নরওয়ে থেকে:-
২০০৭ সালে যখন ইংল্যান্ডে পড়ালেখা করতে যাই তখন মাথার মধ্যে তেমন কোনো প্ল্যান ছিলোনা , কলেজে যেতাম আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতাম। ছুটির দিনে ইচ্ছে মতো লন্ডনের পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম, কাপড় কিনতাম, কফি হাউস বা রেস্টুরেন্টে বসে খেতাম অথবা সালমা ফুফু কিংবা সফিনা আপার বাসায় বেড়াতে যেতাম। মানুষের সাথে কথা বলা, হৃদ্যতাপূর্ণ সৎ একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা আমার ছোট বেলার অভ্যাস বলতে পারেন। একটা সময় ছিল যখন আমার চুলগুলো খুবই সুন্দর ও পরিপাটি ছিল। মাফিয়া মুভিগুলো কেন জানি আকৃষ্ট করতো তাই লন্ডনের দিনগুলোতে চুলগুলোকে সুন্দর করে পেছনের দিকে বেকব্রাশ করে রাখতাম, আর মাফিয়া স্টাইল চুলের রেশ ধরেই ২০০৮ সালে আমার এক্স ওয়াইফের সাথে লন্ডনে দেখা, প্রেম আর বিয়ে।
এক্স ওয়াইফ নরওয়েজিয়ান তাই ওর আবদারে ২০০৯ সালের ১৬ই মে প্রথম নরওয়েতে বেড়াতে আসি। ১৭ ই মে হচ্ছে নরওয়েজিয়ান কনস্টিটিউশন ডে , নরওয়েতে বেশ ঘটা করে প্রতি বৎসর ১৭ ই মে পালন করা হয়। সারাদিন জুড়ে কনসার্ট আর উৎসবের মাতামাতি লেগেই থাকে। তো ১৭ ই মে তে আমার তখনকার স্ত্রী আমাকে খুব সকালে ডেকে তুললো, ও দেখি সেজেগুজে একেবারে ফিটফাট , জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা ? কোথায় রওয়ানা ?? ও বললো যে সময় নাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও , এক্ষুনি শহরে যেতে হবে , কনস্টিটিউশন ডের প্যারেড শুরু হতে বেশি দেরি নেই। শহরে গেলাম , চারিদিকে উৎসবের ঘনঘটা, Anne আগে থেকেই টেবিল বুকিং দিয়ে রেখেছিলো তাই খুব ভালো করে আর সবার সাথে শহরের সবচেয়ে ভালো একটা জায়গায় সকালের নাস্তা সারলাম , দুপুর একটার দিকে ও বললো সেন্ট্রাল চার্চে যেতে হবে বড়ো একটা কনসার্ট আছে। ওই কনসার্টে গিয়ে বাংলাদেশী জনপ্রিয় গায়ক এন্ড্রু কিশোরের সাথে দেখা। উনি বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের পক্ষ থেকে এসেছেন বন্ধুত্বের দূত হিসেবে নরওয়েজিয়ান কনস্টিটিউশন ডে তে বাংলাদেশী ট্রেডিশনাল মিউজিক বাজাতে। কনসার্ট শেষে উনার সাথে দেখা করতে গেলাম, উনি আমাকে দেখে ও আমার সাথে বাংলায় কথা বলতে পেরে আবেগে প্রায় কাঁদো কাঁদো ! উনি বললেন যে তিন দিন ধরে ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহরে এসেছেন , করো সাথে ভালো করে ইংলিশে কথা বলতে পারেন না বলে তিন দিন ধরে হোটেলের রুমেই বসে বসে দিন কাটিয়েছেন, আমাকে পেয়ে উনার অনেক ভালো লেগেছে ও নরওয়েতে যে বাংলাদেশীর দেখা পেয়েছেন তার জন্য এবং নরওয়েতে যে বাংলাদেশিরা ভালো আছেন তা জানতে পেরে উনি অত্যন্ত খুশি। সাউথ নরওয়েতে বাংলাদেশী কম্মুনিটির সংগঠক হিসেবে সেই ২০১০ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে যখনি বাংলাদেশ থেকে পলিটিশিয়ান, শিল্পী বা সরকারি কর্মকর্তা এসেছেন সবাইকে যতোটুতো সম্ভব সময় দেবার চেষ্টা করেছি , ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সহ আসে পাশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো দেখাবার চেষ্টা করেছি। শেষ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের কিছু বাদক এসেছিলেন ১৭ই মে তে পারফরম্যান্স করতে। উনারাও হোটেল রুমে প্রায় বন্দি অবস্থায় ছিলেন , ভাগ্গিশ মিলন ভাইয়ের সাথে উনাদের যোগাযোগ হয় আর তার সুবাদেই নরওয়েতে অবস্থানকালীন শেষের কয়েকটা দিন ওনারা খুবই উপভোগ করে যেতে পেরেছেন, সাথে করে নিয়ে গেছেন নরওয়ের স্মৃতি। সালাম ভাইয়ের বাঁশির সুর এবং মিন্টো ভাইয়ের মরমী গান সত্যি অসাধারণ ছিল। ওনাদের নিয়ে আমি ও মিলন ভাই সাউথ নরওয়ের সর্ব শেষ প্রান্ত লিস্টা শহরের সমুদ্র তীরবর্তী অপূর্ব সুন্দর ও মনোরম আবহাওয়া কেন্দ্রে গিয়েছিলাম।
নরওয়ের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে সবাই মিলে উচ্চ সুরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গেয়েছিলাম যা আমাদের বাঙালি হৃদয়কে আবেগে উদ্বেলিত করেছিল। বাঙালি ও বাঙালির গান, বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস যেন যুগে যুগে বেঁচে রয়। বাংলার ছেলে মেয়েরা যেন সারা পৃথিবির নানা প্রান্তে বাংলার পতাকা উড়ায় আর আমাদের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা গানের মূর্ছনায় বাঙালি হৃদয়কে অদ্বেলিত করে এই প্রত্যাশা রাখি, প্রত্যশা রাখি এক সমৃদ্দ বাংলাদেশের।