বিলি বিশপ এয়ারপোর্ট। “পিয়ারসন” এর পরে টরন্টোর দ্বিতীয় ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। এটি টরন্টো আইল্যান্ড এয়ারপোর্ট নামেও পরিচিত। এই বিমানবন্দর থেকে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশটি গন্তব্যে যাতায়াতের সুযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালে এই বিমানবন্দর উত্তর আমেরিকার সেরা বিমানবন্দর হিসেবে Skytrax World Airport এবং Airport Council International এর স্বীকৃতি অর্জন করে। টরন্টো ডাউনটাউন থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিমানবন্দরে যেতে হলে আগে লেকের একটি অংশ পাড়ি দিতে হতো ফেরিতে। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়া ছিল কিছুটা সময়সাপেক্ষ। যাতায়াতের এই প্রতিবন্দকতা দূরীকরণ এবং যাত্রীদের সুবিধার জন্য ২০১৫ সালে অন্টারিও লেকের পানির নীচ দিয়ে তৈরী করা একটি ‘Pedestrian Tunnel’ চালু করা হয়। আটশত তিপ্পান্ন ফুট দৈর্ঘ বিশিষ্ট এই টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৮২.৫ মিলিয়ন ডলার। একপ্রান্তে গাড়ি পার্ক করে পানির স্তরের ৯৮ ফুট নিচে তৈরী এই টানেল দিয়ে পায়ে হেটে বিমানবন্দরে পৌছুতে সময় লাগে ছয় মিনিট। আমাদের মেয়ে লামিয়াকে নিয়ে এই টানেল দিয়ে হাটতে হাটতে ভাবছি প্রকৌশল বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি। মাথার উপর অন্টারিও লেকের সীমাহীন পানিকে আটকে রেখেছে মজবুত এক ধাতব কাঠামো। নিচে থেকে এর কিছুই বুঝার উপায় নেই।

লামিয়া তার মামা খালাদের সাথে পারিবারিক পুনর্মিলনীতে অংশ নিতে পোর্টার এয়ারলাইন্স এ বোস্টন যাবে। লামিয়ার জন্য উক্তেজনাকর, আনন্দময় একটি ভ্রমণ। জীবনে সে এই প্রথম একা যাচ্ছে অন্য এক দেশে। লামিয়া যতটা পুলকিত ঠিক ততটাই চিন্তিত আমি ও নওশীন। ফ্লাইট এনাউন্সমেন্ট শুনে নির্দিষ্ট গেটের দিকে যাওয়া, প্লেনে উঠা, প্লেন থেকে বোস্টন এয়ারপোর্টে তার মামাকে খুঁজে বের করা, এই কাজগুলো একা একা ঠিকমতো করতে পারবে কিনা- সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছিনা। রিপোর্টিংয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে সিকিউরিটি চেকিং এর সামনে এসে বিদায় নিতে হলো। বারবার তাকে মনে করিয়ে দিলাম ফ্লাইটের ঘোষণা মনোযোগ দিয়ে শুনা, সিটে বসে টেক্সট করে জানানো, পাসপোর্টের দিকে খেয়াল রাখা ইত্যাদি বিষয়ে। লামিয়া সিকিউরিটি চেকিং পার হয়ে যাওয়ার পরেও তখনই ফিরে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না। প্লেন টেক অফ করা পর্যন্ত ওয়েটিং লাউঞ্জে একাই বসে রইলাম।

Free Shipping on ALL cosmetics products!!



লামিয়ার টেক্সটের অপেক্ষার ফাঁকে ভাবছিলাম প্রায় সতের  বছর আগের কথা। ঢাকা থেকে পারাবত বা জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে হবিগঞ্জ ফেরার পথে আব্বা চার পাঁচবার ফোন করে উদ্ভিগ্ন হয়ে জানতে চাইতেন কোথায় আছি, বাড়ি পৌঁছুতে কতক্ষন লাগবে। বুঝতে পারতাম না এতো উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ কি। এখন বুঝতে পারি। নিজে বাবা মা না হলে হয়তো অদৃশ্য এই সুতোর টান বুঝা যায়না। সন্তানের জন্য বুকের গহীন কোণে লুকিয়ে থাকা চাওয়া -পাওয়া বিহীন অব্যক্ত কোনো এক অনুভূতির নামই হয়তো ‘মায়া‘। এই মায়া আমরা বয়ে বেড়াই জীবনভর, বংশ পরম্পরায় – জন্ম থেকে জন্মান্তরে। মানুষ বদলায় কিন্তু মায়ার এই প্রকৃতি বদলায় না। আমার মেয়েও হয়তো একদিন তার নিজের সন্তানের নিরাপদ ভ্রমণের অপেক্ষায় থাকবে, হয়তোবা স্মৃতিকাতর হয়ে বাবা মায়ের কথা মনে করবে। কিংবা হয়তো এসবের কিছুই ভাববে না। আমরা কেউই জানিনা। সেই জানার ক্ষমতা আমাদের নেই। ভবিষ্যত জানার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়নি।

নিজের অজান্তেই ভিজে উঠা চোঁখের কোণের ‘মায়া’ মুছতে মুছতে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই টানেলের বাইরে অপেক্ষমান এয়ারপোর্ট – ইউনিয়ন স্টেশন শাটল বাসের দিকে। পোর্টার এয়ারলাইন্স এর বোষ্টনগামী ফ্লাইট PD 951 ততক্ষনে টরোন্টোর আকাশসীমা ছাড়িয়ে গেছে।

(ছবি সৌজন্য:- The Globe and Mail)

2 মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন