গদ্দিনশীন পীর হিসাবে মনোনীত হন।
পরবর্তী কয়েকদিন তিনি তার বড় পীর হজরত ফরওহা গহমারী (র) সাহেবের জীবন , তার অতীত ইতিহাস ও বিভিন্ন কেরামতি সম্পর্কে আমাদের বললেন। আমরা আমাদের নিয়মিত আড্ডা ভুলে আগ্রহ সহযোগে তার কথা শুনলাম। তার পীর সাহেব ছিলেন ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত অলি হজরত মওলানা সূফি মূফতী আজানগাছি (র) এর একজন শিষ্য। তার হুজরা শরীফ “হাক্কানী আনজুমান” কলকাতা মহানগরীর বাগমারা এলাকায় অবস্থিত। তার পীর সাহেব তার ওস্তাদ পীর হজরত আজানগাছি (র) এর নির্দেশ মোতাবেক হাতিয়াড়ায় খানকা শরীফ স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন ১৯৩৮ সালের দিকে । তিনি তৎকালীন বহু প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তার ধর্ম প্রচার করেন। হাতিয়াড়ায় খানকা শরীফে তিনি কোরান শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ ও ইসলামী শিক্ষার জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেন। ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনে তিনি অনেক কেরামতি দেখিয়েছেন যা আজ তার ভক্তগণের মাধ্যমে জানা যায়। তিনি নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত ও অজিফা প্রণয়ন করেন। তার ভক্তগণ এসব পরম ভক্তি সহকারে অনুসরণ করে থাকেন।
হাতিয়াড়া শরীফের পীর হজরত হামিদ গহমারী (র)
সেসময় দর্শনা অবস্থানকালীন প্রায় প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাগরেব নামাজের পর তার কাছে পীর সাহেবদের ইতিহাস,তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ,খানকা শরীফের ব্যাবস্থাপনা এবং তাদের বিভিন্ন কারামত সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। বর্তমান হাতিয়াড়া শরীফের পীর হজরত হামিদ গহমারী (র)ও একজন কামেল পীর বলে মজিদ সাহেব জানালেন। এসব বিষয় নিয়ে প্রত্যহ আলাপ করতে করতে কোন সময় যে আমরাও তার পীরের ভক্ত হয়ে গেছি সেটা বুঝতে পারিনি। এখন বিষয়টি মনে হলে ভেবে আশ্চর্য হই যে মজিদ সাহেব কিভাবে আমাদের মোটিভেট করতে করতে সফল হয়েছিলেন ! তার এ যোগ্যতাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নাই। কলেজে পড়ুয়া ৪/৫ জন টগবগে তরুণকে আল্লাহের রাস্তায় নিয়ে আসা ,নিয়মিত নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ করা ও পীরের মুরিদ করা সহজ কাজ ছিল না। আমাদের প্রত্যেককে পীর সাহেবের একটি করে অজিফা ও হাতিয়াড়া থেকে প্রকাশিত কিছু ধর্ম বিষয়ক প্রকাশনা পুস্তিকাও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন বাসায় বসে মাঝে মাঝে সেগুলি মাঝে মাঝে খুলে দেখতে ও মন চাইলে তার আমল করতে।
সেবারের মত ছুটি শেষে আবার কলেজের হোস্টেলে চলে গেলাম। এইস এস সি পরীক্ষার পর আবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দর্শনা আসলাম। নিয়মিত মজিদ সাহেবের অফিস-কাম বাসস্থানে যাতায়াত শুরু হল। সেসময় কোনো কারণে মজিদ সাহেব একসাথে অনেকদিন দর্শনায় অবস্থান করেন। প্রতি সপ্তাহে ঢাকা না যেয়ে দর্শনায় থাকতেন। আমরাও সবাই তার সাথে দিন রাতে অনেকটা সময় কাটাতে পারছিলাম। এভাবে আমাদের সময় ভালোই কেটে যাচ্ছিল। একদিন তিনি বললেন, তোমরা সবাই ভালো ছেলে । তোমরা যদি পীর মুর্শিদের মুরিদ হও তবে আরো ভালো করতে পারবে জীবনে। তার কথাটা আমাদের মনে বেশ রেখাপাত করেছিল। তবে সবাই নয়। আমি ও লিমটন ছাড়া আর কেউ তার পীরের মুরি হতে আগ্রহী হয়নি। আর তাজুল ভাই ও রাজি হয়েছিল শুধু তার বস ‘এর সন্তুষ্টির জন্য।
যাইহোক , একদিন সন্ধ্যায় মাগরেব না,আজ শেষে তার হাতে হাত রেখে আমাদের অদেখা পীর সাহেবের মুরিদ হলাম। তিনি বললেন ,রাতে বা দিনে বাসায় যখনই সময় পাবে নামাজ পড়বে ও পীর মুর্শিদের অজিফা পড়বে। এ অজিফার মূল পাঠ্য বিষয় ছিল সূরা ফাতিহা একবার ,সূরা এখলাস তিনবার ও একটি বিশেষ দরূদ তিনবার। এ ছাড়া পবিত্র কুরআন শরীফের বিশেষ কিছু আয়াত। যে দরূদটি তার অজিফায় উল্লেখ ছিল সেটি আমি অন্য কোন ধর্মীয় বইতে দেখি নাই। সম্ভবত সেটা তাদের নিজেদের সুবিধামত পরিবর্তন করা হয়েছিল। তার পরামর্শ মত মাঝে মাঝে রাতে বাসায় এশার নামাজ পড়তাম। নামাজ পরে পীরের দেয়া অজিফা ও অন্যানো দোয়া দরূদ আমল করতাম। এসব দেখে মা বাবা খুশি। বিশেষ করে মা ছিলেন অনেক বেশি খুশি। তবে বাবা যখন জানতে পারলেন যে আমরা কয়লা ইন্সপেক্টর মজিদ সাহেবের মাধ্যমে তার পীরের মুরিদ হয়েছি তখন তিনি বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে তিনি ছেলের এ পরিবর্তনে খুশিই ছিলেন মজিদ সাহেবের প্রতি। দর্শনা এসে মজিদ সাহেবের পীরের দেয়া নির্দেশনা মতে এবাদত করলেও যখনই যশোর যেতাম এবং শার্শায় যেয়ে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব আজিজুল হক পল্টু (আমার সেজো সম্বন্ধী) ও অন্যানো সহপাঠী বন্ধুদের সান্নিধ্যে আসতাম তখনই সব পীর মুর্শিদের কথা ভুলে যেতাম। তাই মনে হয় পীরের মুরিদ বা পীর ভক্তি নিয়ে আমার মধ্যে দ্বৈত সত্তা কাজ করতো। সত্যিকারের পীরের মুরিদের মত হয়ে উঠতে পারিনি কোন সময়।
তারপরও দর্শনায় আসলে আবার যেতাম মজিদ সান্নিধ্যে। তার কথাবার্তা বা আচার-আচরণ ও প্রায় প্রতিদিন তার আপ্যায়ণ আমাদের ভালোই লাগতো। তিনি নামাজের পর আমাদের জন্য দোয়া চাইতেন আল্লাহ ও তার পীর সাহেবের কাছে । তার মোনাজাতের এই দোয়া করার বিষয়ে একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আল্লাহের কাছে দোয়া করা ঠিক আছে কিন্তু আপনি পীর সাহেবের কাছে কিভাবে দোয়া চাইলেন ? তিনি কি দোয়া কবুল করতে পারেন ?? তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিলেন ,আমাদের পীর মুর্শিদ সব সময় জাগ্রত ,তিনি সব কিছু দেখেন ,সব সময় তার মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। তিনি মহানবী ( সঃ ) বংশধর এবং আল্লাহ তায়ালার একজন অলি। আল্লাহ তায়ালার সাথে ছিল তার সরাসরি যোগাযোগ। তার কথাটি কেমন যেন অতিরঞ্জিত মনে হয়েছিল তখন। তবে কোন প্রতিবাদ করিনি সেসময়। নামাজের পর পীর সাহেবের অজিফা পড়তাম।
এভাবে একসময় আমার এইস এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম উচ্চ শিক্ষার জন্য। ইতোমধ্যে আমার বাবার বদলি হয়েছে কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা থানায়। বাসাও সেখানে স্থানান্তরিত হয়েছে। তাই দর্শনার সাথে সরাসরি যোগাযোগ কমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বৃহত্তর পরিসরে লেখাপড়া,সেইসাথে উন্মুক্ত ও অবাধ স্বাধীনতা সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে প্রথম বছর অতি দ্রুত কেটে গেল। জহুরুল হক হলে পল্টু ও কিবরিয়া মামার রুমে থেকে লেখাপড়া শুরু হল। হলের পরিবেশে থেকে নুতন নুতন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন ও অনেক নুতন বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল। প্রতি শুক্রবারে হলের মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গেলে পীরের দেয়া অজিফা মাঝে মাঝে পড়তাম। সেসময় দিনের অন্যানো নামাজ নিয়মিত পড়া হত না। তাই পীরের দেয়া অজিফা ও অন্যানো এবাদতের আমল করাও কমে গেছিল। তবে বিষয়টি আমি একেবারে বাদ দেয়নি। বরং মনে মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল যে কোন এক সময় ইন্ডিয়া যাবো এবং বর্তমান পীর মুর্শিদের সাথে দেখা করবো।
ইতোমধ্যে আমার বাবা কুষ্টিয়া জেলার সদর থানায় বদলি হয়েছেন। একবার বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির সময় কুষ্টিয়া গেলাম। সেখান থেকে দর্শনা বেড়াতে গেলাম একদিন। এসময় আমার ছোট চাচা দর্শনা চিনিকলে চাকরি করতেন। ছোট চাচার বাসায় বেড়ানোর দিন পটু চাচার ফার্মাসিতে গেলাম পুরাতন বন্ধুদের খোঁজে। দর্শনার বন্ধুদের কেউ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,কেউ ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও অন্যানো কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পটু চাচা বললে , তাজুল অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন এবং মজিদ সাহেবও দীর্ঘদিন দর্শনা আসেন না। তাজুল নাকি বলেছিল মজিদ সাহেবের কিছু একটা পারিবারিক সমস্যা ছিল। তিনি হয়তো চাকুরী ছেড়েই দিয়েছেন। তবে এ খবরটি নিশ্চিত নয় বলেও তিনি জানালেন। আমার অন্যানো কোন বন্ধুদের সাক্ষাৎ না পেয়ে সন্ধ্যায় চাচার বাসায় ফিরে আসলাম। এরপর আমার সাথে আর মজিদ সাহেবের কোনদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
দেখতে দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পন করলাম। তবে আমি তখনও পীরের মুরিদ ছিলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া, চলাফেরা ও সার্বিক পরিবেশের প্রভাবে তখন মজিদ সাহেব বা পীর সাহেবের কথা অনেকটাই কমে গেছে। সেসব বিষয়ে এখন আর খুব একটা নজর দেবার সময় হয় না। নামাজ পড়তে গেলে কদাচিৎ অজিফা পড়তাম এবং পীরের কথা স্মরণ করতাম। খুব বেশি কেউ এটা জানতো না। আমি পীর মুর্শিদের ভক্ত একথা জানলে বন্ধু -বান্ধবরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে তাই একথা কাউকে জানায়নি। এভাবে যতই দিন যেতে থাকলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন আরো উপভোগ্য হয়ে উঠল। বন্ধুবান্ধব আরো বেড়েছে। লেখাপড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে বহির্বিশ্ব সম্পর্কেও জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এরকম একটা সময় আমার ইন্ডিয়া যাবার একটা সুযোগ সৃষ্টি হল। আমার মেজো সম্বন্ধী ও তার বন্ধুরা এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যাবসা করে। তারা প্রায়ই কলকাতা যাতায়াত করে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেজো সম্বন্ধী ও তার এক বন্ধুর সাথে কলকাতা যাওয়ার সুযোগ আসলো। জীবনে প্রথম দেশের বাহিরে তথা কলকাতা যাচ্ছি তাই প্রচুর উত্তেজনা। মনে মনে প্ল্যান করেছি তাদের সাথে কলকাতা বেড়ানোর ফাঁকে কোন একদিন দম দমের অদূরে হাতিয়াড়া গ্রামে পীর সাহেবের খানকায় যাবো। দীর্ঘদিন পর ইন্ডিয়া যাবার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি আমি ।পীর সাহেবের বাড়ি বা তার খানকা সরেজমিনে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম।
চলবে…………পর্ব-২ দেখুন