দৈনিক সমাচার পত্রিকার প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা তারিখ ও সনের ক্রমানুসারে পাঠকের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সাথে সাথে কিছু আলোচনা করারও চেষ্টা করেছি। এর আগে, ২১ ও ২২ পর্বে, ক্রমিক নম্বর ০১ থেকে ১৯ পর্যন্ত মোট ১৯ টি লেখা উপস্থাপন করেছি। এখন, এ পর্বে, ক্রমিক নম্বর ২০ থেকে শুরু করছি।

২০. ‘সামাদ সিকদারের গবেষণাগ্রন্থ সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’ শিরোণামে আমার এবং বইটির প্রচ্ছদের ছবিসহ একটি পুস্তক পর্যালোচনা, দৈনিক সমাচার পত্রিকায় সাহিত্যের পাতায় প্রকাশিত হয়। এটি একটি দীর্ঘ পর্যালোচনা নিবন্ধ। এই পুস্তকটির পর্যালোচনা করেছেন কনি আ.শ.ম বাবরআলী। দৈনিক সমাচার পত্রিকায় প্রকাশের তারিখ ২৩ মার্চ ১৯৯৬, ১০ চৈত্র ১৪০২ বঙ্গাব্দ। দীর্ঘ পর্যালোচনার কিছু কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি। কবি আ.শ.ম বাবর আলী আলোচনার সূত্রপাত করেছেন এইভাবে,

‘কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ওপর লেখা সামাদ সিকদারের একখানি গবেষণাগ্রন্থ ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’। কবি সুকান্তের ব্যক্তি জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে – এগ্রন্হে।

সুকান্তর মূল্যায়ণে তিনি দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। তাদের সাহিত্য কর্মের সাথে সুকান্তর সাহিত্য কর্মের কিছু তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। এরপর সুকান্তর সমকালীন পরিস্হিতি ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এসেছে বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ব্যাক্তিত্ব। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি রামদাস, শ্রী চৈতন্য, রাজা রামমোহন রায়, দক্ষিণা রঞ্জন মুখোপাধ্যায়, অক্ষয় কুমার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, মধুসুধন দত্ত, শিবনাথ, মনোমোহন বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভুদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কাব্যচর্চার প্রেক্ষিত হিসেবে বেশ কিছু স্বদেশী আন্দোলন ও সংগ্রাম সম্পর্কে লেখক-গবেষক সামাদ সিকদার এখানে আলোচনা করেছেন। সেগুলি হচ্ছে সাঁওতাল বিদ্রোহ, ফরাজী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ ইত্যাদি। স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার সাধক এবং পথিকৃত হিসেবে রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, স্বামী বিবেকানন্দ, স্যার সৈয়দ আহমদ প্রমুখের ভূমিকা উল্লেখিত হয়েছে। কবি সুকান্তকে উল্লেখ করা হয়েছে এদেরই মানস উত্তরাধিকারী হিসেবে।

সুকান্ত মনেপ্রাণে ছিলেন মানুষের কবি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। সাহসী, বিদ্রোহী ও এক মহান আদর্শের স্বপ্নদ্রষ্টা। এতকিছুর পরও সুকান্ত ছিলেন একজন আধুনিক কবি। সামাদ সিকদারের বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় এ তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। অনেক তথ্য আর উদাহরণ দিয়ে তিনি তা দেখিয়েছেন।

এরপর সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের প্রায় প্রতিটি রচনা ও বই নিয়ে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এ কাজটি করতে গিয়ে লেখক প্রচুর কষ্ট ও অধ্যয়ন করেছেন, তা গ্রন্হটির পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন।

সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কাব্য বৈশিষ্ট্য ও কবিতা কাঠামো নিয়ে একটি বিশেষ গবেষণামূলক আলোচনা আছে গ্রন্থের সর্বশেষে। আলোচনাটি খুব দীর্ঘ না হলেও সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের সাহিত্য কর্মের বিশিষ্টতা ও স্বতন্ত্রতা বিষয়ে অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ ও মূল্যবান।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গর্ব হলেও তাকে নিয়ে, তার সাহিত্য কর্ম নিয়ে একক আলোচনা এদেশে এর আগে আর কখনো হয়নি। পশ্চিম বাংলাতেও হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে সামাদ সিকদারই বোধ হয় প্রথম পথিকৃত। সুকান্তের উপর এমন ব্যাপক আলোচনা এটাই বোধ হয় প্রথম। গ্রন্থটি রচনায় লেখককে অনেক পড়তে হয়েছে, জানতে হয়েছে, একনিষ্ঠ সাধনা করতে হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে কবি সুকান্তর ওপর লেখকের প্রচন্ডতম ভালোবাসা ও আদর্শগত ঐক্যের কারণেই।

তা সে যা-ই হোক, সামাদ সিকদারের ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ ‘ গবেষনাগ্রন্হ খানি যে কবি সুকান্তকে জানতে, বুঝতে আমাদের সহায়তা করেছে, আমাদের সাহিত্য ভান্ডারের একটি শুণ্য দিককে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ জন্য আমাদের মত সাধারণ পাঠকরাতো বটেই, আমাদের সাহিত্য ভান্ডারও সামাদ সিকদারের কাছে ঋৃণী হয়ে রইলো। সুকান্তর উপর ভবিষ্যৎ গবেষকরাও এ গ্রন্থ থেকে অনেকখানি সহায়তা পেতে পারেন। বাংলা সাহিত্যের যে কোনো তথ্যান্বেষী পাঠকের নিকট গ্রন্থটি বিশেষভাবে সমাদৃত হবে – একথা দৃঢ় আশ্বাসে বলা যায়। ‘

২১. ‘হিসেব মেলেনা’ শিরোনামে আমার লেখা একটি কবিতা দৈনিক সমাচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশের তারিখ বৃহস্পতিবার ২৬ মার্চ ১৯৯৬, ১৩ চৈত্র ১৪০২ বঙ্গাব্দ। কবিতার অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরছি,

‘এভাবেই প্রতিদিন অপেক্ষা করি
নতুন দিনের
পড়ন্ত বিকেলেও সবুজ স্বপ্ন দেখি…

তারপরও স্বপ্নে ভেসে যায় সব
নতুন নতুন দিন কী দেয়, কীইবা দিয়ে যায়?
জীবনকে খুঁজতে গিয়ে হিসেব মেলেনা আর। ‘

২২. ‘সামাদ সিকদারের যদি দেখা হয়’ শিরোণামে কবিতার বইটির প্রচ্ছদের ছবিসহ, দৈনিক সমাচার পত্রিকায় একটি পুস্তক পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়। প্রায় ২ পৃষ্ঠাব্যাপী পুস্তক পর্যালোচনাটি করেন কবি- সাহিত্যিক আ.শ.ম বাবর আলী। প্রকাশের তারিখ ৩০ মার্চ ১৯৯৬। দীর্ঘ লেখার শুরুটা ছিল,

‘সমকালীন সমাজ সচেতনতার কবি সামাদ সিকদার। কবিতা লেখেন তিনি সমাজের জন্য। মানুষের জন্য। সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য। শান্তির জন্য। নতুন সমাজ গড়ার জন্য। মানুষের নির্মল স্বাধীন জীবনের জন্য।

এর আগে তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছে একই আবেদন নিয়ে। ‘যদি দেখা হয়’ তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। মোট ৩২ টি কবিতা আছে তিন ফর্মার এ গ্রন্থে। প্রায় প্রতিটি কবিতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছায়া পড়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের স্বত্তা ও স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন কবি সামাদ সিকদার তার এ গ্রন্থে। মানুষের আহত চেতনায় আঘাত করেছেন। জাগিয়ে তোলবার প্রয়াস নিয়েছেন এক নতুন উদ্দীপনায়। তাতে যে তিনি সফল হননি তা নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক কৃতিত্বের দাবীদার হয়েছেন।

ধরা যাক, গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘তোমাকেই খুঁজি’- এর কথা। সামাজিক অস্থিরতা এবং নৈতিক অবক্ষয়তা কবিকে আহত করেছে। কিন্তু এ অবনতির মধ্যেও কবি হাল ছাড়েন না। তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। তাই বিধ্বস্ত সময়কে সঙ্গী করেও তিনি অপেক্ষা করেছেন নতুন পৃথিবীর জন্য। বলেছেন- ‘সমস্ত দেহে সাহসের ধুলো মেখে / অপেক্ষা করেছি আমি / আগামী পৃথিবীর। ‘

এই যে বিধ্বস্ত সময়, বিধ্বস্ত পরিবেশ এ তো কবির কাছে কাল্পনিক কিছু নয়। সত্যের বাস্তবতাকে তিনি টেনে এনেছেন তার অধিকাংশ কবিতায়। যেমন, নাম কবিতা ‘যদি দেখা হয়’তে বলেছেন – ‘দেখি বিশ্বাসঘাতকতার ছবি’। জাতিসংঘের ৫০ বর্ষ পুর্তি উপলক্ষে রচিত ‘অর্ধশতাব্দীর কথকতা’ কবিতায় বিশ্ববাসীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে সামাদ সিকদার দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষের শান্তির জন্য গঠিত জাতিসংঘের লজ্জাজনক ব্যর্থতাকে। দুঃখ করে তিনি বলেছেন – ‘বিশ্ববাসী দেখেনি শান্তির নির্মল আকাশ / এলোমেলো আজও আছে সভ্যতার সাজানো বাগান।’ জাতিসংঘের প্রতি ঘৃণার থুথু ছিটিয়ে সামাদ সিকদার প্রশ্ন করেন – ‘সোমালিয়া, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডিতে জাতিসংঘ করছেটা কী? / বসনিয়া সমস্যা তো প্রতিদিন কালীমা লেপে দেয় / সুন্দর ঐ জাতিসংঘ-পতাকায়।’

এরপর সামাদ সিকদারের এক দুঃসাহসিক অভিব্যক্তি,’ কে যেন চালায় ওকে?’ এই কে এর জবাব কবি সামাদ সিকদার জানেন। বিশ্বের নির্যাতিত মানব সমাজও জানে। সে এক স্বার্থান্বেসী অপশক্তি। এ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে কবি চান পৃথিবীতে শান্তিময় এক নতুন আবাসভূমি সৃষ্টি করতে। তিনি চান এ দুঃসময়ে হাতের কাছেতে বিশ্বাসের শক্ত খুঁটি। এর জন্য প্রয়োজন নতুন উদ্যমী এক পথিকৃতের । তাই সমাজ ভাবনার কবি সুকান্তর সঙ্গী হয়ে সামাদ সিকদারও বলেন – ‘প্রার্থনা করি যেন জন্ম হয় নতুন শিশুর / যে সত্তার স্বপ্ন দেখে মানব সভ্যতা চিরকাল।’ এখানে মনে হয় অকাল প্রয়াত সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের যোগ্যতম উত্তরসূরী কবি সামাদ সিকদার।

সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, সামাদ সিকদারের ‘যদি দেখা হয়’ কাব্যগ্রন্থের ‘অর্ধশতাব্দীর কথকতা” কবিতাটি গ্রন্থভূক্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা। এবং সমকালীন, আমাদের বাংলা কবিতাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। কবিতাটি কাব্য ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ কবিতা বোধ হয় ‘ফেলে আসি প্যানরামা’। সমসাময়িক সমাজ এবং প্রকৃতি অত্যন্ত সুন্দর রূপে উপস্থাপিত হয়েছে এ কবিতায়। কবি সামাদ সিকদারের এ গ্রন্থের আর প্রায় সব কবিতাগুলির মূল সুর প্রায় একই। কিন্তু এক হলেও, বর্ণনা ও বৈচিত্র্যের গুণে পড়তে একঘেঁয়েমি লাগেনা। কবিতায় সমাজ আর মানুষের জন্য মমত্ববোধ কবির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করে। সে শ্রদ্ধাবোধ আরও দৃঢ়তর হয় কবির মানব মুক্তির আশাবাদ দেখে। মুক্তির সৈনিক হয়ে ‘আমি ছোট লোক’ কবিতায় নিজকে তিনি দাবি করেন তিতুমীর, লেলিন, মার্কস, মাওসেতুং, নজরুল, সুকান্ত বলে। ‘জনতার পাঠশালা থেকে’ কবিতায় রাজনীতির বিবর্তন ধারায় নতুন করে স্মরণ করেন হেরোডোটাস, থ্রেসিমেকাস, গ্লাউকন, এন্ডিমেন্টাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, লক, বদিন, কার্লাইল , হেগেল, মার্কস, এঙ্গেলস প্রমুখকে। কবি সামাদ সিকদারের একটা নিজস্ব আদর্শ আছে। তার আদর্শ ঐসকল গুণীজনদেরই ধারাবাহিকতার ফসল।

একজন সত্যিকারের কবিকে নৈরাজ্য কখনও গ্রাস করতে পারে না। যেকোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে কবি থাকেন আশাবাদী। সমাজের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে অবস্থান করেও কবি পরম আশাবাদের স্বপ্ন দেখেন। আশাবাদী সৈনিক হয়ে উদ্বুদ্ধ করেন সমাজের আশাহত মানুষকে।

এমনিভাবে তিনি ভেঙে পড়া সমাজকে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। সত্যিকারের কবির এ এক মহান দায়িত্ব। কবি সামাদ সিকদার এ দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের কবিতা সমূহে। ‘নতুন রানার’ কবিতায় আশাবাদী কবি বলেন, ‘বনেদী প্রাসাদের ধারে / অনাদরে অবহেলায় / গজিয়ে ওঠা মানুষেরা হাসবে ‘। যদি দেখা হয় কবিতায় ‘জীবনের সাহসী সঙ্গীর ছবি দেখি’। কবির পরম এ আশাবাদের কারণ, ‘পৃথিবী থেকে / এখনও যায়নি যৌবন, যাবেও না কোনোদিন। / যৌবন মিছিল চলে পাশাপাশি।’ অর্থাৎ, সমাজ ও জীবন বিনির্মানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের মতো সামাদ সিকদারও সব শক্তিতে আত্নবিশ্বাসী। এ বিশ্বাস কবি সামাদ সিকদারকে এদেশের এ ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ সৈনিক কবির স্বগোত্রীয় করেছে।

একজন আদর্শ কবি একজন দার্শনিকও বটে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জীবনকে দেখেন। উপলব্ধি করেন। সামাদ সিকদারও তা করেছেন। জীবন সম্পর্কে কবির ধারণা – ‘জীবন এক চলন্ত নদী / বাঁকে বাঁকে ভিন্ন রূপ তার ‘। (কিচ্ছা কাহিনী)। জীবনের ভুলকে নিরুৎসাহিত না করে এমনিভাবে তিনি সান্ত্বনা দিয়েছেন – ‘ভুল যদি নাই হতো হাওয়ার / আদমের কথা মতো চলতেন তিনি! / কোথা পেতেন স্রোতস্বিনী নদী / পর্বতের সানুদেশ / গড়ে উঠা বিশ্বস্ত জনপদ / হৃদয়ের সুক্ষ কারুকাজ! (মানুষ ও পৃথিবী)। কী অপূর্ব যৌক্তিক সান্ত্বনা ! নৈরাশ্যের লোনাজলে কী সুন্দর আশাবাদী কবি সামাদ সিকদার!

কবি মাত্রই প্রেমিক। প্রেম ছাড়া কোনো মহৎ কর্মই সম্ভব নয়। কবিতা সৃষ্টির মতো মহৎ কর্মেও সামাদ সিকদারের প্রেম অনুপস্হিত নেই। ‘আমি ছোট লোক’ কবিতায় যে কবি সংগ্রামী, ‘যুদ্ধ’ কবিতায় যুদ্ধকে ধ্বংস জেনেও যে কবি সৈনিক, সেই কঠোর কবি কেমন কোমল হয়ে যান তার প্রমিক সান্নিধ্যে! ‘চলন্ত ট্রেন তুমি আর আমি ‘ কবিতায়৷ সেখানে তিনি বলেন – ‘চলন্ত ট্রেনের সিঙ্গেল কুপে, / জানালায় বসে বসে / রূপসী বাংলাকে যেমন মোহনীয় মনে হয়! / তারও বেশি লোভনীয় / আমার কাছে তুমি ‘। একই কবিতায় প্রিয়ার সৌন্দর্যকে বর্ণনা করেছেন – ‘তুমি যেন এক অনন্ত গ্রাম’! গ্রামের সৌন্দর্যকে সামাদ সিকদার উপমিত করেছেন প্রিয়ার সৌন্দর্যের সাথে। প্রকারান্তরে তিনি ভালো বেসেছেন গ্রামীণ প্রকৃতিকে, শ্রেষ্ঠ কবির যা অবিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য। আর এই প্রকৃতির প্রেমের সুন্দর বর্ণনা আছে ‘ফেলে আসি প্যানরামা’, ‘সেই গোমতীর তীরে’ কবিতাসহ অনেক কবিতায়৷

উপমা আর উৎপ্রেক্ষা কবিতার শ্রেষ্ঠ অলংকার। কবি সামাদ সিকদারের ‘যদি দেখা হয়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা সমূহে তার অনুপস্থিতি নেই। অত্যন্ত সুন্দরভাবে তা সংযোজিত হয়েছে কবির অলংকারিক দক্ষতায়। যেমন ‘গোধুলি’ কবিতায় – ‘আমি কি জমা করি সুখ / ইঁদুরের ধান লুকানোর মতো’! এধরণের উপমা উৎপ্রেক্ষা অনেক আছে এ কাব্যগ্রন্থে।

কাব্য ও কবিগুন সবই আছে সামাদ সিকদারের ‘যদি দেখা হয়’ কাব্যগ্রন্থে। সার্বিক বিচারে এটি একটি উন্নত শ্রেণির সফল কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থের যে কবিতা সমূহ, তা জীবনের মানুষের সমাজের ব্যক্তির। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আন্তর্জাতিকতাকেও স্পর্শ করেছে। কবি সামাদ সিকদারের এ এক অনন্য কৃতিত্ব।

তিন ফর্মার এ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে দেশের একমাত্র কবিতা প্রকাশনা সংস্থা ‘বিশাকা প্রকাশনী। মাহবুব কামরানের প্রচ্ছদে নতুনত্ত্ব আছ৷

(চলবে)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন