(একাদশ পর্ব )

লেখার বিষয়বস্তুর কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না । রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে চৌকিদার এবং বংগভবন, গণভবন থেকে গ্রামের পর্ণকুটির পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো আমার লেখার সীমানা। সমসাময়িক পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, কলাম, ফিচার, চিঠিপত্র,
সাহিত্য-সাময়িকী,
সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি ছিল আমার লেখার মূল উৎস। রাজনীতি, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও শিল্প সাহিত্য ছিল লেখার কেন্দ্রবিন্দু।

কখনো কখনো পত্রপত্রিকার চাহিদা অনুযায়ী কবিতা, নিবন্ধ এবং কলামও লিখেছি। এইসব নিয়ে মজার মজার গল্প ও অভিজ্ঞতা আছে । সময় সুযোগ মতো বলার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক পত্রিকা, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা, দেয়াল পত্রিকা, দেশ-বিদেশের প্রফেশনাল জার্নাল, বিশেষ সংখ্যা ও অনিয়মিত পত্রিকার লেখা মিলিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। কোথায় না লিখেছি, কী না লিখেছি! চিঠিপত্র কলামে চিঠিপত্র,ছড়া,কবিতা, নিবন্ধ-প্রবন্ধ, জনসংখ্যা ও উন্নয়ন,
প্রজনন স্বাস্থ্য, লিঙ্গবৈষম্য ও উন্নয়ন, সামাজিক যোগাযোগ,
কৌশলগত যোগাযোগ, উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ক, উপসম্পাদকীয়, ফিচার, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিসহ বিশেষ সংখ্যার বিশেষ লেখা, সংকলন ও পত্রিকা সম্পাদনা, পুস্তক সমালোচনা, দেশি বিদেশি জার্নালের জন্য গবেষণা নিবন্ধ,
আরও কতো কী যে লিখেছি!

পত্রিকায় লেখার ব্যাপারে আমার কোনো পছন্দ বা চয়েস ছিলো না। যখন যে পত্রিকা লিখা চাইতো বা লিখা ছাপতো তখন সেখানেই যাতায়াত বৃদ্ধি হতো। ঐ পত্রিকাতেই বেশি বেশি লিখতে শুরু করতাম।

অনেক পত্রিকার অনুসৃত নীতিমালার সাথে আমার মতের মিল না হলেও লেখা চালিয়ে যেতাম।কোনো কোনো পত্রিকা ও সাংবাদিকের সাথে আমার আদর্শগত বিরোধ এবং ব্যাক্তিগত অপছন্দ থাকার পরও সে পত্রিকায় গিয়েছি এবং লেখা ছাপতে দিয়েছি। বৈরী সম্পর্কের কারণে কখনো কখনো লেখা ছাপা হতো না। সেটি বুঝতে পেরে মেনে নিতাম। সংবাদপত্র জগতকে তখন বড় রহস্যময় মনে হতো আমার কাছে। বরাবরই মনে হতো এক অন্য জগৎ। ঐ ঘোর এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি!

লেখার কারণে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় যেমনি গিয়েছি তেমনি গিয়েছি দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক সমাচার ও দৈনিক লালসবুজ পত্রিকায়! ঐ সকল পত্রিকায় লিখা পাঠিয়েছি, ওরাও ছেপেছে।

ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের পত্র-পত্রিকায়ও লেখা পাঠিয়েছি। দৈনিক পুর্বকোন ও দৈনিক বার্তা তার মধ্যে অন্যতম। একসময়ে ঐ দুটো পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছি। দেশের আনাচে- কানাচে অনেক পত্রিকা ও সংকলনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমার লেখা।

ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য জেলার সাপ্তাহিক পত্রিকায়ও লিখেছি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক
“নতুন বাংলা” পত্রিকায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সন পর্যন্ত একনাগাড়ে লিখেছি। সাপ্তাহিক নতুন বাংলা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি অনেকদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন পুরোটা সময় সাপ্তাহিক নতুনবাংলা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি।

“হাইমচর দর্পন” নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা চাঁদপুর থেকে সম্পাদনা করেছি। তখন আমি চাঁদপুরেই কর্মরত ছিলাম। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার চাঁদপুর সংবাদদাতা শ্যামাপদ ঘোষ ভুলু পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন জেলাপ্রশাসক আলহাজ্ব জানিবুল হক পত্রিকা প্রকাশে প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন। পাক্ষিক পত্রিকা বের করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনুরূপভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনেক সংকলনও সম্পাদনা করেছি। অনেক জায়গার অনেক সংকলনে লিখেছি ।

ঢাকার কোনো কোনো দৈনিক কখনো কখনো লেখা ছাপেনি। সেখানে আবার লেখা পাঠিয়েছি, ওরা ছেপেছে। অনেক পত্রিকা লেখার জন্য সমাদর করেছে। অনুরোধ করে লেখা চেয়ে নিয়েছে ও ছেপেছে। অনেকে লেখার জন্য নিয়মিত রয়্যালটি অর্থাৎ লেখার বিনিময়ে লেখকের সন্মানী দিতেন। “সুখী পরিবার” এবং “প্রজন্ম” থেকে ৩ মাস পর পর প্রায় আট থেকে দশ হাজার টাকা লেখক সন্মানি পেতাম। অন্যান্য পত্রিকার সন্মানির টাকার পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না।

এবার দৈনিক দিনকাল পত্রিকার কথা বলি। দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় আমার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। লেখা নিয়ে দিনকাল অফিসে বহুবার গিয়েছি। কবি আ.শ.ম. বাবরআলীর সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে দৈনিক দিনকাল পত্রিকা অফিসে। মুশাররাফ করিম ভাইয়ের ওখানে আমরা একসাথে বসে গল্প করতাম। বাবর ভাইও দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় লেখা দিতেই যেতেন।

মাঝেমধ্যে দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় ছড়াকার আবু সালেহ এবং কবি আব্দুল হাই শিকদারের সাথেও দেখা হতো। আবু সালেহ ভাই পান খেতে খেতে গল্প করতেন। অত্যন্ত প্রাণখোলা মানুষ সালেহ ভাই। সালেহ ভাইয়ের সাথে বাবর ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা ছিল। সেই হিসেবে ছড়াকার আবু সালেহ’ র সাথে আমারও সখ্যতা গড়ে উঠে। এখনও সালেহ ভাইয়ের সাথে বাংলা একাডেমির বার্ষিক সভায় এবং বইমেলায় নিয়মিত দেখা হয়। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা-বার্তা হয়।

দৈনিক দিনকাল পত্রিকা অফিসের আনোয়ারুল কবির বুলু ভাইয়ের কথা বলতেই হয়। অত্যন্ত ভালোমনের সদালাপী মানুষ। তিনি ভালো ছড়া লিখেন। মূল বিষয়বস্তু থাকতো ‘মা’।

‘মা’-এর প্রতি বুলু ভাই খুবই দুর্বল। ‘মা’কে উপজীব্য করে ছড়া লেখার জন্য তিনি উৎসাহিত করতেন। এবিষয়ে সংকলন ও পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যাও তিনি বের করেছেন। আনোয়ারুল কবির বুলু ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘মা’ বিষয়ক ছড়া কবিতা লিখে দিয়েছি এবং তিনি আমার অনেক লেখা ছেপেছেন।

দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় কবি মুশাররাফ করিম ভাই আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তি ছিলেন। ঊনার ওখানে বসে বাবর ভাইসহ অনেক আড্ডা দিয়েছি, চা খেয়েছি৷ তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ব্যাক্তি ছিলেন। কাজ পাগলও ছিলেন বটে।

মুশাররাফ ভাইয়ের লেখার হাত ছিল চমৎকার। মুশাররাফ ভাইয়ের দেহের গড়ন ছিলো হাল্কা-পাতলা। সুন্দর ঘন গোঁফ ছিলো। প্রায়শই প্যান্ট আর হাফশার্ট পরতেন। তার চোখের চশমার ফ্রেমটা ছিল বিশেষ ধরনের। চিকন ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। চশমা প্রায়ই চলে আসতো নাকের ডগায়। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার মুশাররাফ করিম ভাইকে খুব সুন্দর লাগতো। ভাবতে কষ্ট হয়,সেই দৃশ্য আর কোনোদিন দেখা হবে না। কারণ তিনি আর ইহলোকে নেই।

মুশাররাফ করিম ছিলেন সত্তর দশকের একজন বাঙালি কবি। তিনি কবিতায় লোকজ শব্দ ব্যবহারের জন্য পরিচিত। মুশাররাফ করিম একাধারে কবি, শিশু সাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক। জীবিকাসূত্রে তিনি সাংবাদিক ছিলেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

মুশাররাফ করিম ভাইয়ের সাথে পরিচয় হবার পর তিনিই দৈনিক দিনকাল পত্রিকার জন্য লেখার চাহিদা পেশ করতেন। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে বা অন্য কোনো বিশেষ সংখ্যার জন্য মুশাররাফ করিম ভাই আগেভাগেই লেখার চাহিদা পেশ করতেন। আমাকে বেশ কোমল গলায় বলতেন, বড় লেখা চাই। আমিও দীর্ঘ লেখা পাঠানোর চেষ্টা করতাম।

একসময়ে দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় মহান বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যায় অনেক লিখেছি। একদিন লক্ষ্য করি, দীর্ঘ ছাপানো লেখার ভেতর কিছু পরিবর্তন! যা আমি লিখিনি তা-ই আমার লেখার ভেতর ঢুকে গেছে। সচেতন পাঠক আশা করি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন। লেখায় এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে আমি চুপ হয়ে গেলাম। মনে কষ্টও পেলাম। কিছুটা রাগও হলো। দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় সকল ধরনের লেখা পাঠানো বন্ধ করে দিলাম।

আমি তখন সপরিবারে ঢাকা শহরের আজিমপুরে থাকি। বিভিন্ন জায়গায় যাই, নানা জনের সাথে দেখা হয়, গল্প-কথা হয়। একদিন তোপখানা রোডের প্রেসক্লাবে গিয়েছি। কী যেন কীসের এক অনুষ্ঠানে! সেইখানে মুশাররাফ করিম ভাইয়ের সাথে দেখা। মুশাররাফ করিম ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আপনি তো বেসিক্যালী কবি। গদ্য তো অনেক লিখেছেন। কয়েকটা কবিতা দেন। আমি সময় মতো কাজে লাগাবো। ”

আমি কিছু সময় চুপ করে থাকলাম। পরে শ্রদ্ধা সহকারে মুশাররাফ করিম ভাইকে বললাম,
“ভাই, কবিতা দিতে পারি। পছন্দসই হলে ছাপবেন, না হয় ফেরত দেবেন। কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।” তিনি ছোট্ট চশমার ফাঁকে মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।

(চলবে)

১০-০৬-২০২০, ১১-০৬-২০২০,
রূপায়ণ টাউন, ভুঁইগড়, নারায়নগঞ্জ, বাংলাদেশ।।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন