দেশ থেকে এসেছি দুই যুগেরও কিছু বেশি। আমি আসার সময় থেকে এপর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান প্রধান প্রতিটি দলই ক্ষমতায় এসেছে, যদিও বর্তমান সরকার সবথেকে বেশি সময় আছে। আমি দেশ ত্যাগের কিছু আগে সামরিক সরকারের পতন হয়। আসে গণতান্ত্রিক সরকার, তাই আসার সময় খুব বেশি না হলেও কিছু কিছু আশা নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলাম যে দেশ হয়তো আস্তে আস্তে সুশাসনের দিকে যাবে, এবং মানুষের মূল্যবোধের কিছুটা পরিবর্তন হবে। উল্লেখ্য, আমি কিন্তু বলছি না তখন কারোরই মূল্যবোধ ছিল না। অবশই বেশ কিছু ভালো মনের ভালো মানুষ ছিলেন এবং এখনো আছেন। কিন্তু আমি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধের অন্তত কিছুটা উন্নতি আশা করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই যখন দেশে যাই অনেক অনেক উন্নতি চোখে পড়লেও অধিকাংশ মানুষের অন্তরের কোনো উন্নতি লক্ষ করি না। আর প্রতি বছর অভিবাসী হয়ে যারা বাইরে আসেন তাদের কাছে এবং দেশে গিয়েও ওই যে কিছু কিছু যে মূল্যবোধওয়ালা মানুষগুলি আছে তাদের কাছে শুনি যে মানুষের মূল্যবোধের আরো অবনতি হচ্ছে। কারণটা কি! ৪০ বছরে এই জিনিসটার কিছুটা কি উন্নয়ণ আমরা আশা করতে পারি না।

তবে খুব ভালো লেগেছে এবার একেবারে গ্রামের সহজ সরল কিছু মানুষকে দেখে। এই ডিজিটাল যুগে এসেও তারা যেন মাটির মানুষ, তাদের সততা, ব্যবহার এবং আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে, উনারা অর্থসম্পদে বড়লোক না হলেও নিঃসন্দেহে মনের দিক থেকে অনেক অনেক বড়োলোক, আর আমার বিশ্বাস আমাদের দেশটি এখনো টিকে আছে এবং থাকবে ওই সকল সহজ সরল ভালো মানুষের জন্য। এবার দেশে গিয়ে সুযোগ হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য বরিশাল এবং সিলেটের দুটি গ্রামে যাওয়ার। ওখানকার মানুষের আচার ব্যবহার এবং আন্তরিকতা খুবই ভালো লেগেছে। সময় স্বল্পতার কারণে খুব বেশি সময় সেখানে থাকা হয়নি।

কিন্তু আজ থেকে দুই যুগেরও বেশি আগে ৯, ৬ কথা বলা, অফিস আদালতে বিনা কারণে হয়রানি/ঘোরানো, তথাকথিত বড়ো ভাইদের দৌরাত্ম, বেনিয়মে চলা, মানুষকে ঠকানো, তুই আমারে চিনস ইত্যাদি যেরকম দেখে এসেছিলাম তার থেকে বরং বেশিই হয়েছে, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ৯, ৬ এর ধরণও পাল্টে নতুন রূপ নিয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের অনেককিছুই চোখে পড়েছে কিন্তু মূল্যবোধের উন্নতি সে হারে বাড়েনি। এই জিনিষগুলি অনুধাবনের জন্য বাইরে যাওয়ারও দরকার নেই, নিজের কাছের লোকজনের মধ্যেই সেটি দেখা যায়। দেশের শিক্ষিতজন, নেতা নেত্রী থেকে শুরু করে অনেকের মধ্যে উপোরোক্ত জিনিষগুলি দেখা যায়। শুধু পশ্চিমা ধাঁচের রাস্তা, রেস্তোরা, বাড়ি বা বাজারঘাট বানালেই হলো, সাথে সাথে মানুষের মানবিকতার উন্নয়ণও কি হতে হবে না।

যেমন ধরুন সরকারি এক অফিসে মাত্র ২/৩ ঘন্টার কাজে খেয়ে নিলো আমার মূল্যবান তিনটি দিন। একদিন কর্মকর্তা বললেন এই কাগজে হবে না ওই কাগজ নিয়ে আসো, আনলাম ওই কাগজ; সেদিন আমাদের অপেক্ষা করতে বলে কর্মকর্তা গেলেন লাঞ্চ করতে কিন্তু ৩০ মিনিট, ৪০ মিনিট,৬০ মিনিট , ৯০ মিনিট উনি আর উনার চেহারা দেখালেন না। এসময় ওখানকার আর এক কর্মকর্তা বললেন লাঞ্চে যাওয়ার সময় সারের কাছে একটা পোটলা দেখলাম, স্যার মনে হয় আরেক কাজে গেছেন তাই স্যার আরো দেরি করতে পারেন বা নাও আসতে পারেন। আমি ছাড়া আরো অনেক লোক ওখানে অপেক্ষা করছিলেন। হলোনা সেদিন। তারপরের দিন গেলাম, স্যার সই করলেন ঠিকিই কিন্তু সার্ভার ডাউন। এরপর সার্ভার আসলো তো বিদ্যুৎ চলে গেলো, বললো এক ঘন্টা পরে আসবে। আসলো না, বললো পরের দিন যেতে। আমাকে ১৪০০ টাকা গচ্ছা দিয়ে আমাদের ঢাকা আসার টিকেট বদলাতে হলো। অবশেষে কাজ হলো। কিন্তু মাওয়া হয়ে ঢাকা আসার পথে যেমন সুবিশাল সুন্দর বড়ো রাস্তা দেখে এবং সেখান দিয়ে যেতে ভালো লাগছিলো, তেমনি ওই সরকারি অফিসে আমার ৩দিন খেয়ে ফেলার এবং ওই কর্মকর্তার আধ ঘন্টার কথা বলে আমাদের বসিয়ে রেখে বিনা নোটিশ হারিয়ে যাওয়ার কথাও ভুলতে পারছিলাম না।

আবার আমি আমার পরিবার এবং ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য লঞ্চের কেবিনে টিকেট কাটলাম সাতদিন আগের থেকে। সমস্ত টাকা পয়সা দেওয়া। ঠিক আগের রাত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ক্যাবিনগুলি স্থানীয় ডিসিকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করুন ৭/৮জন লোক নিয়ে কি বিপদ। কিসের কাস্টমার সার্ভিস, পদবলের ক্ষমতার কাছে জনগণ পিঁপড়ার থেকেও অধম। আর করার কি? যাহোক ভাগ্য ভালো ভাগ্নের পরিচিত একজনের সহায়তায় অন্য একটি লঞ্চের কেবিন পাওয়া গেলো। আবার অপেক্ষাকৃত ভালো মাত্রার বিলাসবহুল একটি বাসে ঢাকা থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে মাঝখানে বিরতির জন্য বাস থামলো। সুপারভাইসর বললেন ২০ মিনিট বিরতি। আমি আমাদের ছোট বড়ো ৬/৭ জন সদস্যকে তাড়া দিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে বাসে উঠলাম। এর মধ্যে আমার বৌ বাসে উঠার সময় দেখলো সুপারভাইসর নিজেই খেতে বসে গেছেন। আমরা ছোট বোন এবং বৌ ২জন আমাকে বেশ বকলেন , কারণ আমি তাদের ভাত খাওয়ার সময় দেয় নাই।
পরে সুপারভাইসর ২০ মিনিটের জায়গায় যখন ৩৫ মিনিট পরে আসলেন, তখন উনি বললেন “ভাই ২০ মিনিট না বললে পাবলিক ৪০ মিন্ট পার করবে”. যাহোক, তখন ভাবলাম এই ক্ষেত্রে ২০ বছর আগে যেই বাংলাদেশ দেখেছিলাম, এখনো সেই আছে। তবে উনি বললেন, পরবর্তী স্টপেজে আপনার লোকজনের খাওয়া না হওয়া পর্যন্ত বাস ছাড়বো না !

এমনি ছোট ছোট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আমি প্রতিবারই দেশে যেয়ে দেখি, আর ভাবি কবে হবে !! বা এই জিনিসগুলির উন্নতির কথা কেউ কি বলছেন। দেশের মিডিয়াগুলির খবর দেখেছি, নামাজের জন্য মসজিদে গেছি, ২/১ জন বড়ো কর্মকর্তার সাথেও আলাপ হয়েছে, কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলি নিয়ে কারো মধ্যে যেন তেমন কোনো বিকার নেই। অথচ একদিন শুনলাম সরকারি কতৃপক্ষের মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে যে, একটি বিশেষ কারণে রাস্তার পাশের গাছগুলিকে সাদা রং করা হয়েছে, কেউ যেন সেখানে পোস্টের না লাগায়, বা রং মুছে না ফেলে, তাহলে জরিমানা করা হবে। কোনটার কি priority সেটা বোঝা দায় !!!

যাহোক উপরোক্ত বৈষম্যের আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে কি না জানি না, তবে আমাকে, আমাদেরকে বার বার সেখানে ফিরে যেতে হবে; সে মাটির টানেই হোক, বা প্রিয়জনের সানিদ্ধের পেতে হোক। আর অনবরত আশায় বুক বেঁধে থাকবো সোনার বাংলায় শুধু জমিতে নয় মানুষের মনেও একদিন সোনা ফলিবে !!!!!

ধন্যবাদ।
মুকুল।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন