(সপ্তম কিস্তি)
দৈনিক সংবাদ পত্রের চিঠিপত্র কলামকে সেকালে (আমার কৈশোর কিংবা উঠতি যৌবনে) অনেক গুরুত্ব প্রদান করা হতো। জনমতের একটা অন্যতম প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। হেলাফেলার বিষয়বস্তু বলে উড়িয়ে দেয়া হতো না। এর একটা মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। দৈনিক সংবাদের ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৯৮ বাংলা সানে (১৯৯১ খ্রীঃ) প্রকাশিত, “সময় বহিয়া যায় ” কলামে “গাছপাথর ” (ছদ্মনাম) তার কলামের শুরুই করেছেন, চিঠিপত্রের কলামে আমার লেখা একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে।
গাছপাথর লিখেছেন, ” গত মঙ্গলবার এই পত্রিকার ‘চিঠিপত্র’ স্তম্ভে আমাকে মারাত্মক এক চ্যালেন্জ দিয়েছেন মৌলভীবাজার সদর থেকে সামাদ সিকদার সাহেব (আমি তখন মৌলভীবাজার চাকরি করি)। বলেছেন, “দয়া করে মুখ খুলবেন কি?” মোটেই প্রশ্ন নয়, চ্যালেঞ্জ একখানা। ভয়াবহ… ” (ফটোকপি সংযুক্ত -১) ।
অনুরূপ একটি দুটি নয়, অনেক চিঠির জবাব পেয়েছি। কোনো কোনো চিঠির অত্যন্ত সুন্দর জবাব দিতেন বিভাগীয় সম্পাদক নিজে। আবার কিছু জবাব দিতেন পত্রিকা পাঠকও । বেশিরভাগ চিঠিই ছিল জনস্বার্থ বিষয়ক বা জনগুরুত্বপূর্ণ। তাই, এনিয়ে কখনো কখনো বেশ সুস্থ বিতর্ক জমে উঠতো পত্রিকার পাতায় । একালে এসব চিন্তাও করা যায় না।
দৈনিক সংবাদের চিঠিপত্র কলামে অনেক চিঠি লিখেছি। আমার স্ত্রীও লিখেছেন স্বপ্না সিকদার নামে। মাঝেমধ্যে আমদের ছেলে আতাউস সামাদ দিসুও লিখতেন। আমাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত জনরাও আমাদের দেখাদেখি চিঠিপত্র কলামে লেখা শুরু করেন।
আমাদের লেখার পাল্টা জবাবও দিতেন কেউ কেউ এবং তা ছাপা হতো।
বিভাগীয় সম্পাদক (চিঠিপত্র বিভাগের) মাঝেমধ্যে নিজস্ব মতামত দিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতেন। চিঠি চালাচালি বেশি হলে তিনি বলে দিতেন যে, পরবর্তীতে এবিষয়ে আর কোনো চিঠি এ কলামে ছাপা হবে না।
দৈনিক সংবাদে অসংখ্য ছোটবড় চিঠি লিখেছি। বড় বড় চিঠি যে লিখতাম তার ২/১ টি নমুনা এখানে উল্লেখ করছি ( ফটোকপি সংযুক্ত –৪ ) । একবার, হাতে লিখা ৫ পৃষ্ঠার একটি বড়সড় চিঠি পাঠালাম চিঠিপত্র কলামে (প্রকাশের জন্যে)। বিভাগীয় সম্পাদক সাহেব কী মনে করে এটিকে উপসম্পাদকীয় হিসেবে ছেপে দিলেন (প্রকাশ করলেন)।
এর শিরোনাম ছিল,
” দুঃসংবাদ, অপরাধ খবর ও একদিনের ‘সংবাদ’ ” — সামাদ সিকদার।
এটি ছিল মূলত একদিনের (২৮ মে তারিখের) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, ফিচার ও নিবন্ধের উপর সামগ্রিক বিশ্লেষণ ধর্মী একটি দীর্ঘ আলোচনা। আমার লেখাটি দৈনিকসংবাদের উপসম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশের তারিখ ছিল ০২ শ্রাবণ ১৪০১ বাংলা (১৯৯১ খ্রীঃ) , পত্রিকার পৃষ্ঠা নম্বর ০৪ ( ফটোকপি সংযুক্ত –৩ ) । এরকম আরও কতো ঘটনা! কতো লেখা, কতো স্মৃতি!
চিঠিপত্র কলাম ছাড়াও অনেক লেখা লিখেছি দৈনিক সংবাদে। এ মুহূর্তে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত সামাদ সিকদারের বেতিয়ারা শহীদ স্মৃতির ওপর যে কয়টি লেখা হাতের কাছে আছে ( ফটোকপি সংযুক্ত – ২ ) তার উল্লেখ করা হলো।
১. বেতিয়ারাঃ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস, শনিবার ১১ নভেম্বর ১৯৯৫ খৃঃ মোতাবেক ২৭ কার্তিক ১৪০২ বাংলা।
২. আজ বেতিয়ারা শহীদ দিবস, ১১ নভেম্বর ১৯৯৮ খৃঃ মোতাবেক
২৭ কার্তিক ১৪০৫ বাংলা।
৩. বেতিয়ারা শহীদ দিবস, ০৯ নভেম্বর ১৯৯৯ খৃঃ ।
৪. নভেম্বর ১১ঃ বেতিয়ারা শহীদ দিবস, ২৭ অক্টোবর ২০০২ খৃঃ।
অনেক পুস্তকের সমালোচনা বা রিভিউ আমি করেছি। বহু পত্রিকায় আমার লেখা ১০-১২ টি বইয়ের রিভিউ হয়েছে , সমালোচনাও হয়েছে। দৈনিক সংবাদ আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধের ওপর “মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি” বইয়ের প্রচ্ছদসহ চমৎকার কভারেজ দিয়েছিল ( ফটোকপি সংযুক্ত–৫ )। মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৩ টি বই শিরোণামে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ খ্রীঃ সনে দৈনিক সংবাদ ” মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি ” ছাড়াও আরও দুইটি বই নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করে। আলোচকের নাম ছিল সৌভিক রেজা।
কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ওপর আমার গবেষনাধর্মী একটি পুস্তক “সুকান্তঃ কবি ও মানুষ” রিভিউর জন্যে দৈনিক সংবাদে দিয়েছিলাম। তখন সংবাদের সাহিত্যের পাতা, বোধ হয়, দেখতেন আবুল হাসানাত সাহেব। সংবাদ পত্রিকা অফিসে “সুকান্তঃ কবি ও মানুষ ” বইটির ২টি কপি রিভিউর জন্যে জমা দেই। জমা দেবার অনেকদিন পরও রিভিউ প্রকাশিত না হতে দেখে একদিন সংবাদ অফিসে ফোন করলাম। হাসানাত সাহেব ফোন ধরলেন। তিনি অপর প্রান্ত থেকে আমাকে বললেন, “শতাধিক পৃষ্ঠার বই, এছাড়া কঠিন প্রকৃতিরও । একটু সময় তো লাগবেই। একজনকে দিয়েছি রিভিউর জন্যে। অপেক্ষা করুন। ” আমি বললাম, “আচ্ছা, ঠিক আছে।”
আদব-কায়দার সাথে ঊনাকে সালাম জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম। আশায়-নিরাশায় রিভিউ দেখার অপেক্ষা করতে থাকলাম। নিরাশা এজন্য যে, কতো জায়গায় কতো কিছু হয়নি, হয়তো এখানেও হবে না। হলে হলো , না হলে নাই!
সংবাদপত্র পাঠক হিসেবে, কুমিল্লার দেবিদ্ধার অঞ্চলে, শুরুর দিকে (১৯৬৮-১৯৬৯ খ্রীঃ) একদিন পরপর পত্রিকা পেতাম। কিছুদিন পর (১৯৭০ খ্রীঃ) , দিনের শেষে ঐ দিনের পত্রিকা পাওয়া যেতো। তারপর তো মাশাআল্লাহ, প্রতিদিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠেই ঐদিনের পত্রিকা নিয়মিত পেতে শুরু করলাম। যখনই পাওয়া যেতো, দৈনিক সংবাদ পাঠ করতেই হতো। কারণ ছোট বেলা থেকেই আমি দৈনিক সংবাদের নিয়মিত পাঠক ও ভক্ত ছিলাম।
একদিন দৈনিক সংবাদ পত্রিকা পাঠ করতে করতে হঠাৎ করে লক্ষ্য
করলাম আমার লেখা “সুকান্তঃ কবি ও মানুষ” – গ্রন্থের ওপর ঢাউস এক পুস্তক সমালোচনা। সমালোচকের নাম – সৌভিক রেজা। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ছয় কলামের সুদীর্ঘ পুস্তক সমালোচনা। তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৫ খৃঃ, পৃঃ ১১। দেখে খুব ভালো লেগেছিল, আনন্দিতও হয়েছিলাম।
কিছুক্ষন পর, দীর্ঘ পুস্তক সমালোচনা পাঠ করে আর সে আনন্দ থাকলো না। মনে হলো, সৌভিক রেজা ঘোরতর সুকান্ত বিদ্ধেষী ও বিরোধী এক লোক। তিনি ব্যাক্তিগতভাবে এখানে আমাকেও আক্রমণ করেছেন। আমি যা বলেছি তা না বলে এবং যা বলেছি তার উল্লেখ না করে তিনি আমার প্রতি অবিচার করেছেন। সমালোচনার নামে ঘোরতর মিথ্যাচার করেছেন। এ এক বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা বই আর কিছুই নয়। দৈনিক সংবাদে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছি, ছাপাও হয়েছে, কিন্তুু সৌভিক রেজা সাহেব মুখ খুলেননি।
মেজাজ খারাপ হলেও ধৈর্য ধারণ করে, আমার লেখা “সুকান্তঃ কবি ও মানুষ” বইটির ওপর সৌভিক রেজার দীর্ঘ পুস্তক সমালোচনাটি আবারও পাঠ করলাম। পাঠশেষে বুঝতে পারলাম, তিনি আমার লেখা বইটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেননি। আরও বুঝতে পারলাম, তিনি যে শুধু সুকান্ত বিরোধী তাই নয়, সৌভিক রেজা সুকান্তকে কবি হিসেবে কোনো গুরুত্ব দিতেই চান না । তিনি লিখেছেন, ” অকাল প্রয়াত এই কবিকে নিয়ে বাঙালির আবেগ ও উচ্ছ্বাস এক সময় আতিশয্যের পর্যায়ে গিয়েছিল এবং … রবীন্দ্র- নজরুলের পরে বাংলা সাহিত্যে
কবি বলতে সুকান্ত ভট্টাচার্য্যকেই বুঝতেন। সাহিত্য বোধ কতটুকু অগভীর এবং অপরিণামদর্শী হলে এই জাতীয় ঘটনা ঘটে! “…
সুকান্ত সম্পর্কে সমালোচকের এ মূল্যায়ণ কতটা যুক্তি সংগত এবং কতোটা বিদ্বেষ মূলক এর বিচারের ভার পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম।
তিনি সুকান্তকে একজন কিশোর মাত্র ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তার ভাব-ভাষা হলো, সুকান্ত একজন স্লোগান সর্বস্ব কবি। তিনি বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ” জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা, কবিতা না হয়ে খবরের কাগজের প্যারাগ্রাফ হলেই যেন মানাতো। ” এই হলো তার সুকান্ত সম্পর্কে ধারণা! ভাবখানা এরকম যে, সুকান্তকে নিয়ে এত বড় বই লেখার কোনো মানেই হয় না।
আমার এত বছরের পরিশ্রম তার কাছে পণ্ডশ্রম মাত্র! কী বলবো? অথচ, বইটি প্রকাশের পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ রেফারেন্স বুক হিসেবে তাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
(চলবে)
২৭-০৫-২০২০, রূপায়ন টাউন।